”Small Town”

সালাহ উদ্দিন শৈবাল

আমার নিজের একটা লেখা আমি নিজেই বারবার পড়ি। বারবার পড়ি। কেউ লেখা চাইলে শুধু এটাই দেই! এই লেখার উপর আমার অন্যায় পক্ষপাত আছে। তাই আজো পড়লাম আর মনে হলো আবার শেয়ার করি। কথা দিতে পারছি না যে আর ভবিষ্যতে শেয়ার করবো না!!

ছোট মফস্বল শহর। একটাই মেইন রোড। তার দুইপাশে কিছু দোকান-পাট। চায়ের দোকান। বাজার। দুপুরে বেশির ভাগ দোকান বন্ধ হয়ে যায়। দোকানীরা দোকান বন্ধ করে বাসায় খেতে যায়। গোসল করে। একটু বিছানায় গড়িয়ে নেয়। বিকেলে রোদ পড়ে এলে আবার দোকান শুরু করে।

একটা-দুটো স্কুল। ছেলেদের। মেয়েদের। একটা কলেজ। একটা বাস-স্ট্যান্ড। রেল ষ্টেশন। দিনে ২-৩ টা গাড়ী হয়তো থামে। বাকি সময় ঝিমোয়।

পাশে একটা নদী। বর্ষাতে পানি আসে। শীত কালে হেঁটে পার হওয়া যায়। নদীর এপারেই ‘শহর’ শেষ। ওপার থেকে গ্রাম শুরু….আদিগন্ত ধানের ক্ষেত…বিছিয়ে আছে….অনেক দুরে..অ-নে-ক দুরে আকাশের সঙ্গে মিশেছে।

এই তো বাংলাদেশের মফস্বল শহর। ছোট শহর।

স্কুল পাশের পর পর অনেকে এলাকা ছাঁড়তে শুরু করে। কলেজ পাশের পর চলে যাওয়া বাড়তে থাকে। ছোট্ট শহর সবাইকে আগলে রাখতে পারে না। ভালো কলেজে পড়া দিয়ে শুরু হয়…তারপর বিশ্ববিদ্যালয়…ডাক্তার…ইঞ্জিনিয়ার….। কেউ অন্য কিছু হতে চায়। কবি..শিল্পী..। বড় শহরেই যেতে হয়। ঢাকায় যেতে হয়।

কিছু মানুষ ঘর ছাঁড়ে। কিছু মানুষ থেকে যায়। কিছু মানুষ ছেঁড়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে। হয়তো সব কিছু মেলে না। মেলাতে ভালো লাগে না।

মফস্বলের উৎসবগুলো তাই অন্য রকম। ঈদের ২/৩ তিন আগে থেকে শুরু হবে প্রতিক্ষা। ছেঁড়ে যাওয়া মানুষগুলো ফিরবে। কয়েক দিনের জন্য। প্রতিটা ট্রেনের জন্য প্রতিক্ষা। প্রতিটা বাসের জন্য প্রতিক্ষা। ব্যাগ হাতে ঘর্মাক্ত মানুষ। এসেই হাঁক দিবে..”গোসলের পানি দাও মা….গাড়ীতে ভীড়…গরম…রাস্তায় ধুলা…আসতে জান বেরিয়ে যায়…”। বাড়ীর সবাই ব্যস্ত হয়ে যাবে। বাকি কটা দিন সবাই ভান করতে থাকবে…এ বাসা ছেঁড়ে কেউ কখনো চলে যায় নি। সব ঠিক আছে। আগের মতোই আছে।

কানাডায় আমি টরন্টো শহরে থাকি। অনেক বড় শহর। বিশাল শহর। থাকতে ভালোই লাগে। কিন্তু সুযোগ পেলেই দুম করে বেরিয়ে যাই। মফস্বলের ছেলে আমি। হাইওয়ে ধরে ঘন্টা দুয়েক গাড়ী চালালেই শহর শেষ হয়ে যায়। খোলা মাঠ। ফার্ম হাউজ। গাছ-পালা…বনভুমি…মাঝে মাঝে লোকালয়! কানাডার ছোট শহর। অনেক সময় খুবই ছোট। এতো ছোটো যে এরা বলে Hamlets। মানে ‘পাড়া’ বা ‘মহল্লা’।

কানাডার ছোট শহর। অনেক সময় খুবই ছোট। এতো ছোটো যে এরা বলে Hamlets. ছবি:আইস্টক

বেশির ভাগ এক রাস্তার শহর। মেইন রাস্তা একটাই। দুই পাশে দোকান-পাট। কয়েকটা লাল ইটের পুরনো বিল্ডিং। সেই সতেরোশো -আঠারোশো শতকের। যখন শে^তাঙ্গরা প্রথম এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছিলো। মেইন রাস্তার থেকে একটু ডানে-বামে ছোট ছোট রাস্তায় ঢুকে গেলে আবাসিক এলাকা। সুন্দর সুন্দর বাড়ী। শহরের এক মাথায় একটা চার্চ…আর শেষ প্রান্তে একটা কবরস্থান। খোলা জায়গায়। রাস্তা থেকে সারি সারি কবরের ফলক দেখা যায়। সাজানো বাগান মাঝে মাঝে। কোন কোন কবরে ফুল রাখা। থমকে দাঁড়াতে হয়। বেঁচে থাকা মানুষেরা তাদের চলে যাওয়া প্রিয়জনদের শহরেই রেখেছে। নিজেদের কাছেই রেখেছে।

দিনের রোদ শেষ হচ্ছে। বউ-বাচ্চা নিয়ে ঘুরছিলাম। হাইওয়ের পাশেই ছোট্ট শহরটা নজড়ে পড়লো। কফি খাওয়া দরকার। গাড়ী পার্কিংয়ে রেখে একটা কফিশপ খুঁজে বের করলাম। “Anne’s Café”। এই সব শহরেরে বেশির ভাগ দোকান-পাট পারিবারিক ব্যবসা। ফ্যামিলি মিলে চালায়। ঘরেই খাবার তৈরি করে। হোম মেইড।

ক্যাফে খালি। কাউন্টারে একজন বয়স্ক মহিলা আমাদের দেখে হাসিমুখে সম্ভাষণ জানালো। আমি জানি এইসব দোকানের একটা/দুটো স্পেশাল আইটেম থাকে। সিগনেচার আইটেম।

“Anne’s Café এর পপুলার আইটেম জিজ্ঞেস করলে কোনটা সাজেষ্ট করবে?”

মহিলা হেসে দিলো। “আমি অ্যান। আমাদের সবই ফ্রেশ। তুমি Sticky Toffee Pudding Cake টা ট্রাই করতে পারো।“

কেক আর কফি অর্ডার করতে করতেই একটা আঠারো/বিশ বছরের তরুণী এসে দোকানে ঢুকলো। মহিলার সংগে চোখাচোখি হল। কথা হলো না। কিংবা চোখে চোখে কথা হলো। আমাদের কথা হয়তো শুনেছে মেয়েটা। জানালার পাশের একটা টেবিল পরিষ্কার করে আমাদের বসতে বললো। বুঝলাম এই মেয়েটিও মালিক পক্ষ।

কিছুক্ষণ পর তরুণী কেক আর কফি রেখে গেলো। তারপর দুজনে দোকান গোছাতে শুরু করলো। বোঝা গেলো দিনের মতো ব্যবসা শেষ। এখন দোকান বন্ধ করা হবে। সবে সন্ধ্যা হচ্ছে আর দোকান বন্ধ!

কৌতুহল হলো। মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কয়টায় দোকান বন্ধ করো? সন্ধ্যায় খোলা থাকে না?”

মহিলা হাতে একটা কফি নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো।

“দিনের শেষ কফিটা তোমাদের সঙ্গে খাই। বসতে পারি?”

“শিওর!“ গল্পের সন্ধান পেলে আমার আবার মাথা খারাপ হয়ে যায়। মেয়েটা বাকি টেবিল-চেয়ার গুছিয়ে রেখে ফ্লোর পরিষ্কার শুরু করলো।

“বিকেলের পর আর কাষ্টমার আসে না। পাঁচটা..বড়-জোর ছয়টা দোকান বন্ধ করে দেই। ছোট্ট শহর। এরপর খুব কম মানুষই বাইরে থাকে। সবাই ঘরে ফিরে যায়। বাইরে থেকেও কেউ আসে না। আমি আর আমার মেয়ে সিডনী। আমাদেরও বাড়ী ফেরা দরকার। আমার স্বামী আর্থার হয়তো এতোক্ষনে কালকের কেনাকাটা শেষে এজাক্স থেকে বাড়ী ফিরে গেছে। ছোট শহরগুলোর ব্যবসা এই রকমই। তোমরা কোথা থেকে? বেড়াতে?“

“আমরা টরন্টো থেকে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। ছোট শহর আমার খুব ভালো লাগে। তাই সুযোগ পেলেই থামি।“

মহিলার চোখ চক চক করে উঠলো, “ভালো লাগে? কেন?”

“আমি ছোট শহরের ছেলে। বাংলাদেশ থেকে এসেছি। ঢিলে-ঢালা জীবন…সিম্পল জীবন আমার দেখতে ভালো লাগে।“

অ্যান হেসে দিলো। হাসতে হাসতে বললো…“ওহ্‌..ভালো বলেছো। দেখতে ভালো লাগে। থাকতে ভালো লাগে না। হা..হা…আমার ছেলে মরিস…বছর দুয়েক টরন্টো চলে গেছে। আমরা চারজন মিলে এই ক্যাফেটা চালাতাম। এখন তিন জন আছি। তুমি জানোতো…কানাডার ছোট শহরগুলো দিন দিন আরো ছোট হয়ে যাচ্ছে। সেদিন একটা নিউজে পড়লাম..কানাডার বড় শহরে লোক সংখ্যা ১৫% বেড়েছে। কিন্তু ছোট শহরে প্রায় ৮% কমে গেছে। আসলে ছেলে-মেয়েরা এখানে থেকে করবেই বা কি বলো? ওদেরতো অনেক স্বপ্ন আছে। বিশ পার হলেই এলাকা ছেঁড়ে চলে যায়। মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে। তারপর একদিন সেটাও বন্ধ হয়ে যায়।“

অ্যান এর গলায় কিছু একটা ছিলো। আমি চট করে সিডনীর দিকে তাকালাম। সিডনী এক মনে ফ্লোর পরিষ্কার করছে। মাথা নিচু। সে তার চোখ দেখালো না।
কফি শেষ হলো। আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। ছোট শহরে সন্ধ্যা নামছে। দোকান-পাট প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তায় লোকজন কম। গাড়ীতে উঠতে ইচ্ছে হলো না। আমরা রাস্তার পাশের একটা বেঞ্চে বসলাম। বেশ বাতাস দিচ্ছে। ছন্দ তার জ্যাকেট টানতে টানতে বলল, “ইশ্‌ কি ঠান্ডা!” তারপর আমার দিকে ঘুরে বলল, “কি তোমার সরিষাবাড়ীর জন্য খারাপ লাগছে? আব্বা-আম্মার জন্য?”
আমি চুপ রইলাম। আসলে বোঝার চেষ্টা করলাম। তারপর আস্তে আস্তে বললাম, “God has prepared a path for everyone to follow”
“তোমার কথা?”
“আরে..নাহ্‌। আমি এতো সুন্দর লিখতে পারি না। Paulo Cohelho লিখেছেন The Alchemist উপন্যাসে। তাইতো ইংরেজিতেই বললাম।“
“আর কি লিখেছেন?”
“Don’t think about what you’ve left behind„.everything is written in the Soul of the World, and there it will stay forever.”
“মানে কি?”
হেসে দিয়ে বললাম, “মানে?…আমিও ঠিক জানি না।“
ছন্দ রেগে গেলো। “তাহলে বললে কেন?”
তার রাগ দেখে মজা লাগলো। বললাম, “ভালো লাগলো তাই বললাম। আমরা কি সব সময় জানি কোন গান কেন ভালো লাগে? কোন সুর? কোন কোন রাত কেনো ভালো লাগে? কোন কোন মানুষ? জানি না। কিন্তু ভালো লাগে। মন শান্ত হয়। মনে হয় এগুলো হৃদয়ের কথা। একেবারে ভেতরের কথা।“
ছন্দ চুপ করে রইলো।
আমি তাড়া দিলাম, “চলো..চলো..। অন্ধকার হয়ে গেছে। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। বাড়ী ফিরতে হবে।”

সালাহ উদ্দিন শৈবাল
টরন্টো