টরন্টোতে স্বাচ্ছন্দে বসবাস করতে হলে একজন কর্মজীবীর বেতন কত হওয়া উচিৎ?

খুরশিদ আলম

গ্রেটার টরন্টো এলাকায় ন্যূনতম সম্মানজনক অবস্থায় বসবাস করতে হলে একজন সাধারণ কর্মজীবী মানুষের মাসিক বেতন কত হওয়া উচিৎ? বিশেষজ্ঞরা বলছেন ৪ হাজার ৮ ডলার। কিন্তু এই পরিমাণ অর্থ কি সাধারণ কর্মজীবী মানুষেরা আয় করতে পারছেন ফুল টাইম কাজ করে?

গত নভেম্বর মাসে অন্টারিওতে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করে ১৫.৫০ ডলার থেকে ১৬.৫৫ ডলারে উন্নীত করা হয়েছে। সেই হিসাবে একজন স্বল্প আয়ের ফুল টাইম কর্মজীবী মানুষের মাসিক আয় গিয়ে দাঁড়ায় ২৬৪৮ ডলার। কিন্তু এই পরিমাণ আয় করতে পারলেও মাস শেষে ঘাটতি থেকে যায় ১৩৬০ ডলার। আবার কিছু কিছু ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আছে যারা নতুন আসা ইমিগ্রেন্ট বা রিফুউজিরদেরকে নূন্যতম বেতন না দিয়ে আরো কম বেতন দেয়। এবং সেটি ক্যাশে। প্রতিবাদ করার উপায় থাকে না। কারণ নতুন আসা লোকদের জন্য চাকরী পাওয়াটা বেশ কঠিন, অন্তত প্রথম কয়েক মাস। প্রফেশনালদের জন্য আরো কঠিন, এক থেকে দেড় বছর বা আরো বেশী সময় গড়িয়ে গেলেও দেখা যায় তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ প্রফেশনে চাকরী খুঁজে পান না। ফলে বাধ্য হয়ে বেশীরভাগ ইমিগ্রেন্টকেই পেশা পরিবর্তন করতে হয়। পেশা পরিবর্তন করে সাধারণত যে সব কর্ম বেছে নিতে বাধ্য হন তাঁরা সেগুলোতে বেতন অনেক কম অথবা আওয়ার কম থাকে। ফলে নূন্যতম সম্মানজনভাবে বেঁচে থাকার উপায় থাকে না তাঁদের।

‘অন্টারিও লিভিং ওয়েজ নেটওয়ার্ক’ এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুসারে দেখা যায়, প্রদেশটিতে বর্তমানে ন্যূনতম যে মজুরি প্রদান করা হচ্ছে তা এখানকার কোন অঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্যই স্বাচ্ছন্দ্যে বা ন্যূনতম সম্মানজনক ভাবে বাসবাস করার জন্য যথেষ্ট নয়। এই নেটওয়ার্কের হিসাব মতে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করার জন্য অন্টারিওতে বর্তমানে একজন কর্মক্ষম কর্মজীবী ব্যক্তির ‘লিভিং ওয়েজ’ হওয়া উচিৎ ঘন্টায় ২৫.০৫ ডলার বা মাসিক ৪ হাজার ৮ ডলার। লিভিং ওয়েজ হলো, ট্যাক্স-পূর্ব আয় যা একজন প্রাপ্তবয়স্ককে তাঁর নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় খরচ নির্বাহ করার জন্য অর্জন করতে হয়। এর মধ্যে আছে নিত্যদিনের খাদ্য, বাড়ি ভাড়া, পরিবহন, পোশাক, জুতা, চিকিৎসা, শিশুর যত্ন, প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষা, ইন্টারনেট, ফোন এবং বিনোদান ও ব্যক্তিগত যত্মের মতো অন্যান্য খরচ। সরকারী করসমূহ এবং সুবিধাও এর মধ্যে ধরা হয়েছে। 

অন্টারিও’র কোন অঞ্চলের বাসিন্দাদের কত আয় হওয়া উচিত তার একটি হিসাব দিয়েছে ‘অন্টারিও লিভিং ওয়েজ নেটওয়ার্ক’। হিসাবটি এরকম :

• $25.05/hr in the Greater Toronto Area
• $22.75/hr in the Grey Bruce Perth Huron Simcoe region
• $21.95/hr in Ottawa
• $20.90/hr in Dufferin Guelph Wellington Waterloo region
• $20.80/hr in Hamilton
• $20.60/hr in the East region, which includes Durham Region, Kingston, Hastings & Prince Edward, Muskoka, Northumberland, Peterborough and United Counties of Prescott & Russell
• $20.35/hr in Brant Niagara Haldimand Norfolk region
• $19.80/hr in North region, which includes Sault Ste. Marie, Thunder Bay and Sudbury
• $18.85/hr in London Elgin Oxford region
• $18.65/hr in the Southwest region, which includes Chatham—Kent and Windsor Essex

গ্রেটার টরন্টো এলাকায় স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে হলে একজন সাধারণ কর্মজীবী মানুষের মাসিক বেতন হওয়া উচিৎ ৪ হাজার ৮ ডলার।। ছবি: সংগৃহীত

আমরা জানি কানাডা একটি ধনী দেশ। কিন্তু সম্পদের সুষম বন্টন নেই দেশটিতে। ধনী দরিদ্রের ব্যবধান আকাশ পাতাল। কয়েক বছর আগে প্রকাশিত কানাডার সেন্টার ফর পলিসি অলটারনেটিভ নামের বাম ঘরাণার একটি সংগঠনের রিপোর্টে দেখা যায়, কানাডায় সবচেয়ে ধনী ৮৬ জন ব্যক্তি বা পরিবার অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার ০.০০২ শতাংশ লোক ক্রমশ আরও ধনী হয়ে উঠছেন এবং তাঁদের হাতে দেশের দরিদ্রতম এক কোটি ১৪ লাখ লোকের সম্পদের সমপরিমাণ সম্পদ পুঞ্জীভূত রয়েছে।

কানাডায় দারিদ্রতার হার চোখে পড়ার মত। স্ট্যাটিসটিকস কানাডার এক হিসাবে দেখা যায়, ২০১৮ সালে দেশটিতে দারিদ্রতার হার ছিল ১১%। এই হার অবশ্য পরবর্তী কয়েক বছরে কিছুটা কমে এসেছে। সর্বশেষ হিসাবে দেখা যায় ২০২১ সালে দারিদ্রতার হার ছিল ৭.৪%।

এই হলো কানাডা। ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ হওয়ার পরও দেশটিতে বহু লোক দারিদ্রসীমার নিচে বাস করছেন এবং অন্যদিকে সম্পদের পাহাড় গড়ছেন মুষ্ঠিমেয় লোক। সম্পদের এই অসম বন্টন দেশটিতে এক অসম সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত অন্যান্য গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে কানাডার এই অতি ধনীরা দিন দিন আরো বেশী পরিমাণের সম্পদের মালিক হচ্ছেন। দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যা ঘটছে তার প্রায় পুরো ফায়দাটা তাঁরাই বাগিয়ে নিচ্ছেন। বাদবাকী যাঁরা আছেন তাঁরা পাচ্ছেন অতি সামান্য সুবিধা অথবা কিছুই পাচ্ছেন না। ফলে সমাজে তৈরী হচ্ছে সীমাহীন বৈষম্য। অক্সফ্যামের পলিসি এন্ড ক্যাম্পেইন ডিরেক্টর লরেন রেভন বলেন, যে সমাজে বৈষম্য অনেক বেশী সে সমাজ অর্থনৈতিকভাবে টেকসই নয়। দীর্ঘ মেয়াদে যদি আমরা দেখি যে সম্পদ মাত্র গুটি কতক লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে তবে আমরা এও দেখবো যে ভবিষ্যতে বাজারে পণ্য কিনার লোক থাকবে না অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য।

দরিদ্র মানুষের কথা ভেবে কানাডার প্রভিন্সগুলো মাঝে মধ্যে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় বটে। কিন্তু তাতে সাধারণ আয়ের মানুষের কোন উন্নতি হয় না। স্মরণ করা যেতে পারে যে ২০২১ সালে করোনা মহামারীকালে কানাডিয়ানদের মর্মপীড়ার মূল কারণ যখন ছিল অর্থসংকট তখন অন্টারিওতে কর্মজীবী মানুষের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছিল ঘন্টায় মাত্র ১০ সেন্ট! অর্থাৎ সপ্তাহে ৪০ ঘন্টা কাজ করলে ৪ ডলার বেশী বেতন পেতেন একজন শ্রমজীবী ব্যক্তি। আর মাসে পেতেন ১৬ ডলার। ঐ বছর অক্টোবর মাসের ১ তারিখ থেকে নতুন ঐ আইন কার্যকর করা হয়েছিল। এর ফলে ন্যূনতম মজুরি তখন ঘন্টায় ১৪.২৫ ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৪.৩৫ ডলারে উন্নীত হয়েছিল। অন্টারিওর প্রধান বিরোধী দল নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি’র সেই সময়কার নেতা এন্ড্রিয়া হোরওয়াথ ১০ সেন্টের এই মজুরি বৃদ্ধির আইনকে শ্রমজীবী মানুষের জন্য অপমানজনক বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। সিবিসি নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, এই মজুরি বৃদ্ধি অন্টারিওর শ্রমজীবী মানুষের জন্য কোন ভিন্নতা বয়ে আনবে না।

উল্লেখ্য যে, অন্টারিও’র বিগত লিবারেল সরকারের করা Fair workplaces better jobs act অনুযায়ী ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারী থেকে ন্যূনতম মজুরি ১৫ ডলারে উন্নীত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু  বর্তমান প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টির নেতা ড্যাগ ফোর্ড  নির্বাচনে জয়ী হয়ে শুরুতেই এই আইনটি বাতিল করে দিয়েছিলেন।

অন্যদিকে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির পর ঐ সময় কিছু কিছু চাকুরীদাতা প্রতিষ্ঠান আত্মরক্ষার নামে কর্মচারীদের বিভিন্ন সুযোগসুবিধা কর্তন করে দিয়েছিল। কিন্তু দেখা গেছে সেই সময় অন্টারিওতে ন্যূনতম মজুরি ১৪ ডলারে উন্নীত করার পর ছয় মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও নতুন চাকরী সৃষ্টিতে তা নেতিবাচক কোন প্রভাব ফেলেনি।

সাম্প্রতিক সময়ে করোনা মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জিনিষপত্রের দাম বেড়ে গেছে অনেক। সাধারণ আয়ের মানুষ রীতিমত হিমসিম খাচ্ছেন জীবন ধারণের জন্য। গত বছর জানুয়ারীতে প্রকাশিত নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৬০ শতাংশ কানাডিয়ানকেই তাঁদের পরিবারের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ খাবার যোগাতে কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে।

এঙ্গুস রেইডের ঐ জরিপে দেখা যায়, ৫৭ শতাংশ কানাডিয়ান জানিয়েছেন, সম্প্রতি তাঁরা তাঁদের পরিবারের জন্য খাবার জোটাতে কঠিন সময় পার করছেন। ২০১৯ সালে সর্বশেষ যখন তাঁদেরকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো তখনকার চেয়ে এই সংখ্যা ৩৬ শতাংশ বেশি। রিপোর্টে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, এই নতুন সংখ্যার ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির ভূমিকা আছে। কানাডা গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে রয়েছে।

জরিপে এটাও দেখা গেছে যে, ৩৯ শতাংশ কানাডিয়ান মনে করেন, তাঁদের আর্থিক অবস্থা গত এক বছর সময়ে আরও খারাপ হয়েছে। এঙ্গুস রেইড ইন্সটিটিউট গত ১৩ বছর ধরে কানাডিয়ানদের আর্থিক অবস্থা অনুসরণ করছে। আর আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়েছে বলে যাঁরা মনে করছেন তাঁদের এই সংখ্যাটি গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

এঙ্গুস রেইড ইন্সটিটিউটের অন্য এক রিপোর্টে বলা হয়, অর্ধেকেরও বেশি কানাডিয়ান  বলেছেন, তাঁরা জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে পারছেন না। সমীক্ষায় আরও দেখা যায় যে, মূল্যস্ফীতি অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকায় প্রতি ১০ জনে সাত জনই বলেছেন, তাঁরা অর্থকড়ি ব্যাপারে চাপে আছেন। রিপোর্টে আরো বলা হয়, দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকায় কানাডিয়ানদের পারিবারিক বাজেট সব দিক থেকেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।

আবাসন, জ্বালানি ও ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকায় মূল্যস্ফীতিও বাড়ছে। এঙ্গুস রেইডের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৫৩ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁরা জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। জরুরী ব্যয়ের প্রসঙ্গে ৫১ শতাংশ উত্তরদাতা বলেন, হঠাৎ কোনও কারণে ১০০০ ডলারের বাড়তি ব্যয়ের প্রয়োজন দেখা দিলে তাঁরা সেটা বহন করতে পারবেন না। এর মধ্যে ১৪ শতংশ উত্তরদাতা রয়েছেন যাঁরা বলেন, কোনওরকম জরুরী প্রয়োজন পূরণেরই সামর্থ তাঁদের নেই।

স্বল্প বেতন এবং আর্থিক চাপের কারণে পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, টানা ছয় বছর ধরে কানাডার প্রায় অর্ধেক মানুষের রাতে ভালো ঘুম হচ্ছে না। এফপি কানাডার প্রেসিডেন্ট এবং সিইও তাসিয়া ব্যাটস্টোন সম্প্রতি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, “কানাডিয়ানরা তাঁদের আর্থিক অবস্থার সঙ্গে অব্যাহতভাবে সংগ্রাম করছেন এবং আর্থিক চাপের প্রভাব কেবল আর্থিক কল্যাণের ওপরেই নয় বরং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও পড়তে পারে।”

সাধারণ কানাডাবাসীর আর্থিক চাপের পেছনে কিছু বড় উপাদানের ভূমিকা রয়েছে, সেগুলি হলো ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি এবং পেট্রোল ও ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। গত কয়েক বছরে তার সাথে যোগ হয়েছে আকাশচুম্বী বাড়ি ভাড়া। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কানাডায় বাড়িভাড়া আকাশ ছুঁয়েছে। রেন্টালস.সিএর (Rentals.ca) সাম্প্রতিক (২০২৩ এর জানুয়ারী) ভাড়া সংক্রান্ত রিপোর্টের তথ্যমতে, ঐ সময় জাতীয় গড় ভাড়া ছিল ২,০০৫ ডলার যা ২০২১ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি। কানাডায় বাড়ি ভাড়ার দিক থেকে এখনও সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর ভ্যাঙ্কুভার। এ শহরে এক বেডরুমের একটি ইউনিটের গড় মাসিক ভাড়া ২,৫৯৬ ডলার।

৩৫টি শহরের তালিকার ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে, ভাড়ার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে টরন্টো যেখান এক বেডরুমের একটি আবাসিক ইউনিটের গড় মাসিক ভাড়া ২,৪৫৭ ডলার। এর পরেই আছে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার বার্নাবি (২,৪৫০ ডলার), টরন্টোর ইটোবিকোক এলাকা (২,১৭১ ডলার) এবং অন্টারিও’র মিসিসাগা (২,১৪৫ ডলার)।

তালিকার ১০ম অবস্থানে থাকা হ্যালিফ্যাক্সে এক বেডরুমের ইউনিটের গড় ভাড়ার গুণতে হয় ১,৯৮৭ ডলার। তালিকায় সবচেয়ে কম ভাড়ায় বাড়ি পাওয়া যায় যে শহরগুলিতে তার সবই আলবার্টায়। সেখানে লয়েডমিনস্টার শহরে এক বেডরুমের ইউনিটের বাসা পাওয়া যায় ৮৪০ ডলারে যা দেশের সর্বনিম্ন।

সারাদেশেই এক বেডরুমের বাসার গড় ভাড়া ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ৭.৯ শতাংশ বেড়ে ১,৬৮১ ডলারে পৌঁছায়। কিন্তু দুই বডরুমের ভাড়া আগের বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ পরিমাণ ৯.৪ শতাংশ বেড়ে ২.০৪৪ ডলারে উঠে যায়।

এক হিসাবে দেখা যায়, টরন্টোতে একজন নিন্ম আয়ের কর্মজীবী মানুষকে এক রুমের বাড়ির জন্য সপ্তাহে ৭৯ ঘণ্টা এবং দুই রুমের বাড়ির জন্য ৯৬ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। অর্থাৎ দিনে প্রায় ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টা কাজ করতে হয়। কানাডার প্রায় সব শহরেই ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করা কোনও ব্যক্তির পক্ষে এক বা দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া দিতে সক্ষম হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। অন্টারিও-ভিত্তিক এক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর পলিসি অলটারনেটিভস’ এর নতুন এক রিপোর্টে একথা বলা হয়েছে।

সেন্টার ফর পলিসি অলটারনেটিভস এর কর্মকর্তা ম্যাকডোনাল্ড বলেন, ‘কানাডার মতো একটি ধনী দেশে একা উপার্জন করেন এমন ব্যক্তি সপ্তাহের পুরো সময় কাজ করলেই কেবল পরিবারের জন্য দুই রুমের একটি মোটামুটি ভদ্রোচিত অ্যাপার্টমেন্টের ব্যবস্থা করতে পারবেন। কিন্তু টরন্টো ও ভ্যাঙ্কুভারের মতো বৃহত্তম মেট্রোপলিটন শহরসহ কানাডার বেশিরভাগ শহরে এমন কোনও এলাকা নেই যেখানে ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করা কোনও ব্যক্তির একক উপার্জনে এক বা দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করা সম্ভব।’

এদিকে তীব্র অর্থনৈতিক চাপের কারণে এবং একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় বেতন বৃদ্ধি না হওয়ায় স্বল্প আয়ের মানুষদের মধ্যে ফুড ব্যাংক ব্যবহারের সংখ্যাও গত কয়েক বছরে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, কানাডায় প্রতিদিন প্রায় এক মিলিয়ন লোককে ফুড ব্যাংকের শরণাপন্ন হতে হয় অভাবের তাড়নায়।

অন্টারিওর প্রায় ৭.৪ মিলিয়ন কর্মজীবী মানুষ বর্তমানে কাজ করছেন স্বল্প বেতনে। এই স্বল্প বেতনের চাকরীরও আবার কোন নিশ্চয়তা নেই, সকালে আছে তো বিকেলের ভরসা নেই। সকলের আবার ফুলটাইম কাজও নেই। অনেকেই পার্টটাইম কাজ করেন। অন্টারিওতে ন্যূনতম মজুুরিতে শ্রম বিক্রি করেন এমন লোকের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে গত কয়েক দশকে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় ১৯৯৭ সালে অন্টারিওতে প্রতি ৪০ জনের মধ্যে একজন ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করতেন। এখন প্রতি ৮ জনের মধ্যে একজন ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করেন। এই পরিস্থিতি দিনে দিনে খারাপের দিকেই যাচ্ছে। আর এই ন্যূনতম মজুরিতে ফুলটাইম কাজ পাওয়াও দিনে দিনে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ফলে এই কর্মজীবী মানুষদের দারিদ্রতাও কমছে না এবং তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যেরও কোন উন্নতী ঘটছে না। এতে করে সরকারের চিকিৎসা ব্যয়ভার যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যান্য সামাজিক ব্যয়ভারও। পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে শ্রম ঘন্টা। কারণ অভাবজনিত অসুস্থতার জন্য অনেকেই ঠিকমত কাজে যেতে পারেন না। এতে করে মোট জাতীয় উৎপাদনও হ্রাস পাচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে সমাজেরও অগ্রগতি।

কানাডায় বেতন বৈষম্যও চোখে পড়ার মত। এই বৈষম্য কতটা ব্যাপক তা তুলে ধরার জন্য কয়েক বছর আগের একটি হিসাব এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। এটি ২০১৫ সালের হিসাব। ঐ বছর কানাডার কয়েকটি কোম্পানীর শীর্ষ কর্মকর্তাগণ যে পরিমাণ বেতন ও সুবিধা গ্রহণ করেছেন সে দিকে তাকালে স্তম্ভিত হতে হয়। বিস্ময়ের সীমা অতিক্রম করে যায় তাঁদের বেতনের পরিমাণ দেখলে। সিবিসি নিউজের এক সংবাদে ঐ সময় বলা হয়, কানাডার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ১০০ CEO (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) ২০১৫ সালে গড়ে ৯.৫ মিলিয়ন বেতন (বিভিন্ন সুবিধাসহ) নিয়েছেন। তালিকার শীর্ষে যিনি ছিলেন তিনি হলেন ভ্যালেন্ট ফার্মাসিউটিক্যাল এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাইকেল পিয়ার্সন। ২০১৫ সালে তিনি ১৮২.৯ মিলিয়ন ডলার বেতন নিয়েছেন! দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন কানাডার মেঘনা ইন্টারন্যাশনাল এর (Magna International Inc) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডন ওয়াকার। তিনি বেতন নিয়েছেন ২৬.৫ মিলিয়ন ডলার। তৃতীয় স্থানে ছিলেন কানাডিয়ান প্যাসিফিক রেলওয়ে লিমিটেড এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হান্টার হ্যারিসন। তিনি বেতন নিয়েছেন ১৯.৯ মিলিয়ন ডলার। চতুর্থস্থানে ছিলেন এলিমেন্ট ফিনান্সিয়াল কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্টিভেন হাডসন। তিনি বেতন নিয়েছেন ১৯.৩ মিলিয়ন ডলার। পঞ্চমস্থানে ছিলেন ওপেন টেক্স কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক বেরেনেচিয়া। তিনি বেতন নিয়েছেন ১৮ মিলিয়ন ডলার। আর এই Top ১০০ CEO এর মধ্যে সবচেয়ে কম বেতন যিনি নিয়েছেন তিনি হলেন মেট্রো ইনক এর প্রধান নির্বাহী এরিখ লা ফ্ল্যাস। তিনি বেতন নিয়েছেন ৩.৬ মিলিয়ন ডলার।

সিবিসি নিউজের প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, অতীতেও বিভিন্ন কোম্পানীর প্রধান নির্বাহীগণ বিপুল পরিমাণের বেতন নিতেন। তবে এখনকার মতো এরকম অবিশ্বাস্য অংকের বেতন ছিল না তখন। এইতো মাত্র ৩০ বছর আগেও তাঁরা যে পরিমাণ বেতন পেতেন তা ছিল এ দেশের সাধারণ কর্মজীবী মানুষদের চেয়ে তিরিশ গুণ বেশী। কিন্তু এখন তাঁরা ১৯৩ গুণ বেশী বেতন পান।

২০১৫ সালে কানাডায় একজন সাধারণ সার্বক্ষনিক (সপ্তাহে ৪০ ঘন্টা) কর্মজীবীর বাৎসরিক গড় বেতন ছিল ৪৯,৫১০ ডলার। সেই হিসাবে উপরে উল্লেখিত Top ১০০ CEO গণ সকাল নয়টায় কাজে হাজির হয়ে দশটার মধ্যে অর্থাৎ এক ঘন্টায় যা আয় করবেন, একজন সাধারণ কর্মজীবীর পক্ষে সেই পরিমাণ অর্থ আয় করতে পুরো এক বছর লেগে যাবে! 

উল্লেখ্য যে, টরন্টোতে কিছু মানুষের আর্থিক দুরাবস্থার কারণে ক্ষতি হচ্ছে প্রতি বছর ৪.৪ থেকে ৫.৫ বিলিয়ন ডলার। ইউনাইটেড ওয়ের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত এক যুগান্তকারী গবেষণায় সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এই তথ্য। দারিদ্রতার কারণে মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটে বেশী। দরিদ্র মানুষ মানসিকভাবে বিষন্ন থাকে যার প্রভাব পড়ে কর্মস্থলের উৎপাদনশীলতায়। দরিদ্র অঞ্চলে মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেশী থাকে যার কারণে পুলিশ ও আইন বিভাগকে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ করতে হয় তা মোকাবেলা করার জন্য। আর এসব সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয় স্থানীয় সরাকারকে।

দারিদ্রতা সত্যিকার অর্থে সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতিটি সদস্যকেই ভোগায়। কারণ, দারিদ্রতার কষাঘাতে যাঁরা জর্জরিত তাঁরা নানান রোগ-শোকে ভোগে, মানসিক রোগ তাঁদের নিত্য সাথী হয়ে দাড়ায়, আইশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেশী সময় ব্যয় করতে হয় তাঁদের  জন্য। ফলে হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় ও আইন-শৃংখলা বজায় রাখার খরচ বৃদ্ধি পায়। দারিদ্রতার কারণে শারীরিক ও মানসিক রোগ লেগে থাকে বলে কর্মস্থলে তাঁদের উপস্থিতি কমে যায়। ফলে জাতীয় উৎপাদন ব্যহত হয়। স্কুল কলেজেও উপস্থিতির হার কমে যায় দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের। ড্রপআউট বেড়ে যায়। ফলে ভবিষ্যতে দক্ষ কর্মীবাহিনীর স্বল্পতা দেখা দেয়। এভাবে আরো নানাভাবে এই দারিদ্রতা সামজ ও রাষ্ট্রকে পিছিয়ে দেয়।

আমরা দেখেছি, অক্সফ্যামও তাঁদের  প্রতিবেদনে বিপজ্জনকভাবে সম্পদ কুক্ষিগত হওয়ার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। তাঁরা বলেছে, যে সমাজে অধিক বৈষম্য থাকে  সে সমাজে অপরাধের মাত্রাও অধিক থাকে। ঐ সমাজ হয় অস্বাস্থ্যকর। মানুষ একে অপরকে বিশ্বাস করেন না। মানুষজন মনে করতে থাকেন তাঁরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন যখন দেখেন ঐ অতি ধনীরা নিজেদের সুবিধার্থে আইন তৈরী করে নেন।

সংস্থাটি এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটাতে ‘নতুন অর্থনৈতিক মডেল’ প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছে। অক্সফ্যাম অবশ্য বেশ কয়েকটি সুপারিশ পেশ করেছে তাঁদের  রিপোর্টে এই বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য। এর মধ্যে আছে বাজেটে প্রগ্রেসিভ টেক্সেশন এর নীতি গ্রহণ করা যেটি নরডিক দেশসমূহে রয়েছে। এই দেশগুলোর মধ্যে আছে সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক ও আইসল্যান্ড। ঐ নীতিতে যাদের আয় বেশী তাদেরকে একটা বড় অংশ প্রদান করতে হয় টেক্স হিসাবে।

একই পরামর্শ দিয়েছেন কার্লটনের অধ্যাপক স্টিফেন হ্যারিস। তিনি বলেন, সম্পদের এই বৈষম্য দূরীকরণে কানাডা কিছু নীতি বা আইন প্রণয়ন করতে পারে যেমনটা নিয়েছে নরডিক দেশসমূহ। এই দেশগুলোতে সম্পদের বৈষম্য এত তীব্র নয়।

আমরাও মনে করি কানাডার সরকারের উচিৎ এ বিষয়ে আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হওয়া। নয়তো দেশটির সমাজব্যবস্থা এগিয়ে যাওয়ার বদলে পিছিয়ে যাবে যা কারো কাম্য হতে পারে না।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ