ভিন্ন দৃষ্টিতে স্বেচ্ছাসেবা
স্বেচ্ছাসেবা হলো আপনি যে সমাজে বসবাস করেন সেই সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দেয়াÑ আপনি যেটিকে ভালো মনে করেন সেই কারণে যতটা পারেন তার চেয়ে বেশি কিছু করা। আমি একবার পড়েছিলাম যে, স্বেচ্ছাসেবা হলো গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অনুশীলনÑ আপনি বছরে একবার নির্বাচনে ভোট দেন, কিন্তু যখন আপনি স্বেচ্ছামূলক সেবা কার্যক্রমে অংশ নেন তখন আপনি যে ধরণের সমাজ দেখতে চান সেই সমাজের জন্য প্রতিদিন ভোট দিচ্ছেন।
একের পর এক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে যে, সুখের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে সেবাদানের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমরা যদি আমাদের সন্তানদের এটি না শেখাই যে কোন কিছু গ্রহণ করার চেয়ে বরং দেয়ার মধ্যেই পরম সুখ নিহিত রয়েছে তাহলে তারা দানের আনন্দের বিষয়টি সম্পর্কে জানবে বা বিষয়টি তাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে আসবে এটি কিভাবে আশা করতে পারি? স্বেচ্ছাসেবা সম্পর্কে এটিই মোদ্দা কথা।
স্বেচ্ছাসেবার আরেকটি দিক রয়েছে যা প্রায়শ নজর এড়িয়ে যায়। স্বেচ্ছাসেবা এক ধরণের বিনিময়ও। ভিন্ন কিছু অর্জনের লক্ষ্য ছাড়াও অনেক কারণ রয়েছে যেজন্য মানুষ স্বেচ্ছাসেবাদানে এগিয়ে আসে:
– কোন কমিউনিটিকে জানাকারও ভাষাগত দক্ষতার উন্নয়ন
– নতুন নতুন বন্ধু তৈরি
– নতুন যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা
– একটি দলের শরিক হওয়া
– নেতৃত্বের গুণ অর্জন
– নতুন কিছু শেখা
– কমিউনিটির সেবা কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পেশা খুঁজে নেয়া
– দক্ষতা ও সক্ষমতার প্রদর্শন
– নিজের সমৃদ্ধ জীবন-বৃত্তান্ত গড়ে নেয়া
– এক ধরণের থেরাপি হিসাবে
আমার বিশ্বাস, ক্যারিয়ার পরিবর্তনকারী এবং/অথবা নতুন চাকরির সন্ধানে নিয়োজিতরা স্বেচ্ছাসেবার সুবিধাগুলোকে প্রকৃতপক্ষে অবমূল্যায়ন করছেন। চাকরির ইন্টারভিউ বা চাকরির প্রস্তাব পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন বিষয় হলো সম্ভবত মানব সম্পদ ব্যবস্থাপকের টেবিলে প্রতিদিন যতো সংখ্যক জীবন-বৃত্তান্ত জমা পড়ে সেগুলোর মধ্যে আপনার জীবন-বৃত্তান্তটি সেরা হলো কিনা তা নিশ্চিত করা। নির্দিষ্ট সংগঠন বা ব্যবসায়িক খাতের প্রতিষ্ঠান বেছে নিয়ে তাতে স্বেচ্ছাসেবা দান হলো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের চেনা ও তাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের, যোগাযোগ গড়ে তোলা এবং নিজের জ্ঞান, দক্ষতা ও সক্ষমতা প্রদর্শনের সবচেয়ে ভালো সুযোগ। এর ফলে সংগঠনগুলোর জন্যও অজ্ঞাত লোক ভাড়া করার চেয়ে ‘‘পরিচিত পণ্য’’ ভাড়া করা সহজতর হয়।
কার্ল ইয়ুং যেমনটা বলেন, ‘‘আপনি যা করেন সেটাই আপনার পরিচয়, যা করবেন বলেন সেটি নয়।’’ স্বেচ্ছাসেবার মধ্য দিয়ে কাজের মধ্যে আপনাকে দেখা যায়, কেবল আপনি যা করবেন বা করতে পারেন বলে জানান সেটি নয়। যে স্বেচ্ছাসেবী নিজের উদ্দীপনা, সামর্থ, কোন কাজে সংশ্লিষ্ট হওয়ার ইচ্ছা এবং এর সাফল্যের ক্ষেত্রে অবদান রাখার আগ্রহ প্রদর্শন করেন সংগঠনগুলো তার সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
স্বেচ্ছাসেবা হলো নিরাপদ অবস্থানে থেকে কর্মস্থল সম্পর্কে পরিচিতি অর্জনের একটি চমৎকার উপায় যেখানে আপনাকে চাকরিজীবী হলে যতটা জবাবদিহি করতে হতো সেই পর্যায়ে জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। সংগঠনগুলোতে সুনির্দিষ্ট করে কোন কোন ক্ষেত্রে কেমন দক্ষতার প্রয়োজন হয় সেটি খুঁজে বের করার, সাফল্যের জন্য কী কী প্রয়োজন এবং কোনটি নয় এবং সবধরণের সাংগঠনিক কাজে সংশ্লিষ্ট হওয়ারও খুব ভালো সুযোগ হলো স্বেচ্ছাসেবা।
আর, কানাডায় নতুন আসা একজন হিসাবে চাকরি খুঁজতে গিয়ে আপনাকে অবশ্যই প্রায়ই শুনতে হবে যে আপনার ‘কানাডীয় অভিজ্ঞতার ঘাটতি’ রয়েছে। এই ‘কানাডীয় কর্ম অভিজ্ঞতা’ অর্জনেরও সেরা উপায় হলো স্বেচ্ছাসেবা। এর মাধ্যমে আপনি যে শহরে অবস্থান করছেন সেখানকার শ্রমবাজারের কায়দা-কেতা শিখে উঠবেন এবং আশা করা যায় যে সম্ভাব্য চাকরিদাতা কোম্পানিগুলো আপনার প্রতি আকর্ষণ বোধ করবে।
এই একই নীতি সমভাবে প্রযোজ্য তরুণ গ্রাজুয়েটদের ক্ষেত্রেও, যাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক জ্ঞান রয়েছে কিন্তু কর্মঅভিজ্ঞতা আছে সামান্যই অথবা একেবারেই নেই। নিজেদের পছন্দের কর্মক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবার মধ্য দিয়ে তারা তাদের জীবনবৃত্তান্ত সমৃদ্ধ করে নিতে পারে। আপনি যখন শ্রমবাজারে চাকরির জন্য চেষ্টা করছেন বা নিজের মেধা প্রদর্শনের অপেক্ষা করছেন তখন আপনার অভিজ্ঞতা ও কোনও স্থানে কাজ করার কার্যকর রেফারেন্স অমূল্য সম্পদ হিসাবে কাজ করবে।
আমি সব সংগঠনের ব্যাপারে বলতে পারবো না, তবে আমি অনেক সংগঠন সম্পর্কে জানি যারা স্বেচ্ছাসেবীদের স্বাগত জানায় এবং তাদের কর্মশক্তির অংশ হিসাবে কাজ করার সুযোগ দেয়। তারা একটি ব্যবস্থাপনার আওতায় স্বেচ্ছাসেবীদের কাজ পর্যবেক্ষণ এবং তাদের নির্দেশনা দেয়। এটি হলো জীবনকে উজ্জ্বল করে তোলার এবং অন্যদের সন্তুষ্ট করার সবচেয়ে ভালো সময়; অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না বলে এই সময়গুলো যেনতেনভাবে কাটিয়ে দেয়া কোনওভাবেই উচিৎ নয়। মনে রাখবেন স্বেচ্ছাসেবা হলো এক ধরণের বিনিময়Ñ আপনি কেন স্বেচ্ছাসেবা দিচ্ছেন? আপনি এর থেকে কী শিখতে চান? কাদের সঙ্গে আপনি দেখা করতে চান? আপনার সময়ের বিনিময়ে আপনি কী পেতে চান?
আমি নিশ্চিত যে, এমন অনেক ছোটবড় সংগঠন রয়েছে যারা স্বেচ্ছাসেবীদের বিনামূল্যের সেবার সুযোগ গ্রহণ করতে চায়। তবে আমি যেসব সংগঠনের বিষয়ে জানি তারা স্বেচ্ছাসেবীদের কাজের সুযোগ দেয় কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনওরকম সুযোগ গ্রহণ করে না। বরং তারা সচেতন যে এধরণের স্বেচ্ছাসেবা বিনিময় থেকে তাদের চাহিদা কতটুকু। স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, উদ্বুদ্ধকরণ, স্বীকৃতিদান ও ধরে রাখার জন্য অনেকটা সময় ও শ্রমের প্রয়োজন হয়। তাদের এই সময় ও শ্রমের বিনিময় কী?
সত্যিকার অর্থে হৃদয় দিয়ে, অঙ্গীকারের সঙ্গে এবং মনোযোগ দিয়ে স্বেচ্ছাসেবা দেয়া হলে তা আপনাকে দরোজায় পা রাখার সুযোগ করে দেবে। সুতরাং শুদ্ধ মনে সামনে এগিয়ে যান এবং আপনার দক্ষতা ও মেধার বিনিময়ে পুরস্কার গ্রহণ করুন।
প্যাট্রিসিয়া টোটি হলেন ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার স্টিভেস্টন সোসাইটির ইভেন্টস অ্যান্ড ভলান্টিয়ার বিষয়ক সমন্বয়কারী।
-সৌজন্যে: প্যাট্রিক টোটি/কানাডিয়ানইমিগ্রেন্ট.সিএ