অপরাধ আবার বাড়ছে, সহিংস অপরাধ ২০০৭ থেকে সর্বোচ্চে
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার রিপোর্টে দেখা যায়, দেশ মহামারির আগের পর্যায়ে ফিরে যাচ্ছে
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : কানাডায় পুলিশে রিপোর্ট করা অপরাধ পর পর দ্বিতীয় বছরের মত বেড়েছে। একই সাথে সহিংস অপরাধ ২০০৭ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছেছে। খবর ভানেসা বলিনটেক – সিবিসি নিউজ।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, ২০২২ সালে সহিংস অপরাধ বেড়েছে পাঁচ শতাংশ। ২০২১ সালে অপরাধ বেড়েছিল ছয় শতাংশ।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার বিশ্লেষক ওয়ারেন সিলভার বলেন, এই বৃদ্ধি সম্ভবত এমন লক্ষণ হতে পারে যে, অপরাধ একটি ঊর্ধ্বমুখি প্রবণতায় ফিরে যাচ্ছে যেমনটা গবেষকরা দেখেছিলেন ২০২০ সালের শুরুর দিকে কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর আগে।
তিনি বলেন, “মহামারির সময় লকডাউনের বিধিনিষেধের কারণে অপরাধ যথেষ্ট কমে যায়Ñ অনেক অপরাধই ছিল অহিংস।
“এটি নিছকই কোনও পুনর্বিন্যাস নাকি আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া তা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে আমরা যেটা বলতে পারি তা হলো, এটি মহামারি ধরণের বাধা সৃষ্টিকারী প্রবণতাসহ পাঁচ বছরের স্বাভাবিক বৃদ্ধির ধারায় আছে।”
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্যমতে, প্রথম লকডাউনের বিধিনিষেধ আরোপের পর ২০২০ সালে সার্বিক পরিমাণ এবং তীব্রতার দিক থেকে অপরাধ “লক্ষ্যণীয়” মাত্রায় হ্রাস পায়। তার আগে ২০১৫ সাল থেকে শুরু করে উপর্যুপরি পাঁচ বছর ধরে অপরাধস্থলে তদন্ত (সিএসআই) বাড়ছিল।
নিউ ব্রান্সউইক, ইয়ুকন এবং নুনাভুত ছাড়া বেশিরভাগ প্রদেশ ও টেরিটোরিতে ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সিএসআই বেড়েছে। ম্যানিটোভায় সর্বোচ্চ বৃদ্ধির রেকর্ড হয়েছে যা ১৪ শতাংশ। এর পরেই আছে নিউফাউন্ডল্যান্ড ও ল্যাব্রাডর, কুইবেক ও প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড। এগুলোর সবখানেই সিএসআই বেড়েছে ছয় শতাংশ।
‘উদ্বিগ্ন হওয়া যথার্থ’
২০২১ সালের উপাত্তের তুলনায়, গত বছর হত্যা ও যৌন হামলার উচ্চ হার দেখা গেছে। আর ডাকাতি ও চাঁদাবাজি সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে এসেছে, যা বেড়েছে যথাক্রমে ১৫ ও ৩৯ শতাংশ।
২০২২ সালে পুলিশে রিপোর্ট করা হত্যার ঘটনা ছিল ৮৭৪টি যা এর আগের বছরের চেয়ে ৭৮ টি বেশি। সার্বিকভাবে বৃদ্ধির হার ছিল আট শতাংশ এবং প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ২.২৫ জন হত্যার শিকার হন। এই পরিসংখ্যান ১৯৯২ সালের পর সর্বোচ্চ বলে জানায় সংস্থাটি।
রিপোর্টে বলা হয়, সহিংসতা ও হত্যার মত অপরাধে সবচেয়ে বেশি জড়িত আদিবাসী ও বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জনগণ। পুলিশের রিপোর্টে জানা যায়, ২০২২ সালে ২২৫ জন আদিবাসী ও ২৬৫জন বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ হত্যার শিকার হন।
টরন্টোর গুয়েলফ হামবার ইউনিভার্সিটির জাস্টিস স্টাডিজেন প্রফেসার লরা ম্যাকডায়ারমিড বলেন, বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর লোকেদের উপনিবেশ এবং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাস আছে যা এখনও “চলমান”।
ম্যাকডায়ারমিড বলেন, “সেই ইতিহাসের অবদান আছে … ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের।”
গত বছর পুলিশ ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ সাত শতাংশ বৃদ্ধির কথা জানায় যা ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ৭২ শতাংশ বেড়েছিল। এই বৃদ্ধির বেশিরভাগই ছিল বিশেষ বর্ণ, জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত ঘৃণাপ্রসূত অথবা যৌনতা সম্পর্কিত অপরাধ।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা এটাও লক্ষ করেছে যে, নির্দিষ্ট কিছু অপরাধ দীর্ঘদিন ধরে বাড়ছে। ২০২২ সালে পুলিশে অভিযোগ করা হয়েছে এমন প্রতারণা, পরিচয় চুরি এবং পরিচয় জালিয়াতির ঘটনা ছিল এক দশক আগের চেয়ে ৭৮ শতাংশ বেশি।
একইভাবে, চাঁদাবাজির ঘটনা ২০১২ সালের চেয়ে ২০২২ সালে ঘটেছে পাঁচগুণ বেশি। সংস্থাটি জানায়, প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে চাঁদাবাজির ঘটনা পাঁচটি থেকে বেড়ে ২৫টিতে দাঁড়ায়।
অটোয়া ইউনিভার্সিটির ক্রিমিনোলজি বিভাগের এমিরিটাস প্রফেসার ইরভিন ওয়েলার সহিংস অপরাধের সার্বিক বৃদ্ধি সম্পর্কে বলেন, “আমি মনে করি এটি বিরক্তিকর।”
তিনি বলেন, “কানাডায় আমাদের সহিংসতা সম্পর্কিত গুরুতর সমস্যা আছে। এ বিষয়ে জনগণের উদ্বেগ যথার্থ।”
গত বছর অসহিংস অপরাধ চার শতাংশ বাড়লেও তা ২০২১ সালের চেয়ে কম হারে বেড়েছে। সে বছর বেড়েছিল ছয় শতাংশ। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা জানায়, ২০২২ সালের বৃদ্ধির অনেকটাই ঘটে সম্পদ সম্পর্কিত অপরাধের হার বেড়ে যাওয়ায়, যার মধ্যে ছিল গাড়ি চুরি ২৪ শতাংশ, দোকানপাটে চুরি ৩১ শতাংশ এবং ছোটখাটো চুরি ১০ শতাংশ।
তবে, সব ধরণের অপরাধের হার বাড়েনি। অসহিংস অপরাধ, যেমন মাদক সম্পর্কিত অপরাধ, মাদকাসক্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো, পরিচয় জালিয়াতি এবং পরিচিতি চুরির হার ২০২১ সালের চেয়ে কমেছে।
তবে ওয়েলার বলেন, এসব অপরাধ প্রভাবিত হয় কত সংখ্যক পুলিশ অফিসার মাঠে আছেন অথবা একটি নির্দিষ্ট সমস্যার পেছনে কতজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা থেকে। তাই এ ধরণের অপরাধ কমে যাবার বিষয়টি পুরো বিষয়টির উন্নতির আভাস নয়।
তিনি বলেন, প্রথম স্তরের যৌন হামলার ঘটনা তিন শতাংশ বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও একই সূত্র প্রযোজ্য, যেখানে ভিকটিমের শারীরিক ক্ষতি ঘটে সামান্য অথবা একেবারেই ঘটে না। তিনি আরও যোগ করেন যে, যৌন হামলা এবং ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর হাতে সহিংসতার শিকার হবার বিষয়গুলি পুলিশের কাছে কমই রিপোর্ট করা হয়।
ওয়েলার বলেন, “কী ঘটছে সেটি পরিমাপের জন্য এসব পরিসংখ্যান মোটেই পুরোপুরি অব্যর্থ উপায় নয়।
নিরোধের দিকে নজর
তথ্য-উপাত্ত বাস্তব পরিস্থিতির আংশিক চিত্র তুলে ধরে। এতে পুরো চিত্র উঠে আসে না।
ম্যাকডায়ারমিড বলেন, অপরাধের শিকার অনেকেই পুলিশে অভিযোগ না করার সিদ্ধান্ত নেন। আর যেসব অভিযোগ দায়ের হয় সেগুলিতে অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পুলিশি তৎপরতায় স্বাভাবিকভাবেই তারা অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারেন।
ম্যাকডায়ারমিড বলেন, “সেই আলোকে এর অর্থ কী সেটা মূল্যায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা যেটা করতে পারে তা হলো “প্রতিক্রিয়া-ভিত্তিক” ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রতিরোধমূলক প্রচেষ্টার দিকে বেশি মনোযোগ দেয়া।
তিনি বলেন, “আমাদের দরকার শিক্ষা, কর্মসংস্থানের সুযোগের মত বিষয়ে আমাদের উদ্যোগ নিয়োজিত করা।
অপরাধ বৃদ্ধির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, তার সরকার জামিন সংস্কার, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা, ক্ষতি হ্রাসকরণ এবং তরুণদেরকে সমাজে সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে এ বিষয়ে কাজ করছে।
ট্রুডো বলেন, “আমাদের খুব বেশি শহরে সহিংস অপরাধের ক্রমবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে এটা ঠিক নয়।”
ওয়েলার আরও যোগ করেন যে, অপরাধের হার কমানো নির্ভর করে পুলিশি ব্যবস্থা কমিয়ে আনা, ঝুঁকিতে থাকা তরুণ ও পরিবারগুলোর জন্য নির্দিষ্ট সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ এবং সরকারের সকল স্তরে পলিসি ও কর্মসূচি প্রণয়নে এই ক্ষেত্রের আরও বিশেষজ্ঞকে জড়িত করার জন্য তহবিল সরবরাহ করার মধ্যে।