অভিবাসীদের মানসিক স্বাস্থ্য মোকাবেলায় যথাযথ সেবাদানের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
আজামু নাঙ্গওয়াইয়া : কানাডার দৃশ্যমান সংখ্যালঘু অভিবাসীদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সাংস্কৃতিক দিক থেকে অধিকতর যথাযথ সেবাদানের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ইতিপূর্বে টরন্টোর পুলিশ কর্মকর্তারা পাঁচ সন্তানের জনক একজন সুদানি অভিবাসীকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যার প্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা এই নতুন সেবার কথা বলছেন।
কানাডার মানসিক স্বাস্থ্য সমিতি (সিএমএইচএ) হিসাব করে দেখেছে যে, প্রতি পাঁচজন কানাডীয়র মধ্যে একজন জীবনের কোনও না কোনও সময় মানসিক রোগে ভুগতে পারেন। সমিতি মানসিক সমস্যাকে একটি স্বাস্থ্যগত সমস্যা হিসাবে বিবেচনা করে যেখানে কোনও ব্যক্তির কার্যকরভাবে কাজকর্ম করতে পারার সক্ষমতা খর্ব হয় অথবা তিনি অন্যদের সঙ্গে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য উপায়ে আচরণ করতে পারেন না।
দৃশ্যমান সংখ্যালঘু অভিবাসীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি মেন্টাল হেলথ সেন্টার এবং সিএমএইচএ উভয়েই এন্ড্রু লুকো নামের এক ব্যক্তির মর্মস্পর্শী ঘটনার ওপর আলোকপাত করেছে। লুকো ইতিপূর্বে টরন্টোর পশ্চিম প্রান্তে এগলিনটন অ্যাভিনিউ ও ক্যালেডোনিয়া অ্যাভিনিউর কাছে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে নিহত হন। গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, লুকোর অ্যাপার্টমেন্টটি ছিল সিএমএইচএ-র বন্ধক দেয়া একটি ভবনে যেটি মানসিক রোগীদের আশ্রয় কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছিল।
অসুস্থতা “লুকিয়ে রাখা”
অ্যাক্রস বাউন্ডারিস-এর নির্বাহী পরিচালক আসিফা সারাঙ বলেন, “বিভিন্ন স্তরেই ব্যবধান থেকে যাচ্ছে। এর মধ্যে আছে স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পর্কে অভিবাসীদের বুঝে উঠতে পারা না পারা থেকে শুরু করে মানসিক স্বাস্থ্য ও আসক্তি বিষয়ে অস্বচ্ছ ধারণা ও বৈষম্যের (সব ধরণের অবদমন) অভিজ্ঞতা এবং একইসঙ্গে সেবা প্রাপ্তির কাঠামোগত বাধা পর্যন্ত নানা বিষয়। অনেক অভিবাসীরই প্রবণতা আছে অসুস্থতা চেপে যাওয়ার এবং সাহায্যের জন্য নিজের অবস্থা কারো সঙ্গে শেয়ার না করার।”
সারাঙ আরও বলেন, অভিবাসীরা যখন এবং যদি সাহায্য চায় তাহলেও তাদেরকে আরও কিছু চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। “যথাযথ ব্যক্তিদের মাধ্যমে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় যথাযথ সেবা (অর্থাৎ, মেডিক্যাল ও মেডিক্যালের বাইরে যেমন,
আয়ুর্বেদ, আকুপাংচার ও যোগ ইত্যাদির একটি সমন্বিত সেবা)খুঁজে বের করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।”
সারাঙ বলেন, কানাডীয় সমিতি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিদ্যমান অস্বচ্ছ ধারণা এবং অজ্ঞতা দূর করার জন্য কাজ করে চলেছে, কিন্তু অভিবাসীরা যে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করছে সেটা অপরিমেয়রূপে জটিল।
সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যবধান যে রয়েছে তা এ সম্পর্কিত গবেষণায় স্পষ্ট। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, সেন্ট মিশেল হাসপাতালের ২০১২ সালের একটি রিপোর্ট। টরন্টোর অভিবাসীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও কল্যাণ শীর্ষক রিপোর্টে আভাস দেয়া হয় যে, সাম্প্রতিক সময়ে আসা এবং আগে আসা অভিবাসীরা কানাডায় জন্মানো নাগরিকদের তুলনায় মানসিক স্বাস্থ্য যেমন বিষন্নতা ও উদে¦গ বিষয়ে একইরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন, যখন বিষন্নতার চিকিৎসার বিষয় আসে তখন কানাডায় জন্মানো নাগরিকদের তুলনায় অভিবাসীরা কম সুযোগ পান।
একটি ব্যক্তিগত কাহিনী
মানসিক সমস্যা কাটিয়ে ওঠা আকিলা আল মাসরি খুব ভালো করে জানেন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাবার ক্ষেত্রে কী ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়।
আল মাসরি বলেন, “মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার একেবারে মূল কাঠামোতেই ব্যবধানের সূত্র নিহিত, যা থেকে আমরা মানসিক অসুস্থতার কারণ বুঝতে ও তা মেনে নিতে পারি। পাশ্চাত্যের পটভূমি থেকে দেখলে যার উদ্ভব ঘটে প্রাথমিকভাবে একটি বায়ো-মেডিক্যাল নমুনা থেকে যেখানে মুখ্যত ফার্মাকোলজিক্যাল ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়।” আল মাসরির এই প্রসঙ্গটি সেন্ট মিশেলস হাসপাতালের রিপোর্টেও ফলাও করা হয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে যে, অভিবাসী নন এমন নাগরিকদের ২১ শতাংশ যখন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা কাটাতে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধপত্র সেবন করেন সেখানে অভিবাসীরা করেন অনেক কম মাত্র ১৩ শতাংশ। তারও ওপর অনেক কম সংখ্যক অভিবাসী মানসিক চিকিৎসক বা মনোবিজ্ঞানীর কাছে যান। ২০১১ সালে অভিবাসী নন এমন নাগরিকদের ১২ শতাংশ যেখানে মনোবিজ্ঞানী বা মনোচিকিৎসকের কাছে গেছেন সেখানে অভিবাসীরা গেছেন আট শতাংশ।
বহুস্তরের চ্যালেঞ্জ
রিয়ারসন ইউনিভার্সিটির সমাজকর্ম অনুষদের প্রফেসর আই আবদিল্লাহি বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাবার ক্ষেত্রে সব অভিবাসীই একই রকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন না। বিশেষ গ্রুপের অভিবাসী এবং জাতিগত পরিচয়ের অভিবাসীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া নিয়ে যে গবেষণা হয়েছে তাতে এই তথ্য পাওয়া গেছে। যেমন, গবেষণায় মন্ট্রিলের নবাগত তরুণ, আফ্রিকান-কানাডীয় এবং টরন্টোতে চীনা-কানাডীয় বয়স্ক অভিবাসী এবং আফগান অভিবাসীদের নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
আবদিল্লাহি মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সংগঠনগুলোর প্রতি কানাডার সমাজে অসাম্য যে ভেতর থেকে উদ্ভূত এই সত্য স্বীকার করে নেওয়ার আহবান জানান।
তার ভাষায়, “এই অসাম্য নিশ্চিতভাবেই জাতিগত পরিচয়ের মানুষের দৈনন্দিন কল্যাণের বিষয়টিকে প্রভাবিত করছে। আর এই অসাম্যের একটি নির্দিষ্ট ক্ষতিকর প্রভাব আছে এবং বিশেষ জাতিগত গোষ্ঠীর সদস্য কারা তার ভিত্তিতে এই প্রভাব কার্যকর হয়।”
আল মাসরিও একই কথার প্রতিধ্বনি করেন। তিনি বহুমুখি নিবর্তনের প্রভাব চিহ্ণিত করার প্রয়োজনের ওপর গুরুত্বরোপ করেন।
সমাধানের প্রস্তাবনা
জাতিগত পরিচয়ের কানাডীয় বিশেষ করে অভিবাসী ও শরণার্থীদের- মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যেহেতু সমস্যা আছে সুতরাং এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ভিন্নভিন্নভাবে পদক্ষেপ গ্রহণেরও প্রয়োজন রয়েছে।
সারাঙ বলেন, “সবার আগে সুস্পষ্টভাবে মেনে নিতে হবে যে, এই ব্যবস্থার ভেতরে অসাম্য বিরাজমান এবং এখানে প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ সক্রিয়। আর এই বর্ণবাদ ব্যক্তিগত বর্ণবাদের সঙ্গে মিশে জটিলতর হয়ে উঠেছে।” তিনি আরও বলেন, “এই স্বীকৃতির জায়গা থেকে আমরা এই অসাম্যের উৎসগুলোর সমাধানের দিকে যেতে পারি এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে এই অসাম্য দূর করার কৌশল সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতে পারবো।”
আল মাসরি এই সঙ্গে যোগ করেন যে, জাতিগত কমিউনিটির লোকজনের আরও বেশি করে বক্তব্য অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে এবং তা অবশ্যই “ধৈর্য, সহানুভূতি, শ্রদ্ধাবোধ, উদারচিত্ততা এবং ব্যক্তিগত, সমন্বয় ও সামাজিক উপসমের মাধ্যমে পরিচালিত হতে হবে।”
সৌজন্যে : নিউকানাডিয়ানমিডিয়া.সিএ