কানাডায় রেস্টুরেন্টে খেয়ে বছরে ২০ লাখ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন

জাতীয় পর্যায়ের চেইন রেস্টুরেন্টে পরিদর্শন, গুরুতর সীমালংঘনের পুনরাবৃত্তি উদ্ঘাটিত

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : জাতীয় পর্যায়ের চেইন রেস্টুরেন্টগুলোতে পরিচালিত জনস্বাস্থ্য পরিদর্শন রিপোর্টের ওপর কানাডার সবচেয়ে বড় বিশ্লে­ষণে প্রকাশ পেয়েছে যে, প্রতি চারটি পরিদর্শনের ক্ষেত্রে একটিতে অন্তত একটি করে গুরুতর সীমালংঘনের ঘটনা পাওয়া গেছে। ইতিপূর্বে সিবিসির মার্কেটপ্লে­স-এর এক অনুসন্ধানে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

গুরুতর সীমা লংঘনের মধ্যে রয়েছে অযথার্থ খাদ্য ব্যবস্থাপনা, হাত ধোয়ার ক্ষেত্রে অবহেলা এবং খাবার নিরাপদ তাপমাত্রায় সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা। এর ফলে জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। হেল্থ কানাডার তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার কারণে বছরে ২০ লাখ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন।

হেল্থ কানাডার তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার কারণে বছরে ২০ লাখ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ছবি: সংগৃহীত

মার্কেটপ্লে­স দেশের পাঁচটি শহরে – ভ্যাঙ্কুভার, ক্যালগেরি, রেজিনা, টরন্টো এবং অটোয়ায় জনস্বাস্থ্য বিভাগের রেস্টুরেন্ট পরিদর্শনের এক বছরের রিপোর্ট বিশ্লে­ষণ করেছে। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন পরিসংখ্যানবিদ ৫হাজার রিপোর্টের তথ্য বিশ্লে­ষণ করেন। এটি ছিলো দেশে এধরণের বৃহত্তম অনুসন্ধান।

টরন্টো জনস্বাস্থ্য বিভাগের ৩৬ বছর ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অবসরপ্রাপ্ত জনস্বাস্থ্য পরিদর্শক জিম চ্যান বলেন, ‘‘খাদ্য নিরাপত্তা একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জনগণের এ বিষয়ে জানার অধিকার রয়েছে যাতে তারা জেনেশুনে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’’

মার্কেটপ্লে­সের অনুসন্ধানে ১৩টি জাতীয় পর্যায়ের চেইন রেস্টুরেন্টের ওপর তথ্য বিশ্লে­ষণ করা হয়। এগুলির মধ্যে ছিলো ফাস্ট ফুড, ফ্যামিলি রেস্টুরেন্ট ও কফি শপ। অনুসন্ধানে যেসব ফাস্ট ফুডের চেইন রেস্টুরেন্ট অন্তর্ভুক্ত ছিলো তার মধ্যে রয়েছে কেএফসি, এঅ্যান্ডডব্লি­উ, সাবওয়ে, ওয়েনডি’স এবং ম্যাকডোনাল্ডস। ফ্যামিলি রেস্টুরেন্টের মধ্যে ছিলো পিজা হাট, সুইস শ্যালে, বস্টন পিজা, দি কেগ অ্যান্ড ম্যাক্সি’স এবং কফি শপের মধ্যে ছিলো স্টারবাকস, সেকেন্ড কাপ ও টিম হরটনস।

মার্কেটপ্লে­সের পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধানী রিপোর্ট ‘কানাডার রেস্টুরেন্টের গোপন তথ্য’ সিবিসি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। এতে অনুসন্ধানের ইতিহাসের ভিত্তিতে স্বতন্ত্র চেইন রেস্টুরেন্টগুলোকে বিভিন্ন র‌্যাঙ্ক দেয়া হয়।

বড় ধরণের সীমালংঘন চলছেই

মার্কেটপ্লে­স রেস্টুরেন্টগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি লংঘনের নানা ধরণের দৃষ্টান্ত খুঁজে পেয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে খাদ্য সংরক্ষণ ও তাপমাত্রার বিষয়, খাদ্য ব্যবস্থাপনা, হাত ধোয়া নিয়ে সমস্যা, পোকা-মাকড় নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য দূষণ এবং সাধারণভাবে রান্নাঘরের পরিচ্ছন্নতা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মার্কেটপ্লে­স দেখেছে যে, জনস্বাস্থ্য বিভাগের পরিদর্শকরা নোটিশ দেয়ার পরও গুরুতর সমস্যা রয়েই গেছে।

– ক্যালগেরিতে সাবওয়ের একটি রেস্টুরেন্টকে তাদের অপরিচ্ছন্ন কাপড়চোপড়ের জন্য স্বাস্থ্য পরিদর্শকরা তিনবার নোটিশ দিয়েছেন।

– ভ্যাঙ্কুভারে মোক্সিস-এর একটি রেস্টুরেন্ট তিনবার পরিদর্শনের পরও তারা খাবারদাবার সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

– ক্যালগেরিতে টিম হরটনের একটি রেস্টুরেন্টে প্রচুর মাছি থাকার বিষয়ে পরিদর্শকরা ৫বার লিখিতভাবে সতর্ক করেছেন।

রিপোর্ট অনুযায়ী, বেশিরভাগ শহরের রেস্টুরেন্টগুলোতে হাত ধোয়ার বিষয়টিই সবচেয়ে বড় সমস্যা। একইরকম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসাবে দেখা গেছে রান্নাঘরের সাধারণ পরিচ্ছন্নতা নিয়েও।

গোপন ক্যামেরা: কিছু অবস্থা ‘গ্রহণযোগ্য নয়’

রিপোর্টের ফলাফল সম্পর্কিত তথ্যউপাত্ত বিশ্লে­ষণের পাশাপাশি মার্কেটপ্লে­স কয়েকটি জায়গায় সমস্যার প্রমাণ সংগ্রহের জন্য একটি গোপন ক্যামেরাও ব্যবহার করেছে।

একটি রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরের মেঝের সর্বত্র নোংরা আবর্জনা পড়ে থাকার দৃশ্য দেখে শঙ্কা প্রকাশ করেন ভ্যাঙ্কুভারের অবসরপ্রাপ্ত জনস্বাস্থ্য পরিদর্শক ডোমেনিক লোসিটো। তিনি বলেন, ‘‘আবর্জনাগুলো অন্তত আবর্জনার পাত্রে রাখার চেষ্টা করা যেতে পারতো। কিন্তু আমার মনে হয় এই রেস্টুরেন্টকে এখনই বন্ধ করার নোটিশ দেয়া উচিৎ। এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’’

অন্যান্য সমস্যার মধ্যে রয়েছে, একটি রেস্টুরেন্টে কর্মচারীদের হাত ধোয়ার জায়গায় যথেষ্ট পরিমাণ গরম পানির ব্যবস্থা না থাকা, এই বিষয়ে স্বাস্থ্য পরিদর্শকরা বেশ কয়েকবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। রেস্টুরেন্টটি পানীয় রাখার জায়গায় বরফের দূষণ রোধ করতেও ব্যর্থ হয়।

লোসিটো বলেন, ‘‘খাবার থেকে ছড়ানো কিছু রোগ আছে যেগুলোর উৎপত্তি দূষিত বরফ থেকে। দূষিত বরফের সংস্পর্শ থেকে রোগের উদ্ভব হতে পারে এবং আপনার মাধ্যমে তা অন্যের দেহে সংক্রমিত হতে পারে।’’

ভিডিও ফুটেজ দেখার পর লোসিটো বলেন, এই রেস্টুরেন্টটি বন্ধ করে দেয়া উচিৎ।

তিনি বলেন, রেস্টুরেন্টগুলো বারবার একই ধরণের ভুল করলে পরিদর্শন কার্যক্রম আরও কঠোর হওয়া দরকার। তিনি বলেন, ব্যবসা খোলা রাখার জন্য আমরা কাজ করি না, আমরা কাজ করি জনগণকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য।’’

গোপন ক্যামেরায় ধরা পড়া আরেকটি ঘটনায় দেখা গেছে, একটি ফাস্টফুডের রেস্টুরেন্টে একজন কর্মচারী প্রথমে হাত দিয়ে নাক ঝাড়ছে, তারপর কাস্টমারের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে এবং তারপর হাত না ধুয়েই গ্লাভস পরে স্যান্ডউইচ বানাতে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এধরণের আচরণ স্বাস্থ্যবিধির গুরুতর লংঘন, কারণ এর ফলে দূষণ ছড়িয়ে পড়ে।

খাবার থেকে সংক্রমিত রোগের প্রধান উৎস রেস্টুরেন্ট

কানাডার পরিবারগুলো বাইরে ডিনার সেরে নেয়ার পেছনে বছরে খরচ করে প্রায় ২ হাজার ডলার। আর হেল্থ কানাডার হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর খাবার থেকে সংক্রমিত রোগে আক্রান্ত ৪০ লাখ লোকের মধ্যে অর্ধেকই আক্রান্ত হন রেস্টুরেন্ট থেকে।

কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, খাবার থেকে রোগের প্রাদুর্ভাব হওয়ার ইতিহাস জড়িয়ে আছে সেইসব রেস্টুরেন্টের সঙ্গে যেগুলো অসংখ্য মানুষকে রোগগ্রস্ত করেছে। ২০০৮ সালের একটি ঘটনায় নর্থ বে-তে হার্ভিস অ্যান্ড সুইস শ্যালে রেস্টুরেন্ট থেকে ছড়িয়ে পড়া রোগে অন্তত ২০০ লোক আক্রান্ত হন। এদের অনেকেই নিশ্চিতভাবে ই-কোলি জীবানুতে সংক্রমিত হয়েছিলেন।

ওই সময় ই-কোলি জীবানুর সংক্রমণে অসুস্থ হয়ে পড়া মি. ব্রাড হিল মার্কেটপ্লে­সকে বলেছেন, ‘‘আপনার জন্য যারা খাবার তৈরি করে তাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। তাদের সবকিছুই হয়তো দেখতে চমৎকার মনে হবে, কিন্তু দু’চার দিন পর আপনি বুঝতে পারবেন যে খুবই মারাত্মক কিছু উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করেছে।’’

গত বছর টরন্টোর আরেকটি ঘটনায় কানাডীয় জাতীয় প্রদর্শনীতে ক্রোনাট বার্গার খেয়ে দুই শতাধিক লোক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। বার্গারের সঙ্গে দেয়া বেকন জ্যাম সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করার কারণে ওই ঘটনা ঘটে।

লোসিটো বলেন, ‘‘খাবার বিষাক্ত হয়ে পড়ার অন্যতম বড় কারণ হলো শীতলীকরণ ও রিফ্রিজারেশনের অপর্যাপ্ততা। খাবার থেকে সংক্রমিত রোগের ৩০ শতাংশেরই কারণ শীতলীকরণের অপর্যাপ্ততা।’’

কিন্তু হেল্থ কানাডার তথ্য অনুযায়ী, কেবল বড় ধরণের সংক্রমণের ঘটনা ঘটলেই সেটা খবর হয়ে ওঠে। কিন্তু সেটি কানাডায় খাবার থেকে রোগ সংক্রমণের সার্বিক সংখ্যার তুলনায় অতি নগণ্য।

অনুসন্ধানের ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য মার্কেটপ্লে­সের পক্ষ থেকে ১৩টি চেইন রেস্টুরেন্টের সব ক’টির সঙ্গেই যোগাযোগ করা হয়। তারা সবাই সিবিসিকে বলেছেন যে, কাস্টমারের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার কারণে এবং স্বাস্থ্যবিধি লংঘনের যে কোন ঘটনার ব্যাপারে ত্বরিৎ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যই তারা নীতিগতভাবে প্রশিক্ষণ ও মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন।

রেস্টুরেন্ট শিল্পের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন রেস্টুরেন্ট কানাডা এ বিষয়ে ক্যামেরার সামনে কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানায়।

সংগঠনটি রেস্টুরেন্ট পরিদর্শনের ফলাফল প্রকাশ্যে টাঙ্গিয়ে দেয়ার বিরোধিতা করে। টরন্টোতে জনস্বাস্থ্য বিভাগ সেফডাইন নামে একটি কর্মসূচি চালু করেছে এবং এই কর্মসূচিটি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। এই কর্মসূচির আওতায় রেস্টুরেন্টগুলোকে পরিদর্শনের ফলাফল প্রকাশ্যে টাঙ্গিয়ে দিতে হয় যাতে লোকেরা সেটি দেখতে পায়। পরিদর্শনের ফলাফল সম্বলিত সেফডাইন কার্ডে তিন রঙের সংকেত দেখানো হয় (সবুজ রঙ হলো ‘‘উত্তীর্ণ’’, হলুদ হলো ‘‘শর্তাধীনে উত্তীর্ণ’’ এবং লাল রঙ হলো ‘‘বন্ধ’’) যাতে এটি সহজে বোধগম্য হয়।

রেস্টুরেন্ট কানাডার বক্তব্য হলো, হলুদ কার্ড হলো ‘‘সমস্যাপূর্ণ এবং বিভ্রান্তিকর’’ কারণ অনেক বিষয় জড়িয়ে আছে যেগুলো নির্ভর করে বিষয়গত মূল্যায়নের ওপর। আর রেস্টুরেন্টের গ্রেডিং করে দেয়াটা নিরাপত্তার ধারণার অতিমাত্রায় সরলীকরণেরই প্রতিফলন।

সংগঠনটির মতে পরিদর্শনের সময় রেস্টুরেন্টটির পারফরম্যান্স কেমন ছিলো কোন কাস্টমার সেটা জানতে চাইলে তাকে অনলাইনে রিপোর্ট পড়তে হবে।

কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে পরিদর্শনের রিপোর্ট অনলাইনে দেয়া হলেও অনেক ক্ষেত্রেই দেয়া হয় না।