দক্ষ অভিবাসরাও কেন যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের চেয়ে কানাডায় প্রায়শ বেশি খারাপ অবস্থায় পড়েন?

বিশ্বের সেরা ও সবচেয়ে উজ্জ্বল ব্যক্তিদেরও কানাডায় চাকরি পেতে তীব্র সংগ্রাম করতে হয়

কানাডা যখন অতি যত্নের সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে শিক্ষিত কর্মীদের আকৃষ্ট করার জন্য কাজ করছে তখনও দেশটি তার সবচেয়ে দক্ষ অভিবাসীদের অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধনে নাটিকীয় অবনতির মুখোমুখি হয়েছে। উচ্চদক্ষ অভিবাসীদের প্রতি কানাডার চেয়ে অনেক কম বন্ধুভাবাপন্ন দেশও এধরণের অবনতি এড়াতে সক্ষম হয়েছে। ছবি : এমা দেবী-সিবিসি

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : সঞ্জয় মাভিনকুরভি ও তার স্ত্রী সম্বিতা পাড়ুকোন বেশ কিছুদিনের জন্য ছিলেন কানাডার উদার ও নমনীয় অভিবাসন ব্যবস্থার রীতিমত প্রতীকের মতো। কানাডার অভিবাসন এই দেশ এবং এদেশে নবাগত উভয়ের জন্য কতটা উপকারী সে সম্পর্কে তারা দীর্ঘদিন উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। ২০০৮ সালে তারা যখন বিয়ে করেন তখন মাভিনকুরভি যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিতে বসবাস করছিলেন। তার জন্ম ভারতে, বেড়ে উঠেছেন সৌদি আরবে এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেছেন। সিলিকন ভ্যালিতে তিনি প্রকৌশলীদের একটি দলের নেতা হিসাবে মোবাইল ফোনের জন্য গুগল ম্যাপস-এর ডিজাইন তৈরির কাজ করছিলেন। আর পাড়ুকোন সিঙ্গাপুরের বৃহত্তম ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকে অর্থনীতি সম্পর্কিত দায়িত্ব পালন করছিলেন। মাভিনকুরভি যুক্তরাষ্ট্রে যে অস্থায়ী ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে কাজ করছিলেন তার আওতার তার স্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করার সুযোগ ছিলো না। তাই গুগল কর্তৃপক্ষ মাভিনকুরভিকে তাদের টরন্টো অফিসে ট্রান্সফার করে। ধারণা করা হচ্ছিলো যে, প্রকৌশল ও অর্থনীতিতে ডিগ্রিধারী এবং আন্তর্জাতিক ব্যাংকিংয়ের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ পাড়ুকোন এখানে কোনও চাকরি জুটিয়ে নিতে পারবেন।

কানাডা যখন অতি যত্নের সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে শিক্ষিত কর্মীদের আকৃষ্ট করার জন্য কাজ করছে তখনও দেশটি তার সবচেয়ে দক্ষ অভিবাসীদের অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধনে নাটিকীয় অবনতির মুখোমুখি হয়েছে। উচ্চদক্ষ অভিবাসীদের প্রতি কানাডার চেয়ে অনেক কম বন্ধুভাবাপন্ন দেশও এধরণের অবনতি এড়াতে সক্ষম হয়েছে। ছবি : এমা দেবী-সিবিসি

তাদের এই ঘটনার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত বেশ কিছু রিপোর্টে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত আমলাতান্ত্রিক অভিবাসন নীতি কীভাবে সেদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এদিকে কানাডার গণমাধ্যমের লোকেরা টরন্টোর কেন্দ্রীয় এলাকায় তাদের সাদামাঠা অ্যাপার্টমেন্টে কানাডার পতাকার নিচে সোফায় বসা তাদের হাস্যোজ্জ্বল ছবি দিয়ে এই নবীন দম্পতিকে কানাডার অভিবাসনের প্রতীক হিসাবে তুলে ধরে।

শেষ পর্যন্ত তাদের কাহিনী কানাডীয় স্বপ্নের ছবির চেয়েও নগণ্য হয়ে পড়ে এবং দেশটিতে বহু নবাগত কানাডীয় যে কদর্য বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে তারই চিত্র হয়ে দাঁড়ায়। পাড়ুকোনকে একটি চাকরির জন্য তীব্র সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। তিনি চাকরিদাতাদের কাছে চিঠি লিখতে থাকেন। কখনও জবাব পান না, কখনও তাকে বলা হয়, এখানে চাকরি পেতে হলে তাকে কানাডায় কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। তখন তাদের পরিবারও কানাডায় এসে বসবাস করছে। তারা ভেবেছিলেন ধীরে সুস্থে শুরু করবেন। কিন্তু এখানে জীবন কতটা কঠিন হয়ে উঠেছে তাই দেখে তারা মর্মাহত হয়ে পড়েন। মাভিনকুরভি বলেন, “আমি মাথা থেকে এমন সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করতে থাকি যে, আমার স্ত্রীকে এসব পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন না। কিন্তু তখন আমি পিএইচডি ডিগ্রিধারী ট্যাক্সিচালকদের দেখতে পাই, সেই সঙ্গে দেখি টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে যে, ‘একজন দক্ষ অভিবাসীকে চাকরি দিন।”

২০০৯ সালের শেষদিকে এই দম্পতি টরন্টোর পাট চুকিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে চলে যান। সেখানে অস্থায়ী ওয়ার্ক পারমিটের বলে পাড়ুকোন তার প্রথম চাকরির আবেদনেই আমাজনের প্রধান কার্যালয়ে চাকরি পেয়ে তাতে যোগ দেন। কানাডায় তাদের স্বল্পকালীন অবস্থান তাদেরকে কানাডায় অভিবাসনের স্বরূপ কি সে বিষয়ে অনেক শিক্ষা দিয়েছে। মাভিনকুরভি ঠিক সেই কথাটাই বললেন যেটি “কোনও কানাডীয়ই শুনতে চাইবে না।” তিনি বলেন, “বাস্তবে কানাডা অভিবাসীদের জন্য বন্ধুভাবাপন্ন নয়।”

কানাডার পয়েন্টভিত্তিক অভিবাসন প্রথা হলো বিশ্বে এ ধরণের প্রথম ব্যবস্থা। এর উদ্দেশ্য ছিলো ব্যাপকতর ও স্থানান্তরযোগ্য দক্ষতাসম্পন্নদের বাছাই করা যা তাদের দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক সাফল্য এনে দেবে এবং এর ভিত্তিতে একটি বহুসংস্কৃতিভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েক দশকে এর সম্পূর্ণ বিপরীত প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি কানাডা যখন অতি যত্নের সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে শিক্ষিত কর্মীদের আকৃষ্ট করার জন্য কাজ করছে তখনও দেশটি তার সবচেয়ে দক্ষ অভিবাসীদের অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধনে নাটিকীয় অবনতির মুখোমুখি হয়েছে। উচ্চদক্ষ অভিবাসীদের প্রতি কানাডার চেয়ে অনেক কম বন্ধুভাবাপন্ন দেশও এধরণের অবনতি এড়াতে সক্ষম হয়েছে।

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭০ সালে কানাডায় আসা একজন

অভিবাসী শ্রমিক কানাডীয় শ্রমিকের আয়ের ৮৫ শতাংশ আয় করতো যা এক দশকে বেড়ে ৯২ শতাংশে উন্নীত হতো। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে অভিবাসীরা স্থানীয় শ্রমিকদের তুলনায় মাত্র ৬০ শতাংশ আয় করতো যা পরবর্তী এক দশকে বেড়ে দাঁড়াতো ৭৮ শতাংশে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী অভিবাসী শ্রমিকরা তাদের কানাডীয় বংশোদ্ভূত প্রতিপক্ষের তুলনায় ৬৭ শতাংশ আয় করছে।

এই অবনতি সাম্প্রতিক সময়ে আরও বেশি তীব্র, কারণ এখনকার অভিবাসীরা আগের প্রজন্মগুলোর তুলনায় আরও বেশি শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার  রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে কানাডায় আসা অভিবাসীদের মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী। সেই তুলনায় কানাডায় জন্মগ্রহণকারী জনগোষ্ঠীর মাত্র ২৫ শতাংশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি রয়েছে।  আজ পর্যন্ত অভিবাসী এবং কানাডায় জন্মগ্রহণকারী শ্রমিকদের মধ্যকার আয়ের সবচেয়ে বড় ব্যবধান ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীদের ক্ষেত্রেই। কানাডায় দীর্ঘ সময় ধরে দরিদ্র থেকে যাওয়া অভিবাসীদের প্রায় অর্ধেক হলো তারা যারা দক্ষ কর্মী হিসাবে এদেশে এসেছে।

এই দেশটির ক্ষেত্রে অভিবাসনের প্রভাব বিপুল, কারণ অভিবাসী আগমনের হার কানাডাতেই বিশ্বের সর্বোচ্চ এবং পাশ্চাত্যের অন্য

দেশগুলোর চেয়ে কানাডা অনেক বেশি সংখ্যক দক্ষ অভিবাসী গ্রহণ করে থাকে। কানাডার অভিবাসীদের প্রায় অর্ধেক হলো অর্থনৈতিক কারণে দেশত্যাগী মানুষ। দেশের অর্থনীতিকে জোরদার করার মতো দক্ষতা তাদের আছে এই বিবেচনায় তাদেরকে গ্রহণ করা হয়েছিলো। সেই তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক অভিবাসীর সংখ্যা মাত্র ১৬ শতাংশ। অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রী জেসন কেনী বলেন, অভিবাসীদের অর্থনৈতিক কল্যাণের অবনমন “একটি বিরাট সমস্যা।” তিনি বলেন, “অভিবাসীদের বেকারত্ব ও আধা বেকারত্বের প্রতিনিধিত্বকারী আমাদের অর্থনীতির মূল্য, উৎপাদনশীলতার আনুকূল্যের মূল্য হিসাব করা অসম্ভব।

কানাডার অভিজ্ঞতার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীরা তাদের আমেরিকায় জন্মানো কর্মীদের সঙ্গে আয়ের বৈষম্য কার্যত শূন্যে নামিয়ে এনেছে। ১৯৮০-র দশকে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীরা তাদের আমেরিকায় জন্মানো প্রতিপক্ষের আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আয় করতো। কানাডাতেও আয়ের ব্যবধান ছিলো এই রকমই। কিন্তু ২০১১ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীদের আয় দাঁড়ায় স্থানীয় শ্রমিকদের আয়ের ৯৩ শতাংশ। অন্যদিকে বিদেশে জন্মগ্রহণকারী কলেজের ডিগ্রিধারীরা এখন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী প্রতিপক্ষকে আয়ের দিক থেকে পেছনে ফেলে দিয়েছে।

বিগত অর্থনৈতিক মন্দার সময় ২০১০ সালে কানাডায় বিদেশে জন্মানো বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েটদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিলো সর্বোচ্চ, ৮.৪ শতাংশ (যারা পাঁচ বছরের কম সময় ধরে এদেশে বসবাস করছিলো তাদের ক্ষেত্রে এই হার ছিলো ১৪ শতাংশের বেশি)। সেই তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশে জন্মানো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিলো ৪.৪ শতাংশ। এমনকি মন্দা পরিস্থিতির সবচেয়ে গুরুতর সময়েও কানাডায় জন্মানো বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েটদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিলো মাত্র ৩.৫ শতাংশ।

আর শুধু যুক্তরাষ্ট্রই কানাডাকে লজ্জার মধ্যে ফেলেছে এমন নয়। যুক্তরাজ্যে একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের অন্য সব দেশে জন্মগ্রহণকারী দক্ষ অভিবাসীরা এখন আয়ের দিক থেকে স্থানীয়দেরকে পেছনে ফেলেছে। আর সেখানে অভিবাসী ও ব্রিটেনে জন্মগ্রহণকারীদের কর্মসংস্থানের হার মোটামুটিভাবে প্রায় সমান। অস্ট্রেলিয়া ১৯৯০-এর দশকে তার অভিবাসন ব্যবস্থা পুরোপুরি পাল্টে ফেলে। তারা সেইসব অভিবাসীদের অগ্রাধিককার দিচ্ছে যাদের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।  এর ফলে অভিবাসীদের কর্মসংস্থান ও আয়ের পরিমাণ স্থিরভাবে বেড়েছে। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) সূত্রমতে, কানাডার অভিবাসীদের প্রায় ২৩ শতাংশই দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে। যেখানে ওইসিডির দেশগুলোর গরীবের গড় হার হলো ১৭ শতাংশ।

অভিবাসীদের শিক্ষার সঙ্গে তাদের চাকরির সামঞ্জস্য বিধান করাতেও কানাডার অবস্থান খুব নাজুক। এক্ষেত্রে দেশটি কেবল এস্তোনিয়, ইতালি, স্পেন ও গ্রিসের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। কানাডায় উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন অভিবাসীদের মাত্র ৬০ শতাংশ এমন কাজ করেন যেজন্যে উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন লোকই দরকার। যেখানে ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোতে উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন লোকেদের নিজ ক্ষেত্রে কাজের হার ৭১ শতাংশ।

অভিবাসন নিয়ে এই উভয়সঙ্কট ব্যাপকতরভাবে বেতন কাঠামোকেও প্রভাবিত করে। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনীতির ওপর অভিবাসনের প্রভাবের তুলনা করে হার্ভার্ডের অর্থনীতিবিদ জর্জ বোর্জাস ও সাবেক স্ট্যাটিসটিকস কানাডার সিনিয়র রিসার্চার আবদুর রহমান আয়দেমির দেখেছেন যে, কানাডা তার অর্থনীতির প্রকৃত চাহিদার চেয়েও বেশি সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কর্মী নিয়োগ দিয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কর্মীর প্রয়োজন আছে এমন চাকরির বেতন কমিয়ে এনেছে এবং এমনকি হাইস্কুলের শিক্ষারও প্রয়োজন নেই এমন নিম্ন দক্ষতার চাকরির বেতন বড়াতে সহায়ক হয়েছে। ১৯৯০-এর শুরুর দিক থেকে পরবর্তী দশকে যখন কানাডা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে অভিবাসনের সংখ্যা সংযুক্ত করার দীর্ঘদিনের নীতি বর্জন করে এবং প্রধানত কানাডার বাসিন্দাদের আত্মীয়-স্বজনকে আসতে দেওয়ার নীতি থেকে দেশের সঙ্গে কোনওরকম সম্পর্কহীন দক্ষ অভিবাসীদের আসতে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটদের বেতন আট শতাংশ কমে যায়। অন্যদিকে হাইস্কুলের লেখাপড়া যারা শেষ করেনি তাদের উপযোগী চাকরির বেতন আট শতাংশ বেড়ে যায়। এই পরিবর্তনের কারণে প্রধানত অভিবাসীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারণ কানাডায় জন্মানো কর্মীদের তুলনায় অভিবাসীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীর সংখ্যা ছিলো অনেক বেশি। আর যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন সৃষ্টি করেছে বিপরীত প্রভাব।

মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার দেশগুলো থেকে আসা বিপুল অবৈধ অভিবাসীর কারণে হাইস্কুল থেকে ঝরে পড়া লোকেদের চাকরির বেতন ২০ শতাংশ কমে যায়। অন্যদিকে চাকরিদাতার স্পন্সরশিপ ভিসা নিয়ে আসা পোস্ট-গ্রাজুয়েট ডিগ্রিধারী দক্ষ অভিবাসীদের বেতনের পরিমাণ একই হারে বেড়ে যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি এবং বিদেশে কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অভিবাসীদের বিপুল সমাবেশের অর্থ হলো কানাডার কোম্পানিগুলো এখন যে নিয়মিতভাবে “কানাডীয় কাজের অভিজ্ঞতার” শর্ত দিচ্ছে সেটা হলো সম্ভাব্য হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থীকে বাছাই করে বাদ দেওয়ার উপায়মাত্র। এর ফলে বৈষম্য বাড়ছে। ( অন্টারিও’র সরকার শিগগিরই একটি নতুন আইন করতে যাচ্ছে যা পাশ হলে চাকরিতে নিয়োগের জন্য অথবা আবেদপত্রে ‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’ এর শর্ত জুড়ে দেয়া নিষিদ্ধ করা হবে।)

টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ফিলিপ অরেওপোলাস কর্মী চাই বিজ্ঞাপন দেখে হাজার হাজার আবেদনপত্র পাঠিয়েছেন। তিনি দেখেছেন যে, ইংরেজি নাম পাল্টে ভারতীয় বা চীনা নাম দিয়ে আবেদনপত্র পাঠালে নিয়োগদাতাদের সাড়া ৫০ শতাংশ কমে যায়। বেশিরভাগ চাকরিদাতা মনে করেন বিদেশি নাম দিয়ে আবেদন করলে ধরে নেওয়া যায় যে প্রার্থী ইংরেজিতে দুর্বল হবে। কিন্তু “কানাডীয় কর্মঅভিজ্ঞতা” চাওয়ার ব্যাপারটা ঘটে হাজার হাজার আবেদনপত্রে সয়লাব হয়ে যাবার কারণেও। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও অভিজ্ঞতার বিষয়টি যাচাই করার জন্য অনলাইনে  কয়েক মিনিটমাত্র সময় ব্যয় করলেও এই বিপুল চাপ নেওয়াটা ঠিক যেন পোষায় না। অরেওপোলাস বলেন, “ভিন্ন কোনও দেশ থেকে আসা লোকেদের সম্পর্কে তাদের (নিয়োগদাতা) প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হলো, ‘আমি এই লোকটির ব্যাপারে কিছুই জানি না, তাই কোনওরকম ঝুঁকি নিতে চাই না।” তিনি বলেন, “কিন্তু আপনি যখন মাত্র ২০০ আবেদনপত্র নিয়ে কাজ করবেন তখন সেটার ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াটাও হয় কাজের।”

কানাডার কোম্পানিগুলোর মতই মার্কিন নিয়োগদাতারাও বৈষম্যমূলক কিন্তু যেহেতু অভিবাসনের আগেই শ্রমিকদের চাকরির প্রস্তাব পাওয়া দরকার সেজন্যে ওই বৈষম্য সম্ভাব্য অভিবাসীকে ওয়ার্ক পারমিট দেওয়া এবং নতুন দেশে যাবার তার পরিকল্পনার আগেই ঘটে যায়।

সমালোচকেরা আমেরিকার অস্থায়ী কর্মসংস্থানভিত্তিক অভিবাসনের সমালোচনা করেন কারণ এই পদ্ধতিতে অভিবাসীরা তাদের চাকরিদাতার ইচ্ছা-অনিচ্ছা অথবা অর্থনীতির প্রবণতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তবে মাভিনকুরভি বলেন, ওই পদ্ধতির কিছু অপ্রত্যাশিত উপকারিতাও আছে। তিনি বলেন, “মার্কিন পদ্ধতিতে ঝুঁকি গ্রহণকারীদের বাছাই করার ক্ষেত্রে কিছু স্বেচ্ছাচারি উপায় আছে। এটা সত্য হোক বা না হোক মানুষের ধারণা এমন যে, কানাডার চেয়ে আমেরিকায় বিনামূল্যে দেওয়া সার্ভিসের পরিমাণ অনেক কম আর এর ফলে কারও পক্ষে নিজে থেকে দেশ বেছে নেওয়ার সুযোগ বেশি, যারা বলতে পারে যে, ‘বিনামূল্যের নিশ্চিত স্বাস্থ্যসেবার আমি থোরাই কেয়ার করি। আমেরিকা থেকে ঘাড় ধরে বের করে দিলেও আমার কিছু এসে যায় না। আমি এমন দেশে যেতে চাই যারা আমাকে ফেসবুক ও গুগল দেবে।’”

তিনি বলেন, ভারতে প্রায়ই শোনা যায় অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে দেশে ফিরে আসছেন। কারণ তারা চাকরি হারিয়েছেন এবং তাদের অস্থায়ী ওয়ার্ক পারমিট কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এসব কাহিনী স্থায়ী অধিবাসী হিসাবে কানাডায় আসা দক্ষ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ঘটে না। আর সেজন্যেই এমন ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, অব্যাহতভাবে কাজ করার মত চাকরি খোঁজার জন্য কানাডাই সবচেয়ে ভালো জায়গা।

কারা সোমারভিলি এবং স্কট ওয়ালসওর্থ নামে সাসকাটচাওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দম্পতির একটি টিম ২০১১ সালে ভারত সফরে যান। তারা অনুসন্ধান করেন যে, কানাডায় নবাগতরা যে দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য হয় সে সম্পর্কে দশকের পর দশক ধরে বিস্তারিত লেখালেখি হওয়ার পরও নবাগতরা চাকরির বাজারে ঢোকা কত কঠিন ছিলো সেই বিষয়টি নিয়ে সব সময়ই এমন মর্মাহত হয়ে পড়ে কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ভারতের ৫০০ শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার গ্রহণের পর তারা আবিষ্কার করেন যে, নতুন দেশে গিয়ে অভিবাসীরা কত বেশি কঠিন সংগ্রামের মুখোমুখি হন সে বিষয়টি তারা একেবারেই গোপন করে যান। এর প্রধান কারণ হলো নিজ দেশে ফেরার পর তারা নিজেদেরকে সফল মানুষ হিসাবে তুলে ধরার ব্যাপারে প্রবল সামাজিক চাপের মধ্যে থাকেন। যে অ্যাপার্টমেন্টে তারা অনেকের সঙ্গে গাদাগাদি করে থাকেন তার গল্প না করে আশেপাশের উন্নততর গাছপালায় ছাওয়া বাড়ির সামনে নিজের ছবি তোলেন। তারা যে কোম্পানিতে কাজ করেন সেটাকেই ছবিতে তুলে ধরেন কিন্তু বলেন না যে, তিনি আসলে ক্যাফেটেরিয়ায় কাজ করেন। সোমারভিলি বলেন, তারা কানাডায় নিজেদের সংগ্রামের কথা হয়তো বলেন, তবে তাতে প্রথম কয়েক মাসের কথাই কেবল উঠে আসে, “পাঁচ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামের কথা তাতে থাকে না। তাদের মাস্টার্স বা পুরো পিএইচডি ডিগ্রি যে নতুন করে করতে হচ্ছে সেটাও বলেন না।”    

মাভিনকুরভির মতো অভিবাসীর জন্য সমাধানটা খুবই সরল: বিশ্বের কোন দক্ষ শ্রমিক তার দরকার সেই সিদ্ধান্ত নিয়োগদাতাকেই নিতে দিন এবং কোম্পানি ও অভিবাসীরা সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার করবে না এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের ওপর ছেড়ে দিন। তিনি বলেন, “কানাডার অভিবাসন নীতির সবচেয়ে বড় যে গলদ তা হলো তাদের এমন একটি নীতি রয়েছে যেখানে অটোয়ার আমলারা সিদ্ধান্ত নেন কানাডার অর্থনীতিতে অবদান রাখার মত যোগ্য দক্ষতা কাদের আছে।”

সেই সময়কার অভিবাসন মন্ত্রী জেসন কেনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, কানাডার অভিবাসনের চূড়ান্ত গন্তব্য ওটাই। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে কনজারভেটিভ দলের সরকার অব্যাহতভাবে এই অভিবাসন নীতির সংস্কার করেছে, অস্থায়ী ওয়ার্ক ভিসার সংখ্যা বাড়িয়েছে এবং নিয়ন্ত্রণের অনেকটাই প্রাদেশিক সরকারগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়েছে। কেনি বলেন, সবচেয়ে নাটকীয় পরিবর্তন আসবে সামনের বছর যখন কয়েক দশকের পুরনো পয়েন্ট পদ্ধতি বাতিল করে কেনির ভাষায় এক ধরণের “আগ্রহ প্রদর্শনের” নীতি গ্রহণ করা হবে যা অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মতো দক্ষ শ্রমিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে প্রণীত হবে।

ভাষাগত দক্ষতা, শিক্ষা ও কাজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পয়েন্ট পাওয়ার পরিবর্তে সম্ভাব্য অভিবাসীদের ভাষাগত দক্ষতা এবং শিক্ষাগত ও অন্যান্য প্রমাণপত্রাদি তৃতীয় কোনও পরিষেবাদাতার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে। মূল্যায়নে উত্তীর্ণ হলে তাদেরকে অভিবাসী হিসাবে অনুমোদন দেয়া হবে এমন লোকেদের একটি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। চাকরিদাতারা সেই তালিকা দেখে কাউকে চাকরি দেওয়ার উপযুক্ত বলে বিবেচনা করলে তিনি আগের দক্ষ-শ্রমিক কর্মসূচির আওতায় পাঁচ বছর ধরে অপেক্ষা করার পরিবর্তে এক বছরের মধ্যে তাকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন। কেনি বলেন, সম্ভাব্য অভিবাসীদের সঙ্গে নিয়োগদাতাদের সংযোগ ঘটানোর ক্ষেত্রে এটি যেন একটি ডেটিং সার্ভিসের মতো।

এটি হবে একটি তাৎপর্যপূর্ণ রূপান্তর এবং কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে স্বীকার করে নেওয়া যে, গত ৫০  বছর ধরে কানাডার অভিবাসন নীতির মূল ভিত্তি ছিলো যে পয়েন্ট সিস্টেম তা আসলে যথাযথভাবে কাজ করেনি। কেনি বলেন, “আমি বলছি না যে, এটি পুরোপুরি ব্যর্থ ছিলো কিন্তু এর মাধ্যমে যে ফলাফল পাওয়া গেছে তা যথেষ্ট ছিলো না।”

চাকরিদাতাদের দিয়ে পরিচালিত অভিবাসন নীতি বিতর্কের সৃষ্টি করবে তাতে সন্দেহ নেই। কানাডার অস্থায়ী বৈদেশিক শ্রমিক কর্মসূচি এরই মধ্যে সমালোচনার মুখে পড়েছে। ইতিপূর্বে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার একটি কয়লা খনিতে ২০০ চীনা শ্রমিক নিয়োগের জন্য একটি চীনা কোম্পানিকে অনুমতি দেওয়ার পরই এই সমালোচনার সূত্রপাত হয়। আর কানাডীয়দের কিছু চাকরিতে ভারতীয় শ্রমিকদের নিয়োগের কারণে ইতিপূর্বে রয়্যাল ব্যাংককে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়। রয়্যাল ব্যাংক যে আউটসোর্সিং কোম্পানিকে ভাড়া করেছিলো তারা অস্থায়ী বৈদেশিক শ্রমিক কর্মসূচির ভিত্তিতেই ওই ভারতীয়দের নিয়োগ দিয়েছিলো।

সমালোচকরা বলছেন, দক্ষতাভিত্তিক অভিবাসন ব্যবস্থার মূল ধারায় চাকরিদাতাদের স্বল্পমেয়াদি চাহিদার নীতি আরোপ করা মোটেই কোনও সমাধান নয়, যেহেতু একজন চাকরিদাতার কাছে বর্তমানে যে ধরণের দক্ষতার চাহিদা আছে পাঁচ বা ১০ বছর পর সেই একই চাহিদা না-ও থাকতে পারে। কিন্তু অন্যরা সতর্ক করে দেন যে, বর্তমান অভিবাসন ব্যবস্থা অনেক বেশি খারাপ। অরেওপোলাস বলেন, “এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা কারণ আমাদের একটি নীতি রয়েছে যা এমন অভিবাসীদের বাছাই করে নেওয়ার লক্ষ্যে প্রণীত যারা শ্রমবাজারে সফল হবে। কিন্তু আমরা তাদেরকে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দিচ্ছি।”

সোমারভিলি বলেন, “আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অভিবাসীদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন বেকারত্বের অভিশাপে না ভোগে এবং দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য না হয় সেটা নিশ্চিত করার জন্য কানাডায় অভিবাসী হওয়ার যে অর্থ সেটাকেই পুরোপুরি পাল্টে দেওয়া দরকার। তিনি বলেন, “এর সত্যিকারের অর্থ হলো, কানাডা আগাগোড়াই একটি সম্ভাবনার জায়গা এই মানসিকতা পাল্টে ফেলা।” কানাডীয় ও অভিবাসী উভয়ের জন্যই এই বার্তার মুখোমুখি হওয়া কঠিন হবে।

– সূত্র : দি ম্যাকলিনস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *