কানাডায় মানসিক রোগে ভুগছেন প্রায় একচতুর্থাংশ প্রবাসী

টরন্টোর বাংলাদেশী কমিউনিটিতে একজন সুপরিচিত ও সুচিকিৎসক ডাক্তার আবু আরিফের ক্লিনিক ড্যানফোর্থ ও ওয়ার্ডেনের মোড়ে। অল্পদিনেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন কমিউনিটিতে। প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে তার কাছে আমরা জানতে চেয়েছিলাম প্রবাসী বাংলাদেশীরা প্রধানত কি কি রোগে ভুগছেন এবং এই রোগগুলো কি শুধুমাত্র প্রবাসে আসার কারণেই হয়েছে না অন্য কোন কারণও আছে। প্রবাসীদের মধ্যে মানসিক রোগীর সংখ্যা কেমন। এই মানসিক রোগও কি শুধুমাত্র প্রবাসে আসার কারনেই হয়েছে কি না। যারা বয়োবৃদ্ধ বা সিনিয়র সিটিজেন তাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা কি এই প্রবাসে।

ডাক্তার আরিফ তার অভিজ্ঞতার আলোকে উত্তর দিয়েছেন এই প্রশ্নগুলোর। তিনি যা উত্তর দিয়েছেন তা থেকে বেড়িয়ে এসেছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য।  আসুন শুনি তিনি কি বলেছেন।

প্রশ্ন ১: প্রবাসী বাংলাদেশী অর্থাৎ প্রথম প্রজন্ম সবচেয়ে বেশি কোন রোগে ভুগছে?

উত্তর: প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে যারা অনেক দিন ধরে এদেশে আছে তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টরেল এবং ডায়াবেটিসে ভোগে। আর ব্যায়ম না কারণে প্রবাসী বাংলাদেশীদের ছেলেমেয়েরা অনেক সময় অতিরিক্ত ওজন সমস্যায় ভোগে।

প্রশ্ন২: রোগীর সংখ্যা পুরুষদের মধ্যে বেশি নাকি নারীদের মধ্যে?

উত্তর: এদেরমধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। পুরুষরা কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সময় করে উঠতে পারে না। অনেকে ওভার টাইম কাজ করে, অনেকে রাতে কাজ করে দিনে ঘুমায়। যার ফলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ফুসরৎ পায় না। যদি মনে করে যে মোটামুটি ভাল আছে তাহলে আর ডাক্তারের কাছে আসতে চায় না।

প্রশ্ন ৩: প্রবাসী বাংলাদেশীদের উচ্চ রক্ত চাপ, কোলেস্টরেল, ডায়াবেটিকস প্রতিরোধে কি কি ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে?

উত্তর: এসব রোগ প্রতিরোধে প্রথমত নিয়মিত কোলেস্টরেল, সুগার এগুলো চেক আপ করানো উচিৎ। দ্বিতীয়ত সুস্থ্য থাকার জন্য প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করা খুব জরুরি। খাদ্যাভাসের দিকেও নজর দেয়া দরকার। চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করে শাক সবজি ফলমুল বেশি করে খাওয়া উচিৎ। চর্বিযুক্ত খাবার খেয়ে যদি ব্যায়াম করা না হয় তাহলে শরীরে চর্বি জমতে থাকে। এরফলে অনেক ধরণের রোগ সৃষ্টি হয়।

প্রশ্ন ৪: দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রোগ কোনটা?

উত্তর: এটা বলা বেশ কঠিন। উচ্চ রক্তচাপ তারপর কোলেস্টরেল আর ডায়াবেটিস আছে তিন নম্বরে।

প্রশ্ন ৫: অনেক সময় এদেশীয় ডাক্তাররা বলেন, বাংলাদেশীদের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেশি, এর কারণ কি?

উত্তর: এর কারণ খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়াম না করা।

প্রশ্ন ৬: মানসিক রোগীর সংখ্যা কেমন আসে আপনার কাছে?

উত্তর : এর ধরণের রোগীর সংখ্যা প্রচুর। মানসিক চাপ, দুঃচিন্তা, হতাশা বা ডিপ্রেশনের মতো সমস্যা নিয়ে অনেক রোগী আসে। কারণ এদেশে আসার পরে প্রথমে এরা বুঝে উঠতে পারে না কি

করবে? অনেকের দেশের প্রতি পিছুটান থাকে। প্রবাসে নিজের খরচের পর বাংলাদেশে টাকা পাঠাতে হয়। আবার অনেকে বাংলাদেশের ভাল চাকরি ছেড়ে এখানে আসে যাদের আর্থিক অবস্থা হয়তো খুব ভাল ছিল। নিজেদের কিছু করতে হতো না, সবকিছু অন্য লোকেরা করে দিত। এখানে সবকিছু নিজেকে করতে হয়। এইসব কিছু মিলে তারা খুব মানসিক চাপের মধ্যে থাকে। অনেকে আবার হাতশায় ভোগে।

প্রশ্ন ৭: কি ধরণের মানসিক রোগী আপনার কাছে বেশি আসে?

উত্তর: দুঃচিন্তা এবং হাতাশা বা ডিপ্রেশনের রোগী বেশি আসে ।

প্রশ্ন ৮: তাদের অভিযোগগুলো কি থাকে?

উত্তর: অনেকের ঠিক মতো ঘুমাতে পারে না, অস্থিরতা অনুভব করে, অনেকের হার্টবিট বেড়ে যায়। আবার মাথাঘোরা সমস্যা নিয়েও আসে কেউ কেউ। অনেকেই এসে বলে তাদের কোন কিছু করতে ভাল লাগে না। হতাশায় ভোগে।

প্রশ্ন ৯: এদের পারসেন্টেন্স কেমন?

উত্তর: এখানে বাংলাদেশী যারা আছেন তাদের মধ্যে গড়ে প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কোন না কোনভাবে মানসিক সমস্যায় ভোগে।

প্রশ্ন ১০: মানসিক রোগী পুরুষ না নারী বেশি?

উত্তর : মানসিক রোগীর ক্ষেত্রে মহিলারা বেশি। কারণ ছেলেরা ব্যস্ত থাকে।

প্রশ্ন ১১: মানসিক রোগীদের প্রতি আপনার পরামর্শ কি?

উত্তর: তাদের নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য থাকতে হবে। এখানে আসলেই যে সাথে সাথে সবকিছু পেয়ে যাবে, এটা ভাবা ঠিক না। এখানে সবকিছু নতুন করে আরম্ভ করতে হয়। কাজেই সবকিছু ঠিকঠাক করে নিতে সময় দিতে হবে। কোনভাবেই হতাশ হওয়া যাবে না। চেষ্টা করতে হবে। তারপরও যদি দুঃচিন্তা বা হতাশা হয়, তাহলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিৎ। কাউন্সিলিং, সাইকো থ্যারাপির দরকার হলে ডাক্তার সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারে। অনেক সময় ওষুধও দেয়া হয়।

প্রশ্ন ১২: স্ত্রীকে শারীরিক বা মানসিকভাবে নির্যাতন করা অপরাধ। এর বিরুদ্ধে কঠোর আইন আছে। তারপরও এটা হচ্ছে। এরকম নির্যাতনের শিকার মহিলারা সপ্তাহে বা মাসে কয়জন আসে আপনার কাছে?

উত্তর: সঠিক সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলা মুসকিল। তবে অনেক আসে। কিন্তু মহিলারা সাধারণত নির্যাতনের কথা বলতে চায়না।

প্রশ্ন ১৩: নির্যাতনের ধরণগুলো কেমন হয়?

উত্তর: বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গালাগালি করা, বন্ধু-বান্ধব বাবা-মা’র সাথে কথা বলতে না দেয়া- এ ধরণের মানসিক নির্যাতন হয়। আর শারীরিক নির্যাতন তো আছেই। যেমন থাপ্পর দেয়া, বালিশ দিয়ে মুখের উপর চেপে ধরা, লাঠি বা জুতা দিয়ে পেটানো।

প্রশ্ন ১৪: নির্যাতনের শিকার কোন পুরুষ আসে কি আপনার কাছে?

উত্তর: আসে, তবে এদের সংখ্যা খুব কম। চিকিৎসকের কাছে এসে যারা নির্যাতনের কথা স্বীকার করে তাদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা ৫-৭%। পুরুষের সংখ্যা ১%।

প্রশ্ন ১৫: যারা বয়োবৃদ্ধ অর্থাৎ সিনিয়র সিটিজেন, তারা সাধারণত কোন ধরণের সমস্যা নিয়ে আসে?

উত্তর: বয়োবৃদ্ধরা বেশিরভাগই ডায়াবেটিস ও হার্টের সমস্যা নিয়ে আসেন। এছাড়া কোলেস্টরেল, হাই ব্লাড প্রেসার নিয়েও আসেন অনেকে।

প্রশ্ন ১৬: বয়োবৃদ্ধরা যেসব সমস্যা নিয়ে আসেন সেগুলো তাদের বয়সজনিত কারণে নাকি প্রবাসের ভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে?

উত্তর: বেশিরভাগ সমস্যা বয়সের কারণেই হয়ে থাকে। তবে নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ার অনেক বিষয় থাকে। এগুলো নিয়ে এক ধরণের চাপের মধ্যে পড়তে হয়। এই মানিসক চাপ থেকেও বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে।

প্রশ্ন ১৭: তারা তো এখানে আসার পর নিঃসঙ্গ থাকেন। এই নিঃসঙ্গতা কি কোন রোগের কারণ হতে পারে?

উত্তর: নিঃসঙ্গতার কারণে অনেক সময় শ্বাসকষ্ট বা ঘুমে সমস্যা হতে পারে।

প্রশ্ন ১৮: বয়োবৃদ্ধদের মধ্যে কোন মানসিক সমস্যা দেখতে পেয়েছেন আপনি?

উত্তর: বয়োবদ্ধদের মধ্যে দুশ্চিন্তাটাই বেশি দেখা যায়।

প্রশ্ন ১৯: দেখা গেছে কানাডায় যাদের সামর্থ ও সুযোগ আছে তারা অনেক সময় স্পন্সর করে বাবা-মা, শ্বশুর-শ্বাশুরিকে নিয়ে আসেন। কিন্তু দেখা যায় অনেকেই তাদের দেখাশুনা ঠিকমতো করেন না। উল্টো তাদের দিয়ে ঘরকন্নাসহ বিভিন্ন ধরণের কাজ করানো হয়। ক্ষেত্র বিশেষে বাড়তি আয়ের জন্য তাদেরকে দিয়ে অড জব করানো হয়। এসব কারণে কি বয়োবৃদ্ধরা শারীরিক বা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়তে পারেন? এ ধরণের কোন রোগী কি আসে আপনার কাছে?

উত্তর: এটা প্রায়ই ঘটে। অনেকেই বাবা-মাকে নিয়ে আসেন ঠিকই কিন্তু ঠিকমত দেখাশুনা করেন না। তাদেরকে দিয়ে ঘরের সমস্ত কাজ করানো হয়, থাকতে দেয়া বেসমেন্টে, ঘরের বাইরে কাজ করতে চাপ দেয়া হয়, জরুরি ওষুধপত্র কিনে দেয়া হয় না। এ কারণে যারা বাংলাদেশ থেকে ডায়াবেটিস বা অন্যান্য রোগ নিয়ে এখানে আসেন তাদের অবস্থা আরো খারাপের দিকে যায়।

প্রশ্ন ২০: বয়োবৃদ্ধরা যাতে সুস্থ্য থাকতে পারেন সেজন্য স্পন্সরকারীদের করণীয় সম্পর্কে আপনার পরামর্শ কি?

উত্তর: আমার মনে হয় বাবা-মাকে নিয়ে আসার আগে স্পন্সরকারীদের অবশ্যই আগে থেকেই ভেবে দেখা উচিৎ, তাদেরকে ভরণ পোষণ করতে পারবেন কিনা। কারণ বাবা-মা তো বয়স্ক। তারা এখানে এসে কাজ করতে পারবেন না। সেহেতু এদের ভরণ পোষণ করার সামর্থ্য থাকলে তবেই তাদের নিয়ে আসা উচিৎ। আনার পর এতো কষ্ট দেয়া ঠিক না। আমি বলবো এটা এক ধরণের নির্যাতন।

প্রশ্ন ২১: কথায় বলে স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল আর প্রবাসে সুস্থ্য থাকা আরো জরুরি। কারণ এখানে অসুস্থ্য হলে সাধারণত দেখার কেউ থাকে না। সুস্থ্য থাকতে হলে প্রবাসীদের কি কি নিয়ম মেনে চলা দরকার বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর: আমার মতে, সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো যদি কোন সমস্যা দেখা দেয় তাহলে প্রাথমিক অবস্থায়ই ডাক্তার দেখানো। তাহলে ডাক্তার কোন রোগ জটিল হওয়ার আগেই সনাক্ত করতে পারেন। এছাড়া প্রতি বছর চেক আপ করানো উচিৎ। নিয়মিত ব্যায়াম এবং খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো খেলে সুস্থ্য থাকা সম্ভব।