কানাডায় বসবাসকারী বাংলাদেশীরা হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বয়সের তুলনায় আগেভাগে এবং কঠিনভাবে
খুরশিদ আলম
গবেষণায় দেখা গেছে হৃদরোগের কারণে দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মৃত্যুর হারও শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠির চেয়ে বেশী। এশীয়দের শরীরে অধিকমাত্রার বডি ফ্যাটও রয়েছে। এশীয়দের পেটেও রয়েছে অধিকমাত্রার ফ্যাট।
কানাডায় স্বাস্থ্য সচেতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে অধিকাংশ বাংলাদেশীর। তাঁদের লাইফ স্টাইল বা জীবনধারা বেশ অস্বাস্থ্যকর এ কথা বললে অত্যুক্তি করা হবে না। আর এই ধরণের জীবনধারার কারণে অল্প বয়সেই নানান জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তাঁদের অনেকে। দীর্ঘস্থায়ী বা দুরারোগ্য এই রোগগুলোর মধ্যে আছে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এমনকি মানসিক জটিলতার মত রোগও। আরো আছে স্থুলতার সমস্যা। মূলত নিস্তেজ বা অলস ধরণের জীবনধারার কারণে মানুষ প্রথমে স্থুল আকার ধারণ করতে থাকে। এবং এর অবসম্ভাবী পরিনতি হলো উপরে উল্লেখিত রোগগুলো।
নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে কানাডায় বসবাসকারী দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়ের লোকেরা হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বয়সের তুলনায় আগেভাগে এবং কঠিনভাবে। এই দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে বাংলাদেশীরাও পড়েন। গত ফেব্রুয়ারিতে গবেষণার এই খবরটি প্রকাশিত হয় সিবিসি নিউজে।
জার্নাল অফ দ্য আমেরিকান কলেজ অফ কার্ডিওলজির ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও আয়ারল্যান্ডের গবেষকরা জানিয়েছেন যে, দক্ষিণ এশীয় হৃদরোগী অথবা ডায়াবেটিক রোগীদের শরীরে ভাস্কুলার রি-জেনারেটিভ ও রিপারেটিভ সেল বা পুনরুৎপাদনশীল ও পুনসংস্কারকারী কোষ শে^তাঙ্গ রোগীদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণে থাকে।
গবেষণার “ফলাফল থেকে আভাস পাওয়া যায় যে, দক্ষিণ এশীয় লোকেদের মধ্যে এমন ব্যতিক্রমী কিছু আছে যা অংশত ক্ষতিগ্রস্ত রক্তনালী সারিয়ে তোলার মত যথেষ্ট অক্ষমতার কারণে তাদেরকে সত্যিকারের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে।” বলেছেন, গবেষণার সহলেখক ড. সুবোধ ভার্মা। তিনি টরন্টোর সেন্ট মাইকেলস হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জন এবং টরন্টো ইউনিভার্সিটির প্রফেসার।
গবেষণায় দক্ষিণ এশীয় বলে পরিচয় দেওয়া ৬০ জন রোগীর সঙ্গে ৬০ জন শ্বেতাঙ্গ রোগীর তুলনামূলক পরীক্ষা করা হয় টরন্টো এলাকার বিভিন্ন প্রাইমারি কেয়ার অথবা হৃদরোগ বিষয়ক ক্লিনিকে। যেসব রোগীর হৃদরোগ অথবা ডায়াবেটিস আছে বলে প্রয়োজনীয় নথিপত্র রয়েছে এবং একইসাথে হৃদরোগের অন্তত একটি ঝুঁকির উপাদান আছে এমন রোগীদেরই গবেষণার জন্য বেছে নেওয়া হয়।
উল্লেখ্য যে, এর আগেও গবেষকরা অনুমান করেছিলেন, ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আসাÑ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং অন্য ৫০টিরও বেশি দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত মানুষেরা, যারা বিশ্বের জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশের প্রতিনিধিত্ব করেÑ শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় রোগীদের চেয়ে প্রায় পাঁচ থেকে ১০ বছর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয় এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হবার পর তাঁদের মৃত্যুর হারও বেশি।
ইতিপূর্বে হ্যামিলটনের ম্যাক্মাস্টার ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে কানাডায় দক্ষিণ এশীয় ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে হৃদরোগীর সংখ্যা কানাডার শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠির চেয়ে অনেক বেশী। ডায়াবেটিস এবং স্থুলতার সমস্যাও শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠির চেয়ে দক্ষিণ এশীয় ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে বেশী।
সিবিসি নিউজে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, ঐ গবেষণায় ১৯৭৯ সাল থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে প্রায় ৫.৮ মিলিয়ন লোকের ডাটা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে কানাডায় দক্ষিণ এশীয় ইমিগ্রেন্টদের (ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা এবং পাকিস্তান) মধ্যে উচ্চমাত্রায় হৃদরোগ বিদ্যমান। এর মধ্যে আছে angina, এবং stroke. এনজিনা হলো হৃদযন্ত্রে রক্তসরবরাহের অপ্রতুলতাহেতু অল্প পরিশ্রমেই বুকে যে ব্যথা হয় সেটি। স্ট্রোক হলো মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। হৃদযন্ত্রের সমস্যা বেশী হলে অনেকেরই বাইপাস সার্জারী করাতে হয়। একটি বা দুটি আর্টারিতে ব্লক এর মাত্রা ৮০% এর মত হলে আর্টারীতে রিং পড়ানো হয়। এর জন্য বুকে কাটাছেড়া করতে হয় না। তবে এসবই নির্ভর করে রোগীর প্রকৃত অবস্থার উপর এবং কার্ডিওলজিস্ট এর সিদ্ধান্তের উপর।
ঐ গবেষণায় আরো দেখা গেছে হৃদরোগের কারণে দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মৃত্যুর হারও শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠির চেয়ে বেশী। এই রোগে শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের মৃত্যুর হার ২৯% আর দক্ষিণ এশীয় পুরুষদের ৪২%। আর শ্বেতাঙ্গ মহিলাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ১৯% এবং দক্ষিণ এশীয় মহিলাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ২৯%। দক্ষিণ এশীয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ এ ভোগা রোগীর সংখ্যাও শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠির চেয়ে বেশী।
গবেষকগণ তাঁদের প্রাপ্ত তথ্য তুলনা করে দেখতে পান একই মাপের দৈহিক উচ্চতা ও ওজনের একজন শ্বেতাঙ্গ মানুষের তুলনায় একজন এশীয় মানুষের শরীরে অধিকমাত্রার বডি ফ্যাট রয়েছে। এশীয়দের পেটেও রয়েছে অধিকমাত্রার ফ্যাট। তাছাড়া এশীয় মহিলাদের কোমড় এবং নিতম্বে রয়েছে উচ্চমাত্রার ফ্যাট। আর এই সমস্যাগুলো হৃদরোগকে লালগালিচার সংবর্ধনা দিয়ে শরীরে ডেকে আনে।
কিন্তু কানাডায় দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠির মধ্যে হৃদরোগী সংখ্যা এত বেশী কেন? এবং একই সাথে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যাও?
এর কারণ খুঁজে পাওয়া সহজ নয় বলে জানিয়েছেন ম্যাক্মাস্টার ইউনিভার্সিটির মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপিকা সোনিয়া আনান্দ। সিবিসি নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে এখনো গবেষণা করা হচ্ছে। দক্ষিণ এশীয়দের জেনেটিক দিকটাও পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এটি আসলে জটিল একটি বিষয়। শুধু জেনেটিক বিষয়টি দায়ী তাও বলা যাচ্ছে না।
তাহলে এই মুহুর্তে দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠি কি করতে পারে হৃদরোগ আর ডায়াবেটিসকে মোকাবেলা করার জন্য? সোনিয়া বলেন, লাইফস্টাইল বদলাতে হবে। যেমন নিয়মিত ব্যায়াম করা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া -বিশেষ করে কম মাত্রায় কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠির সব বয়সের লোকদেরকেই এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।
কিন্তু সমস্যাটা হলো, এখানে অধিকাংশ বাংলাদেশী কানাডিয়ানই এ বিষয়ে সতর্ক নন। তাঁদের লাইফস্টাইলে ব্যায়াম বলে কোন শব্দ নেই, অধিকমাত্রায় কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার তাঁদের অতি প্রিয়, মিষ্টি জাতীয় খাবার তাঁদের না হলেই নয়। এ রকম আরো কিছু খাবার আছে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক জেনেও তাঁরা নিয়মিত খেয়ে যাচ্ছেন।
আমরা লক্ষ্য করেছি কানাডায় যারা বাংলাদেশী আছেন এবং বিশেষ করে যাদের বয়স পঞ্চাশোর্ধ তাদের প্রায় অধিকাংশেরই রয়েছে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের সমস্যা। কোন পার্টিতে পঞ্চাশোর্ধ দশজন বাঙ্গালীর সমাগম হলে দেখা যায় এদের মধ্যে অর্ধেকের বেশী ডায়াবেটিস রোগী। আর হৃদরোগের বিষয়টি একটু ভিন্ন রকম। অনেকে হয়তো জানেনই যে তিনি হার্টে ব্লক নিয়ে চলাফেরা করছেন। বাহ্যিক কোন লক্ষণ নেই। তাই ঠিক বুঝতে পারেনা। হৃদরোগ থাকলে সবার বেলায় লক্ষণ প্রকাশ নাও পেতে পারে। বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস আছে তাঁদের অনেকের ক্ষেত্রেই লক্ষণ প্রকাশ পায় না। একদিন হয়তো দেখা যায় হঠাৎ করেই একটা বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে যায়। এ কারণেই ডাক্তারগণ বলে থাকেন, যাঁদের বয়স হয়েছে এবং যাঁরা ডায়াবেটিস এর রোগী তাদের উচিৎ কার্ডিওলজিস্ট এর পরামর্শ নেয়া।
কানাডিয়ান জার্নাল অব ডায়াবেটিস এর তথ্য থেকে আরো জানা যায়, যে সকল দক্ষিণ এশীয় মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসেন এবং যারা অনুন্নত দেশ থেকে উন্নত দেশে আসেন (যেমন কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য) তাঁদের মধ্যে স্থূলতা, ইনসুলিন রেজিস্টেন্স, টাইপ ২ ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এর প্রাদুর্ভাব বেশী।
একটা সম্পূর্ণ নতুন দেশে আসার পর প্রথম প্রজন্মের অধিকাংশ ইমিগ্রেন্টদেরকে নানারকম আর্থ-সামাজিক প্রতিকুলতার সম্মুখীন হতে হয় এবং এর সাথে যোগ হয় মানসিক চাপ, হতাশা ও অস্থিরতা। এগুলোর একটা উল্ল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকতে পারে উচ্চ মাত্রার ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ হওয়ার পিছনে। আরো আছে শারীরিক সক্রিয়তার অভাব। এটির অভাব যেমন রয়েছে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে, তেমনি রয়েছে শিশু কিশোরদের মধ্যেও। এশীয়দের মধ্যে উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ হওয়ার পিছনে এই শারীরিক সক্রিয়তার অভাব সম্ভবত একটি বড় ধরণের কারণ।
কারণ আরো আছে। সেটি হলো খাদ্যপ্রীতি। বাঙ্গালীসহ দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে ভোজনরসিকের অভাব নেই। ভোজন রসনার তৃপ্তি ঘটাতে খাদ্যের মধ্যে তারা ব্যবহার করেন অতিমাত্রায় নানান জাতের মশলা আর তেল-ঘি ও চিনি। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নিজ বাড়িতে বা আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়িতে পার্টি থাকে তাঁদের। সেখানে উচ্চমাত্রার চর্বিযুক্ত নানান পদের মজাদার সব খাবার পরিবেশন করা হয়। সেই সাথে আছে উচ্চ মাত্রার চিনিযুক্ত নানান রকমের মিষ্টান্ন। আরো আছে অতিমাত্রায় চিনি ও চর্বিযুক্ত কোমল পানীয়। আর এই সব পার্টিতে খেতে বসে পরিমাণের বিষয়ে অধিকাংশেরই কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
কোন কোন বিজ্ঞানী অবশ্য বলছেন যে হৃদরোগের প্রধান কারণ মানসিক। মার্কিন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা: ক্রিচটন দীর্ঘ গবেষণার পর এ কথা বলেন। তার এ কথার সঙ্গে কানাডা ও অন্যান্য উন্নত দেশে ইমিগ্রেন্ট হিসাবে আগত দক্ষিণ এশীয় ইমিগ্রেন্টদের বর্তমান স্বাস্থ্যগত অবস্থার যথেষ্ট মিল লক্ষ্য করা যায়। বিশেষত হৃদরোগের ক্ষেত্রে। আমরা দেখেছি ইমিগ্রেন্টদের অনেকেই নতুন একটি দেশে আসার পর নানারকম টেনশন আর স্ট্রেস এর মুখমুখি হন। এর মধ্যে আছে নিজ নিজ পেশায় চাকরী না পাওয়া, যোগ্যতার তুলনায় অনেক নিচ স্তরের চাকরী করা, এক চাকরীতে সংসার চলেনা বলে দুই চাকরী করা, তারপরও স্বল্প আয়, আর সেই আয় দিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে হিমসিম খাওয়া, আর্থিক অনটনের কারণে পারিবারিক কলহ ও অশান্তি, ঋণগ্রস্ত হওয়া, উচ্চহারে সেই ঋণের সুদ দেওয়া, কখনো কখনো ছেলে-মেয়ের বিপথগামী হওয়া অথবা বিপথগামী হতে পারে সেই দুশ্চিন্তা। আরো আছে নতুন দেশের নতুন ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চাপ, দেশে ফেলে আসা বাবা-মায়ের জন্য দুশ্চিন্তা এবং তাদের জন্য কিছু করতে না পারার অপরাধবোধে দংশিত হওয়া। এক পর্যায়ে হতাশা আর বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়া। এসব কিছু মিলে ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে একটা চরম মানসিক সংকট তৈরী হয়। আর সম্ভবত সে কারণেই আমরা লক্ষ্য করছি ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস আর হৃদরোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে।
মানসিক কারণসহ বিজ্ঞানীরা আরো যে সব কারণকে হৃদরোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করে থাকেন তারমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো- বয়স, জেন্ডার, বংশগত, ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রার অধিক্য, ডায়াবেটিস, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব এবং অতিরিক্ত ওজন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই কারণগুলোর প্রায় সবকটিই পঞ্চাশোর্ধ অধিকাংশ প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে বিদ্যমান। সেই সাথে মানসিক চাপতো আছেই। বিজ্ঞানীরা উপরোক্ত সবগুলো কারণের মধ্যে একক গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে স্ট্রেসকে চিহ্নিত করছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, কোনও ব্যক্তির রক্তের উচ্চ কোলেস্টেরল লেভেল, উচ্চ রক্তচাপ বা ধূমপানের অভ্যস থাকা সত্ত্বেও স্ট্রেস- ফ্রি থাকার কারণে তিনি হৃদরোগ থেকে মুক্ত রয়েছেন।
ইতিপূর্বে টরন্টোর বাংলাদেশী ডাক্তার আবু আরিফের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনে। সেখানে তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে যারা অনেক দিন ধরে এদেশে আছেন তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টরেল এবং ডায়াবেটিসে ভোগেন। আর এদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। পুরুষরা কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সময় করে উঠতে পারেন না। অনেকে ওভার টাইম কাজ করেন, অনেকে রাতে কাজ করে দিনে ঘুমান। যার ফলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ফুসরৎ পান না। যদি মনে করেন যে মোটামুটি ভাল আছেন তাহলে আর ডাক্তারের কাছে আসতে চান না। আর যারা বয়োবৃদ্ধ অর্থাৎ সিনিয়র সিটিজেন তারা বেশিরভাগই ডায়াবেটিস ও হার্টের সমস্যা নিয়ে আসেন। এছাড়া কোলেস্টরেল, হাই ব্লাড প্রেসার নিয়েও আসেন অনেকে।
তবে ইমিগ্রেন্টদের শারীরিক স্বাস্থ্যই যে কেবল ঝুঁকির মধ্যে আছে তা কিন্তু নয়, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যও খুব একটা ভাল নেই। এ প্রসঙ্গে ডাক্তার আবু আরিফ বলেন, প্রবাসে বাঙ্গালী কমিউনিটিতে মানসিক রোগীর সংখ্যা রয়েছে প্রচুর। মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, হতাশা বা ডিপ্রেশনের মতো সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে প্রচুর রোগী আসেন। মানসিক রোগ কি কারণে হচ্ছে এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এদেশে আসার পরে প্রথমে এরা বুঝে উঠতে পারেন না কি করবেন। অনেকের দেশের প্রতি পিছুটান থাকে। প্রবাসে নিজের খরচের পর বাংলাদেশে টাকা পাঠাতে হয়। আবার অনেকে বাংলাদেশের ভাল চাকরি ছেড়ে এখানে আসেন যাদের আর্থিক অবস্থা হয়তো খুব ভাল ছিল। নিজেদের কিছু করতে হতো না, সবকিছু অন্য লোকেরা করে দিত। এখানে সবকিছু নিজেকে করতে হয়। এইসব কিছু মিলে তারা খুব মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন। অনেকে আবার হাতশায় ভোগেন। আর কমিউনিটিতে এদের সংখ্যা গড়ে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। মানসিক রোগীর ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় মহিলাদের সংখ্যা বেশী।
কানাডায় বেশীদিন থাকা ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে হৃদরোগসহ অন্যান্য কয়েকটি নির্দিষ্ট রোগের প্রাদুর্ভাব কেন বেশী করে দেখা যাচ্ছে তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ কেউ জেনেটিক কারণ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তবে এর সাথে পরিবেশকেও দায়ি করার চেষ্টা করছেন কোন কোন গবেষক।
এই পরিবেশটা কি? গবেষণায় সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা হচেছ না। সবই সম্ভাবনার কথা। এই পরিবেশ হতে পারে আবহাওয়াগত। কারণ এ দেশে বেশীরভাগ সময়ই থাকে শীত। শীতে মানুষের চলাফেরা সীমিত থাকে। ফলে শারীরিক পরিশ্রম কমে যায়। যারা ডায়াবেটিক তাদের বেশীরভাগই শীতের দোহাই দিয়ে হাঁটা বন্ধ করে দেন। এতে করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে না। আর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকার অর্থ হলো শরীরের ভাইটাল অরগানগুলোর দ্রুত ক্ষতিবৃদ্ধি। এর মধ্যে এক নম্বর অরগান হলো হৃদযন্ত্র।
কানাডায় আলাদাভাবে বাংলাদেশীদের স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কোন জরিপ চালানো হয়েছে বলে এ মুহুর্তে আমাদের জানা নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে অবস্থিত ডিপার্টমেন্ট অব ফ্যামিলি মেডিসিন, নর্থ ব্রোংস্ হেলথ নেটওয়ার্কের ডাক্তার প্যাটেল এর চালানো স্বল্প পরিসরের এক জরীপে দেখা যায় সেখানে বেশীরভাগ বাঙ্গালী মহিলার স্বাস্থ্য চলনসই অথবা খারাপ। মাত্র ৩৫ ভাগ মহিলা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ফিজিক্যাল একটিভিটিতে জড়িত ছিলেন। ঐ শহরে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মানদন্ড অনুযায়ী একজন মহিলার ওজন যেটুকু হওয়া উচিৎ তার চেয়ে অনেক বেশী ওজন নিয়ে চলাফেরা করছেন শতকরা ৭৪ ভাগ বাংলাদেশী মহিলা। ধারণা করা যায় কানাডার টরন্টো ও মন্ট্রিয়লসহ অন্যান্য শহরেও বাংলাদেশী মহিলাদের ওজন সমস্যা কমবেশী একই রকম। বাংলাদেশীদের যে কোন পার্টিতে বা জনসমাবেশে গেলে এর প্রমাণ মিলে খুব সহজেই।
কথায় বলে স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। আর প্রবাসে সুস্থ্য থাকা আরো জরুরী। কারণ এখানে অসুস্থ্য হলে সাধারণত দেখার কেউ থাকে না। আমরা এই প্রবাসে প্রায় সকলেই আত্মীয়-পরিজন ছাড়া থাকি। কিছু একটা ঘটলে নিজের দেখাশুনা মূলত নিজেকেই করতে হয়। স্বামীরও সময় হয়না সারাক্ষণ অসুস্থ স্ত্রীর পাশে বসে থাকার, অন্যদিকে স্ত্রীরও সময় হয়না সারাক্ষণ অসুস্থ স্বামীর পাশে বসে থাকার। কারণ সবাইকে কাজ করতে হয়। কাজ বন্ধ তো বাড়ির মর্টগেজ দেয়া বন্ধ, কাজ বন্ধ তো গাড়ির পেমেন্টে দেয়া বন্ধ, কাজ বন্ধ তো এরকম আরো অনেক কিছুর পেমেন্ট দেয়া বন্ধ হয়ে যায় যার পরিনতি হয় খুব করুণ।
সে কারণে এই প্রবাসে প্রবাসী তথা ইমিগ্রেন্টদের যতটা সম্ভব সুস্থ্য থাকাটা খুবই জরুরী। হৃদযন্ত্রটাকে সঠিক রাখতে হলে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে আমাদের খাদ্যাভাসের ব্যাপারে, আমাদের ঘুমের ব্যাপারে, আমাদের শারীরিক সক্রিয়তার ব্যাপারসহ আরো অনেক কিছুর ব্যাপারে। আর ডাক্তার আবু আরিফের মতে, “সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো যদি কোন সমস্যা দেখা দেয় তাহলে প্রাথমিক অবস্থায়ই ডাক্তার দেখানো। তাহলে ডাক্তার কোন রোগ জটিল হওয়ার আগেই সনাক্ত করতে পারেন। এছাড়া প্রতি বছর চেক আপ করানো উচিৎ। নিয়মিত ব্যায়াম এবং খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো খেলে সুস্থ্য থাকা সম্ভব।”
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কন্ঠ