মনের আয়নাতে
সাইদুল হোসেন
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
নো ওয়েডিং বেলস
জীবনে বিয়ের বাদ্য আর বাজবে না, শানাইয়ের করুণ সুর কন্যার আসন্ন বিদায়ক্ষণ আর ঘোষণা করবে না। বিয়ের পাট নারীপুরুষের জীবন থেকে ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে, বিবাহিত স্বামীস্ত্রীর প্রেমময় জীবন আর কাম্য নয় – নূতন সম্পর্কের মেরুকরণ চলছে পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজে। ধর্মীয় অনুশাসনের গুরুত্ব ক্রমেই কমছে, বিয়ের ধর্মীয় পবিত্রতা আর কেউ মানতে রাজী নয়, বিয়ের সংজ্ঞা যাচ্ছে বদলে। দেশের আইন ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও রুচিপছন্দ মাফিক বদলানো হচ্ছে। Freedom of sex life, freedom of choice of life partners অপ্রতিহত শক্তিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে চলেছে। বিবাহিত জীবনের দৃঢ় বন্ধন নরনারীর আর কাম্য নয়, সন্তান ও পারিবারিক দায়িত্ব-বন্ধনহীন স্বাধীন জীবনের প্রতি আকর্ষণ ক্রমে বেড়েই চলছে। সন্তানের আকাক্সক্ষাও ক্রমশঃ লোপ পাচ্ছে এমনকি বিবাহিত নারীপুরুষের মাঝেও-ফ্রীডম অ্যান্ড ফান-ই মুখ্য, সৃষ্টি হয়েছে No Kidding Club -এর। মাতাপিতা হওয়ার আকাক্সক্ষা নিতান্তই গৌণ। ফলে সন্তানের সংখ্যা একটি-দু’টিতে নেমে এসেছে সচ্ছল পরিবারগুলোতে। কানাডাতে পুরুষরা গড়ে ৩০ বছর বয়সে এবং নারীরা ২৮ বছর বয়সে প্রথম বিয়ে করে থাকে।
কানাডা-ব্যাপী ২৫,০০০ হাউসহোল্ডের উপর সার্ভে করে Statistics Canada-র ২০০১ সনের General Social Survey-র “Do you think you will ever marry?” এই প্রশ্নের জবাবে কানাডিয়ান নারীপুরুষগণ যা বলেছে তার বিশ্লেষণ টরন্টোর Metro পত্রিকার ৮ই জুন ২০০৫ সংখ্যায় No Wedding Bells শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। তা থেকে দেখা যায় যে ২৯ থেকে ৫৪ বছর বয়সের নাগরিকদের অন্ততঃ শতকরা ৫০ জনের জীবনে বিয়ের বাদ্য আর বাজবে না। কি কারণ? কারণটা হলো তারা বিয়ে করতে রাজী নয়। কেন? কারণগুলো নানাবিধ ঃ
১. বিবাহিত জীবনের প্রতি ক্রমবর্ধমান অনীহা ও আকর্ষণের অভাব;
২. হাই স্কুল ড্রপআউটদের কম শিক্ষার ফলে নিম্নবেতনের কাজ; জীবনযাপনের উপযুক্ত আয়ের অভাব;
৩. বিবাহিত ও যৌনজীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীর আমূল পরিবর্তন;
৪. সিঙ্গেল পেরেন্টসদের নানাবিধ সমস্যা; অধিকতর বিবাহ-বিচ্ছেদ;
৫. আর্থিক ও সামাজিক রিসোর্সের অভাব;
৬. ভালবাসা এবং বিয়ে জীবনে সুখের ভূমিকা রাখে এই মতবাদে অনাস্থা ও অবিশ্বাস;
৭. শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আকর্ষণীয় বেতনের অভাব;
৮. নারীপুরুষের লিঙ্গভেদে সামাজিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য;
৯. কৃষ্টিগত দৃষ্টিভঙ্গী (কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ড)
সেই বিশ্লেষণে আরো একটি বড় বিষয় দৃষ্টিগোচর হয়েছে যে বিবাহযোগ্যা নারীদের শতকরা ৬৬ জন বিয়ে করার কথাটা ভাবছেই না!
এখানে এসে একটা অর্থনৈতিক সত্য (economic truth) নিয়ে একটু আলোকপাত করা যেতে পারে।
নারীশিক্ষার প্রসারের পূর্বে সংসার জীবনে নারীদের স্ত্রী ও মাতা হওয়া ছাড়া, সংসারের সকল ভার বহন করা ছাড়া অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল না। নারীরা ছিল আজীবন অন্যের উপর নির্ভরশীল – শৈশবে পিতার, যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীন। অশিক্ষিত, অনুপার্জনশীল, পরনির্ভর, অবহেলিত জীবন ছিল তাদের অধিকাংশেরই দেশে দেশে। কিন্তু অবস্থাটার দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে, অধিক থেকে অধিকতর সংখ্যায় নারীরা শিক্ষিত হয়ে পুরুষের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে অফিস-আদালত- ফ্যাক্টরীসহ সর্বপ্রকার পেশায় নিজেদের স্থান করে নিচ্ছে। শিক্ষা তাদের আলোকিত, অবহিত করে তুলছে তাদের প্রকৃত অবস্থান ও অধিকার সম্পর্কে এবং একই সাথে অর্থনৈতিক মুক্তিও এনে দিচ্ছে। নারীরা ক্রমে পুরুষের উপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠছে, স্বাধীনভাবে একক জীবন কাটানোর মত মনোভাব ও সাহস গড়ে তুলছে, সরকারী আইনও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। এমন কি দেশে দেশে সমাজটা পুরুষ শাসিত হলেও নারীদের প্রতি প্রাচীন অবজ্ঞার দৃষ্টিভঙ্গীটা আর ধরে রাখতে চেষ্টা করছে না। ফলে বিয়ে না করেও স্বামীবিহীন স্বাধীন জীবন কাটানো আর অসম্ভব কাজ বলে তাদের দমিয়ে রাখতে পারছে না। একই সঙ্গে বিবাহিত জীবনে নারীদের প্রতি অত্যাচার এবং অবহেলাও তাদের দৃষ্টি এড়াচ্ছে না। অতএব বিয়ের প্রতি নারীদের অনীহার মনোভাবটা ক্রমে দৃঢ়তর হচ্ছে।
আহবমান কাল ধরে বিয়েটা ছিল একজন পুরুষ ও একজন নারীর মাঝে ধর্মীয়, সামাজিক এবং পারিবারিক একটা পবিত্র বন্ধন। বিয়েটা নারী ও পুরুষের মাঝেই হতো, প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যৌন আনন্দ লাভ ও সন্তান উৎপাদন, বংশ রক্ষা। কিন্তু সেই মনোভাব ও রীতি আজ ধুলায় লুণ্ঠিত। Sexual orientation খুব একটা powerful যুক্তি এখন। তাই কানাডা এবং আরো কিছু দেশে আইন পাস করা হয়েছে যে নারীপুরুষে বিয়ে (heterogeneous marriage)-এর পাশাপাশি homosexual or same sex marriage-ও (পুরুষে পুরুষে বিয়ে, নারীতে নারীতে বিয়ে) আইনসিদ্ধ এবং গ্রহণযোগ্য যা ইতিপূর্বে ছিল ঘৃণ্য ও অতি নিন্দনীয়। সমাজ এখন এ বিষয়ে বড়ই উদার, ফলে স্কুল-কলেজেও ছাত্র-ছাত্রীদের শেখানো হচ্ছে যে homosexuality is quite normal behaviour. ফলে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণটা ক্রমে সমলিঙ্গের প্রতি চালিত হচ্ছে। এখন বিয়ের (marriage-এর) সংজ্ঞা দাঁড়িয়েছে union যার অর্থ হবে সম্ভবত ‘বন্ধন’ অথবা ‘মিলন’। বছরে বছরে মহাসমারোহে ও ধুমধামের মাঝে টরন্টো শহরে সমকামীদের নিশান উড়িয়ে GAY PRIDE PARADE অনুষ্ঠিত হচ্ছে, লোকেরা সেটা উপভোগ করছে! চালু হয়েছে এবং ক্রমশঃ জনপ্রিয়তা লাভ করছে Common Law relationship বিয়ে না করেই নারীপুরুষের স্বামীস্ত্রীর মত বসবাস, সন্তানের মাতাপিতা হওয়া। এটাও আইনসিদ্ধ এই কানাডাসহ পৃথিবীর আরো কিছু দেশে। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে এমন সম্পর্ক যদিও গুরুতর অপরাধ, তথাপি State and Church যেহেতু এই সব দেশে separate, তাতে আইন পাস করতে কোন বাধা নেই। ধর্মীয় নেতাদের এ-ব্যাপারে আপত্তি তোলার বা বাধা দেয়ার কোন অধিকার নেই। কমন ল’ রিলেশনশিপে বসবাস করতে হলে গভর্ণমেন্টকে annual tax return এর Marital Status Box এর মাধ্যমে জানালেই হয়, wedding bells বাজিয়ে পরিবারে-সমাজে প্রচার করতে হয় না।
নারীদের বিয়ের প্রতি অনাগ্রহের অপর কারণ হচ্ছে পুরুষের যৌনক্ষমতাবর্ধক Viagra Pills-এর আবির্ভাব। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিলেই পাওয়া যায় এই পিল্্স্। পুরুষেরা দারুণভাবে খুশী এই অস্ত্র হাতে পেয়ে। প্রয়োজন না থাকলেও ব্যবহার করে যাচ্ছে তারা।
কিন্তু ডেভিড গ্রাহাম লিখিত ডিসেম্বর ১২, ২০০৩- এর ‘টরন্টো স্টার’ পত্রিকার হেলথ সেকশনে প্রকাশিত এক দীর্ঘ প্রবন্ধ থেকে দেখা যায় যে,
১. Viagra doesn’t create love or intimacy or desire. Viagra may actually make men even more penis-centric.
২. নারীরা এতে অখুশী কারণ পুরুষরা তাদের দেহসৌন্দর্য অথবা যৌনকামকেলী উপেক্ষা করে উত্তেজনা এবং আনন্দের জন্য শুধুমাত্র এই পিলের ক্ষমতার উপর নির্ভর করে যাচ্ছে, নারীদের নারীত্ব হচ্ছে অবহেলিত। পুরুষেরা আর নারীকে দেখে উত্তেজনা বোধ করছে না, নারীর দেহকে ভালবাসছে না-পুরুষের আকর্ষণ ও ভালবাসা এখন এই ভায়াগ্রা পিলের জন্য। এটা নারীদের এক বিরাট পরাজয়, এতে তারা ক্ষ্ব্ধু।
৩. এই পিল অপরদিকে পুরুষদেরও ক্ষতি করছে। পুরুষরা এখন নিজের দৈহিক যৌন-ক্ষমতার উপর ক্রমে আস্থা হারিয়ে এই artificial power-এর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। তারা আর চেষ্টা করে দেখতে রাজী নয় নারীকে যৌনতৃপ্তি দিতে তাদের নিজস্ব পৌরুষ কতখানি সক্ষম। নিজেদের ক্ষমতার প্রতি পুরুষরা ক্রমে psychologically সন্দিহান হয়ে উঠছে যার দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া শুভ নয়।
৪. এই পিল্ নারী ও পুরুষের মাঝে তাদের ভালবাসার বন্ধনে ফাটল ধরিয়ে দিচ্ছে। এই পিল্্ ক্রমে ভালবাসার ক্ষেত্রে, যৌনতৃপ্তির ক্ষেত্রে পুরুষের কাছে নারীর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াচ্ছে যার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ের প্রতিক্রিয়া অশুভ। পিলের উপর নির্ভরশীল, আবেগবিহীন, যৌনসুখসর্বস্ব পুরুষ ক্রমে নারীর স্নেহ-ভালবাসা হারিয়ে বসবে, দু’জনের সম্পর্কের মাঝে ধরবে ফাটল, পারিবারিক জীবন হয়ে পড়বে বিপর্যস্ত। এই আশঙ্কা নিতান্ত অমূলক নয়।
অন্যদিকে প্রতিষ্ঠা হয়েছে নারীপুরুষের অবাধ মিলনের জন্যে, পুরুষে পুরুষে, নারীতে নারীতে পার্টনার বেছে নিয়ে নিজ নিজ পছন্দ মত যৌনতৃপ্তি লাভের জন্য নানাধরনের ক্লাব শহরে শহরে। যৌনতৃপ্তি বা যৌন আনন্দলাভ আজ আর শুধু নারীকেন্দ্রিক নয় পুরুষের জন্য, পুরুষকেন্দ্রিক নয় নারীর জন্যে, তৃপ্তির মাধ্যম আজ বহুবিধ। পৃথিবীর দেশেদেশে আজ adult stores-এর ছড়াছড়ি যেখানে sex toys and accessories অবাধে বিক্রি হচ্ছে যান্ত্রিক উপায়ে যৌন আনন্দ লাভের সহায়ক হিসেবে।
এমন সময় ছিল যখন বিবাহ-বন্ধন ছাড়া অথবা লজ্জাকর বেশ্যাগমন ছাড়া যৌন তৃপ্তি লাভের অন্য কোন পন্থা খোলা ছিল না। আজ সেই যুগের ঘটেছে অবসান, বিয়ের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। Wedding Bells বাজিয়ে ঘটা করে লোক জানিয়ে বিয়ে করার যুগ অতীত হতে চলেছে উন্নত দেশগুলোতে। বর্তামান ইলেক্ট্রনিক উৎকর্ষের যুগে Global Village-এর বাসিন্দা হয়ে পৃথিবীর অনুন্নত দেশগুলোও এই যৌনতার অবাধ, মুক্ত জোয়ার থেকে আর বেশী দিন নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। সেই সব দেশেও তখন বিয়ের শানাই কমই শোনা যাবে।
জর্জ রামনাথ রামকাদর
রামনাথ রামকাদর। একজন গায়ানীজ সিনিয়র সিটিজেন। পরিচয় ৭-৮ বছরের, আমাদের হাইরাইজ অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়েই সস্ত্রীক বসবাস করতেন। তিনি কবিতা লিখতেন, কখনো কখনো তাঁর কবিতা আমাকে পড়তেও দিতেন। গড-এর উপর গভীর বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতা তাঁর। আধ্যাত্মিক মন, সবারই মঙ্গল হোক, সবাই শান্তিতে থাকুক এই সদিচ্ছা প্রকাশ করতেন সর্বদা। অমায়িক ব্যবহার। ধারণা করেছিলাম তিনি একজন হিন্দু, অন্তত তাঁর নামটা থেকে তিনি অন্য কোন ধর্মালম্বী হতে পারেন সেটা কখনো আমার মনে আসেনি। কিন্তু ধারণাটা বদলাতে হলো একদিন।
২০০৫-এর অক্টোবর মাসের কোন একদিন আমাদের বিল্ডিংয়ের এলিভেটরের পাশের দেয়ালে সাঁটানো একটা নোটিসে হঠাৎ নজরে পড়ল রামকাদরের ফটোটার উপর, নীচে লেখা রয়েছে তিনি সেপ্টেম্বর মাসে আকস্মিকভাবে মারা গেছেন, সেদিন তাঁর শোকসভা হতে যাচ্ছে আমাদেরই বিল্ডিংয়ের রিক্রিয়েশন রুমে। তাঁর আপনজনেরা, বন্ধু ও পরিচিতরা স্মৃতিচারণ করবেন, গড-এর কাছে তাঁর আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা জানাবেন। সবাই সাদরে আমন্ত্রিত। তবে নামটায় একটু নূতনত্ব চোখে পড়ল – জর্জ রামনাথ রামকাদর। ধর্মে খৃষ্টান।
শোকসভাতে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই গেলাম। উপস্থিত বহু লোকের মাঝে দেখা পেলাম রামকাদরের এক মেয়ের, নাম গ্লোরিয়া। তাকে আমার নাম-পরিচয় দেয়ার পর বললাম : রামকাদর আমার একজন বন্ধু ছিলেন, আমি তাঁর সম্পর্কে আপনাদের সামনে কিছু বলতে চাই যদি কোন আপত্তি না থাকে। মহিলা সানন্দে রাজি হলেন এবং তৎক্ষণাৎ আহ্বান জানালেন মঞ্চে যেতে। গেলাম, এবং সেখানে দাঁড়িয়ে আমি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম : রামকাদর আমার একজন বন্ধু ছিলেন, তাঁর মৃত্যুতে আমিও আপনাদের মত শোকাহত। গড তাঁর আত্মার শান্তি দিন।
রামকাদরকে চিনতাম একজন শান্তিপ্রিয় লোক হিসেবে, উদার-হৃদয় ব্যক্তি হিসেবে, একজন কবি হিসেবে। তাঁর কবিতা পড়তে আমি খুব ভালবাসতাম। একে একে ছ’টি কবিতা তিনি আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন Tomorrow, Forgiveness, What is Religion? Education, Good. Love. কবিতাগুলোতে মানুষের প্রতি ভালবাসা, প্রগাঢ় মমতা, এই সংসারের/পৃথিবীর অসারতা, গড- এর প্রতি ভক্তি ও তার প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা স্থান পেয়েছে।
রামকাদর একজন তৃপ্ত, ধার্মিক, ও উদার-হৃদয় লোক ছিলেন। আমি দেখা হলেই তাঁকে বলতাম : রামকাদর, আপনি একজন কবি, একজন আধ্যাত্মিক মনের মানুষ, আই লাইক ইউ। আমার কথা শুনে তিনি বলতেন : কেন লজ্জা দিচ্ছেন, আমি কবিও নই অথবা হোলিম্যানও নই, আমি একজন নগণ্য ব্যক্তি মাত্র, আমি শুধু সৎপথে থেকে সত্যের অনুসন্ধান করে যাচ্ছি মাত্র।
এবং সবশেষে বললাম : রামকাদরকে নিয়ে একবার আমি একটা গল্পও লিখেছিলাম আমাদের বাংলা ভাষায় টরন্টো থেকে প্রকাশিত একটা কমিউনিটি নিউজপেপারে যা আমার ‘আজো মনে পড়ে’ নামে গল্পের বইতে স্থান পেয়েছে। বইটা আমার হাতেই ছিল, হাত উঁচু করে বইটা দেখালাম সবাইকে।
আমি ওদের গায়নীজ কমিউনিটির কেউ নই, একজন খৃষ্টানও নই, আমি একজন মুসলিম কিন্তু তা সত্ত্বেও রামকাদরকে প্রশংসা করে গল্প লেখা, তাঁর সম্পর্কে কিছু প্রশংসাবাক্য সবার সামনে বলা ওদের কাছে খুব অবাকই লাগলো। প্রচুর প্রশংসা ও ধন্যবাদ জানালো ওরা আমাকে সেজন্যে। রামকাদরের মেয়ে গ্লোরিয়া জানতে চাইল আমার বইটার একটা কপি সে পেতে পারে কি না। বললাম : বইটা আপনাদের কোন কাজে লাগবে না কারণ এটা বাংলা ভাষায় লেখা, আপনারা তো বাংলা ভাষা পড়তে জানেন না। শুনে মেয়েটি বলল : খুব একটা প্রোব্লেম হবে বলে মনে হয় না, কারণ আমার এক আত্মীয় বর্তমানে ইন্ডিয়ান পুন্্জাবী (অর্থাৎ পাঞ্জাবী) ভাষা শিখছে, সে নিশ্চই পড়তে পারবে।
ওর কাথা শুনে আমি হেসে দিলাম, বললাম : নো ম্যাডাম, সেটা সম্ভব হবে না কারণ বাংলা এবং পুন্জাবী দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষা, একটা জানলেই আর একটা পড়া যায় না। শুনে মেয়েটা খুব হতাশ হলো। ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম সেদিন।
ভেবেছিলাম প্রসঙ্গটার ইতি হয়ে গেছে, কিন্তু আমার সেই ভুল ভাঙ্গল যখন দু’মাস পর ডিসেম্বর মাসের তীব্র ঠান্ডা এক সন্ধ্যায় গ্লোরিয়া এসে আমার অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় করাঘাত করল। ভেতরে এনে বসালাম। সে বলল : আমি এখান থেকে বেশ দূরের শহর শেলবার্নে থাকি, সেখান থেকে ঠান্ডা আর বরফ ঠেলে দু’ঘন্টা ড্রাইভ করে আপনার কাছে এসেছি আমার বাবাকে নিয়ে যে গল্পটি আপনি লিখেছেন তার একটা কপি নিতে। সেটা আমার এক বাঙ্গালী বন্ধুকে দিয়ে ইংলিশে অনুবাদ করিয়ে পড়ে দেখতে চাই আমার বাবা সম্পর্কে আপনি কি লিখেছেন। হয়ত আমাদের অজানা কিছুও থাকতে পারে এবং আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ সেদিন বাবার মেমোরিয়াল অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে সবার সামনে বাবা সম্বন্ধে কিছু বলার জন্যে। এখন যদি সম্ভব না হয় এই নিন আমার ঠিকানা, আপনার অবসর সময়ে গল্পটার এক কপি আমাকে পাঠিয়ে দেবেন প্লীজ।
আমি আরো এসেছি এই জন্যে যে আপনার মুখ থেকে আমার বাবা সম্পর্কে আরো কিছু জানবো। বলবেন কি, প্লীজ?
তার বাবার প্রতি মেয়েটির গভীর ভালবাসা আমাকে মুগ্ধ করলো। বেশ কিছুক্ষণ ধরে বসে সে আমার স্মৃতিচারণ শুনলো। অবশেষে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিল।
পরদিন সন্ধ্যায় পোস্ট অফিসে গিয়ে গল্পটার একটা ফটোকপি এবং আমারই করা ট্রান্সলেশনটা মেল করে গ্লোরিয়ার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম।
মাস দুই পর আবার গ্লোরিয়া এসে উপস্থিত। কি খবর? বলল : সব খবর ভাল, থ্যাঙ্ক গড। আমি আপনার পাঠানো মেলটা পেয়েছি এবং আমার বাবা সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি। বেঁচে থাকাকালীন বাবাকে আমরা ঠিকমত চিনতে পারিনি, বলা চলে নিজেদের নিয়ে অতি ব্যস্ততার কারণে তাঁর প্রতি তেমন মনোযোগও দিইনি। বড় ভুল হয়ে গেছে। যাহোক আপনাকে আবারো ধন্যবাদ।
বিদায় নিল গ্লোরিয়া। মনটা আমার একটা স্নিগ্ধ অনুভূতিতে ভরে গেল। (চলবে)
সাইদুল হোসেন। মিসিসাগা