ভোট দিবেন কাকে

২৭ অক্টোবর টরন্টোতে নির্বাচন : মেয়র আর কাউন্সিলরপ্রার্থীদের ডিবেটে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে নগরী

খুরশিদ আলম। অক্টোবর ৫, ২০১৪ : আসছে ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে টরন্টো মিউনিসিপালিটির নির্বাচন। ঐ নির্বাচনে টরন্টোবাসী বেছে নিবেন তাদের পরবর্তী মেয়র বা নগর পিতা কে হবেন। এদিকে বর্তমান মেয়র রব ফোর্ডের ব্যক্তিগত কান্ডকীর্তি ও কেলেংকারীতে অতিষ্ঠ এবং বিরক্ত টরন্টোবাসী তাকে আবারো ক্ষমতায় নিয়ে আসবেন কি না এ নিয়ে যখন জল্পনা কল্পনা চলছিল তখন ঘটে গেল এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। মেয়র রব ফোর্ড অসুস্থ্য হয়ে পড়লেন। ধরা পরলো দূরারোগ্য ব্যাধি। নিজে থেকেই তাকে সরে দাঁড়াতে হলো মেয়র নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে। তার শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে আসলেন তারই বড় ভাই ড্যগ ফোর্ড। ড্যগ ফোর্ড বর্তমানে ওয়ার্ড ২ (ইটবিকক্ নর্থ) এর কাউন্সিলর। আর রব ফোর্ড অসুস্থ হয়ে মেয়র পদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে এসে এই ওয়ার্ড ২ এ কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে যে পরিমান সময় ও দৌড়-ঝাপ দিতে হবে সেটা দেওয়ার মত শারীরিক অবস্থা এখন রব ফোর্ডের নেই। তবে কাউন্সিলর পদের জন্য অতটা সময় ও দৌড়-ঝাপের প্রয়োজন পড়বে না তার।

কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, মেয়র রব ফোর্ডের এতসব কেলেংকারীর ঘটনার পরও তার সমর্থকদের সংখ্যা কিন্তু কম ছিল না। বরং আশ্চার্য্য হওয়ার মতোই ঘটনা যে, জরীপে তিনি দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন। মাদক কেলেংকারী, বউ পেটানো, মিডল ফিংগার প্রদর্শন, ট্রাফিক আইন লংঘনসহ আরো অনেক অঘটনের জন্ম দেয়া এই মেয়র শুধু টরন্টোতে নয়, আলোচিত হয়েছেন বিশ্বব্যাপী। সেই আলোচনার ঝড় থেমে যায়নি এখনো। তিনি মেয়র পদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাড়ানোর পর তার প্রতি ভোটারদের যেটুকু সমর্থন ছিল সেটি ইতিমধ্যে হস্তান্তর হয়ে গেছে তার ভাই ড্যগ ফোর্ডের প্রতি।

এদিকে নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, বিভিন্ন জরীপ প্রতিষ্ঠানের জরীপও ততই নতুন নতুন তথ্য দিচ্ছে। তবে সব জরীপ প্রতিষ্ঠানের জরীপেই এবার এগিয়ে আছেন জন টরি যিনি ২০০৩ সালের মেয়র নির্বাচনে ডেভিড মিলারের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। অবশ্য ২০০৫ সালে তিনি টরন্টোর ডাফরীন -পিল এলাকা থেকে এমপিপি পদে জয়ী হন। কিন্তু তার পরাজয়ের আরো ইতিহাস আছে। ২০০৭ সালে অন্টারিও পিসি পার্টির প্রধান হিসেবে অন্টারিও প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনে তিনি দলের নেতৃত্ব দেন। কিন্তু তার দল পরাজিত হয়। সেবার তার ভধরঃয-নধংবফ বফঁপধঃরড়হ রফবধ তাকে ডুবিয়েছিল। এমনকি তিনি তার নিজের আসনটিও হারিয়েছিলেন।

জন টরি ইতিপূর্বে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ব্রায়ান মালরুনীর উপদেষ্টা ছিলেন, ছিলেন সাবেক প্রিমিয়ার বিল ডেভিসের সিনিয়র উপদেষ্টা। রজার্স কমিউনিকেশনের টপ এক্সিকিউটিভও ছিলেন। আরো ছিলেন কানাডিয়ান ফুটবল লীগের কমিশনার। ব্যবসা, আইন পেশা এসবকিছুতেই তিনি ছিলেন সফল ব্যক্তি। রাজনীতিতে এসে বার বার কেন পরাজিত হয়েছেন সে প্রশ্ন আজো রয়ে গেছে অনেকের কাছে। হয়তো তার নিজের কাছেও। সম্ভবত সে কারণে ২০১০ সালে মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে তিনি বিরত ছিলেন।

কিন্তু এবার মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে তিনি শুরু থেকেই এগিয়ে আছেন জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে। দিন যত যাচ্ছে তার জনপ্রিয়তা ততই বাড়ছে। বর্তমানে তিনি টরন্টোর সব নির্বাচনী এলাকায়ই এগিয়ে আছেন জনপ্রিয়তার দিক থেকে। এমনকি ফোর্ড ভ্রাতৃদ্বয়ের নির্বাচনী এলাকায়ও তিনি এগিয়ে আছেন। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে এই রিপোর্ট তৈরীর সময় ওঢ়ংড়ং জবরফ এর জরীপ রিপোর্ট অনুযায়ী তার জনপ্রিয়তার হার ছিল শতকরা ৪৮ ভাগ। অন্যদিকে জন টরির নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি অলিভিয়া চাউ এবং ড্যগ ফোর্ড এই দুইজনেরই জনপ্রিয়তার হার ছিল মাত্র ২৬ ভাগ।

জন টরি ইতিপূর্বে একাধিকবার নির্বাচনী দৌড়ে পরাজিত হলেও রাজনীতিতে তার বিরোধীরা তাকে যথেষ্ট সমীহ ও সম্মান করেই চলেন। কিন্তু তার রাজনৈতিক দূরদর্শীতা নিয়ে লোকজনের মনে একটা সংশয় মাঝে মাঝে উঁকি দেয়।

এদিকে নির্বাচনের আর বেশী দিন বাকি নেই। টরন্টোর প্রকৃতি একদিকে ঠান্ডা হয়ে আসছে কিন্তু টরন্টোর রাজনৈতিক অঙ্গন গরম হয়ে উঠেছে নির্বাচনী উত্তাপে। জরীপ রিপোর্টের ৪৮ বনাম ২৬ এর মধ্যে ব্যবধান অনেক বেশী। কিন্তু তারপরও জনমনে আরেক সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে থেমে থেমে। সেটি আর কিছুই নয়- মেয়র রব ফোর্ডের অসুস্থতা। এই অসুস্থতা কি ফোর্ড পরিবারের জন্য শাপে বড় হয়ে দেখা দিবে? এমনি জল্পনা- কল্পনা শুরু হয়ে গেছে এর মধ্যে।

মেয়র রব ফোর্ডের অসুস্থতা ধরা পড়ার আগেও জনপ্রিয়তার বিভিন্ন মাপকাঠিতে তিনি পিছিয়ে ছিলেন। প্রথম দিকে ছিলেন তৃতীয় অবস্থানে। অর্থাৎ অলিভিয়া চাউ এর পরের অবস্থানে। পরে অলিভিয়া চাউকে পিছনে ফেলে তিনি চলে আসেন দ্বিতীয় অবস্থানে। কিন্তু তারপরও বিতর্ক তার পিছু ছাড়েনি। আর রব ফোর্ড মূলত এমন এক ব্যক্তি যিনি বিতর্কিত হতে ভালবাসেন। কেউ তাকে নিয়ে বিতর্ক না করলে তিনি নিজে থেকেই বিতর্ক তৈরী করেন যাতে লোকে তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু অসুস্থতা ধরা পড়ার পর তিনি যেন একটু নম্র হয়েছেন বলে মনে হয়। অবশ্য এতদিন তিনি যা করে এসেছেন তাতে করে শান্ত,নম্র এই শব্দগুলো তার চরিত্রের সঙ্গে মোটেও খাপ খায় না। আগামীতে তিনি আরো কি কি বিতর্কের জন্ম দিবেন তা এখনি বলা মুষ্কিল। কিন্তু তিনি যে দমার পাত্র নন তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি যখন সেপ্টেম্বরের ২৭ তারিখে অসুস্থ্য শরীর নিয়েই নির্বাচনী প্রচারণায় ফিরে আসেন। তবে এবার মেয়র পদের জন্য নয়, কাউন্সিলর পদের জন্য। হাস্যোজ্জল মুখে তিনি ইটোবিককে এক নির্বাচনী প্রচারণা সভায় লোকজনের সামনে এসে উপস্থিত হন স্ত্রী ও শিশু সন্তানদের সহ।

নির্বাচনী প্রচারণায় শিশু সন্তানদের নিয়ে এলেন কেন তিনি? এর কোন সহজ উত্তর নেই। আর এটি করে তিনি নির্বাচনী আইন ভঙ্গ করেছেন তাও বলা যাবে না। তবে ফোর্ডের নিন্দুকেরা হয়তো বলতে পারেন, তিনি ভোটারদের সহানুভূতি লাভের আশায় এমনটি করে থাকতে পারেন। কথাটি হয়তো সত্যি অথবা হয়তো সত্যি নয়। কিন্তু এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রব ফোর্ডের প্রতি ভোটারদের সহনুভূতি জেগে উঠা বিচিত্র কিছু নয়। পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে এরকম বহু নজির আছে যেখানে পিছিয়ে থাকা প্রার্থীরা ব্যক্তিগত অসুস্থতা বা পরিবারিক বিপর্যয়ের শিকার হওয়ার কারণে ভোটের দিন হাঁসি মুখে বিজয়ের বেশে বাড়ি ফিরেছেন। ফোর্ড পরিবারের বেলায়ও যে তা ঘটবে না তা কে জানে। টরন্টোর মেইন স্ট্রিম মিডিয়াতে সে রকম ইঙ্গিত দিয়ে রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যে। এদিকে ছোট ভাই রব ফোর্ডের অসুস্থতার পর মেয়র নির্বাচনে নাম লিখিয়ে ড্যগ ফোর্ড প্রথম দিন যে আবেগী বক্তৃতা দেন সেটার পরপরই তার জনপ্রিয়তার মাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুর করে যেটা তাৎক্ষনিক জরীপেই প্রকাশিত হয়। আর সপ্তাহ পার না হতেই দেখা গেল তার জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে। অবশ্য জনপ্রিয়তার বিচারে এখনো জন টরি থেকে বহু পিছিয়ে আছেন। তবে আগামী কয়েকদিনে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় তা এখনো বলা যাচ্ছে না। আর জন টরি যদি জরীপ ফলাফল দেখে ওভারকনফিডেন্ট হয়ে বসে থাকেন তাতেও ফলাফল উল্টে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়।

এবারের নির্বাচনী ইস্যুসমূহ

গত জুলাইতে ঘধহড়ং জবংবধৎপয পরিচালিত এক জরীপে দেখা গেছে ভোটাররা এবার যে সব ইস্যুতে জোর দিচ্ছেন তা হলো, পাবলিক ট্রানজিট, হাই প্রপার্টি ট্যাক্স, জব, লোকাল ইকনমী ও ট্রাফিক।

পাবলিক ট্রানজিট : ভোটারদের দাবীর প্রতি লক্ষ্য রেখে অলিভিয়া চাউ তার নির্বাচনী প্রচারনার কৌশল তৈরী করেছেন পাবলিক ট্রনজিটের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। তিনি জোর দিয়েছেন উন্নত বাস সার্ভিসের উপর। পিক আওয়ারে বাস সার্ভিস ১০% বৃদ্ধি করবেন বলে তিনি ভোটারদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। রব ফোর্ড প্রতিযোগিতায় থাকা অবস্থায় বলেছিলেন তিনি সাবওয়ের বিস্তৃতি ঘটাবেন। ৯ বিলিয়ন ডলার খরচ করে তিনি ৩২ কিলোমিটার বিস্তৃতি ঘটাবেন সাবওয়ে সিস্টেমে। ড্যগ ফোর্ড এসে তার ভাইয়ের পলিসিকেই অনুসরণ করছেন। অন্যদিকে জন টরি জোর দিচ্ছেন তার স্মার্ট ট্রাক প্লানের উপর। তার এই প্লানে আছে ২২টি স্টপেজসহ ৫৩ কিলোমিটার নতুন রেইলট্রাক গড়ে তোলা।

প্রপার্টি ট্যাক্স

নির্বাচিত হলে প্রপার্টি ট্যাক্সের ব্যাপারে অলিভিয়া চাও এর প্রতিশ্রুত হলো, যে সকল প্রপার্টি ২ মিলিয়ন ডলারের চেয়ে বেশী মূল্যে বিক্রি হবে সেগুলোর উপর ১% ভাগ হারে লেভি চার্জ বৃদ্ধি করা হবে। রব ফোর্ডের প্রতিশ্রুতি ছিল মুদ্রাস্ফীতি রেটের অনেক নিচে রাখা হবে প্রপার্টি ট্যাক্স। জন টরির প্রতিশ্রুতি হলো, প্রপার্টি ট্যাক্স বৃদ্ধি করা হবে মূদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল রেখে।

কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি

অলিভিয়া চাউ নির্বাচিত হলে অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য টরন্টোকে নর্থ আমেরিকার প্রধান ট্রেডিং সেন্টার বানাবেন চাইনিজ কারেন্সির জন্য। জন টরির বার্তা হলো, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তিনি হবেন প্রধান সেলস পারসন ও অ্যাম্ব্যাসেডর ফর দি সিটি। ড্যগ ফোর্ড কি করবেন তা এখনো জানা যায়নি।

টরন্টোকে মেরামত করার সবচেয়ে ভাল পরিকল্পনা কার

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি আধুনিক নগর পরিকল্পনার দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে এ কথা সহজেই বলা যায় যে, টরন্টোর বহু বছরের পুরানো অবকাঠামো ও এফোর্ডেবল হাউজিং সমস্যা সমাধান করতে যে পরিমান আর্থিক সামর্থ্য থাকা প্রয়োজন তা বর্তমানে সিটি কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। বর্তমান অবকাঠামোতে পর্যাপ্ত সুবিধা নেই বলে নগরীর কোন কোন

অঞ্চলে রাশ আওয়ারে ট্রাফিক জ্যাম নিত্যনৈমিত্যিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যত বাণী হলো, এই বেকায়দা অবস্থার মধ্যে আগামী ১৫ বছরে নগরীতে যোগ হবে আরো এক মিলিয়নেরও বেশী গাড়ি। অন্যদিকে টরন্টোতে রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্বল্প আয়ের পরিবার। এদের জন্য রয়েছে এফোর্ডেবল হাউজিং এর ব্যবস্থা। কিন্তুু সেই ব্যবস্থা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। গত মাসে প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যায় বর্তমানে টরন্টোতে ১ লাখ ৬৫ হাজার স্বল্প আয়ের পরিবার ওয়েটিং লিস্টে আছেন এফোর্ডেবল হাউজিং এর জন্য। এফোর্ডেবল হাউজ পাওয়ার জন্য এই পরিবারগুলোকে অপেক্ষা করতে হবে গড়ে ৬ বছর। কারো কারো ক্ষেত্রে এই অপেক্ষার সময় ১০ বছর পর্যন্ত হতে পারে।

এখন সহজেই অনুমেয়, আসন্ন মেয়র নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীদেরকে নগরীর প্রধান এই সমস্যাগুলো সমাধানে বেটার প্লান নিয়ে এগুতে না পারলে ভোট পাওয়া তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাড়াবে। টরন্টোর ট্রাফিক ব্যবস্থা ও ট্রাফিক জ্যাম যেহেতু অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় আছে তাই এটাকেই প্রধান ইস্যু বানিয়ে মেয়র প্রার্থীরা জোর নির্বাচনী প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ বলছেন বাস সার্ভিস উন্নত করবেন, কেউ বলছেন সাবওয়ে সিস্টেমের বিস্তার ঘটাবেন। কেউ বলছেন সারফেস ট্রেন ব্যবস্থার বিস্তার ঘটাবেন। কিন্তু কার পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি সবচেয়ে বেশী অকৃষ্ট করতে পেরেছে ভোটারদেরকে?

এ পর্যন্ত পরিচালিত বিভিন্ন জরীপ প্রতিষ্ঠানের সব কটি জরীপে আমরা দেখতে পাচ্ছি রেসে সবচেয়ে বেশী এগিয়ে আছেন জন টরি। তাহলে কি আমরা ধরে নিতে পারি যে জন টরির স্মার্ট ট্রাক প্লানটাই সবচেয়ে যুৎসই টরন্টোকে ফিক্স করার জন্য? কিন্তু জন টরির প্লানকে অনেকেই উচ্চাভিলাষী বলে কটাক্ষ করছেন। অন্যদিকে অলিভিয়া চাউ এবং ড্যগ ফোর্ড এর ট্রানজিট প্লান কতটা বাস্তবমুখী সেটাও বিবেচনায় আনতে হবে। আর এ কথা ভাবার বা বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই যে, কানাডা একটি উন্নত দেশ বলে এখানকার রাজনীতিকরা ‘সদা সত্য কথা বলেন’। ভোট পাওয়ার জন্য তারাও যে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিতে পিছপা হন না তার প্রমান খুঁজে পাওয়া খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়। সুতরাং টরন্টোর সমস্যাগুলো মেরামত করার জন্য কার পরিকল্পনা সবচেয়ে ভাল তা যেমন খুটিয়ে দেখতে হবে, তার পাশাপাশি এটিও দেখতে হবে কে তার কথা রাখবেন বা রাখতে পারবেন। অনুন্নত দেশের রাজনীতিকদের স্টাইলে গালভরা বুলি আর ঝুঁড়ি ঝুঁিড় প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চাইবেন আর ভোটাররা তাতে বিশ্বাস করে ভোট দিবেন এমনটা এখানে হওয়ার আশা কম। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগন মনে করেন, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদেরকে বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে কথা বলতে হবে যদি তারা সত্যিই ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে চান।

বর্তমানে টরন্টোর প্রধান প্রধান সমস্যার কথা চিন্তা করলে প্রথমেই ট্রানজিট ও জানযটের প্রসঙ্গ এসে যায়। এ সমস্যা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে তাতেও কোন সন্দেহ নেই। গত ২৯ সেপ্টেম্বর টরন্টো ইউনিভারসিটির একদল গবেষকও এই বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে মেয়র প্রার্থীদেরকে অবশ্যই ট্রানজিট সমস্যাকে সবার উপর স্থান দিতে হবে। তাদের রিপোর্টে আরো বলা হয়, মেয়র রব ফোর্ডের নেতৃত্বে গত প্রায় চার বছরে টরন্টো মূলত কর্মহীনতার মধ্যে ছিল। আর এবারের নির্বাচনের পূর্বমুুহুর্তে প্রার্থীরা যে হারে প্রতিশ্রুত দিচ্ছেন টরন্টোর ট্রানজিট সিস্টেমকে ঢেলে সাজাবেন সেটা বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ সিটি কর্তৃপক্ষের আর্থিক যে পরিস্থিতি তা দিয়ে কোনরকমে হয়তো বর্তমান ট্রানজিট, স্যুয়ারেজ ও হাউজিং সমস্যার সংস্কারের কাজগুলো করা যেতে পারে। এই অবস্থায় প্রার্থীরা যে সকল বিগ বাজেটের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তার অর্থ কোথা থেকে আসবে সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। রিপোর্টে সতর্ক করে দেয়া হয় এই বলে যে, প্রভিন্সিয়াল বা ফেডারেল সরকার সিটিকে আর্থিক যোগান দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসবে সে সম্ভাবনা খুবই কম।

প্রার্থীদের প্রোফাইল

জন টরি : জন টরি ছিলেন অন্টারিও কনজারভেটিভ দলের প্রধান। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে তিনি গত ২০০৩ সালে মেয়র নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন। পরে ২০০৭ সালে আবারো পরাজিত হন অন্টারিও নির্বাচনে। বস্তুত তিনি কানাডার ফেডারেল, প্রভিন্সিয়াল ও মিউনিসিপাল এই তিন স্তরেই দীর্ঘ ৩০ বছর যাবত রাজনীতি করে আসছেন। কিন্তু তার প্রথম এবং একমাত্র বিজয়ের ইতিহাস কেবল একটি। সেটি হলো ২০০৫ সালে টরন্টো থেকে এমপিপি নির্বাচিত হওয়া।

জন টরির জন্ম ১৯৫৪ সালে। ১৯৭৫ সালে টরন্টো ইউনিভারসিটি থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি নেন। ১৯৭৮ সালে ইয়র্ক ইউনিভারসিটি থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি নেন। বিয়ে করেন ১৯৭৮ সালে। চার সন্তানের জনক তিনি।

ড্যগ ফোর্ড : ড্যগ ফোর্ড এর পারিবারিক ইতিহাস একদিকে যেমন সমৃদ্ধ, অন্যদিকে তেমনি বিতর্কিত। তার বাবা ড্যগ ফোর্ড সিনিয়র ছিলেন অন্টারিও প্রভিন্সের এমপিপি। ড্যগ ফোর্ডের ছোটভাই টরন্টোর বর্তমান মেয়র। আর তিনি নিজে টরন্টোর ওয়ার্ড ২ এর বর্তমান কাউন্সিলর। তিনি একজন ব্যবসায়ি। জন্ম ১৯৬৪ সালের নভেম্বর মাসে। ৪ সন্তানের জনক। কার্লটন ইউনিভারসিটির গ্রাজুয়েট তিনি।

গত বছর ১৭ জুলাই টরন্টোর অভিজাত দৈনিক গ্লোব এন্ড মেইলে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয় – মেয়র রব ফোর্ডের ভাই ড্যগ ফোর্ড আশির দশকের দিকে টরন্টোতে ড্রাগ বিক্রি করতেন। তার আরেক ভাই যার নাম রেন্ডি, তিনিও এই ড্রাগ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই ব্যবসা করতে গিয়ে এক অপহরনের মামলায় তিনি অভিযুক্ত হয়েছিলেন। ড্যগ ফোর্ডের বোন ক্যাথি ড্রাগ সম্পর্কিত গান ভায়োলেন্সের শিকার হয়েছিলেন। আর ছোট ভাই টরন্টোর বর্তমান মেয়র রব ফোর্ড তো ড্রাগ সেবন করতে গিয়ে একের পর এক কেলেংকারীর জন্ম দিয়েছেন গত কয়েক বছরে।

অলিভিয়া চাউ : হংকংয়ে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে চাউ বড় হয়ে উঠেছেন। তার বাবা উইলসন ওয়াই সান চাউ ছিলেন একজন সম্মানিত সরকারি কর্মকর্তাÑ একজন স্কুল সুপারিনটেন্ডেন্ট। তার মা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। তাদের পরিবারটি শহরের উপকণ্ঠে একটি চমৎকার বাড়িতে স্বচ্ছন্দে বসবাস করতো। রান্না ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করার জন্য তাদের সার্বক্ষণিক কাজের লোক ছিলো। ১৯৭০ সালের মধ্যে চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূত্রপাত হয় এবং পরিবারটি হংকং ছেড়ে কানাডায় পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। চাউ এর বয়স ছিলো তখন ১৩ বছর।

কানাডায় আসার ফলে তাদের একটি দারুন সুন্দর নতুন জীবনের সূচনা হবে বলে তারা মনে করলেও চাউ-এর কাহিনী অন্য অনেক অভিবাসীর কাহিনীরই প্রতিধ্বনিমাত্র। চাউ এর বাবা শিক্ষিত এবং ইংরেজিতে দক্ষ হলেও কানাডায় কর্মজীবন শুরু করার জন্য তাকে যথেষ্ট সংগ্রাম করতে হয়েছে। তিনি প্রথমে ডেলিভারি গাড়ির চালক, পরে ট্যাক্সি চালক এবং মাঝেমধ্যে শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করেছেন। তার মা একমাত্র যে কাজটি করতে পারতেন সেটি হলো সেলাই করা। চাউ নিজেও তার মায়ের পাশাপাশি কিছু কাজ করতেনÑ তখনকার সময়ের ফ্যাশন অনুযায়ী জিন্স-এর কাপড়ে অলংকৃত বোতাম লাগাতেন। এক পর্যায়ে চৌর বাবা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন, তিক্ততার অনুভূতি প্রকাশে মাঝেমধ্যেই তার মাকে নির্যাতন করতেন এবং এক পর্যায়ে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তার মায়ের উপর বাবার ক্রমবর্ধমান অত্যাচার-নির্যাতন সামাল দেয়ার মতো কোন আত্মীয় বা বন্ধু কানাডায় ছিলো না এবং শেষ পর্যন্ত তার বাবাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। আর চাউ তার পরিবার চালানোর জন্য একাধিক খন্ডকালীন কাজ জুটিয়ে নেন। পরবর্তীতে চাউ ইউনিভারসিটি শেষ করে কলেজ প্রফেসর হিসেবে পেশা জীবন শুরু করেন।

পরের ইতিহাস অবশ্য অন্যরকম। চাউ এর বিয়ে হয় জ্যাক লেটনের সঙ্গে যিনি ছিলেন নিউ ডেমক্রেটিক পার্টির প্রধান। জ্যাক লেটনের মৃত্যু হয় ২০১১ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে। কানাডায় প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক পরিবার ছিলেন চাউ ও লেটন। এদের প্রথম দেখা হয় ১৯৮৫ সালে যখন চাউ স্কুল ট্রাস্টি বোর্ডের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। ঐ সময় জ্যাক লেটন লড়ছিলেন সিটি কাউন্সিলর পদের জন্য। তিন বছর পর তাদের বিয়ে হয়। চাউ পরবর্তীতে সিটি কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। পর পর ৫ বছর তিনি নির্বাচিত হন। পরে জাতীয় নির্বাচনেও জয়ী হন চাউ। তিনি টরন্টোর ট্রিনিটি-স্পাডাইনা এলাকা থেকে এমপি নির্বাচিত হন। ঐ পদ ছেড়েই তিন এবার মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এসেছেন।

ডেট লাইন ২৭ অক্টোবর

সময় আর বেশী বাকি নেই। ২৭ অক্টোবর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কি হবে ঐ দিন। কে হবেন নগরপিতা। জরীপ রিপোর্টে যা বলা হচ্ছে তা কি শেষ পর্যন্ত ঠিক থাকবে না ভোটের দিন চমকপ্রদ কিছু ঘটবে। নাকি অঘটন কিছু ঘটবে? গত ১২ জুন অনুষ্ঠিত অন্টারিওর প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনে পূর্বঘোষিত সব জরীপকেই ওলটপালট করে দিয়েছিলেন ভোটারা। এবারও কি তাই ঘটবে? এর উত্তর পেতে হলে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই এই মূহুর্তে। আমরা জানি জরীপে জন টরি এগিয়ে থাকলেও টরন্টোর আনডিসাইডেট ভোটারদের মতিগতি এখনো অনুমান করা যাচ্ছে না। এই আনডিসাইডেট ভোটারদের সংখ্যা কম নয়। এবং এরা ভোটের দিন জরীপের সকল জল্পনা কল্পনাকে উল্টিয়ে দিতে পারেন।