জাস্টিন ট্রুডোর বিদায়ের দিন কি সত্যিই ঘনিয়ে আসছে?
খুরশিদ আলম
কানাডার প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন রাজনেতিক দল লিবারেল পার্টি অব কানাডার প্রধান নেতা জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তা এখন অনেকটাই অনুজ্জ্বল। গত নির্বাচনেও ট্রুডো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি। ফলে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এখন নির্ভর করতে হচ্ছে তৃতীয় অবস্থানে থাকা বিরোধী দল এনডিপি’র উপর।
গত বছর অক্টোবরে প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, কানাডিয়ানরা মনে করছেন, ট্রুডো হলেন গত ৫৫ বছরের মধ্যে দেশের সবচেয়ে কম পছন্দের প্রধানমন্ত্রী। রিসার্চ কো. নামের একটি প্রতিষ্ঠানের জনমত জরিপে এমনটাই জানা গেছে। সম্প্রতি এই জরিপের রিপোর্টটি প্রকাশ করে নাউ.কম পত্রিকা।
মজার ব্যাপার হলো, ঐ জরিপে দেখা গেছে জাস্টিন ট্রুডোর প্রয়াত বাবা পিয়েরে ট্রুডো পেয়েছেন দেশের সবচেয়ে প্রিয় নেতার মুকুট।
অনলাইন জরিপে দেখা যায়, ২০ শতাংশ কানাডীয় মনে করেন, পিয়েরে ট্রুডো ছিলেন ১৯৬৮ থেকে এখন পর্যন্ত দেশের সেরা সরকারপ্রধান।
পিয়েরে ট্রুডো সেরা বিবেচিত হন ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় (২৭%), অন্টারিওতে (২৩%) এবং আটলান্টিক কানাডায় (২২%)।
সেরা হিসাবে বিবেচিতদের মধ্যে স্টিফেন হারপার ১৭% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় এবং তার পরেই রয়েছেন Jean Chrétien.
অদ্ভুত ঘটনা এই যে, স্টিফেন হারপারকে ভোটাররা কানাডার দ্বিতীয় সেরা নেতা যেমন বলেছে তেমনই তিনিই পেয়েছেন দ্বিতীয় সবচেয়ে খারাপ নেতার অবস্থানও।
এদিকে, জাস্টিন ট্রুডো পেয়েছেন সবচেয়ে খারাপ প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে শীর্ষ স্থানটি। ৩০ শতাংশ কানাডীয় এ বিষয়ে একমত।
এই ফলাফল এসেছে সম্প্রতি অনলাইনে ১০০০ প্রাপ্তবয়স্ক কানাডীয়র মধ্যে অনুষ্ঠিত জরিপ থেকে। এদিকে তারও আগে পরিচালিত অন্য এক জরিপে দেখা গিয়েছিল কনজারভেটিভ দলের নতুন নেতা পিয়েরে পয়লিভার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পছন্দের দিক থেকে জাস্টিন ট্রুডোকে টপকে গেছেন। জরিপটি পরিচালিত হয়েছিল একান্তভাবে গ্লোবাল নিউজের জন্য।
এই খবরটি প্রকাশ করে গ্লোবাল নিউজ জানায়, ইপসোস পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের সিইও ড্যারেল ব্রিকার মনে করেন, ২০১৫ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হবার পর ট্রুডোর জনপ্রিয়তা ক্রমশ ফিকে হয়ে এসেছে এবং জনগণ পরিবর্তন চায়। তিনি বলেন, “পছন্দের তালিকায় লিবারেল পার্টির নেতা ট্রুডোর ঊর্ধ্বগতি মন্থর হয়ে পড়েছে।”
একান্তভাবে গ্লোবাল নিউজের জন্য পরিচালিত ঐ জরিপে দেখা গেছে, জরিপে অংশ নেওয়া ৩৫ শতাংশ কানাডীয় মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী পদে পয়লিভার হলেন সেরা প্রার্থী, যেখানে ৩১ শতাংশ কানাডীয় ট্রুডোকে সেরা প্রার্থী মনে করেন।
এই পরিসংখ্যান ট্রুডোর লিবারেল দলের সমস্যার সর্বশেষ লক্ষণের প্রতিফলন, যে দলটি জনগণের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের সম্মুখিন হচ্ছে। জরিপে দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতি ও ক্রয়ক্ষমতা নিয়ে জনগণের অসন্তোষ বাড়ছে।
ইপসোস পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের সিইও ড্যারেল ব্রিকার বলেন, “মি. পয়লিভারের দৃশ্যপটে আসাটা তার কোনও বিশেষ কাজ বা কথার ফলশ্রুতি নয়, বরং এটি হলো অনেকটাই জনগণের পছন্দের ফল যারা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জায়গায় নতুন কাউকে দেখতে চায়।”
“এটা স্পষ্ট যে, কানাডার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই মুহূর্তে বিকল্পের সন্ধান করছে।”
এমনকি যে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় ৩৮ শতাংশ জনসমর্থন নিয়ে ট্রুডোর অবস্থান ছিল সবচেয়ে জোরালো সেখানেও পয়লিভারের চেয়ে ট্রুডো মাত্র দুই পয়েন্ট এগিয়ে ছিলেন। কুইবেক ও আটলান্টিক কানাডা ছাড়া অন্য প্রত্যেকটি প্রদেশে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ছাড়িয়ে গেছেন পয়লিভার।
এর মধ্যে আছে অন্টারিও প্রদেশও। সেখানে লিবারেল দলকে উৎখাত করার চেষ্টায় কনজারভেটিভ দল ভোটারবহুল গ্রেটার টরন্টো এলাকায় বহু বছর থেকে বড় ধরণের সাফল্য পাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
নতুন এই জরিপ এসেছে ইপসোস-এর আরেকটি আলাদা জরিপের পর পরই। আগের ওই জরিপে দেখা যায়, সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন এমন ভোটারদের মধ্যে কনজারভেটিভরা সার্বিকভাবে লিবারেল দলের চেয়ে পাঁচ পয়েন্টে এগিয়ে আছে। পয়েন্টের এই সীমা অন্টারিওতে হয়ে যায় সাত পয়েন্ট। সেখানে এখন টোরি বা কনজারভেটিভ দলের জনসমর্থন ৩৭ শতাংশ।
ওই জরিপে দেখা যায়, দুই-তৃতীয়াংশ ভোটার বলেন, এখন লিবারেলদের কাছ থেকে অন্য দলের ক্ষমতা নেয়ার সময় এসেছে। কারণ, গত শরতের পর থেকে ট্রুডোর পুননির্বাচনের পক্ষে জনসমর্থন চার পয়েন্ট কমে এখন মাত্র মাত্র ৩৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
জরিপের ফলাফল থেকে স্পষ্ট, ভোটাররা ট্রুডোর প্রতি সন্তুষ্ট নন এবং তাকে তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে অপেক্ষাকৃত নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন।
পয়লিভার যদিও জরিপে অংশ নেয়া কানাডীয়দের মতামতে ট্রুডোকে পেছনে ফেলেছেন- এবং ট্রুডো ও পয়লিভার উভয়েই এনডিপি নেতা জগমিত সিংকে পেছনে ফেলেছেন- তার পরও পয়লিভারকে দেখা হচ্ছে এমন একজন নেতা হিসাবে যিনি কানাডার জন্য সবচেয়ে ভালো পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেন (২৪শতাংশ), কাজ সুসম্পন্ন করতে পারবেন (২৪ শতাংশ) এবং সত্যিকারের জনস্বার্থে কাজ করতে ইচ্ছুক হিসাবে কানাডার নেতৃত্ব দিতে পারবেন (২৫ শতাংশ) – এই তিনটি প্রশ্নে প্রতিটিতেই ট্রুডো মাত্র ২১ শতাংশ জনসমর্থন পেয়েছেন।
এদিকে ট্রুডোকে এখনও এমন একজন নেতা হিসাবে দেখা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যার মেজাজ সবচেয়ে ভালো এবং পরিপক্কতা আছে। এক্ষেত্রে তিনি পেয়েছেন ২৬ শতাংশ মানুষের সমর্থন, আর তিনি কানাডার ঐতিহ্য ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন এই প্রশ্নে পেয়েছেন ২৪ শতাংশের সমর্থন।
উল্লেখ্য, জরিপে অংশ নেয়া কানাডীয়দের প্রতি ১০ জনের মধ্যে চার জনেরও বেশি বলেছেন, নেতাদের মধ্যে কোনও একজনও এমন নেই যার উপর তারা বিশ^াস রাখতে পারেন, যিনি সরকারি ব্যয়ের ওপর ভালো রকমের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবেন অথবা যার স্বাস্থ্য সেবা অথবা অর্থনীতির ক্ষেত্রে সেরা পরিকল্পনা আছে।
জরিপে দেখা যায়, ভোটারদের বিবেচনায় শীর্ষে রয়েছে ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার ব্যয় (৪০ শতাংশ) এবং স্বাস্থ্য সেবা (৩৫ শতাংশ), এর পরেই রয়েছে অর্থনীতি ও আবাসন। এই দুটি ইস্যুই পেয়েছে ২৩ শতাংশের মত।
এরপরও জরিপে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের ৪২ শতাংশ বলেন, আবাসন, ক্রয়ক্ষমতা অথবা প্রাপ্যতার বিষয়গুলির সমাধানে কোনও পার্টিই অন্য পার্টির চেয়ে ভালো করতে পারবে না। ৩৪ শতাংশ মানুষ একই ধরণের কথা বলেন জীবনযাত্রার ব্যয়ের প্রসঙ্গে এবং ৩০ শতাংশ একই মত দেন স্বাস্থ্য সেবার বিষয়ে। ব্রিকার বলেন, “জীবনযাত্রার ব্যয়ের বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে ভোটারদের ওপর প্রভাব ফেলে।” “আর তারা প্রধান রাজনৈতিক পার্টিগুলির দিকে তাকিয়ে আছে, তারা বলছে, আমি এমন কিছুই দেখছি না যা থেকে মনে হবে, এই বিষয়ে আপনাদের ভালো কোনও পরিকল্পনা আছে।”
অবশ্য সুনির্দিষ্ট দলের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এমন কানাডীয়দের ধারণা, কনজারভেটিভ পার্টিরই অর্থনীতি এবং মূল্যস্ফীতি সামলে নেয়ার মত সবচেয়ে ভালো উপায় উপকরণ আছে (যথাক্রমে ৪২ শতাংশ এবং ৩৩ শতাংশ)। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুর সবচেয়ে ভালো সমাধান দেবার প্রশ্নে লিবারেল পার্টি ও এনডিপি ২৫ শতাংশের সমর্থন নিয়ে সম অবস্থায় রয়েছে।
তবে জরিপ রিপোর্ট যাই বলুক, ট্রুডো মনে করছেন তিনি দেশটিকে সঠিক পথেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। যদিও তার দলের ভিতরই কেউ কেউ বলছেন এখন সময় এসেছে তার সরে দাঁড়ানোর। এদের মধ্যে কয়েকজন দলীয় এমপিও আছেন। কিন্তু ট্রুডোর সাফ কথা, তিনি নিজে নিজে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াবেন না।
মাস ছয়েক আগে পরিচালিত বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে লিবারেল পার্টির প্রধান এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তা বাড়ছে না। তবে ক্রমেই বাড়ছে প্রধান বিরোধী দল কনজার্ভেটিভ পার্টির নেতা পিয়েরে পয়লিভরে’র জনপ্রিয়তা।
অন্যদিকে The Leger poll এর সাম্প্রতিক এক জরিপের বরাত দিয়ে গত ১৫ নভেম্বর দি কানাডিয়ান প্রেস জানায় – বর্তমানে প্রায় প্রতি তিনজনের মধ্যে দুইজনই জাস্টিন ট্রুডোর প্রতি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করছেন এবং অর্ধেক কানাডিয়ানই চাচ্ছেন আগামী নির্বাচনের আগে তিনি পদত্যাগ করুক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রুডো ও তাঁর সরকারের প্রতি জনগণের ব্যাপক অসন্তোষের অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে আছে বাড়ির মূল্য ও ভাড়া আকাশচুম্বী হওয়া, দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যাওয়া, স্বাস্থ্য সেবা যথাযথভাবে না পাওয়া ইত্যাদি।
ইপসোস এর সিইও ডেরিল ব্রিকার বলেন, “জরিপ থেকে এটা স্পষ্ট, আজ যদি নির্বাচন হয় তাহলে কনজারভেটিভ পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে পারে।” জীবনযাত্রার ব্যয়, আবাসনের প্রাপ্যতা ও মূল্যস্ফীতির উল্লেখ করে ব্রিকার বলেন, “এই মুহূর্তে কানাডিয়ানরা যেভাবে ভাবছেন সে বিষয়ে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, তাঁদের মধ্যে দেশ যেদিকে যাচ্ছে তা নিয়ে সত্যিকারের অসন্তোষ আছে। নির্দিষ্ট করে বললে, সেইসব গুরুতর বিষয়ে যেগুলি তাঁদের ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত।”
কানাডা এখন অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসেবা ও গৃহায়ন সম্পর্কিত যেসব প্রধান সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে সে বিষয়ে জরিপে দেখা যায়, তিনটি ক্ষেত্রেই পয়লিভরে’রই সেরা পরিকল্পনা আছে বলে বহু কানাডিয়ান মনে করেন।
আঞ্চলিক ক্ষেত্রে, কুইবেক ছাড়া প্রতিটি প্রদেশ ও অঞ্চলেই পয়লিভরে’র পক্ষে আনুকূল্য তালিকার শীর্ষে রয়েছে। টেরিটোরিগুলি এই জরিপে অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
জরিপে দেখা যায়, অন্টারিওতে পছন্দের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পয়লিভরে-কে এগিয়ে রেখেছে ৪২ শতাংশ মানুষের সমর্থন, সেই তুলনায় ট্রুডোর সমর্থন ৩৮ শতাংশ।
ইপসোস জরিপের ফলাফলে বোঝা যাচ্ছে, ৬০ শতাংশ কানাডিয়ান মনে করেন, এখন ট্রুডোর নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানো এবং পরবর্তী নির্বাচনে লিবারেল পার্টির নেতৃত্ব দেয়ার জন্য অন্য কাউকে সামনে নিয়ে আসা উচিত। এই সংখ্যাটি ২০২২ সালের এক জরিপের চেয়ে বেশি। সেই জরিপে একই কথা বলেছিল ৫৪ শতাংশ উত্তরদাতা।
বর্তমান সংখ্যালঘু লিবারেল সরকারের পক্ষে এনডিপির সমর্থন ও আস্থার চুক্তি রয়েছে। এনডিপি ২০২৫ সালের শরতে অনুষ্ঠিতব্য পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত সরকারকে সমর্থন দিতে সম্মত হয়েছে।
বিনিময়ে লিবারেল দল ডেন্টাল কেয়ার এবং ফার্মাকেয়ারের মত এনডিপির অগ্রাধিকারের বিষয়গুলি এগিয়ে নিতে সম্মত হয়।
৫৩ শতাংশ উত্তরদাতা অবশ্য বলেন, এনডিপির জন্য লিবারেল দলের প্রতি সমর্থন দেয়া বন্ধ করা এবং নির্বাচন আদায় করার এখনই সময়। অবশিষ্ট উত্তরদাতারা মনে করেন, এনডিপির উচিৎ নির্বাচনের জন্য চাপ সৃষ্টি না করে লিবারেল সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখা।
গত ২৩ ডিসেম্বর গ্লোবাল নিউজে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে জাস্টিন ট্রুডো বলেন, “আমি জানি যে লোকেরা আমার প্রতি হতাশ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের ভোটাররা যারা ২০১৫ সালের নির্বাচনে লিবারেল পার্টিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠনে সহায়তা করেছিল। আট বছর পর আমরা এখন যে বৈশি^ক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি সেটার কারণে সেদিনের সেই তরুণ প্রজন্ম আজ বাড়ি ভাড়া দিতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে, নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে এখন তারা চিন্তিত।
জাস্টিন ট্রুডো বলেন, জনমত যাই হোক, আমি এই পরিস্থিতিতে সরে দাঁড়াচ্ছি না। এটা হাতপা গুটিয়ে নেওয়ার সময় না। বরং আমি দেশবাসীর স্বার্থে আরো জোরালো পদক্ষেপ নিয়ে সামনে এগিয়ে যাব।
ট্রুডো আরো বলেন, আমাদের সরকারে একটা দুর্দান্ত টিম রয়েছে যারা কানাডিয়ানদের বর্তমান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে আছে আবাসন, খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি, জলবায়ুসহ আরো কিছু সমস্যা।
সাম্প্রতিক সময়ে জাস্টিন ট্রুডোকে নিয়ে আরো কিছু জরিপ ফলাফল:
তবে আট বছর দায়িত্ব পালনকারী পূর্বসূরীদের তুলনায় ট্রুডোর প্রতি সমর্থনের দীর্ঘদিনের প্রবণতার চিত্র তুলে ধরার লক্ষে এঙ্গুস রেইডের পরিচালিত সমীক্ষায় যে ফলাফল পাওয়া যায় তা বহুলাংশে অনুকূল, যদিও একটি বড়ো অংশ তাঁকে সমর্থন করেননি।
ট্রুডোর প্রতি সম্মতি দেন ৪০ শতাংশ মানুষ। এটি তাঁর সমান সময় দায়িত্ব পালনকারী আগের তিনজন প্রধানমন্ত্রীর প্রতি জনগণের সম্মতির হারের চেয়ে বেশি। শুধু Jean Chrétien এদিক থেকে ট্রুডোকে ছাড়িয়ে গেছেন।
ট্রুডোর প্রতি অনুমোদনের এই হার পাওয়া গেছে গত মে মাসের শুরুর দিকে ১৬০০ প্রাপ্তবয়স্ক কানাডিয়ানের ওপর পরিচালিত সমীক্ষায়।
আট বছর দায়িত্বে থাকার পর ট্রুডোর প্রতি জনগণের অনুমোদনের হার সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের চেয়ে চার পয়েন্ট বেশি, একই সঙ্গে এই হার তাঁর বাবা পিয়েরে এলিয়ট ট্রুডোর চেয়ে আট পয়েন্ট বেশি।
ব্রায়ান মালরোনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আট বছর ক্ষমতায় থাকার পর জরিপে তার প্রতি জনগণের অনুমোদনের হার ছিল মাত্র ১২ শতাংশ। ১৯৯৩ সালের ফেডারেল নির্বাচনে তার দল অপসৃত হবার আগের বছরই মালরোনি প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দেন।
যাই হোক, জরিপে অংশ নেয়া ৫৫ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা জাস্টিন ট্রুডোকে পছন্দ করছেন না। অন্যদিকে ৪০ শতাংশ “জোরালোভাবে অপছন্দের” অপশন বেছে নেন। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, কানাডিয়ানরা ট্রুডোর ব্যাপারে মতামত দেয়ার ক্ষেত্রে ঐক্য থেকে অনেক দূরে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭০ সাল থেকে ক্ষমতাসীন প্রায় সব প্রধানমন্ত্রীই বেশিরভাগ কানাডিয়ানের অপছন্দের ছিলেন।
এঙ্গুস রেইড উল্লেখ করে যে, এবারের বসন্তে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা ট্রুডোর প্রতি সমর্থনে প্রভাব রেখে থাকতে পারে। যেমন, “নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপের বিষয়ে তদন্ত শুরু করা, জ্যামাইকায় তার এক লাখ ৬০ হাজার ডলার ব্যয়ে অবকাশ কাটানোর বিষয়ে যাচাই-বাছাই, বাজেট সম্পর্কিত একটি বিভাজনমূলক পুনঃপূর্বাভাস দেয়া এবং কানাডা সম্ভবত ন্যাটোর দেয়া শর্তাবলী কখনই পূরণ করতে পারেবে না এমন একটি স্বীকারোক্তি ফাঁস হয়ে যাওয়া।”
তার পরও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রতি মানুষের মতামত গত বসন্ত থেকেই ৪০ শতাংশের কয়েক পয়েন্টের মধ্যে থেকে গেছে, যা গত বছরের মার্চে সবচেয়ে কমে ৩৭ শতাংশ ছিল।
এঙ্গুস রেইডের তথ্যমতে নারীদের মধ্যে ট্রুডোকে পছন্দ করার হার অনেক বছর ধরেই তাঁর গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে অন্যতম ধারাবাহিকতা। অন্য সব বয়স গ্রুপের চেয়ে ৫৫ বছরের বেশি বয়সের নারীদের মধ্যে ট্রুডোর গ্রহণযোগ্যতার হার অব্যাহতভাবে সর্বোচ্চ রয়ে গেছে। শুধু ৫৫ বছরের বেশি বয়সের নারীদের গনায় ধরা হলে ট্রুডোর গ্রহণযোগ্যতা ৪৮ শতাংশে দাঁড়ায়।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ৩৫-৫৪ বছরের নারীদের মধ্যে ট্রুডোর গ্রহণযোগ্যতায় ভাটার টান ধরে, ২০২৩ সালের মে মাসে তার গ্রহণযোগ্যতা দাঁড়ায় ৩৭ শতাংশে, যেখানে সেপ্টেম্বরে ছিল ৪৫ শতাংশ।
ট্রুডো তার পার্টিকে সবচেয়ে ভালোভাবে সাহায্য করতে পারেন নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়ে:
এদিকে বাজার গবেষণার বিশ^খ্যাত প্রতিষ্ঠান ইপসোস-এর তথ্যমতে, অনেকে বলছেন যে, অজনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নতুন কারো কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের মাধ্যমে তার দলকে সর্বোত্তম সাহায্য করতে পারেন। ইপসোস-এর জরিপ অনুযায়ী, নতুন নেতৃত্ব নিতে পারেন খুব সম্ভব একজন অপেক্ষাকৃত তরুণ, নবীন ও নতুন মুখ- সম্ভাব্য একজন নারী নেত্রী: উপপ্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যালানি জোলি অথবা ট্রেজারি বোর্ডের প্রেসিডেন্ট অনীতা আনন্দ।
দরজা উন্মুক্ত করে দেয়া হলে আরও কেউ কেউ নেতৃত্বের জন্য আগ্রহী হতে পারেন- উদ্ভাবন, বিজ্ঞান ও শিল্পমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া-ফিলিপ্পে শ্যাম্পেন অথবা রাজনীতির বাইরের কেউ, যেমন ব্যাংক অব কানাডার সাবেক গভর্নর মার্ক কার্নে। এই জরিপ চালানো হয়েছিল একান্তভাবে গ্লোবাল নিউজের জন্য।
উল্লেখিত ব্যক্তিদের কেউই অবশ্য এখন পর্যন্ত নেতৃত্বের জন্য প্রকাশ্যে কোনও আগ্রহ প্রকাশ করেননি।
কয়েকমাস আগে সাসকাচুয়ানে এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ফ্রিল্যান্ড বলেন, “আমরা একটি টিম হিসাবে প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন দেয়ার ব্যাপারে শতভাগ অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং কানাডাবাসীর সেবায় কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি।”
স্মরণ করা যেতে পারে যে, প্রথমবার জাতীয় নির্বাচনে জাস্টিন ট্রুডোর বিস্ময়কর বিজয়ের পর কানাডাসহ বিশ্ব মিডিয়ায় তাকে নিয়ে ব্যাপক সাড়া পড়ে গিয়েছিল। কানাডার টপ ক্যাটাগরীর নিউজ মিডিয়া কানাডিয়ান প্রেস, ম্যাকলিন ম্যাগাজিনসহ দেশের বেশ কয়েকটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান তাকে নিউজমেকার অব দ্যা ইয়ার হিসাবে ঘোষণা করেছিল। লিবারেল সমর্থকদের মধ্যে তখন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তা বা সমর্থন বাস্তবিক অর্থে ছিল আকাশচুম্বী। ফোরাম রিসার্সের হিসাব অনুযায়ী লিবারেল দলের সমর্থকদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ৯০%। কিন্তু EKOS এর জরীপে দেখা গিয়েছিল এই জনপ্রিয়তা আরো বেশী। শতকরা ৯৮ ভাগ।
প্রথমবার নির্বাচনের আগে শুরুর দিকে দেখা গিয়েছিল জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তা অনেক কম। প্রধান ৩ দলের মধ্যে লিবারেল পার্টির প্রতি ভোটারদের সমর্থন ছিল সেই সময় সবার পিছনে। কিন্তু ভোটের দিন যতই এগিয়ে আসছিল ততই জাস্টিন ট্রুডো ও তার দলের প্রতি ভোটারদের আস্থা ও সমর্থন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এবং নির্বাচনের দিন দেখা গেল জাস্টিন ট্রুডো সাবইকে অবাক করে দিয়ে বিপুল ভোটে জয় লাভ করেন। নিরঙ্কুশ সংখ্যা গড়িষ্ঠতা পাওয়ার জন্য যে কয়টি আসন প্রয়োজন ছিল তার চেয়েও বেশী আসনে জয় লাভ করেছিল লিবারেল পার্টি। অভ্যন্তরীন নেতৃত্বের কোন্দলে যে দলটি অনেকদূর পিছিয়ে পড়েছিল এবং প্রায় ডুবতে বসেছিল সেই দলটিকে সঠিক ও যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে বিপুল ভোটে জয়ী করে জাস্টিন ট্রুডো ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন।
জাস্টিন ট্রুডোর এই উত্তেজনাপূর্ণ বিজয় তাকে এনে দিয়েছিল আরো কিছু খ্যাতি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত বিভিন্ন নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও ডিরেক্টরদের কাছে তিনি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আকর্ষণীয় এক ব্যক্তিত্ব। এ কথা বলেন কানাডিয়ান প্রেস এর প্রধান সম্পাদক স্টিফেন মুরিস।
নির্বাচনের জয় পরাজয় সবসময়ই বড় মাপের সংবাদ হয়ে থাকে। কিন্তু জাস্টিন ট্রুডোর জয় ছিল ঐতিহাসিক এবং এই বিজয় তাকে অনেক নিউজ মিডিয়া কর্মীদের কাছে আলাদা চরিত্র হিসাবে দাড় করিয়ে দেয়। আন্তর্জাতিক মহলেও তার উচ্চ প্রশংসাধ্বনি উচ্চারিত হতে থাকে। নির্বাচনে জীয় হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহনের পরপরই জাস্টিন ট্রুডো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেন এবং ঐ সম্মেলনগুলোতে তিনি ছিলেন সকলের মধ্যমনি। সিরিয়ার রিফিউজিদের গ্রহণ করেও তিনি আন্তর্জাতিক মহলে প্রচুর সম্মান লাভ করেন। এ সমস্ত কিছু মিলিয়ে তিনি ২০১৫ সালে নিউজমেকার অব দ্যা ইয়ার নির্বাচিত হন কানাডায়।
শুধু রাজনৈতিকভাবেই যে জাস্টিন ট্রুডো কানাডা ও অন্যান্য দেশের গণমাধ্যমের নজর কেড়েছেন তা নয়। তার ব্যক্তি ইমেজ ও সুদর্শন অবয়বও নজর কেড়েছে অনেকের। আমেরিকার খ্যতিমান ও জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ভোগ এর কভার ম্যান হিসাবেও
এসেছেন তিনি। ভোগ ম্যাগাজিনের কভারে সাধারণত মুভি স্টার বা ফ্যাশন স্টারদেরকে আনা হয়। কিন্তু জাস্টিন ট্রুডোর বেলা সেই রীতি ভঙ্গ করা হয়েছে। ভোগ ম্যাগাজিনে জাস্টিন ট্রুডোকে তারুন্যে ভরপুর ও আশাবাদী এক নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল।
কিন্তু দিনে দিনে সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এর মধ্যে অবশ্য গোটা পৃথিবী অভাবনীয় এক ঘটনার সাক্ষী হয়। সেটি হলো কভিড-১৯ বা করোনা মহামারী। গোটা পৃথিবীর অর্থনীতি এক বড় রকমের ধাক্কা খায় সেই মাহামারীর কারণে। অর্থনীতিতে দেখা দেয় মহামন্দা। সেই মহামন্দার ধাক্কা খায় কানাডাও। তবে জাস্টিন ট্রুডো সেই যাত্রায় দেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যান। সে কারণে কানাডিয়ানরা তাকে সেরা নেতা হিসাবে বিবেচনা করছিলেন তখন। দি কানাডিয়ান প্রেস-এ তখন এই তথ্য প্রকাশ পেয়েছিল। জরিপে অংশ নেওয়া ভোটাররা তখন ট্রুডোকে বেশ বড় ব্যবধানে অন্যতম দৃঢ়সংকল্প, বুদ্ধিদীপ্ত ও ক্যারিশম্যাটিক নেতা এবং সবচেয়ে সেরা যোগাযোগকারী ব্যক্তিত্ব হিসাবে বর্ণনা করেন। তাকে তখন দেখা হয় অন্যতম যত্নশীল এবং দরদী মানুষ হিসাবেও।
তবে রাজনীতি বড়ই বিচিত্র জিনিষ। সেই দৃঢ়সংকল্প, বুদ্ধিদীপ্ত, ক্যারিশম্যাটিক ও দরদী মানুষটা এখন আর বেশীর ভাগ কানাডিয়ানের পছন্দের তালিকায় নেই। আগামী বছর ২০ অক্টোবর কানাডার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সেদিন কানাডিয়ানরা তাদের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে কাকে বেছে নিবেন তা দেখার জন্য আরো প্রায় এক বছরের কিছুটা বেশী সময় অপেক্ষা করতে হবে। চলতি জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান Ipsos এর সর্বশেষ জরিপে দেখা যাচ্ছে এই মুহুর্তে যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তবে প্রধান বিরোধী দল কনজার্ভেটিভ পার্টি পাবে ৪২% ভোট যা হবে অভিভূত করার মত জয়। অন্যদিকে জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বাধিক লিবারেল পার্টি পাবে মাত্র ২৪% ভোট।
তবে শেষ পর্যন্ত আসলে কি হয় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ২০২৫ সালের ২০ অক্টোবর পর্যন্ত। আর মনে রাখতে হবে – জরিপের ভবিষ্যতবাণী সবসময় সঠিক হয় না।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ