কানাডাকে নিজের বাড়ি বানাতে চেয়েছিলাম : পরে বুঝলাম, আমার ডিগ্রি এখানে মূল্যহীন

কোমালদ্বীপ মাক্কার

আমি বেড়ে উঠেছি ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে। আমার রাজ্যের প্রায় প্রতিটি সড়কেই এমন বিলবোর্ড ছিল যেগুলোতে কানাডায় উচ্চতর বেতনে উন্নততর জীবন ও প্রচুর চাকরির সুযোগের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। আমি অনেক পরিবার চিনতাম যাদের তরুণরা কানাডায় যাবার জন্য ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য ভাষা কোর্সে ভর্তি হয়েছিল।

তাদের ছেলে বা মেয়ে কানাডায় বসবাস করতে যাচ্ছে এমন খবর জানানোর সময় ওইসব বাবা-মার চোখে যে গর্বের ছাপ দেখেছি তা আমার মনে গভীর প্রভাব ফেলে। আমারও মনে হয় কানাডায় আশ্চর্যজনক সব সুযোগ আছে এবং একদিন সেটি আমারও বাড়ি হতে পারে।

আমি ভারতে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক এবং নগরপরিকল্পনা বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছি। স্থপতি হিসাবে কাজ করতে আমি নয়াদিল্লি এবং পরে দুবাই যাই। সেখানে আমি বহুজাতিক সংস্তাগুলোর সঙ্গে কাজ করেছি। দুবাইতে এমন বেতন অর্জন করেছি যেটি ভারতে কখনই সম্ভব হতো না। একইসঙ্গে সেখানে কর্ম ও জীবনের চমৎকার ভারসাম্যও ছিল। কিন্তু দুবাইতে প্রবাসীদের নাগরিকত্ব পাবার কোনও সহজ পথ নেই। তাই আমার কর্মজীবনের লক্ষ এগিয়ে নিতে এবং আমার স্থায়ী বাড়ি বলতে পারবো এমন একটি জায়গার খোঁজে আমি ২০১৭ সালে কানাডার এক্সপ্রেস এন্ট্রি প্রোগ্রামে অবেদন করি। আবেদনের প্রক্রিয়া চলার সময় আমি একজন স্থপতিকে বিয়ে করি এবং ২০২০ সালে পারমানেন্ট রেসিডেন্সি ভিসা লাভ করি। অবশেষে এত দিন ধরে শোনা ও পড়া সেই দেশে  যাচ্ছি বলে আমি এবং আমার স্বামী খুবই উত্তেজিত বোধ করছিলাম।

২০২১ সালের জানুয়ারিতে যখন আমরা টরন্টোতে এসে নামি, জীবনে প্রথম তুষারপাত দেখতে পাই। নির্মল বাতাসে শ্বাস নেয়া এবং প্রকৃতির শব্দ শোনা আমার ভালো লাগে। এই বাতাস ও প্রকৃতির শব্দ ভারতের থেকে অনেকটাই আলাদা। কিন্তু আমাদের সেই শীতকাল শিগগিরই শীতলতর হতে শুরু করে। কয়েক মাস ধরে চাকরি খুঁজতে খুঁজতে আমি বুঝতে পারি, আমার লেখাপড়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে নয় বছরের কাজের অভিজ্ঞতা কোনই কাজে লাগছে না।

কানাডার বাজারে আমাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে কিভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারি তা শিখতে আমরা টরন্টোতে আসার পর সরকারি অনুদান পাওয়া নিউকামারস প্রোগ্রামে যোগ দিই। কর্মসংস্থান বিষয়ক একাধিক পরামর্শক আমাকে জীবনবৃত্তান্ত থেকে মাস্টার্স ডিগ্রির বিষয়টি বাদ দিতে বলেন। এই ডিগ্রিই এক্সপ্রেস এন্ট্রি গ্রোগ্রামে আমাকে অতিরিক্ত পয়েন্ট এনে দিয়েছিল। তারা আমাকে জীবনবৃত্তান্তে কর্ম অভিজ্ঞতা কয়েক বছর কমিয়ে দেখানো এবং কিছু হাই-প্রোফাইল প্রকল্পে কাজের অভিজ্ঞতা বাদ দেওয়ারও পরামর্শও দেন যাতে আমি যেসব চাকরির জন্য আবেদন করছি সেসব পদের জন্য অতিরিক্ত যোগ্য বলে বিবেচিত না হই।

কানাডায় স্থাপত্য পেশায় যোগ দিতে লাইসেন্স নিতে হয়Ñ অন্যভাবে বলা যায়, নিজেকে স্থপতি বলে পরিচয় দেয়ার অনুমতি আমার ছিল না। কেবল আন্তর্জাতিকভাবে প্রশিক্ষিত একজন স্থাপত্য পেশাজীবী বলে পরিচয় দিতে পারতাম। আমাদের বিভ্রান্তি আরও বেড়ে যায় এই বাস্তবতায় যে, অভিবাসনের বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্বেÑ আর আমরা আমাদের যোগ্যতার কারণেই পয়েন্ট সিস্টেমে উচ্চতর স্কোর করেছিÑ কিন্তু লাইসেন্স দেয়ার বিষয়গুলি দেখে প্রাদেশিক সরকার যেখানে আমাদের ডিগ্রির স্বীকৃতি নেই। আমি যদি নিজেকে আর্কিটেক্ট বলতে চাই তাহলে আমাকে একটি ব্যয়বহুল কানাডীয় মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তি হতে হবে এবং এরই মধ্যে যে ডিগ্রি আমার আছে তারই পুনরাবৃত্তি করতে হবে অথবা একেবারে শুরুর পর্যায়ের কোনও ইন্টার্নশিপ নিয়ে আবারও করপোরেট ধাপে ওঠার জন্য হামাগুঁড়ি দিতে হবে। আমার উপদেষ্টাদের কাছে এবং অন্যান্য অভিবাসী যারা এভাবেই কাজ করেছেন তাদের কাছে এসব পরামর্শই আমি পেয়েছি। এতে আমি গভীরভাবে অপমানিত ও হতাশা বোধ করেছি।

আমাকে ইন্টারভিউর জন্য ডাকা হয়েছে এমন বেশিরভাগই ছিল শিক্ষার্থীদের কাজের অভিজ্ঞতা অর্জনের মত অথবা অবৈতনিক কাজ। আর্কিটেকচারাল টেকনিশিয়ানের পদে কয়েকটি কাজের অফার পাই যেগুলিতে ঘণ্টাপ্রতি বেতন পাওয়া যাবে ১৫ ডলার। আমি পুরোই দিশাহীন হয়ে পড়ি। কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রক্রিয়ায় আমি জীবনের অনেক বছর এবং প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছি। কিন্তু যে বিষয়ে পড়ালেখা করেছি এবং যে পেশার জন্য এত পরিশ্রম করেছি সেই খাতে চাকরি পাইনি। বরং শুধু টরন্টোর জীনযাত্রার ব্যয় মেটাতে দিনে দিনে আমার সব সঞ্চয় ফুরিয়ে আসছিল।

কানাডিয়ান ড্রিমের বাস্তবতা দেখে আমার স্বামী ও আমার মোহভঙ্গ হতে শুরু করে। আমরা দুজনেই উপসাগরীয় বিভিন্ন দেশ, আফ্রিকা এবং ভারতের মত অনেক অঞ্চলে বড় আকারের নানা প্রকল্পে কাজ করেছি। আর এদেশে নবাগত হিসাবে এখন আমরা কোম্পানিগুলিকে ব্যাখ্যা করছি, কেন আমাদের দৃশ্যত বিশেষ ‘কানাডীয় অভিজ্ঞতা’ নেই।

আমাদের সামনে যেসব বিকল্প ছিল সেগুলি বিবেচনা করি। এখানে থেকে যাওয়ার অর্থ হল কানাডীয় স্থপতি হিসাবে চাকরি পাবার আশায় শিক্ষার পেছনে আরও বিপুল অর্থ ব্যয় করা এবং একই সঙ্গে আমাদের অবসরের বা একটি বাড়ি কেনার জন্য অর্থ সঞ্চয়ের পরিকল্পনাগুলি আটকে রাখা। এতে আমাদের বহু বছরের শিক্ষা এবং দেশ-বিদেশে পেশাগত কাজের সব অভিজ্ঞতাই নিষ্ফল হয়ে যেত। অভিবাসীদেরকে তাদের পেশায় সফল হতে না দেবার জন্য পদ্ধতিগতভাবে অবরোধ তুলে রাখা একটি দেশে গড় জীবনযাত্রার চেয়ে হীনতর জীবনযাপনের বদলে আমরা বরং দেশটি ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিই। এখানে থাকা যতটা গুরুত্বপূর্ণ তারও চেয়েও আমি নিজেকে বেশি সম্মান করি।

আমি বুঝতে পারি না কানাডা সরকার কিভাবে বলে যে তারা শ্রমিকের ঘাটতি পূরণে বছরে পাঁচ লাখ অভিবাসী গ্রহণের পরিকল্পনা করছে, যখন তারা যোগ্যতাসম্পন্ন পেশাজীবীদের সঙ্গে এরকম অবজ্ঞাসূচক আচরণ বন্ধের জন্য কিছুই করার দরকার মনে করে না। অভিবাসন নীতি এবং চাকরিতে নিয়োগের মধ্যবর্তী ফাঁকফোকরগুলিতে বিদ্যমান ব্যবধান বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমরা সেইসব গল্প শুনতেই থাকবো যেখানে বিদেশি প্রশিক্ষিত ডাক্তার উবার চালকে পরিণত হন এবং শিক্ষকেরা কেবল দারোয়ানের কাজ পেতে পারেন।

আমি এটাও খুব ভালো করে বুঝি, কেন আমাদের মত অবস্থায় পড়েও অনেক অভিবাসী এখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন- যে বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন দেখানো হয়েছে সেটির বৈধতা দেয়ার জন্য। এদের অনেকেই এমনকি আমার নিজ শহরের মানুষ। আমি কখনই তোয়ালে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি এমনটা ঘটেনি, যতক্ষণ না আমি আমার ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখেছি। এখন আমরা দুবাইতে থাকি, যেখানে আমরা গর্বের সাথে নিজেদেরকে স্থপতি বলতে পারি, চমৎকার চাকরি করছি এবং একটি মানসম্মত জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে পারছি যা আমাদের অর্জন। আর এ নিয়ে আমাদের বাবা-মায়েরা গর্ব করতে পারেন। আমরা আর কানাডায় ফেরার কথা ভাবি না।

লেখক: ফ্রিল্যান্স প্রদায়ক। সূত্র : সিবিসি নিউজ