কোথায় মুক্তি জানা নাই

জসিম মল্লিক

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা একটা গোলকধাঁথা। শুধু ঘুরপাক খাচ্ছি। ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় স্থির হয়ে আছি। কিছুতেই ধাঁধা থেকে বেরুতে পারি না, ছুটতে পারছি না। কোথায় যে বাঁধা বুঝতে পারি না। অথচ এরকম জীবন আমি কখনও চাইনি। আমার একটা ছুটি দরকার। কেমন সে ছুটি বুঝতে পারি না। আমি মুক্তি চাই। কিসের মুক্তি তা জানিনা। আমি যা ভাবি আমার জীবন তেমন না। আমার ভাবনার উল্টোটা আমার জীবন। এখনও সপ্তাহ জুড়ে কাজ করি আমি। কাজই ধর্ম, কাজই সচল থাকার উপায়, কাজই ফাইনান্সিয়াল ফ্রিডম দেয়। কাজ ছাড়া আমার বাঁচার অন্য কোনো তরিকা জানা নাই। কাজ না করলে আমাকে ফার্মগেট ওভারব্রিজে বাটি নিয়ে বসতে হবে। আমি জানি আমাকে কেউ কিছু করে দেবে না। আমাকেই সব করতে হবে। কারো কাছে আমি কিছু চাইব না। কারো কাছে হাত পাতিনি কখনও। সংসার নামক অর্থহীন জীবন থেকে কোনো মুক্তি নাই আমার। কিছু অর্থহীন বিষয় পাথরের মতো চেপে বসে আছে আমার উপর।

এই পাথর আমি সরাতে পারি না। তাই আমার কখনো মুক্তি মিলবে না। মৃত্যু বা বনবাস একমাত্র মুক্তির পথ। আমি চোখ কান বন্ধ করে থাকা মানুষ না। সেনসেটিভ মানুষ। ভিতু মানুষ। অহিংস মানুষ। আমার দুর্বলতা হচ্ছে অন্যকে আঘাত দিতে পারি না। কিন্তু অন্যেরা আমাকে বিনাদ্বিধায় আঘাত করে, আমাকে উপেক্ষা করে। যারা বেশি দ্বায়িত্বশীল তাদের উপর সব চেপে বসে। এটাই সংসারের নিয়ম। সবাই সুযোগ নেয়। সবাই খুব ধুর্ত, স্বার্থপর আর লোভি। আমি বোকা মানুষ। নিষ্ঠুরতা, লোভ, স্বার্থপরতা আমি দেখাতে পারি না। ওসব আমার মধ্যে আসে না।

তাই আমার মুক্তি মিলবে না সহজে। আমি জীবন সংগ্রামে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, বিধ্বস্ত। সংসার বা সমাজ কোথাও কৃতজ্ঞতাবোধ নাই। আমি যেটা পাই সেটা হচ্ছে অভিযোগ। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো শেষ নেই। স্ত্রীর অভিযোগ, আত্মীয়দের অভিযোগ, বন্ধুদের অভিযোগ। আমি অনেক কিছু উপেক্ষা করতে পারি না। এটাই আমার বড় সমস্যা। কেউ কষ্ট পাবে এমন কিছু আমি বলতে পারি না। নিজের কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকি। কিন্তু অন্যকে আঘাত করতে পারি না। সংসারে সহানুভূতির কোনো জায়গা নাই। কৃতজ্ঞতাবোধের কোনো জায়গা নাই। জীবন যেনো একটা ভারবাহি পশু। আমি ক্রিয়েটিভ মানুষ। লেখালেখি আমার কাজ কিন্তু ক্রিয়েটিভির চেয়েও জীবন সংগ্রাম বড় হয়ে উঠে, জীবন ধারণ বড় হয়ে উঠে। এই জীবন থেকে মুক্তিই একমাত্র পথ। কিন্তু কোথায় মুক্তি জানা নাই।

নিজেকে মাঝে মাঝে চিনতে পারি না। খুবই অচেনা একজন হয়ে যাই। খুবই দুঃখী হয়ে যাই। সুখের অনুভূতি খুবই ক্ষণস্থায়ী। এই আছে এই নাই। কিন্তু দুঃখের অনুভূতি খুবই দীর্ঘ। সুখের দিনে অনেককেই পাশে পাওয়া যায় কিন্তু দুঃখের দিনে কেউ পাশে থাকে না। সুখ শেয়ার করা যায় কিন্তু দুঃখ শেয়ার করা যায় না। সুখের অংশীদার আছে কিন্তু দুঃখের কোনো অংশীদার নাই। এই রকম মুহূর্তে আমি অন্যদের কথা ভাবি। আমার আশে পাশের মানুষদের কথা ভাবি। কোনো এক অদ্ভুত কারণে অনেকেই আমাকে তার কষ্টের কথা শেয়ার করে। আমি মানুষের কষ্টগুলোকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করি। সুখী মানুষদের সাথে আমার তেমন সখ্যতা হয় না। দুঃখীরাই আমাকে খুঁজে বের করে। আমার চেনা অনেক মানুষ আছে যারা আমার চেয়েও অনেক কষ্টে আছে। আমার চেয়েও অসুবিধায় আছে। সেই দিক থেকে যদি চিন্তা করি তাহলে আমি অনেক ভাল অবস্থায় আছি।

এই রকম সময়ে আমি ভোম্বলদাশ হয়ে যাই। মাথা আউলা ঝাউলা হয়ে যায়। এলেবেলে একজন হয়ে যাই। তখন কিছুই ভাল লাগে না। লিখতে ভাল লাগে না, বেড়াতে ভাল লাগে না, খেতে ভাল লাগে না, বন্ধুত্ব ভাল লাগে না, প্রেম ভাল লাগে না, আশ্লেষ ভাল লাগে না, গান ভাল লাগে না, সিনেমা ভাল লাগে না, ফেসবুক ভাল লাগে না, রাগ অভিমান ভাল লাগে না। তখন শুধু নিজের জগতে ডুব দিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। নিজেকে চিনতে ইচ্ছে করে। নিজেকে খুঁজে পেতে ইচ্ছে করে। তখন দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে। অজানা কোথাও। সেটা হতে পারে সমুদ্রের কাছে, সেটা হতে পারে কোনো পাহাড়ে, সেটা হতে পারে গভীর অরণ্যে অথবা সেটা হতে বরিশালে মা বাবার কবরের কাছে। যেখানে আমি শায়িত হতে চাই। সবসময় তাই চাই। বা হয়ত এর কোনোটাই না। এমন কোথাও যেখানে কেউ আমাকে খুঁজে পাবে না। যেখান থেকে আর ফিরব না আমি। কোথাও ফিরব না। গৃহে ফিরব না, সন্তানের কাছে ফিরব না, প্রেমিকের কাছে ফিরব না, কাজে ফিরব না, লেখার টেবিলে ফিরব না। যেখান থেকে কেউ ফেরে না। মাথার ভিতর যখনই একটা আস্ত আকাশ ঢুকে পড়ে তখনই এসব ভাবি আমি।

এখন আমার মাথায় একটা আকাশ ঢুকে আছে।

টরন্টো ১ জুলাই ২০২৪

আমি ও আমেরিকা

আমি সুযোগ পেলেই যে দেশটিতে ঘুরতে যাই সেটি হচ্ছে আমেরিকা। কানাডা থাকি বলেই না, যখন কানাডা আসিনি তখনও বেশ কয়েকবার আমি আমেরিকা ঘুরতে এসেছিলাম। স্কুলে পড়ার সময় শংকরের এপার বাংলা ওপার বাংলা পড়েই আমেরিকা আমার মনের মধ্যে গেঁথে যায়। তখন ভাবতাম পৃথিবীতে সত্যিই এমন একটা দেশ আছে! এটাও ভাবতাম আচ্ছা আমি কি কখনও আমেরিকা যেতে পারব! প্লেন দেখলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। মনে হতো আমি প্লেনের মধ্যে বসে আছি। আমেরিকা যাচ্ছি। নিউ ইয়র্কের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। এবং অবাক কান্ড আমি প্রথম যে দেশটিতে এসেছিলাম সেটি আমেরিকা। শুধু আমি না অনেকেরই প্রথম পছন্দ আমেরিকা। যারা আমেরিকার তীব্র বিরোধী তাদেরও প্রথম পছন্দ আমেরিকা। তারাও আমেরিকায় সেটল করতে চায়, আমেরিকায় সম্পদ কেনে, সন্তানদের পড়তে পাঠায়, ট্রেনিং এ আসে, টাকা পাচার করে। আমেরিকা এই পৃথিবীকে অনেক কিছু দিয়েছে। সবকিছুতে আমেরিকা সেরা, নম্বার ওয়ান। অন্যান্য দেশও আমেরিকাই হতে চায়। আমেরিকাকে অনুকরন করে, কপি করে।

ফোর্থ জুলাই। আমেরিকার জন্মদিন। হ্যাপি আমেরিকা। ছবি : এল পাসো টাইমস

নীল লোহিতের তিন সমুদ্র সাতাশ নদী, সুনীলের ছবির দেশে কবিতার দেশে বা সমরেশের বিনেসুতোয় ইত্যাদি পড়েও আমেরিকা আমার মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। আমি তীব্রভাবে চাইতাম একদিন ওই দেশটিতে পা রাখব।  ওখানে থাকব এমন কখনও মনে ভাবনায় আসেনি, শুধু দেখব কি আছে দেশটিতে! শৈশব কৈশোর থেকেই অদ্ভুত অদ্ভুত সব স্বপ্ন কাজ করত আমার মনের মধ্যে। সব সময় ভাবতাম আমি একদিন দূরে কোথাও চলে যাব। যেখানে কেউ আমাকে খুঁজে পাবে না। হয়ত সেই দেশটা আমেরিকাই বা অন্য কোথাও। আজও আমার এমনই মনে হয়। দূরেই আছি তাও মনে হয় আরো দূরে কোথাও চলে যাব। সংসার, সমাজ, জীবন সংগ্রাম, পরিবার, সাফল্য আমার কাছে অসহ্য লাগে। হয়ত আমি একসময় আমেরিকায়ই সেটল করব বা হতে পারে সেটা বাংলাদেশ। কে জানে কখন কি ঘটে! মানুষ যা মন থেকে চায় তা পায়।

আজ ফোর্থ জুলাই। আমেরিকার জন্মদিন। হ্যাপি আমেরিকা।

টরন্টো ৪ জুলাই ২০২৪

অরিত্রির বোকা বাবা

ছেলে মেয়েরা বাবা মায়ের অনেকখানি সাথে নিয়ে চলে যায়। আমার ছেলে মেয়েরা তাই করেছে। আমিও করেছি। আমি বরিশাল ছাড়ার পর আমার মায়ের জগতটা শূণ্য হয়ে গিয়েছিল তেমনি আমিও মাকে ছেড়ে আসার পর বুঝেছি মা কতখানি জুড়ে ছিলেন আমার জীবনে। শিশু বয়েসে বাবা হারানো সন্তান আমি। মাই ছিল আমার বল ভরসার জায়গা। আমি সবসময় সন্তানদের সাথে জড়িয়ে থাকতাম। ওদের পাশে পাশে ঘুরঘুর করতাম। এখন ওরা কাছে নাই বলে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করি সপ্তাহান্তে কখন অর্ক আসবে, কবে অরিত্রি আসবে আমেরিকা থেকে। অর্কর সাথে টুকটাক কথা হয় শুধু কিন্তু অর্ক এসেছে এতেই আমি আনন্দিত। সেই তুলনায় অরিত্রির সাথে বেশি কথা হয় আমার। অনেক অদরকারি কথাও বলি। জাষ্ট কিছু একটা বলে সান্নিধ্য পাওয়া। কিন্তু আমি যে ওদের জন্য তীব্রভাবে অপেক্ষা করি তা কখনও প্রকাশ করি না।

আজও ঘরে ঢুকেই অভ্যাসমতো অরিত্রির রূমে একবার ঢু মারি। অরিত্রি যখন এখানে থাকে তখন হয় কাউচের এক কোনায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকে যেটা আগেও করত, না হয় নিজের ঘরে খাটে বসে ল্যাপটপ ঘাটে। আজ এসে দেখি অরিত্রি ঘরে নাই। তাহলে বাইরে গেছে বন্ধুদের সাথে কোথাও। নিজের ঘরে যেতে যেতে যেনো একটু অরিত্রির কন্ঠস্বরও শুনলাম! এটা প্রায়ই হয় আমার। অরিত্রি নাই তাও কন্ঠস্বর শুনতে পাই! ভুতুরে কান্ড যত। হঠাৎই মনে পড়ল আরে অরিত্রিতো কাল চলে গেছে! বিকেলেওতো অরিত্রির সাথে বললাম! ঘুম ঘুম স্বরে ফোন ধরল! কিভাবে ভুলে গেলাম অরিত্রি চলে গেছে! আসলে প্রায় তিন সপ্তাহ ছিল তো! ঘরেই থাকত থাকত বেশিরভাগ সময়, তাই এমন মনে হয়েছে হয়ত! কালকে অরিত্রি যাওয়ার আগেই আমাকে বের হতে হয়েছিল তাই যখন মাথাটা বুকে নিয়ে বললাম, আম্মু সাবধানমতো যাইও। তখন অরিত্রি বলল, আগামী মাসে আবার আসব বাবা! যখন গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে কাজে যাচ্ছি হঠাৎই আবিষ্কার করলাম বুড়ো বাপের চোখে পানি! কোনো মানে হয়!

টরন্টো ৬ জুলাই ২০২৪

আমার চোখ এবং বাংলাদেশের ডাক্তার

গত প্রায় দুই আড়াই বছর থেকে আমার বাঁ চোখে একটু অস্বস্তি আছে। ড্রাইনেসে ভুগছি আমি। আমার নিয়মিত আই স্পেশালিস্ট হচ্ছেন ডাক্তার গ্যারি মোরো। টরন্টোর বিখ্যাত মাইকেল গ্যারোন হসপিটালের সার্জন এবং অপথোমলজিতে বিশাল বিশাল সব ডিগ্রী আছে। যেহেতু আমি ষাট পার হয়েছি এবং আমার ডায়াবেটিস আছে তাই তিনি বছরে দুইবার আমার চোখ দেখেন। তিনি আমার এই ড্রাইনেসকে তেমন পাত্তা দিচ্ছেন না। শুধু আই-ড্রপ এমজিডি নামে একধরণের লিকুইড জেল বা আই লিড এন ল্যাশ নামের ওয়াইপস ব্যবহার করতে বলেন, আর ওমেগা থ্রি সফট জেল খেতে বলেন। ডাক্তার যা বলেন তা আমি পালন করি। আমি প্রতিবছর ঢাকায় যাই। ডা আলী আকবর বেশ সিনিয়র আই স্পেশালিষ্ট। তাঁকে চিনি যখন থেকে আমি বিচিত্রায় কাজ করি তখন থেকেই। তখন বিজয় নগরে বসতেন। এখন ধানমন্ডিতে বাংলাদেশ আই হাসপিটালে বসেন। তার কাছে গেলাম একদিন। তিনি নানা পরীক্ষা করে বললেন জসিম তোমার ড্রাইনেস। বললেন একটু টিয়ারিং হওয়া ভালতো। তিনি ইনসেপটার ফ্রেশফিল নামে একটা ড্রপ দিলেন।

তারও আগে আমি একবার এভারকেয়ারেও গিয়েছিলাম। সেখানে ১২ হাজার টাকা দিয়ে পরীক্ষার নিরীক্ষার পর ডাক্তার একই ধরণের ড্রপ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ আই হসপিটালে লেগেছিল মাত্র দুই/ তিন হাজার টাকার মতো। এ বছর আমি কোলকাতা গিয়েছিলাম। হঠাৎ মনে হলো এখানকার একজন ডাক্তার দেখানো যাক। জাস্ট ক্রসচেক। কে কি বলে শুনি। মোটকথা চোখ নিয়ে আমি রীতিমতো গবেষণা শুরু করে দিয়েছি। আমার বন্ধু রানুকে বললাম একজন ভাল ডাক্তারের সাথে এপয়মেন্ট করে দাও। সে একদিন এপোলোতে নিয়ে গেলো। সেখানকার একজন তরুণ আই স্পেশালিষ্ট দেখলেন। ফি দিতে হয়েছিল মাত্র ১২০০ রুপি। তিনিও একই কথা বললেন। ড্রাইনেস। তিনি  সিসটেন নামে একটা আইড্রপ দিলেন। আই-ড্রপ বা এন ল্যাশ ওয়াইপস বেশ এক্সপেনসিভ। আই- ড্রপ প্রায় পঞ্চাশ ডলার প্রতিটা। সিসটেনের চেয়েও বাংলাদেশের ফ্রেশফিল খুবই কার্যকরি মনে হয় আমার কাছে এবং দামেও কম। কানাডার বাইরে অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে আমি বাংলাদেশের ডাক্তারদের উপর খুবই আস্থাশীল এবং ওখানকার ওষুধও আর্ন্তজাতিক মানসম্পন্ন।

টরন্টো ৭ জুলাই ২০২৪

প্রেম ও বিয়ে.

প্রেম কি? নারী পুরুষের একটা সম্পর্ক হলেই কি সেটাকে প্রেম আখ্যা দেওয়া যায়? ভালবাসাই বা কি? কোথায় থাকে ভালবাসা? অনেকবার এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে কিন্তু উত্তর মেলে নি। ভালবাসার ফাঁদ থেকে উত্তরনের পথ মানুষ আজও খুঁজে পায়নি। প্রেম কি কেবল একটা শরীরী আকর্ষণ মাত্র, তার বেশি কিছু নয়? নারী ও পুরুষ যে পরষ্পরের প্রতি আসক্ত হয়, সেটা বায়োলজিক্যাল যদি না হয় তাহলে নিতান্তই গাড়লত্ব। মানুষ চতুর বলেই বায়োলজিকে ঢাকা দিতে ওই গাড়লত্বকে সৃষ্টি করেছে। মাছ ঢাকা দিতে শাক। প্রেমের তলায় থিক থিক করে শরীর। অর্থাৎ মাংস ও স্থুলতা, লালসা ও রিরংসা। পৃথিবী ক্রমে ক্রমে ওই শাকটুকু সরিয়ে ফেলে মাছটিকে আব্রুহিন করে দিচ্ছে। চারদিকে যৌনতা এতই প্রকট, এতই বিজ্ঞাপিত যে ইয়ারপ্লাগ ব্যহারের সময় এসেছে। বিয়ে কি? অনেকের ধারণা স্বামী বা স্ত্রী হচ্ছে দ্বিতীয় সত্বা। আসলে দ্বিতীয় সত্ত্বার তত্ত্বটা সবার কাছে এক নয়। প্রতিটা মানুষের উচিত নিজেকে নিজের বাইরে গিয়ে একবার দেখা। এ্যাভারেজ বুদ্ধি আর অতিশয় বোধশূন্য মানুষের কাছে দ্বিতীয় সত্ত্বার তত্ত্বটা ওরকমই হওয়ার কথা। বিয়ে মানেই কি শরীর, স্বেদ, সংঘর্ষ! বিয়ে মানেই কি সেই অবশ্যম্ভাবী কিছুক্ষনের পশুর মতো আচরণ!! বিয়ে কি কোনও সূক্ষ্ম সম্পর্ক নয়..!

১৪ জুলাই ২০২৪

কে জানে

একটা সম্পর্ক যখন তৈরী হয়, তার পিছনে কিছু কার্যকারণ নিহিত থাকে। কার্যকারণ ছাড়া কিছুই হয় না। সব সম্পর্কই যে একটা পরিনতি পাবে তাও হয়ত নয়। অমিমাংসিত থেকে যায় অনেক কিছু। সমান্তরাল থাকে ভালবাসার সূত্রগুলো। কিছুতেই এক মোহনায় মিলিত হতে পারে না। স্বপ্নের মতো কিছুতেই এগুনো যায় না সামনের দিকে, ভালবাসার দিকে। সারা পৃথিবী জুড়ে অবিরল যে অজস্র ঘটনা ঘটে যাচ্ছে সেগুলো কী অর্থহীন ঘটনামাত্র? সবই কি আকস্মিক? নাকি এইসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাও ঘটে অমোঘ কার্যকারণ সূত্রেই? আফ্রিকার কোনও গহন অরণ্যে লতাপাতার ছায়ায় একটি সাপ বয়ে যাচ্ছে এঁকে বেঁকে, দক্ষিণ আমেরিকার কোনো চাষীর জুতোর ওপর একটি শুয়াপোকা হাঁটছে, হিমালয়ের কোনো উত্তুঙ্গ পাহাড়ের গায়ে একটা গাছ দুলছে বাতাসে। এসব ঘটনার কি কোনো অর্থ নেই? না ঘটলেও চলত? নাকি অবশ্যম্ভাবি ছিল সারা পৃথিবী জুড়ে এই সব অদ্ভুত, অর্থহীন, পারষ্পর্যহীন, যুক্তিহীন ঘটনাবলী?

১৫ জুলাই ২০২৪

দেখেছি তার কালো হরিন চোখ

সেটা ২০০৩ সাল। জুলাই মাস। চারিদিকে স্বপ্নের মতো প্রকৃতি। মিষ্টি আর আইসক্রীমের মতো মোলায়েম। মাত্র কানাডা এসেছি। অটোয়ায় থাকি। অটোয়া একটি ছিমছাম ছবির মতো নিভৃত শহর। কানাডার রাজধানী। তখন অটোয়ার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৭ লাখ। আমাদের মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে এরচেয়ে জনসংখ্যা বেশী হওয়ার কথা। একমাস ঘুরে ফিরে দেখার পর বাস্তবতার মুখোমুখী হলাম। কাজ খুঁজছি। এক মাসের একটা ট্রেনিং কোর্সে ভর্তি হলাম। ট্রেনিং শেষ হলে চাকরি কনফার্ম। ট্রেনিং করছি। নানা কিছু শেখাচ্ছে। কানাডিয়ান ইংরেজী যদিও খুব মিষ্টি কিন্তু তারপরও বুঝতে হিমশিম খাচ্ছি।

একদিন ট্রেনিং শেষ হলো। পরীক্ষা হলো। পরীক্ষায় পাশও করে গেলাম। গ্রাজুয়েশন পার্টির দিন অনেক ফান হলো, খাওয়া দাওয়া হলো। সবাই সেজেগুজে এসেছে। ওইদিনই একটি সিকিউরিটি কোম্পানী এসেছে আমাদের মধ্য থেকে হায়ার করতে। আমার চাকিরও হলো। কিন্তু আমি এক সপ্তাহের বেশী চাকরিটা করতে পারিনি। কারণ আমার শিফট ছিল রাতে। আমি একদম রাত জাগতে পারি না। সেদিন আমি সুন্দর একটা ব্লেজার পড়লাম। জেসমিন আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, এটা কি পড়েছো। তোমাকে জঘন্য লাগছে দেখতে। এটা চেঞ্জ করো। আমি এটা কিনেছিই পার্টির জন্য। তাই জেসমিনের কথায় কান দিলাম না।

আমরা প্রায় বিশ জনের মতো ট্রেনিংটা করেছিলাম। বিভিন্ন দেশের মানুষ। কী চমৎকার মাল্টিকালচার। এই প্রথম এতোগুলো ভিন্ন দেশের মানুষের সাথে মেশার সুযোগ হলো। তার মধ্যে কয়েকটা মেয়েও ছিল। একটা মেয়ে ছিল জেনিফার নাম। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো হলেও খুবই সুশ্রী দেখতে। পৃথিবীর যেকোনো সুন্দর মেয়ে তার কাছে হার মানবে। তার ছিল দুটো অসাধারণ মায়াবী চোখ। সেদিন গ্রাজুয়েশন পার্টিতে আমাকে ব্লেজার পরা দেখে জেনিফার বলল, জসিম, ইউ লুকস গরজিয়াস! শুনে আমার আমার বুকের মধ্যে একশটা ব্যাঙ লাফ দিয়ে উঠেছিল! সেদিনই জেনিফার বলল আমি ফ্লোরিডা চলে যাচ্ছি। একবারে। আই উইল মিস ইউ গাইস। আমি জেনিফারের ভেজা গভীর কালো চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম..!

১৬ জুলাই ২০২৪

হৃদয়ে মিলেছে হৃদয়

নারীদের কাছ থেকে সমসয়ই আমি আনুকল্য পেয়েছি। প্রশ্রয় পেয়েছি। তাই নারীদের কাছে আমার বেশি প্রত্যাশ্যা থাকে সবসময়। পুরুষদের চেয়ে নারীদের আমি বেশি প্রাধান্য দেই। আমি আমার মাকে নিয়ে অনেক লেখা লিখেছি। আমার স্ত্রী জেসমিন বা আমার মেয়ে অরিত্রিকে নিয়েও অনেক লিখেছি। ‘আমার মা’ নামে একটা বইও আছে। জেসমিন আর অরিত্রিকে নিয়ে যত লেখা লিখেছি সেগুলো দিয়েও আলাদাকরে বই হতে পারে। আমার জীবনে অসংখ্য ঘটনা আছে যেখানে নারীর পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। কোনো বিশেষ কারণ ছাড়াই এই পক্ষপাত। এমন না যে আমি একজন সুদর্শন, ধনাঢ্য এবং বিশাল বড় কোনো ব্যক্তি। আমি খুবই সিম্পল একজন মানুষ। গোটানো মানুষ। নিজেকে তুলে ধরতে পারি না। আলোয় আসার চেষ্টা করিনি কখনো। লাজুক টাইপ মানুষ। নারীদের পছন্দ খুবই রহস্যে ভরা!

সেটা ২০২০ সালের কথা। জুলাই মাস। কয়দিন থেকে আমি অসুস্থ। ভার্টিগো টাইপ সমস্যায় বেসামাল অবস্থা। আগামী ৪ আগষ্ট ইএনটি স্পেশালিষ্টের সাথে আমার এপয়নমেন্ট। এখনও অনেকদিন বাকী। মাঝে মাঝে সত্যি আমি খুব বুদ্ধিমানের মতো কাজ করি এবং নিজেই নিজের বুদ্ধিমত্তায় অবাক হই। আমি করলাম কি গতকাল একটা ফোন দিলাম স্পেশালিষ্ট ডা. ব্রাড হুবার্টের অফিসে। ধরলেন তার সেক্রেটারী।

আমি বললাম, আমার তো অনেক খারাপ লাগে তুমি যদি কোনোভাবে আমার এপয়নমেন্টটা একটু এগিয়ে দিতে পার খুব ভাল হয়।

এদেশে যেটা হয় নিয়মের বাইরে কেউ যেতে চায় না। কিন্তু সেক্রেটারি মেয়েটি মোলায়েম কন্ঠে বলল, ধরো দেখি কোনো সুযোগ আছে কিনা।

আমি ফোন ধরে অপেক্ষা করছি। অধীর অপেক্ষা। মেয়েটি তিরিশ সেকেন্ড পরেই বলল,

তুমি আজকেই আসতে পারবা! ৪.২০ এ!

তখন দুপুর সাড়ে বারোটার মতো বাজে।

আমি বললাম, নিশ্চয়ই পারব।

মাত্র তিনদিন আগে এই এপয়নমেন্ট পেয়েছি। এখানে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানই সব। এই এপয়নমেন্টের জন্য রিকোয়েষ্ট পাঠিয়েছেন ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান। যখন যে ডাক্তার প্রয়োজন হয় সব ব্যবস্থাই ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান করেন। আমার ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানও একজন নারী, চাইনীজ ক্যানিডিয়ান, ডা হো চারমিন। উল্লেখ্য কালকেই ডা হোর সাথে আমার এপয়নমেন্ট ছিল। সময় ছিল দুপুর ২.৫০। ফোন করলেন ৩.১০ এ।

হাই জসিম কেমন আছ আজকে!

দুই দিন পর পর ফোন করে খবর নিচ্ছেন ডা হো।

একই রকম ফীলিংস। স্পিনিং, লাইটহেডনেস, ডিজিনেস আর একটু হার্টবীট।

ওষুধে কাজ হচ্ছে না!

ওয়েল ডাক্তার হো, আমার মনে হয় তেমন কাজ হচ্ছে না।

এক কাজ করো। ওষুধটা তিনবার না খেয়ে শুধু রাতে ঘুমানোর সময় খাও।

ওকে। বাই দ্য ওয়ে ডা. হো, আমার স্পেশালিষ্ট এপয়নমেন্ট ৪ আগষ্ট দিয়েছিল, আমি রিকোয়েষ্ট করে আজকেই করেছি। বিকেল ৪.২০ এ।

তুমি তো মিরাকল করে ফেলেছো!

ডাক্তার হো খুব খুশী।

বলল, তোমাকে একটু ওয়েট করতে হবে চেম্বারে। বিজি ডাক্তার। দুই ঘন্টাও লাগতে পারে। ড্রাইভ করবা না কিন্তু। কাউকে বলো নিয়ে যেতে।

কানাডায় যে কোনো স্পেশালিষ্টের এপয়নমেন্ট পেতে দুই থেকে ছয় মাস পর্যন্ত লেগে যায়। সেখানে আমার তিন দিনেই হয়ে গেলো! আমি ডাক্তার দেখিয়ে আসার সময় সেক্রেটারি মেয়েটিকে বিশেষ ধন্যবাদ দিয়ে এসেছি। বাংলাদেশে দেখেছি হাসপাতাল

বা ডাক্তারের সিরিয়াল পেতে প্রভাবশালী কেউ থাকতে হয়, তদবির লাগে। বিপদে কোথায় যাবে জানেনা। দিশেহারা হয়ে আরো অসুস্থ্য হয়ে যায়।

এদিকে ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়া নিয়ে একটু সমস্যা তৈরী হলো। আমার ড্রাইভ করা নিষেধ। অর্ককে ম্যাসেজ দিলাম, তুমি ফ্রী থাকলে আমাকে একটু ড্রপ দিয়ে এসো। আমার বাসা থেকে অর্কর বাসা বেশ দূরে। বন্ধু আলমকে বললাম কিন্তু সে তার অনলাইন ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। কোভিডের কারণে আমি উবার বা ট্যাক্সি এভোয়েড করতে চাচ্ছি। এর মধ্যেই অর্কর ম্যাসেজ, ইধনধ কযধঃরুধ রিষষ পড়সব ঃড় ঃধশব ুড়ঁ নবপধঁংব ও’স াবৎু নঁংু রিঃয ড়িৎশ. আমি বললাম ওকে সমস্যা নাই। একটু পরই খাতিজার ম্যাসেজ, ইধনধ ফড় ঁ হববফ সব ঃড় পড়সব? ও পধহ পড়সব, হড় ঢ়ৎড়নষবস.

আমার অসুস্থতা নিয়ে একটা পোষ্ট দিয়েছিলাম ১৬ জুলাই। পোষ্টটা ছিল এরকম,..‘৪ জুলাই রাতে প্রথম ধাক্কা। এরকম আগে কখনো হয়নি। নতুন অনুভূতি। খুব অস্বস্তি এবং কষ্টের। ডাক্তার বলছেন ভার্টিগো। এতোদিন নাম শুনেছি এখন নিজেই এর শিকার। ওষুধ খাচ্ছি। আশা করি ঠিক হয়ে যাব। বন্ধুরা দোয়া করো।..’ বন্ধুরা এতো এতো উৎকন্ঠা আর শুভকামনা জানিয়েছেন যে আমি মনে মনে খুবই লজ্জিত হয়েছি। এই কান্ড এর আগেও আমি করেছি। শুধু শুধু মানুষকে উৎকন্ঠায় ফেলা। মানুষের কি আর অসুখ হয় না! পৃথিবীতে কত মানুষ কত কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে! যার কষ্ট সেই জানে। সেই পোষ্ট দেওয়ার পর টরন্টোর একজন নারী আমাকে শুধু বিস্মিতই করেনি আমার চোখে পানি এনে দিয়েছিল।

সে ম্যাসেজ দিয়ে জানাল, ইফ ইউ নীড এনি হেল্প অর গ্রোসারিস প্লীজ লেট মী নো, আই ইউল ডু ইট ফর ইউ। কোনো দ্বিধা করবেন না দাদা। ভগবান যেনো আপনাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে দেন।

আমার অনেক নারী বন্ধু প্রতিদিন খোঁজ নিয়েছে, নামাজ পড়ে দোয়া করেছে। অন্ততঃ দুজন মানত করেছে।

একজন নারী ঢাকা থেকে লিখেছেন, জসিম ভাই, কালকে আমার টরন্টোর ফ্লাইট। কিছু দরকার হলে বলেন।

ঢাকায় তখন রাত। সাধারণতঃ আমি সহজে কারো ফেবার নিতে চাইনা তাও আমি একটা ওষুধের নাম বললাম। ভার্টিগোর ওষুধ। জেসমিনের ফ্রেন্ড রুমানা ওষুধটার কথা বলেছে।

তিনি ঘন্টাখানেক পর ওষুধের ছবি পাঠিয়ে বললেন, কেনা হয়ে গেছে, নিয়ে আসব।

এভাবেই নারীরা আমার প্রতি তার পক্ষপাত দেখিয়েছে। এতোটা আমার প্রাপ্য না। এই ভালবাসার কোনো তুলনা নাই। ভালবাসলেই শুধু ভালবাসা মেলে এটা জেনেছি।

টরন্টো ১৮ জুলাই ২০২৪

জসিম মল্লিক

টরন্টো / jasim.mallik@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *