কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাফল্য লাভ করছে অভিবাসীদের সন্তানেরা

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : পরিসংখ্যান প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার প্রকাশিত ইতিপূর্বের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, কানাডায় জন্মগ্রহণকারী বাবা-মার সন্তানের তুলনায় কানাডায় অভিবাসী হয়ে আসা বাবা-মায়ের সন্তানের সংখ্যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় দ্বিগুণ হবে।

সমীক্ষা অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে এমন পরিবারের সন্তান যারা পরিবারের সঙ্গে কানাডায় অভিবাসী হয়ে এসেছে। বাবা-মায়ের মধ্যে একজন অভিবাসী এমন পরিবারের সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে ৩১ শতাংশ আর বাবা-মা উভয়েই কানাডীয় এমন পরিবারের সন্তান ভর্তি হবে ২৫ শতাংশ।

চিনা বংশোদ্ভূত শিক্ষার্থীরা খুব বেশি হলে কলেজ পর্যন্ত উঠবে। সার্বিকভাবে, কানাডীয়দের তুলনায় এশিয়া থেকে আসা অভিবাসী পরিবারের সন্তানদের কলেজ পর্যন্ত ওঠার সম্ভাবনা কানাডীয়দের তুলনায় চারগুণ বেশি, যদিও মাধ্যমিক স্কুলে তাদের পারফরমেন্স নগণ্য। অন্যদিকে ইউরোপ থেকে আসা অভিবাসীদের ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে এমন পরিবারের সন্তানদের ক্ষেত্রে সাধারণত তৃতীয় প্রজন্মের কানাডীয় হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

এদিকে অন্য এক সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, কানাডায় অভিবাসী পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের তরুণরা সাফল্যের প্রতিযোগিতায় ছাড়িয়ে যাচ্ছে তাদের সমবয়সী কানাডিয়ানদেরকে। এমনকি বয়সে বড় কানাডিয়ানদেরকেও হার মানাচ্ছে তারা সাফল্যের দৌড়ে! দ্বিতীয় প্রজন্মের এই তরুণ অভিবাসীদের মধ্যে আছে বাংলাদেশী কানাডিয়ানরাও।

কানাডায় অভিবাসী পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের তরুণরা সাফল্যের প্রতিযোগিতায় ছাড়িয়ে যাচ্ছে তাদের সমবয়সী কানাডিয়ানদেরকে। ছবি : ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ওয়েবসাইট

কানাডায় যারা প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী, তাদের মধ্যে অনেকেরই মনে ক্ষোভ ও হতাশা রয়েছে এই ভেবে যে, কানাডায় এসে তাঁরা কিছুই করতে পারেননি। ডক্তারগণ ডাক্তারী পেশায় নেই, ইঞ্জিনিয়ারগণ ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায় নেই, কৃষিবিজ্ঞানীগণ কৃষি পেশায় নেই। এরকম আরো বহু পেশাজীবী অভিবাসীগণ তাদের নিজ নিজ পেশায় নেই। হাতে গোনা দুই চারজন ছাড়া বাকী সবাইকে পেশা বদল করে নিন্ম আয়ের কাজে যোগ দিতে হয়েছে। ফলে তাঁদের অনেকেই রয়েছেন তীব্র মানসিক চাপ ও যন্ত্রনার মধ্যে। সেই সাথে শারীরিক চাপও রয়েছে। যারা এই শারীরিক ও মানসিক চাপকে সামাল দিতে পারছেন না তারা বুড়িয়ে যাচ্ছেন দ্রুত। শরীর ও মনে বাসা বাধছে নানান রোগ।

তবে এত হতাশার মাঝেও আশার আলো দেখাচ্ছে অভিবাসী পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা। ইতিপূর্বে প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার এক গবেষণা তথ্য এই আশাব্যঞ্জক চিত্রটি তুলে ধরেছে। ঐ গবেষণা তথ্যে বলা হয়, ২০১৮ সালের অভিবাসন সম্পর্কিত আনুপূর্বিক ডেটাবেসের সর্বশেষ উপাত্ত থেকে আভাস পাওয়া যায় যে, সময়ের পরিক্রমায় অভিবাসী শিশুরা কানাডার সমাজ ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। যদিও স্থানীয় নিবাসী শিশুদের (১৫.৪%) চেয়ে অভিবাসী শিশুদের (৩২.২%) দ্বিগুণেরও বেশি সংখ্যককে স্বল্প-আয়ের পরিবারে বেড়ে উঠতে হয়েছে। কানাডার শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা অর্জনের সুযোগ এবং সরকারি ভাষাগুলোতে বর্ধিত সাচ্ছন্দ্য অর্জনের মত উপাদানগুলো অভিবাসী শিশুদেরকে প্রাপ্ত বয়সে পৌঁছে তাদের কানাডায় জন্মানো সহকর্মীদের অনুরূপ বেতন পাবার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে।

অভিবাসী শিশুদের বিষয়ে স্ট্যাটিসটিকস কানাডার গবেষণা থেকে আরো যে সকল তথ্য জানা যায় তা হলোÑ

– শিশু বয়সে যেসব অভিবাসী কানাডায় এসেছে তাদের মাধ্যমিক-উত্তর শিক্ষা অর্জনের সম্ভাবনা দেশের সার্বিক জনসমষ্টির চেয়ে বেশি

– ট্যাক্স পরিশোধের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ২০ বছর বয়সী অভিবাসীদের মধ্যে ৭০ শতাংশই মাধ্যমিক-উত্তর শিক্ষায় ভর্তি হয়। এরা ১৫ বছর বয়সে কানাডায় এসেছিলো।

– ওই বছর ২০ বছর বয়সী সার্বিক জনগোষ্ঠীর উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় ভর্তির হার ছিলো ৫৬%।

শিশু বয়সে কানাডায় আসা অভিবাসীদের মোটামুটি আয় তাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সার্বিক জনগোষ্ঠীর আয়ের অনুরূপ পর্যায়েই বৃদ্ধি পায়। ২০১৮ সালে সার্বিক জনগোষ্ঠীর একজন ২৫ বছর বয়সী কানাডীয়র মোটামুটি আয়ের পরিমাণ ছিলো ২৯,৭১০ ডলার (বার্ষিক)। সেই তুলনায় শিশুবয়সে কানাডায় আসা একজন একই বয়সের অভিবাসীর আয় ছিলো বছরে ৩০,৩০০ ডলার। ৩০ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে একজন কানাডীয়র আয় যেখানে ছিলো ৪১,৮১০ ডলার সেখানে ৩০ বছর বয়সী একজন অভিবাসী যে শৈশবে কানাডায় এসেছে তার আয় ছিলো ৪৭,৪০০ ডলার। দেখা যাচ্ছে, শৈশবে কানাডায় আসা একজন ৩০ বছর বয়সী অভিবাসীর মোটামুটি আয়ের সঙ্গে সার্বিক জনগোষ্ঠীর একজন নাগরিকের আয়ের পার্থক্য দাঁড়াচ্ছে ১৩.৪%।

উল্লেখ্য যে, স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা ইতিপূর্বেও অভিবাসী শিশুদের অগ্রগতি নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত করেছিল। ২০০৬ ও ২০১৬ সালের আদমশুমারির সমন্বিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত এক সমীক্ষায় একদল অভিবাসী শিশুর শিক্ষা ও শ্রমবাজারে তাদের অর্জন পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে যাদের বয়স ২০০৬ সালে ছিলো ১৩ থেকে ১৭ বছর। ঐ সমীক্ষায় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা অভিবাসী বাবা-মার সন্তানদের অর্জনের তুলনা করা হয়েছে কানাডায় জন্মানো বাবা-মা’র সন্তানদের অর্জনের সঙ্গে।

২০১৯ সালের ২০ নভেম্বর প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার ঐ রিপোর্টের সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায় –

Ñ   অভিবাসী শিশুদের উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সমাপ্ত করার সম্ভাবনা তাদের তৃতীয় বা তারও পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি। উদাহরণ স্বরূপ, ২০০৬ সালে ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়স ছিলো এমন অভিবাসী শিশুদের ৪৩% শতাংশই ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন করে। যেখানে তাদের তৃতীয় বা তারও পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিপক্ষের শিশুদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন করে ২৯% শতাংশ।

Ñ    এশীয় অভিবাসীদের সন্তানদের উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সম্ভাবনা অনেক বেশি। উদাহরণ স্বরূপ, পূর্ব এশিয়া থেকে আসা অভিবাসী শিশুদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জনের সম্ভাবনা ২০১৬ সালে ছিলো তাদের তৃতীয় বা তারও পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিপক্ষের শিশুদের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি।

Ñ    সাধারণভাবে স্বল্পশিক্ষিত বাবা-মায়ের সন্তানরাও স্বল্পশিক্ষিত থেকে যায়। অবশ্য বাবা-মায়ের শিক্ষার স্তর অভিবাসী শিশুদের শিক্ষার স্তরের বিষয়ে যতটা না প্রভাব রাখে তার চেয়ে বেশি প্রভাব রাখে কানাডায় জন্মানো বাবা-মায়ের সন্তানদের ওপর।

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার ঐ রিপোর্টের ভূমিকায় বলা হয়, শরণার্থীদের স্বাগত জানানোর ক্ষেত্রে মানবিক ঐতিহ্যের বাইরে কানাডার অভিবাসন নীতির আরেকটি লক্ষ্য হলো সারাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি অর্জন। তার ওপর আন্তর্জাতিক অভিবাসনের লক্ষ্য থাকে যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যতের দক্ষ শ্রমশক্তির অভাব পূরণ করা যায়।

এসব লক্ষ্য সামনে রেখে

অভিবাসনের জন্য আবেদনকারীদের বাছাই করার সময় তাদের শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণের বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ধরে নেয়া হয় যে, চাকরি খুঁজে নিতে সক্ষম হলে অভিবাসীদের জন্য সমাজে একীভূত হতে অপেক্ষাকৃত কম ভোগান্তি হবে এবং তারা যদি কোনও স্বীকৃত উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সম্পন্ন করে তাহলে তাদের জন্য ভালো চাকরি খুঁজে পাওয়া কম কষ্টের হবে।

স্ট্যাটিস্টিকস কানডার ভূমিকায় আরো বলা হয়, কানাডায় অভিবাসনের জন্য বাছাইয়ের মানদণ্ড হিসাবে শিক্ষার ভূমিকাকে পরিসংখ্যান সমর্থন করে। যেমন, ২০১১ ও ২০১৬ সালের মধ্যে কানাডায় আসা ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী অভিবাসীদের মধ্যে ৫৭% শতাংশের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক বা ডিপ্লোমা বা তারও উচ্চস্তরের সার্টিফিকেট রয়েছে (অর্থনৈতিক অভিবাসীদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত ৭১% শতাংশ)। সেই তুলনায়, একই বয়সের অভিবাসী নয় এমন কানাডীয়দের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আছে মাত্র ৩০% শতাংশের।

প্রবাসের এই দ্বিতীয় প্রজন্মের তরুনদের সাফল্যগাঁথার কথা উঠে এসেছে অন্য একটি গবেষণা পত্রেও যেটি কয়েক বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল স্যোসাল সাইন্স রিসার্স জার্নালে। টরন্টো ইউনিভারসিটির অধ্যাপক জেফরী জি. রিটজ্ ও অধ্যাপক নাওকো হকিংস এবং মন্ট্রিয়লের ম্যাকগিল ইউনিভারসিটির অধ্যাপক হিদার জ্যাং তাদের ঐ গবেষনা পত্রে উল্লেখ করেছেন, কানাডায় মেইনস্ট্রিম জনগোষ্ঠির মধ্যে যাদের বয়স ২৫ থেকে ৩৯ তাদের বাৎসরিক আয় ৫০ হাজার ডলার। অন্যদিকে চীনা বংশোদ্ভূত দ্বিতীয় প্রজন্মের তরুনদের বাৎসরিক আয় ৬৩ হাজার ডলার।

কানাডায় দক্ষিণ এশীয় অন্যান্য এথনিক গ্রুপের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের সাফল্যও কমবেশী একইরকম। অধ্যাপক তিনজন তাদের গবেষণা পত্রে আরো উল্লেখ করেন যে, চীন এবং দক্ষিণ এশীয় তরুন ছেলে মেয়েদের মধ্যে গ্রাজুয়েশন লাভ করার হারও মেইনস্ট্রিম ছেলে মেয়েদের তুলনায় বেশী।

চীন ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের ছেলে-মেয়েরা কেন সাফল্যের দৌড়ে মেইনস্ট্রিম ছেলে-মেয়েদের তুলনায় এগিয়ে আছে সেই রহস্য লুকিয়ে আছে প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীদের মধ্যেই। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আছে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, শ্রী লংকা, মালদ্বীভস্, নেপাল, ও ভূটান। টরন্টো ইউনিভারসিটির অধ্যাপক জেফরী জি. রিটজ বলেন, “চীন ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে গত দুই বা তিন দশকের মধ্যে আগত অভিবাসীরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। তাদের ছেলে-মেয়েদের সাফল্যের পিছনে সম্ভবত এটি একটি কারণ হতে পারে। প্রবাসে আসার পর প্রথম প্রজন্মের এই অভিবাসীদেরকে অর্থনৈতিক চাপসহ আরো নানারকমের চাপের মধ্যে থাকতে হয়। কিন্তু তা সত্বেও এই অভিবাসীরা শিক্ষার কদর ও প্রয়োজনীতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বুঝিয়ে দেন তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে। আর এই কারনেই হয়তো তাদের ছেলে-মেয়েরা শিক্ষার প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহিত হয় এবং কর্মক্ষেত্রেও তারা সাফল্য লাভ করে।”