প্রবাসে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও বাঙ্গালী সংস্কৃতির এক মেলবন্ধন কানাডা বাংলাদেশ হিন্দু মন্দির
একটি বাড়ির বেইজমেন্ট ভাড়া করে যাত্রা শুরু করে বর্তমানে এক বিশাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে কানাডা বাংলাদেশ হিন্দু মন্দির। পূজার আয়োজন ছাড়াও হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও কানাডায় বাঙ্গালী সংস্কৃতির এক মেলবন্ধন তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। শুরু থেকেই মন্দিরটির সঙ্গে ছিলেন বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য নির্মল কর ও শিবু চৌধুরী, বর্তমান প্রেসিডেন্ট সুভাস রায় আর সাবেক প্রেসিডেন্ট অরুণ দত্ত। তাদের মুখ থেকে জানা গেল কানাডা প্রবাসী বাঙ্গালী হিন্দুদের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার স্থানটির আদ্যপান্ত।
একটু পিছনে ফিরে তাকানো যাক। ১৯৯৮ সাল। কিছু সাংস্কৃতিক কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বাংলাদেশ কানাডা হিন্দু কালচারাল সোসাইটির কর্মকান্ড। ২০০০ পর্যন্ত এই ব্যানারেই চলতো কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশী হিন্দুদের ধর্ম-কর্ম। নির্মল করের মতে কিছু ব্যক্তি বিশেষের আচরণে একসময় সংগঠনটিতে কিছু বিভাজন তৈরি হয়। এ বিভাজন দূরীকরণ ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হিন্দু ধর্মের বার্তা পৌঁছে দিতেই একটি মন্দির প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালান তারা। মন্দিরটির নেপথ্যে কাজ করা ঐ চার জনের কাছে প্রশ্ন ছিল তাহলে কি শুধু ধর্ম পালনের উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠা করা হয় কানাডা-বাংলাদেশ হিন্দু মন্দির? জবাবে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য নির্মল কর জানান, এখানে যারা মারা যান তাদের শ্রাদ্ধ করতে হলে স্বজনদের যেতে হতো টরোন্টোর কাছে কালীবাড়িতে। যা ছিল সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। তাছাড়া সন্তান জন্মের পর সত্যাগ্র থেকে শুরু করে যে কোন ধরনের পূজা করা ছিল রীতিমত কঠিন। এই মনোপীড়া থেকেই একটি মন্দির প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশী হিন্দুরা।
বাংলাদেশ থেকে সুদূর এই প্রবাসে বসে এরকম একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করা সহজ কাজ নয়। অনেক পরিশ্রম, সময় আর অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে এর পিছনে। এ কাজটি কিভাবে সমাধা করা হলো তা জানতে চাইলে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য শিবু চৌধুরী বলেন, এটি কোন একক কাজ নয়। সকলের সহযোগিতা, কঠোর প্ররিশ্রম আর ঐকান্তিক প্রচেষ্টারই ফসল আজকের এই মন্দিরটি। তবে এখনো কাজ বাকী রয়েছে আমাদের। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমরা কমিউনিটির লোকদের কাছ থেকে প্রচুর সহযোগিতা পেয়েছি। শুধু হিন্দু কমিউনিটি নয়, মুসলমান কমিউনিটির কাছ থেকেও অনেক সহযোগিতা পাচ্ছি। এখানে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে আন্তরিকতা অনেক বেশী। আমাদের এখানে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। সবার জন্যই এই মন্দির খোলা। আমাদের ধর্ম ভিন্ন হতে পারে কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি তো এক।
শিবু চৌধুরী আরো বলেন, মন্দির প্রতিষ্ঠার পিছনে আমাদের প্রথম উদ্দেশ্য হলো মানুষকে সামাজিক সেবাপ্রদান করা এবং এর পরে যে উদ্দেশটি নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি তা হলো, এই প্রবাসে প্ররবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা বজায় রাখা যাতে গড্ডালিকা প্রবাহের মতো তারা হারিয়ে না যায়।
মন্দিরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সুভাস রায় এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে সামজিক-ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের প্রসার ও সমর্থন করা। এই প্রয়োজনটা শুধুমাত্র হিন্দুধর্মাবলম্বী নয়, যারা আমরা প্রবাসী সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এখানে আমরা একটা ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে এসে পড়েছি। ধর্মাশ্রিত সংস্কৃতি এবং আমাদের সেই সংস্কৃতির সাথে কানাডিয়ান সংস্কৃতির একটা সেতুবন্ধন তৈরি করে যাতে আমরা যারা এখানে এসেছি তারা সবাই সুন্দরভাবে বসবাস করতে পারি। এটা ধর্মীয় হতে পারে ব্যক্তিগত হতে পারে, সর্বোপরি সামাজিক যে প্রয়োজনগুলো আছে সেগুলো পুরণে সহায়তা করা”।
হিন্দু কমিউনিটির অনুদান ও সংগঠনের করা বিভিন্ন অর্থ উপার্যানকারী প্রকল্প থেকে আসা অর্থে পরিচালিত হচ্ছে আজকের এই মন্দির, যার শুরু হয় বেসমেন্টের ৫০০ ডলার ভাড়ার একটি বাড়ি থেকে।
বর্তমানে মন্দিরটিতে পূজা বা ধর্ম-কর্মের পাশাপাশি চলছে ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষা শিক্ষার কার্যক্রম। এসব কর্মকান্ডের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতারা জানান, কানাডায় নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে মুক্ত একটি সংস্কৃতিতে যেখানে ধর্ম তাদের জীবনে তেমন প্রভাব ফেলে না। ফলে তাদের নিজ ধর্ম, সংস্কৃতি আর ভাষাকে লালন করার নেপথ্যে কাজ করে যাচ্ছে মন্দিরটি।
মন্দিরে হিন্দু কমিউনিটির দ্বিতয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের উপস্থিতি কেমন এ বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী সাধারণ সম্পাদক শুভ্রা শিউলি সাহা বলেন, আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম যাদের জন্ম এখানে বা খুব ছোট বয়স থেকে এখানে বড় হয়েছে বা হচ্ছে তাদের সঙ্গে আমাদের মূল্যবোধের যথেষ্ট পার্থক্য অনেক সময় দেখা যায়। কারণ আমাদের সামাজিকায়ন আর ওদের সামাজিকায়ন কিছুটা ভিন্ন। ওরা অনেক সময় দেখা যায় যুক্তি ছাড়া কোন কিছু মানতে চায় না। আমাদের কিছু কিছু বিশ্বাস আছে যা অনেক গভীরে না গেলে বোঝা যায় না। কোন দেবতা কি, কার কি মাহাত্ম্য এগুলো তারা সহজে বুঝে উঠতে পারেনা। আমরা যারা দেশ থেকে এসেছি, আমাদের মধ্যে ধর্মের বিশ্বাস, আচার-আচরণ ও মূল্যবোধগুলো যে ভাবে গেঁথে আছে সেগুলোতো দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সেভাবে প্রবেশ করতে পারছে না। কারণও আছে, আমরা নতুন একটি দেশে এসে বেঁচে থাকার জন্য কঠিন জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত হয়ে পরি। ছেলে-মেয়েদেরকে সে ভাবে আমরা সময় দিতে পারিনা। সুতরাং তারাও খুব বেশী কিছু আমাদের কাছ থেকে শিখতে পারেনা। তবে আমি বিশ্বাস করি, এই মন্দির একটি বিশেষ মাধ্যম বা সুযোগ যার মাধ্যমে আমরা আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে আমাদের ধর্মীয় চেতনা, মূল্যবোধ, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে প্রবেশ করিয়ে দিতে পারবো। আমাদের এই মন্দিরে একটি ইয়ূথ ফোরামও আছে। এখানকার ইউনিভারসিটির ছেলে-মেয়েরা মিলে এটি চালায়। এরা স্বরস্বতী পূজাসহ বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।
বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় সংখ্যালঘু। এই কানাডায় আরো বেশীমাত্রায়। কিন্তু তাতে কি ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হচ্ছে? এই প্রশ্নের জবাবে শুভ্রা শিউলি বলেন, বাংলাদেশে আমাদেরকে অনেক চাপের মধ্যে থাকতে হতো, এখনো হচ্ছে। কিন্তু কানাডার চিত্র ভিন্ন। এখানে আমরা সংখ্যালঘু বা যাই হই না কেন, এটি একটি মাল্টিকালচারাল সোসাইটি, একটি ডাইভার্সিফাইড সোসাইটি। এখানে সরকারই যার যার কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে উৎসাহ যুগিয়ে আসছে। কানাডা বিশ্বাস করে একটি সংস্কৃতির ভিতর অনেক রিসোর্স থাকে, একটি ভাষার মধ্যেও অনেক রিসোর্স থাকে। সুতরাং কোনটাই যেন হারিয়ে না যায়। একটি বাগানে যেমন নানান ধরণের ফুল থাকে, প্রত্যেকটি ফুলই যেমন বাগানের সৌন্দর্য বাড়ায় তেমনি কানাডার মাল্টিকালচারল সোসাইটিতেও প্রতিটি সম্প্রদায় কানাডার সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। কোনটার গুরুত্বই কোনটা থেকে কম নয়।
মন্দিরের আরেক সদস্য অপর্ণা বণিক। তিনিও এর বিভিন্ন কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত। মন্দিরে ছোট ছোট বাচ্চাদের বাংলা শেখান। পূজার ভোগ রান্নায় সহায়তা করেন। তার কাছে প্রশ্ন ছিল কানাডায় তিনি বা মন্দিরের অন্য কোন সদস্য ধর্মপালনের ক্ষেত্রে কখনো কোন বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন কি না। উত্তরে তিনি বললেন, না, কখনো এরকম পরিস্থিতির শিকার হয়নি আমরা। কানাডায় আমরা বিভিন্ন পূজা-পার্বনে বেশী আনন্দ করতে পারি। এর বেশী আমার আর বলার কিছু নেই।
আজকের এই সফলতা দেখে বোঝার উপায় নেই যে একসময় নিজের কমিউনিটি থেকেও বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতারা। সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, অধ্যাবসায় আর বেশির ভাগ মানুষের সহযোগিতায় দীর্ঘদিনের চেষ্টার পর ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কানাডা বাংলাদেশ হিন্দু মন্দির। এরপর আর দমানো যায়নি প্রতিষ্ঠানটির অগ্রগতি। বর্তমানে বর্ণবৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে উঠে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। কানাডায় বসবাসকারী আড়াইশ’টির বেশি বাঙ্গালী হিন্দু পরিবারের অনুদানে মূলত চলছে মন্দিরটি।
মন্দিরটির সফলতার জন্য সাবেক প্রেসিডেন্ট অরুণ দত্তসহ প্রত্যেকেই হিন্দু কমিউনিটির পাশাপাশি মুসলমানদের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানান। সভাপতি বলেন, “মুসলিম কমিউনিটির কাছ থেকে আমরা অনেক সহযোগিতা পাই। এখানে শুরুতেই সংগঠনটা সেই ১৯৯৪ সালে যখন গড়ে উঠে তখনই হিন্দু মুসলমান মিলেই এই কালচারাল সোসাইটিটা গড়ে তোলা হয়। এবং সে চর্চাটা এখনো আছে। আমরা পহেলা বৈশাখ পালন করি, এই অনুষ্ঠানটা যদি খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক কতটা গভীর। মুসলিম কমিউনিটিতে বেশ কয়েকজন আমাদের কাজটা এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন এবং এখনো করছেন। বাংলাদেশের মতোই এখানে আমরা হৃদ্যতার সাথে কাজ করছি”।