সময় এসেছে বাংলাদেশের কলুষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের

খুরশিদ আলম

ইতিহাসের শিক্ষা হলো একনায়কতন্ত্রের পতন একটা পর্যায়ে এসে অনিবার্য হয়ে উঠে। এবং শেষ পর্যন্ত পতন ঘটেও। ইটালির মহা ক্ষমতাধর কুখ্যাত একনায়ক মুসোলিনি এবং জার্মানীর মহা ক্ষমতাধর কুখ্যাত একনায়ক হিটলারের করুণ পরিণতির কথা বিশ্ব ইতিহাসে আজও এক জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে আছে। কিন্তু সমস্যা হলো এই ‘ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেন না, আর ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।’

দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও কথাটি প্রযোজ্য। আমরা দেখেছি স্বাধীনতার পর দেশের সবকটি রাজনৈতিক দলের প্রধানরাই ক্ষমতায় গিয়ে একনায়ক হয়ে উঠেছিলেন। ইতিহাসের শিক্ষা তাঁরা নেননি। তাঁদের মধ্যে দু’জনের পতন ঘটেছিল অত্যন্ত করুণভাবেই। তবে সৌভাগ্যক্রমে শেখ হাসিনার পরিণতি সেরকমভাবে হয়নি। কিন্তু যে ভাবে হয়েছে সেটা বেশ লজ্জাজনকভাবেই হয়েছে। ক্ষমতা ছেড়ে তাঁকে দেশ থেকে পালাতে হলো। বাংলাদেশের ইতিহাসে ইতিপূর্বে আর কোন স্বৈরশাসককে এভাবে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়নি।  

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল পরাধীনতার কবল থেকে মুক্ত হয়ে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ, সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার স্বপ্ন নিয়ে। সাম্যবাদেরও স্বপ্ন ছিল সেদিনের মুক্তিকামী মানুষের।

কিন্তু একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর আমাদের সেই সব স্বপ্ন কোনটাই আর বাস্তবতার মুখ দেখলো না। সাময়িকভাবে কখনো কখনো কিছুটা আলোর মুখ দেখলেও তা নিভে যেতে সময় লাগেনি।

আন্দোলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের একাংশ। ছবি : বিবিসি

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্বও একসময় ছিনতাই হয়ে গেল। অথচ এই মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার, আলবদর আর আলশামস ছাড়া প্রতিটি বাঙ্গালীর অবদান রয়েছে। সবচেয়ে বেশী অবদান রয়েছে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের। তাঁরা অস্ত্র ছাড়া যুদ্ধ করেছেন হানাদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে। বিপদ হতে পারে জেনেও আশ্রয় দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। খাবার সরবরাহ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। এই জনতার সহযোগিতা ও ছত্রচ্ছায়া না পেলে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করতে পারতেন না বাংলায়?

এরকম একটি যুদ্ধে নেতৃত্ব যেমন প্রয়োজন ছিল তারচেয়ে বেশী প্রয়োজন ছিল সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা। এখানে কারও ভূমিকাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য বাংলার সাধারণ মানুষের। তাঁদের অবদানের কোন স্বীকৃতি আজও কেউ দিল না। স্বীকৃতি এককভাবে শুধুমাত্র একজনের হয়ে গেল!

গত প্রায় এক মাস ধরে কোটা বিরোধী সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল। আন্দোলনরত এই ছাত্রদের প্রতি সংহতি জানিয়েছিলেন দেশের সাধারণ মানুষও। ফলে এটি হয়ে উঠেছিল একটি  গণআন্দোলন। কিন্তু এই গণআন্দোলনতো এক রাতেই শুরু হয়ে যায়নি। বহুদিনের সঞ্চিত ক্ষোভ থেকেই সাধারণ মানুষ রাজপথে নেমেছিলেন। সমর্থন দিয়েছেন শিক্ষার্থীদের আন্দোন ও দাবীদাওয়াকে।

সাধারণ মানুষ স্বৈরশাসন ও শ্বৈরশাসককে পছন্দ করেন না। আজকে যাঁরা রাজপথে প্রধান বিরোধী দল, সেই বিএনপি-ও একসময় দেশে শ্বৈরশাসন চালিয়েছে। মানুষ ভুলে যায়নি তাঁদের সেই অপশাসনের কথা। আর আজকে যাঁরা সংসদে প্রধান বিরোধী দল তাঁরাও একসময় দেশে শ্বৈরশাসন চালিয়েছে। তাঁদের কথাও ভুলেনি মানুষ। দুর্ভাগ্যই দেশবাসীর এই কারণে যে, এই দুই দলের নেতা কর্মীরা আজ মুখে গণতন্ত্রের খৈ ফুটায়। গণতন্ত্রের খৈ ফুটিয়ে যাচ্ছিল সদ্য বিদায়ী স্বৈরাচারী সরকারও। আবার পাশাপাশি তাঁরা মানুষের মুখ বন্ধ করার জন্য দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেছিল। দেশের প্রতিটি প্রিন্ট ও টেলি মিডিয়া এতদিন স্বাধীন সাংবাদিকতা করতে পারছিল না। সুদীর্ঘ সময় ধরেই এই অবস্থা বিরাজ করছিল দেশে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও যাতে কেউ কোন প্রতিবাদ না করতে পারে সেজন্য যত ধরণের আইনী ব্যবস্থা নেয়া যায় তার সবকটিই করে রাখা হয়েছিল। এরাই আবার গণতন্ত্রের কথা বলে মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছিল।

আওয়ামী সরকার কার্যত দেশকে বিরোধীদল শূন্য করে ফেলেছিল। বিএনপি’কে বানিয়ে ফেলেছিল একটি পঙ্গু দল, জাতীয় পার্টিকে একটি গৃহপালিত দল। জামায়াতে ইসলামীকে দিন কয়েক আগে করেছিল নিষিদ্ধ। অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতাকারী কুখ্যাত এই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে একসময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সরকার বিরোধী আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগ!

এ কথা সবাই জানেন যে, শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া একটি দেশে সুষ্ঠ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। আর কলুষিত রাজনৈতিক পরিবেশে যখন কোন দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যখন কোন দল স্বৈরাচারী হয়ে উঠে তখন দেশে দুর্নীতি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পরে। তার প্রমাণ আমরা ইতিপূর্বের সরকারগুলোর আমলে দেখেছি। দেখলাম সদ্য বিদায়ী সরকারের আমলেও। দেশে প্রতিটি স্বৈরাচারী সরকারের আমলেই বিভিন্ন খাতে দূর্নীতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

আজকে আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় নেই। সেনাবাহিনী দায়িত্ব নিয়েছে। তাঁরা সবার সাথে আলোচনা করে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে শীঘ্রই নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।

কিন্ত এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, জনগণ কাকে ভোট দিবেন? দেশের প্রধান তিন দলের তিন শীর্ষ নেতাইতো ইতিপূর্বে প্রামাণ করে গেছেন তাঁরা ক্ষমতায় গেলেই স্বৈরশাসক হয়ে উঠেন। দুর্নীতিতে হয়ে ‍উঠে চ্যাম্পিয়ন। এবারের তত্ত্বাবধায়ক সরকার অচিরেই যে নির্বাচন দিবে তাতে এই তিন দলই আবার অংশ নিবে। অংশ নিবে জামায়াতও যারা বাংলাদেশ চায়নি একসময়। আজও তাঁরা তাদের ভুল স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চায়নি তাঁদের অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য।

তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়াচ্ছে? জনগণকে কি এই স্বৈরাচারীদেরই কাউকে আবার ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে হবে? আবারও দেশ রসাতলে যাবে? জনগণের বাক স্বাধীনতা হরণ করা হবে? কড়া সেন্সরশীপে চলবে দেশের সব মিডিয়া? দুর্নীতিতে ছেয়ে যাবে গোটা দেশ? সরকারের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে দেশের মানুষ ক্রমাগত শোষিত হতে থাকবেন? পাড়া- মহল্লায় নতুন করে কিশোর গ্যাং গড়ে তোলা হবে স্থানীয় এমপি বা কাউন্সিলরদের প্রভাব বিস্তারের জন্য? যাঁরা পুনরায় ক্ষমতায় আসবেন তাঁরা কি তাঁদের ছাত্র সংগঠনকে ( ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, জাতীয় ছাত্র সমাজ, ছাত্র শিবির) অবার পুনর্গঠিত করবেন সন্ত্রাস চালানোর জন্য। বিরোধী দলকে দমন করার জন্য?

অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, বাংলাদেশের কলুষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কোন উন্নতি ঘটবে না। হয়তো কোন দল পুনরায় ক্ষমতায় এসে সাময়িকভাবে ভদ্রবেশ ধরবে। কিন্তু পর্যায়ক্রমে তাঁরা আবারও সেই পুরোনো পথেই হাটবে।

তাই আজ খুব বেশী করে দরকার বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বদলানো। আর এটি পুরোনোদের দিয়ে হবে না। সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে। রাজনীতিতে তাই এখন প্রবলভাবে প্রয়োজন আলোকিত সেই মানুষদের যাঁরা সত্যিকারভাবে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হবেন, সহনশীল হবেন, অসাম্প্রাদায়িক হবেন, বিরোধী দল ও মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন, দুর্নীতির প্রতি জিরো টলারেন্স দেখাবেন, ‘আমি’ না বলে সবসময় ‘আমরা’ বলবেন, অহংকারী মনোভাব দেখাবেন না, পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করবেন না, দেশকে নিজের সম্পদ ভাববেন না এবং সর্বোপরি সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হবেন।

বাংলাদেশের বয়স অর্ধশতাব্দী পার হয়ে গেছে। মুক্তির এখন এই একটি পথই খোলা আছে। আজকে যেই তরুণরা দেশে দ্বিতীয় স্বাধীনতা এনেছে সেই তরুণদেরকেই এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে নতুন বাংলাদেশ গড়ার। যে দেশ হবে জনগণের। কোন ব্যক্তি বা পরিবারের নয়। জানি এটি রাতারাতি সম্ভব নয়। তবে প্রক্রিয়াটি এখন থেকেই শুরু করতে হবে।

আমরা অপেক্ষায় রইলাম সেই নতুন বাংলাদেশ দেখার।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ

টরন্টো