শুচিতা

নজরুল ইসলাম

(কানাডার দৈনন্দিন বাস্তবতার দিকে লক্ষ্য রেখে কাল্পনিক এই উপন্যাস ‘শুচিতা’। লিখেছেন কানাডা প্রবাসী নজরুল ইসলাম।

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মানস এযাবৎ মন্ট্রিয়েল কোনো কাজের ব্যবস্থা করতে পারেনি। সে প্রতি সপ্তাহ শেষে কাজ করে অটোয়া থেকে বাসে মন্ট্রিয়েল গিয়ে নিমির সঙ্গে দুই দিন থেকে চলে আসে। আবার কখনো নিমি অটোয়া এসে প্রিয়ব্রত, অদিতি ও নিলয়কে দেখে যায়। নিলয় গ্রেড ফোরের ছাত্র; আজকাল নিজে নিজে স্কুলে যায় এবং ৪টার দিকে স্কুল থেকে বাসায় এসে প্রিয়ব্রত ও অদিতির জন্য অপেক্ষা করে।

এক বিকেলে মানস প্রিয়ব্রতের বাসায় এসে বলে, দেশ থেকে মা-বাবা বারবার নিমিকে নিয়ে গিয়ে ঘুরে আসতে বলছে। অদিতি বলে, তোমরা ইচ্ছা করলে যেতে পারো, বাবার খোঁজখবর আমরা রাখছি, এ নিয়ে তোমাদের ভাবনার কিছু নেই; তবে বাবাকে পাওয়া গেলে যে করে হোক ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দেব। ইন্ডিয়া মানসিক রোগীর ভালো চিকিৎসা আছে, তা ছাড়া ওখানে দেখাশোনার লোক আছে। নিমি বলে, ইন্ডিয়া আমাদের জানাশোনা কেউ আছে বলে জানি না। আমরা এখানে থাকি, এ নিয়ে আরও বেশি ভাবনা হবে। প্রিয়ব্রত বলে, বাবাকে পাওয়া গেলে সে দেখা যাবে।

নিমি মানসকে বলে, ঠিক আছে চলো এই শীতে ইন্ডিয়া গিয়ে ঘুরে আসি। নিমি ও মানস কেনাকাটা করে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি টিকিট কেটে ইন্ডিয়া চলে যায়। ওরা আমিরাতের প্লেনে লন্ডন গিয়ে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসে দিল্লি এয়ারপোর্ট পৌঁছে। দিল্লি থেকে কলকাতা দমদম এয়ারপোর্টে পৌঁছে বাইরে এসেই মানসের মা-বাবা ও ভাইবোনকে পেয়ে সবাই আনন্দে মেতে ওঠে। ওরা ট্যাক্সি নিয়ে নিজেদের বাড়ি পৌঁছে। বাড়ির ও গ্রামের মানুষ মানসকে বহুদিন পর পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। সবাই বলে, তুমি বহু বছর পর আমাদের দেখতে এসেছ। এই গ্রামে প্রথম মানসই বিদেশে পড়াশোনার জন্য গিয়েছে।

গ্রামে মানস নিমিকে নিয়ে আসার পর পুরা নাটক পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। মানস কানাডা যাওয়ার আগে গ্রামে বিয়ে করেছে। নিমি বিয়ের আগে জানেনি বা মানস কিছু বলেনি। ওর বাবা রথীন্দ্রের আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায়, ওদের গ্রামের এক বিত্তশালী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার মেয়ে সবিতাকে বিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে তাকে টাকা খরচ করে পড়াশোনার জন্য কানাডা পাঠায়। কিন্তু কানাডা আসার পর সে ওই বিয়ে ভেঙে দিয়ে টাকা ফেরত দিয়ে দিতে চাইলে ওরা শত্রু হয়ে দেখা দেয় এবং গ্রামে তার বাবা-মা এবং ভাইবোনের ওপর নানাভাবে নির্যাতন চালায়। মানস দেশে গিয়ে লোকজন নিয়ে এর মীমাংসা করে ঋণের টাকা সুদসহ দিতে চাইলে ওরা মারমুখী হয়ে ওঠে। মানস বিয়ে ভেঙে দিলেও সবিতা এখনো কপালে সিঁদুর দিয়ে চলে এবং বলে, আমার বিয়ে একবারই হয়েছে মানসের সঙ্গে এবং আর বিয়ে করব না। নিমি গ্রামে এসব জানতে পেরে বলে, তোমাদের গ্রামে আমাদের থাকা কি নিরাপদ?

মানস এর কোনো গুরুত্ব না দিয়ে বলে এতে কিছুই হবে না; তুমি অযথা ভয় করছ। নিমি এ ব্যাপারে কিছু বলছে না এবং মনে করছে এখানে মানসকে কিছু বলতে যাওয়া ঠিক হবে না। সারা বাড়ি লোকে লোকারণ্য যেন যেকোনো মুহূর্তে একটা সংঘর্ষ বেধে যাবে।

এই পরিস্থিতিতে মানসের কিছু আত্মীয় এসে নিমি ও মানসকে লুকিয়ে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে বলে, তোমরা কলকাতা চলে যাও। নিমি কলকাতা তার এক আত্মীয়ের বাসায় উঠে ওদের এই সমস্যা জানায়।

নিমির আত্মীয় এই সমস্যা জেনে বলে, তোমাদের কলকাতা থাকা নিরাপদ না; বরং দিল্লি আমাদের এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে থাকো। ওরা দিল্লি আসার পর গ্রামের বাড়িতে বা কলকাতা ভয়ে ফেরত যায়নি।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তার ছেলেরা মানসকে না পেয়ে মানসের আত্মীয়ের যে যেখানে আছে, খোঁজ নিয়ে মানসকে বের করতে চেষ্টা করে। মানস দুই সপ্তাহ দিল্লি থাকার পর নিমিকে কানাডা পাঠিয়ে দিয়ে বলে, আমি মা-বাবার একটা ব্যবস্থা না করে যেতে পারি না। মানস দিল্লি এয়ারপোর্টে নিমিকে বিদায় দিতে গিয়ে মনের দুঃখে কেঁদে বলে, এ ভুলের জন্য আমার দরিদ্রতা একমাত্র দায়ী। আর্থিক সাহায্যের জন্য আমি সবিতাকে বিয়ে করলেও তাকে ভালোবাসতে পারিনি এবং তাকে বিদায় করতে গিয়ে তোমাকে বিয়ে করতে দেরি করেছি। তুমি বারবার আমাকে বিয়ে করতে দেরি কেন করেছি এ নিয়ে অভিযোগ করলে আমি তার সঠিক জবাব দিতে পারিনি। নিমি কোনো কথার জবাব না দিয়ে বলে, তুমি ভালো থেকো এবং আমি তোমার খোঁজ নেব।

মানস এ অবস্থায় কোর্টের শরণাপন্ন হয় এবং দেবেন্দ্রনাথ ও তার ছেলেদের বিরুদ্ধে কোর্টে কেস করে যে ওরা তার বাবার বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। অপরদিকে দেবেন্দ্রনাথ ও তার ছেলেরা সবিতাকে নিয়ে মানসের বিরুদ্ধে কেস দিয়ে ওর নিকট থেকে কোর্ট কর্তৃক পাসপোর্ট আটক করে। সবিতা মানসকে তার স্বামী বলে স্বীকার করে এবং কোর্টে গিয়ে কেস শেষ না হওয়া পর্য্যন্ত দেশ ত্যাগ করতে কোর্টের প্রতি অনুরোধ করে। মানসকে কোর্ট আসামি হিসেবে এরেস্ট করে, যেকোনো মুহূর্তে দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারে।

নিমি কাউকে কিছু না বলে অটোয়া এয়ারপোর্ট এসে ট্যাক্সি নিয়ে প্রিয়ব্রতের বাসায় ওঠে। নিমি ও মানসের দুই মাস ইন্ডিয়া থাকার কথা। কিন্তু হঠাৎ করে চলে আসায় বাসার সবাই হকচকিয়ে যায়। তারা বলে, মানস আসেনি?

ও কিছুই বলছে না, চোখের পানি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে কেঁদে অদিতিকে জড়িয়ে ধরে। নিজেকে সামলিয়ে বলে, মানসের আসতে দেরি হবে। ওদের গ্রামের বাড়িতে কে বা কারা শত্রুতা করে রাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। মানস আমাকে নিয়ে কলকাতা এবং শেষে দিল্লি এসে রিটার্ন বুকিং দিয়ে পাঠিয়েছে। ও এসব ঝামেলা মিটিয়ে কবে আসবে বলতে পারছি না। অদিতি বলে, মানস সবকিছু লুকিয়ে রেখে তোমাকে বিয়ে করা এক হঠকারিতা এবং তার অন্যায়ের শাস্তি হওয়া উচিত। প্রিয়ব্রত বলে, আমি ওকে এ ধরনের লোক হিসেবে মনে করিনি।

নিমি পরদিন কলকাতায় তার আত্মীয়ের বাসায় টেলিফোন করে শুনেছে যে মানসকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জেলে আটক করা হয়েছে। ওকে ওর মা-বাবা জামিনে নেওয়ার জন্য চেষ্টা করতেছে।

সবিতা বাদী হয়ে ওর স্বামীর নামে কেস করেছে যে মানস তার বাবার নিকট থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে তাকে বিয়ে করে কানাডা গিয়েছে। কানাডা গিয়ে সে তার বাবা-মা ও ভাইদের কাছ থেকে পড়াশোনার নাম করে চাপ দিয়ে কয়েক লাখ টাকা নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে ওকে বিয়ে ভাঙার নোটিশ দিয়েছে। সবিতার পক্ষের উকিল বলে, এটা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কোর্ট মানসকে জামিন না দিয়ে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেয়।

অদিতি ও প্রিয়ব্রত ইন্ডিয়ায় কী সমস্যা হয়েছে শুনে বলে, তুমি নিজের জীবন নিয়ে চলে এসেছ, এটা ভগবানের কৃপা। তুমি সবকিছু আমাদের খুলে বলো, তবে মানসকে আমরা এ পরিস্থিতে কোনো সাহায্য করতে রাজি না।

নিমি বলে, দাদা, আমি এ মুহূর্তে তোমাকে আর কিছু বলতে পারছি না। ঠিক আছে তুমি শান্ত হয়ে আমাকে পরে সবকিছু খুলে বলবে। এদিকে বাবা ললিতের কোনো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

নিমি কলকাতা মানসের আত্মীয় অনির সঙ্গে টেলিফনে করে বলে, আমি ভালোভাবে পৌঁছেছি। মানসের খোঁজখবর নিয়ে বলে, আমি একটা অনুরোধ করব যদি কিছু না মনে করো আমাকে মানসের স্ত্রী সবিতার টেলিফোন নম্বর সংগ্রহ করে দিতে পারবে কি?

ওর টেলিফোন নম্বর দিয়ে তুমি কী করবে?

আমি ওর সঙ্গে কথা বলে দেখি কীভাবে এর মীমাংসা করা যায়। ঠিক আছে আমি দেখব যদি সংগ্রহ করতে পারি তোমাকে জানাব।

সবিতা তার মোবাইল নম্বর নিমিকে দিয়েছে তার সঙ্গে কথা বলার জন্য। নিমি টেলিফোন করে বলে, আমি অটোয়া, কানাডা থেকে মানসের স্ত্রী নিমি কথা বলছি। সবিতা বলে, আমি মানসের স্ত্রী এবং আমি তোমাকে চিনি না। তুমি কীভাবে বিয়ে করো আমার স্বামীকে?

নিমি বলে, মানস বিয়ের আগে তোমাকে বিয়ে করেছে বলে আমাকে জানিয়েছে এবং আইন মতে বিবাহবিচ্ছেদ করেছে। সবিতা বলে, হিন্দু ধর্ম মতে স্বামী-স্ত্রী জীবিত থাকতে আর কোনো বিয়ে করতে পারে না। তুমি আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করে ধর্মমতে ভুল করেছ। নিমি বলে, ধর্ম সম্পর্কে আমার ভালো জ্ঞান নেই। মানস বর্তমানে জেলে আছে এবং ইন্ডিয়ান আইন অনুসারে তার বিচার হবে। তুমি যদি কিছু বলতে চাও কোর্টে গিয়ে বলবে। মানস আমার স্বামী, তুমি জেনেশুনে মানসকে বিয়ে করেছ; হিন্দু ধর্ম মতে, দুই বিয়ে একসঙ্গে হয় না। তোমাকে মানস বিয়ে করলেও এ বিয়ে ধর্মমতে এবং আইনের চোখে টিকবে না।

নিমি অনিকে টেলিফোন করে বলে, আমি কি মানসের উকিলের সঙ্গে কথা বলতে পারি। অনি বলে, আমি উকিলের সঙ্গে কথা বলে ওর টেলিফোন নম্বর নিয়ে দেব। অনি টেলিফোন নম্বর ব্যবস্থা করে দিয়ে বলে, নিমি, তুমি উকিলের সঙ্গে কথা বলতে পারো। পরদিন নিমি টেলিফোন করে উকিলকে বলে, মানসের কেসের কী অবস্থা?

উকিল বলে, ওর কেস আগামী মাসের ১৫ তারিখ সকাল ১০টা বাজে কোর্টে উঠবে। তুমি কি উপস্থিত থাকতে পারবে?

নিমি বলে, আমি কানাডা, কীভাবে সম্ভব?

উকিল বলে, না থাকলে তোমার বিয়ের কাগজ কুরিয়ার সার্ভিসে আমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবে এবং আমি কোর্টে জমা দেব। নিমি দুই দিন পর বিয়ের দলিল কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিয়ে বলে, আমি আসতে পারব না।

বাসায় অদিতি ও প্রিয়ব্রত বলে, মানস একটা লম্পট যে তোমার জীবন ধ্বংস করেছে তার কথা মাথা থেকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কী আছে। সে দেশে বিয়ে করে অন্যের টাকায় বিদেশে এসে পড়াশোনা করে কীভাবে অমানুষের মতো তার বিবাহিত স্ত্রীকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। তাকে তুমি কোনো অবস্থাতেই বিশ্বাস করতে পারো না। সে গ্রামের একটা অবলা মেয়েকে বিয়ে করেছে এবং তার পরিবার নিজের সর্বস্ব তার পেছনে খরচ করেছে। এখন সে জেলে আছে এবং তার স্ত্রী ও লোকজন কোনো দিন তাকে ছেড়ে দেবে না। তার নির্ঘাত শাস্তি হবে। নিমি কোনো কিছুই শুনতে চায় না এবং বলে, তোমরা আমাকে এ-সম্পর্কে কিছুই বলবে না।

নিমি এক সপ্তাহ বাসায় থেকে পুনরায় কাজে যোগদান করেছে এবং তার পুরোনো বন্ধু নাহিদকে টেলিফোনে বলেছে, আমি ইন্ডিয়া থেকে ফিরে এসেছি। নাহিদ সবকিছু শুনে বলে, আমি মানসকে এ ধরনের প্রতারক বলে মনে করিনি। সে তোমাকে কিছুই বলেনি তার অতীত বিয়ে নিয়ে! নিমি বলে, আমি এ-সম্পর্কে কিছুই জানি না। তবে সে আমাকে তিন বছর ঘুরিয়েছে এই বলে যে দেশে তার অনেক ঋণ আছে, যা আগে পরিশোধ করা দরকার। আমি এখন যা বুঝতে পারলাম, ওদের ঋণ শোধ করা দরকার, সে জন্য বিয়ে করতে দেরি করেছে। তা ছাড়া সে তার স্ত্রী সবিতাকে ডিভোর্স দিয়ে কাগজ পাঠিয়ে ওই দিক পরিষ্কার করতে সময় নিয়েছে।

নিমি বলে, আমি মানসকে নিয়ে ওদের গ্রামে গেলে এ নিয়ে লোকদের মধ্যে অনেক সমালোচনার মুখে পড়ি। লোকজন আমাকে সরাসরি বলে, তুমি কি তার আগের বিয়ে সম্পর্কে কিছুই জানতে না?

আমি বলেছি যে আমি জেনে শুনে বিয়ে করেছি; যদিও আমি ওর আগের বিয়ের কিছুই জানিনে। আমি মানসকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে কলকাতা চলে এসে জীবন রক্ষা করি। কলকাতার ঠিকানা কেউ জানতে পারে যে জন্য আমরা ভয়ে দিল্লি চলে আসি। আমি মানসকে বলেছিলাম একত্রে কানাডা চলে আসার জন্য। চলে এলে ওকে আজ কেস বা জেলে যাইতে হতো না এবং তার মা-বাবা কোনোপ্রকার নিজেদের সামলিয়ে নিতে পারত। কিন্তু সে বলে, তুমি চলে যাও, আমি এর একটা কিছু মীমাংসা করে চলে আসব।

পরের সপ্তাহে শুচিতা এবং নাহিদ মন্ট্রিয়েলে নিমিকে দেখতে আসে। ওরা আসার পর নিমি ওদের নিয়ে বাইরে ঘুরতে গিয়ে কিছু বাজার করে খেয়েদেয়ে বাসায় এসে তার ইন্ডিয়া ভ্রমণের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলে, মানসের মা-বাবা আমাদের দেখে অনেক ভয় পেয়ে বলেছিল যে তোমরা গ্রামের বাড়িতে থাকতে পারবে না। মানস বলে, আমি সবিতাকে ডিভোর্স দিয়েছি, ওদের কাছ থেকে যা ঋণ করেছি আলাপ করে দিয়ে দিলেই হবে। কিন্তু পরিস্থিতি এত ঘোলাটে হয়ে পড়েছে যে সবিতার ভাই ও আত্মীয়রা এসে মারমুখী হয়ে আক্রমণ করে। আমি ভয়ে কাঁদতে থাকি এবং বাড়ির কিছু লোক এসে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, তোমার তো কোনো অপরাধ নেই, তুমি শান্ত থাকো। আমরা বাড়ির লোকজন দেখব। এই পরিস্থিতিতে মানসের কিছু কিছু আত্মীয় এসে আমি ও মানসকে লুকিয়ে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে বলে, তোমরা কলকাতা চলে যাও। শুচিতা ও নাহিদ হতভম্ভ হয়ে নিমির চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে!

উইকেন্ডে প্রদীপ বলে, শুচিতা, চলো ধ্রুবকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি। প্রিতম ও আভা বলে, সুমিতকে এক মাসের মতো হলো দেখতে যাওয়া হয়নি। যদি পারো একবার ঘুরে এসো। ওরা শপিং মলে গিয়ে এটা-সেটা কেনাকাটা করে এক রেস্টুরেন্টে গিয়ে ধ্রুবকে নিয়ে খেয়ে বলে, চলো সুমিতকে একটু দেখে আসি। শুচিতা রেস্টুরেন্ট থেকে সুমিতের জন্য একটু খাবার নিয়ে বিল্ডিঙের পার্কিং লটে গিয়ে বলে, প্রদীপ, তুমি অপেক্ষা করো আমি ধ্রুবকে নিয়ে গিয়ে দেখে আসি। প্রদীপ বলে, ঠিক আছে।

শুচিতা ধ্রুবকে নিয়ে এলিভেটর দিয়ে ওদের ফ্লোরে গিয়ে দরজা নক করতেই আরতি এসে দরজা খোলে। সে প্রণাম জানিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখে সুমিত হুইল চেয়ারে বসে আছে। শুচিতা হাতের খাবার ডাইনিং টেবিলে রেখে বলে, সুমিত, তুমি কেমন আছ?

এই তো কোনো রকম। ধ্রুব বলে, প্রদীপ আংকেল আমাদের নিয়ে এসেছে। সুমিত বলে, ও কোথায়?

শুচিতা বলে ও গাড়িতে অপেক্ষা করছে, আমরা বেশিক্ষণ থাকব না, সে জন্য ওপরে আসেনি। সুমিত রেগে চিৎকার করে বলে, তুমি কি ওকে ছাড়া চলতে পারো না, বাস্টার্ড?

শুচিতা চিৎকার করে বলে, ও আমার কাজিন। সুমিত, আমি তোমাকে দেখতে এসেছি, তুমি আমাকে বাস্টার্ড বলে গালি দিলে?

হ্যাঁ, তুমি রাত দিন ওর সঙ্গে থাকো, এদিকে আমার সঙ্গেও সম্পর্ক রাখতে চাও। শুচিতা খেপে গিয়ে চিৎকার করে বলে, তুমি একটা নীচ। সুমিত রেগে তার হাতের লাঠি দিয়ে শুচিতার মাথায় আঘাত করে এবং শুচিতা সঙ্গে সঙ্গে ফ্লোরে পড়ে যায়। ওর মাথা থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়। শুচিতা জোরে চিৎকার করতে থাকে।

সুমিতের বাবা কমল নিরুপায় হয়ে কানাডার নিয়ম অনুযায়ী ৯১১ অ্যাম্বুলেন্স কল দিলে সঙ্গে সঙ্গে ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্স এসে দেখে শুচিতার রক্তমাখা চেহারা, ফ্লোরে পড়ে আছে এবং পাশে ধ্রুব মা মা বলে চিৎকার করে কান্না করছে। পুলিশ সুমিতকে হাতকড়া দিয়ে পুলিশ হেফাজতে এবং শুচিতাকে অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ধ্রুব চিৎকার করে প্রদীপকে বলে, আংকেল, মা মা!

প্রদীপের দুই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, ধ্রুবকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে। পুলিশ প্রদীপকে বলে, তুমি এই বাচ্চা ছেলেকে সামলাও। প্রদীপ হাসপাতাল থেকে প্রিতমকে কল দিয়ে কেঁদে বলে, আংকেল শুচিতা হাসপাতালে, আবেগে আর কিছুই বলতে পারছে না। প্রিতম ও আভা হাসপাতালে এসে শুচিতার রক্তমাখা চেহারা দেখে আর্তনাদ করে বলে, আমরা তোমার এ অবস্থা দেখতে বেঁচে আছি? (সমাপ্ত)