কানাডায় সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ নয়, ভালবাসা ও মানবিকতার জয় হোক

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাশী ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি মুসলমানদের নিয়ে যে অমর্যাদাকর মন্তব্য করেছেন তা নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই নিন্দার ঝড় উঠে। তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের জন্য সাময়িকভাবে হলেও যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে। তিনি আরো বলেন, আমেরিকার প্রতি মুসলিমদের বিদ্বেষ এত তীব্র যে তা ‘ধারণারও বাইরে’। তার মতে, এই ঘৃণার উৎস কী এবং আমেরিকার জন্য তা কী হুমকি সৃষ্টি করেছে, তা পুরোপুরি বুঝে না ওঠা পর্যন্ত মুসলিমদের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা চালু রাখতে হবে।

ট্রাম্পের ওই বক্তব্যের জন্য তাঁকে ‘বিকৃত মস্তিষ্ক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন রিপাবলিকান দলের আরেক মনোনয়নপ্রার্থী ও ফ্লোরিডার সাবেক গভর্নর জেব বুশ। হোয়াইট হাউস এবং মুসলিম নেতাদের পক্ষ থেকেও ট্রাম্পের ওই বিতর্কিত মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করা হয়।

তবে নিন্দার ঝড় উঠলেও ট্রাম্পের প্রতি সমর্থনেরও অভাব ছিল না। আর সেই সমর্থন দেখা গেছে কানাডাতেও। অহমঁং জবরফ ওহংঃরঃঁঃব পরিচালিত সাম্প্রতিক এক জরীপে দেখা গেছে ৩৩% কানাডিয়ানের সমর্থন রয়েছে ট্রাম্পের বক্তব্যের প্রতি! বাকি দুই তৃতীয়াংশ কানাডিয়ান মনে করেন ট্রাম্পের বক্তব্য সমর্থনযোগ্য নয়।

ডধংযরহমঃড়হ চড়ংঃ-অইঈ’র যৌথ জরীপে দেখা গেছে ট্রাম্পের বক্তব্যের প্রতি ৩৬% আমেরিকানের সমর্থন রয়েছে। অর্থাৎ এই উভয় দেশেই মুসলিম বিদ্বেষ প্রায় সমান সমান।

কানাডিয়ানদের এই ৩৩% সমর্থনকে হালকাভাবে নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। একটি দেশের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন যদি কোন সম্প্রদায় বিশেষের প্রতি কোন কারণে বিদ্বেষী হন তবে তা নিশ্চিতভাবেই ভাবনার বিষয়। অবশ্য মুসলিম বিদ্বেষী এই কানাডিয়ানদের মধ্যে প্রায় সকলেই কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থক। কানাডার গত জাতীয় নির্বাচনেও আমরা দেখেছি এই কনজারভেটিভ পার্টি দেশটিতে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নানান কুটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল। তবে সিংহভাগ কানাডিয়ান বিশেষ করে লিবারেল পার্টি ও এনডিপি সমর্থকগণ সেই কুটকৌশলের দাতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন নির্বাচনের দিন।

কনজারভেটিভ পার্টি পরাজিত হয়েছে রাজনৈকিভাবে। কিন্তু তাদের আদর্শ বা নীতি একই রয়ে গেছে এবং থাকবে। আর ঐ ৩৩% কানাডিয়ানের ট্রাম্পপ্রীতি বা মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব যে আগামীতে আরো বৃদ্ধি পাবে না বা তাদের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে না তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। আজকে সিরিয়ান রিফিউজিদের আগমনকেও তারা ভাল চোখে দেখছেন না। কানাডায় প্রতি ফ্লাইটে আসা সিরিয়ান রিফিউজিদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মুসলিম বিদ্বেষী এই কানাডিয়ানদের গাত্রদাহ ও অন্তরজ্বালা। তাদের সন্দেহ বা ভয় হলো এই সিরিয়ান রিফিউজিদের মধ্যে ইসলামী জঙ্গী বা আইএস এর সদস্য থাকতে পারে।

এই ভয় থাকাটা অযৌক্তিক কিছু নয়। রিফিউজিদের মধ্যে জঙ্গী বা জঙ্গী মনোভাবাপন্ন কেউ থাকবে না এমন শতভাগ গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। প্যারিসের সাম্প্রতিক জঙ্গী হামলার পর সেই ভয় আরো বৃদ্ধি পেয়েছে কানাডায় বসবাসরত ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবার মনেই। কিন্তু এ জন্য সাধারণ মুসলমানদেরকে ঢালাওভাবে দায়ী করা কতটুকু যৌক্তিক তাও ভেবে দেখা প্রয়োজন। তাছাড়া জঙ্গীদের উৎপাতে সন্ত্রস্ত থাকেন কানাডার সাধারণ মুসলমানগণও।

আমরা জানি জঙ্গীপনা বর্তমান বিশ্বের অশুভ রাজনীতিরই সৃষ্টি। এর সাথে সাধারণ মুসলমানদের কোন সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক নেই ইসলামেরও। ইসলামের নাম করে যারা জঙ্গীপনা করে বেড়াচ্ছে তারা মূলত অনৈসলামিক কাজই করছে। আমরা এও জানি যে, কানাডার হোমগ্রোন টেররিস্টদের ব্যাপারে প্রয়োনীয় তথ্য ও সন্ধান আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর কাছে দিচ্ছেন এই সাধারণ মুসলমানগণই।

সুতরাং ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যের প্রতি সমর্থণ জানানো বা তার সঙ্গে গলার সুর মিলিয়ে কানাডায় মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানো বর্ণবাদেরই নামান্তর বলে আমরা মনে করি। আর এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সাবেক কনজারভেটিভ সরকারের কিছু নীতিও ইন্ধন যুগিয়েছে। এ কথার সমর্থন আমরা দেখতে পাই টরন্টোর ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গুইডা ম্যান এর এক বক্তব্যেও। কনজারভেটিভ পার্টি ক্ষমতায় থাকা কালে তিনি একবার বলেছিলেন নারিকত্ব অনুষ্ঠানে নেকাব পরার মত বিষয়ে অটোয়া থেকে যেসব কথা বলা হয় সেগুলো অভিবাসন সম্পর্কে বর্ণবাদী মনোভাব তৈরীতে ভূমিকা রাখে।

কনজারভেটিভ পার্টি এখন ক্ষমতায় নেই, স্টিফেন হারপারও বিদায় হয়েছেন। লিবারেল পার্টি ক্ষমতায় এসে বিপুল সংখ্যক সিরিয়ান রিফিউজি আনছে কানাডায় মানবিক দিক বিবেচনা করে। ২৫ হাজারের স্থলে এখন সরকার ভাবছে ৫০ হাজার রিফিউজি আনবে। এটি লিবারেল সরকারের উদারতারই পরিচয় বহন করে। আর লিবারেল সরকার কয়েক দফা সিকিউরিটি চেক করেই সিরিয়ান রিফিউজিদেরকে কানাডায় আসার অনুমতি দিচ্ছে।

আমরা বর্তমান সরকারের এই মানবিক উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। কানাডায় সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ নয়, ভালবাসা ও মানবিকতার জয় হোক এটাই আমরা কামনা করি।