মনের আয়নাতে

সাইদুল হোসেন

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বিজ্নেস্ওম্যান

আমার বাসার কাছে দু’টি চাইনীজ গ্রোসারী স্টোর আছে, ওগুলো থেকেই মাছ-সবজী-মশলা ইত্যাদি কিনি সচরাচর। স্টোরের প্রায় সবার সঙ্গেই মোটামুটি পরিচয় আছে, ওখানে গেলে হাই-হ্যাল্লো করি।

স্টোর দু’টির একটিতে বেশ সুন্দরী এবং শিক্ষিতা এক চাইনীজ তরুণী কাজ করে বহু বছর ধরেই। একদিন অমি ওকে বললাম : ম্যাম, বহুদিন ধরেই ভাবছি তোমাকে একটা প্রশ্ন করবো কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছি না।

একটু হেসে সে বলল : নিশ্চই তুমি কোন অশালীন প্রশ্ন করবে না সেটা আমি বুঝি। এখন বল, কি জানতে চাও?

বললাম : তুমি তো একজন শিক্ষিতা মহিলা, খুবই সুন্দরী এবং স্মার্ট। তোমার জন্য ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে অভিনয় করা অথবা নাচগান করা অধিকতর appropriate হতো বলে আমি মনে করি। আমার জানতে ইচ্ছা করে তোমার youth and talent এর অপচয় করছ কেন?

আমার প্রশ্ন শুনে সে বলল : আমার সৌন্দর্য এবং ট্যালেন্টের প্রশংসা করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। আমি স্বীকার করি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে গেলে একটা কিছু হয়ত অ্যাচিভ করতে পারতাম, একটা পরিচিতি অর্জন করতে পারতাম, হয়ত কিছু পয়সারও আমদানী হতো। কিন্তু একটা কথা কি জান? আমরা হচ্ছি বংশগতভাবে বিজনেসম্যান, এবং এই স্টোরটা আমাদের নিজেদের। ট্রেডিশনটা বড় মূল্যবান আমাদের কাছে। বিজনেস করাটা ক্রমেই জটিলতর হয়ে উঠছে দিনে দিনে। তাই মা-বাবাকে সাহায্য করাটা, বিজনেসটাকে প্রফিটেবল রাখাটা আমার জীবনের priority list এ film industry’র glamorous life থেকে অনেক উর্ধে স্থান পেয়েছে। I belong here, I feel more comfortable here.

কর্মরত একজন বিজনেসওম্যান। ছবি: কেন্তারো টাকাহাসি/বিবিসি

এই প্রসঙ্গে এই আলোচনার বছর কয়েক আগের আর একটা ঘটনার উল্লেখ করছি। তখন আমি বড় একটা school supplies স্টোরে কাজ করতাম। ফ্যাক্স পাঠানো এবং রিসিভ করা, ফটোকপিং, ল্যামিনেটিং সার্ভিস ইত্যাদিও আমরা দিতাম। আমাদের পাশেই বেশ বয়স্কা এক ইন্ডিয়ান মহিলা একটা মাঝারি ধরনের গিফ্ট শপ চালাতেন। কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করলাম ৩০-৩২ বছরের এক ইন্ডিয়ান যুবতীও সেখানে কাজ করছে। ফ্যাক্স, ফটোকপি, স্টেশনারী ইত্যাদির প্রয়োজনে সেই যুবতী ঘনঘন আমাদের স্টোরে আসতো।

একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম : তোমাকে এই গিফ্ট শপে কাজ করতে দেখছি অল্প কিছুদিন ধরে। এর আগে তুমি কি করতে?

জবাবে সে বলল : স্টোরটা আমাদের। একা একা স্টোরে কাজকর্ম সামলাতে মায়ের বড় কষ্ট হচ্ছিল। আমি এর আগে এক ল’ইয়ারের অফিসে তার অ্যাসিস্টেন্ট হিসাবে কাজ করছিলাম, বেতনভাতা খুব খারাপ ছিল না। সে কাজ করার ডিপ্লোমাও আমার আছে। কিন্তু ভেবে দেখলাম বিজনেসে ফিরে আসাটাই প্রেফারেবল, কারণ আমরা বংশপরস্পরায় পাঞ্জাবী বিজনেসম্যানের পরিবার, সেটাই আমাদের বড় পরিচয়। তাই ঐ কাজটা ছেড়ে দিয়ে মায়ের কাছে চলে এলাম। মায়ের তো বয়স হয়েছে, একটু আরাম দরকার। তাছাড়া তাঁর কাছ থেকে বিজনেসের নানা কায়দাকানুন শিখে নেবো যাতে আমি স্বাধীনভাবে বিজনেসটা চালাতে পারি।

দাড়ি ও টুপি

আমার বাসার খুব কাছেই একটা ফুড স্টোর আছে, বুড়ো-বুড়ি দুই ভিয়েতনামীজ ও তাদের এক ছেলে এবং এক মেয়ে সেটা চালায়। কিছু বেতনভুক কর্মচারীও আছে। সপ্তাহে সাতদিনই খোলা থাকে। বাংলাদেশের পরিচিত মাছ-ফল-সবজী পাওয়া যায়, চাইনীজ ও থাই সামগ্রী রাখে ওরা। রিজনেবল প্রাইস, ওদের ব্যবহারও খুব অমায়িক, তাই বহু প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিই আমি ওখান থেকে কিনি। বুড়িকে ডাকি মাম্মী, বুড়োকে ‘হাই সিনিয়ার’। বড় মেয়েটা আমাকে দেখলেই বলে ‘কোমস্তা, আমিগো?’ অর্থাৎ হাউ আর ইউ, মাই ফ্রেন্ড? ওদের স্টোরে সাউথ আমেরিকান কাস্টমারদের আনাগোনা খুব বেশী, তাই ওদের স্প্যানীশ ভাষায় কোমাস্তা, আমিগো কথাটা শিখে নিয়েছে এবং প্রায় সব নন-চাইনীজ, নন ভিয়েতনামীজ কাস্টমারের বেলায় ঐ কথাগুলোই ব্যবহার করে থাকে মেয়েটা। ঐ পরিবারের সবার সঙ্গেই আমার একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে গত ৬-৭ বছরে।

একদিন আমি এক হালাল মীট স্টোর থেকে বের হতেই দেখি তার ভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে সেই ভিয়েতনামী বুড়ো। আমাকে দেখে সে চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করল : ইউ মুসলিম?

হেসে বললাম : ইয়েস, আই অ্যাম।

বুড়ো তখন সংশয়ান্বত। তাই আবার বলল : কিন্তু তোমাকে দেখে তো একজন মুসলিম বলে মনে হয় না।

জিজ্ঞাসা করলাম : মুসলিম বলে চেনার নিদর্শন কি?

বলল : কেন, তোমাদের মাথায় টুপি এবং মুখে দাড়ি?

এবার পট পরিবর্তন।

এক এরাব বুকস্টোরে যেতাম মাঝেমাঝে ইসলামী বই কিনতে। স্টোরের মালিকের সঙ্গে কিছুটা মুখ পরিচয় ছিল। সে একদিন আমাকে প্রশ্ন করল : ব্রাদার তুমি নিজেকে একজন মুসলিম বলে দাবি কর এটা ভাল কথা। আলহামদুলিল্লাহ! কিন্তু ব্রাদার, তুমি যে একজন মুসলিম তার প্রমাণ কি?

বললাম : আমার ঈমান, আমার ইবাদত।

সে বলল : সে তো ভতরের ব্যাপার; বাহ্যিক প্রমাণ কি?

বলাম : বাহ্যিক প্রমাণ বলতে তুমি কি বোঝাতে চাইছ? আমি এসে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে বলব, আসসালামু আলাইকুম, জেনে রাখ আমি একজন মুসলিম?

সে তখন বলল : না, সেটা নয়। ইসলামী নিদর্শন মুখে দাড়ি ও মাথায় টুপি তোমার মাঝে অনুপস্থিত। সেটার কথা বলছি। তোমাকে দেখে আসসালামু আলাইকুম বলার ইচ্ছা জাগে না, কারণ আমি নিশ্চিত নই তুমি একজন মুসলিম কি না।

বলাম : তোমার সালাম পাওয়ার জন্য অমি মোটেই লালাইত নই। তুমি বল, ইসলাম কি তবে দাড়ি এবং টুপিতেই সীমাবদ্ধ? ঈমান এবং ইবাদতের কি কোন মূল্য নেই? লোক দেখানো নিদর্শনগুলোই তবে ইসলাম? বহু অমুসলিমও তো দাড়ি রাখে, টুপি মাথায় দেয়। তারা কি তবে শুধু ঐ দু’টি নিদর্শনের কারণেই মুসলিম হয়ে গেল, আর ও দু’টি নেই বলে আমি হয়ে গেলাম অমুসলিম?

আমার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে সে বলল : তুমি বড়ই কুতর্ক কর, ব্রাদার।

আবার দৃশ্যান্তরে যাই।

টরন্টোর কোন এক ইসলাম প্রচার সমিতির  এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম একদিন। সেখানে একজন বক্তা সমবেত লোকজনের সম্মুখে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য রাখছিলেন। আমিও সবার সঙ্গে বসে গেলাম। একসময় বক্তাকে বলতে শুনলাম : ভাইয়েরা আমার, ভুলে যাবেন না যে আপনারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী মুসলিম। এবং আপনাদের ঈমান ও আমল পাকাপোক্ত করার সাথে সাথে আপনাদের বাইরের ইসলামী নিদর্শনগুলোর দিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে – আপনাদের ইসলামী লেবাস, মুখে দাড়ি এবং মাথায় টুপির কথা যেন ভুলে যাবেন না। আপনারা মুসলিম অথচ দাড়ি-টুপিবিহীন। আপনাদেরকে আমি আসসালামু আলাইকুম বলে সম্বোধন করব কিসের ভিত্তিতে?

যুক্তিহীন ধর্মীয় গোঁড়ামী (senseless fundamentalism) আমাদের মুসলিম সমাজের কত গভীরে প্রবেশ করেছে এগুলো তারই দৃষ্টান্ত মাত্র। ধর্মের মূল শিক্ষা থেকে দূরে সরে গিয়ে বাহ্যিক অনুষ্ঠানিকতাকেই এবং লেবাসকেই ইসলাম বলে ভাবতে শুরু করেছি এবং সেই ত্রুটিপূর্ণ মতবাদ অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়ারও চেষ্টা করছি। এর ফলাফল সমগ্র মুসলিম সামাজের জন্য শুভ নয়। আমাদের সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। নাহলে ‘All Muslims are terrorists and all terrorists are Muslims’ এই অপবাদ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে না।

স্ত্রী ও সন্তান

টরন্টোবাসী এক বাঙ্গালী ভদ্রলোক আমাকে মাঝে মাঝে ফোন করেন। তাঁর বয়স ৫০-৫২। আমাকে বেশ শ্রদ্ধার  চোখেই দেখেন। কখনো কখনো তাঁর মনের কথা বেশ অকপটেই বলে ফেলেন।

একদিন জিজ্ঞাসা করলাম : আর কতদিন একা একা কাটাবেন? বার্ধক্যের দোর গোড়ায় পৌঁছে যাবার আগেই একজন জীবনসঙ্গিনী জুটিয়ে ফেলুন, জীবনটাকে খানিকটা হলেও উপভোগ করে নিন। যৌবন তো ইতিমধ্যেই বিদায় নিয়েছে।

জবাবে তিনি জানালেন : বাকি জীবনটা একাকীই কাটাতে হবে। দু’দুবার বিয়ে করেছি। দু’বারই অল্প ক’দিন পর স্ত্রী আমাকে ত্যাগ করে চলে গেছেন। তৃতীয়বার ছাঁদনাতলায় যেতে আর প্রবৃত্তি হয় না।

বলাম : স্ত্রীরা বারবার আপনাকে পরিত্যাগ করে চলে যাওয়ার কারণ কি?

আছে কারণ, বললেন তিনি।

জানতে চাইলাম : আপনার ব্যক্তিগত কোন ব্যবহার অথবা অন্য কোন ত্রুটি কি এর জন্য দায়ী?

একটু চুপ করে থেকে বললেন : আপনার অনুমান যথার্থ। দোষ আমারই। সে জন্যই আবার নিজেকে বিয়ের ঝামেলায় জড়াতে চাই না।

*   *   *

অপর এ বাঙ্গালী পরিবারের সমস্যার প্রকৃতিটা ভিন্নধর্মী। ভদ্রলোকের বয়সও ৫০-৫২’র ভেতরেই। ২৫ বছরের বিবাহিত জীবন, আজও কোন সন্তান হয়নি। স্ত্রী সন্তান ধারণে অপরাগ, ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন। ভদ্রলোক মা-বাবার একমাত্র সন্তান। 

ওদের সঙ্গেও আমার খুব ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তাই কথা প্রসঙ্গে একদিন মহিলাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম : তাঁর সন্তান ধারণের অপারগতায় তাঁর স্বামীর প্রতিক্রিয়া কি? মহিলা অতি সহজ কণ্ঠে জানালেন : আমার স্বামী আমাকে দোষ দেয় না, দোষ দেয় তার ভাগ্যকে। আমি তাকে অকপটে বলেছি, তুমি তোমার মা-বাবার একমাত্র সন্তান, তোমার পুত্র সন্তান না হলে তোমার বংশ লোপ পেয়ে যাবে। তুমি বরং আর একটা বিয়ে কর, হিন্দু ধর্মে তো এমতাবস্থায় দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণে কোন বাধা নেই: সমাজেরও বাধা নেই: আমি সানন্দে সম্মতি দিচ্ছি তুমি আবার বিয়ে কর। আমার কথা শুনে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে সবই আমার ভাগ্য, ভগবানের ইচ্ছা। আর একটা বৌ ঘরে আনলেই আমার পুত্র সন্তান হবে, বংশ রক্ষা হবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? তাছাড়া দু’টি স্ত্রী নিয়ে এ যুগে বড় অশান্তিময় জীবন হবে। আর যতই তুমি মুখে বল না কেন, তুমিও তো মনে কষ্ট পাবে। এতসব জেনেশুনে কেন নিজেদের মাঝে অশান্তি ডেকে আনব? সুতরাং এ প্রসঙ্গ বাদ দাও।

কথায় কথা বাড়ে। এই প্রসঙ্গে বহু অতীতের (১৯৪৬-৪৯) একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। তখন আমি হাই স্কুলে পড়ি। আমার এক সহপাঠির বড়ভাই ভালবেসে একটি মেয়েকে বিয়ে করে, কিন্তু পাঁচ বছর বিবাহিত জীবনে তাদের কোন সন্তান না হওয়াতে ওর ভাই তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করে। বছর দুই পর তাদের সন্তান জন্মেছিল সেই খবর আমার সহপাঠি এক সময়ে আমাকে বলেছিল সে কথা আজো মনে আছে।

অন্সে

এক রোগী এলো ভর্তি হতে। কার্ডে নাম লেখা দেখলাম  Once. জিজ্ঞাসা করলাম : তোমার নামটা কি করে বলতে হবে? ইংলিশ Once (ওয়ানস) এর মতো না ভিন্ন ভাবে?

মহিলা আমার প্রশ্ন শুনে খুব মজা পেলো, বলল : নো, নো, নট্ লাইক ইংলিশ। আমি একজন সাউথ আমেরিকান, আমাদের ভাষা স্প্যানিশ। আমাদের ভাষা অনুসারে আমার নামের উচ্চারণ ‘অন্সে’ যার  অর্থ ‘এগারো’। আমি আমার মা বাবার এগার নম্বর সন্তান!

আফ্রিকা মহাদেশের গল্প

মহিলার নাম Amma. আফ্রিকা মহাদেশের ঘানার অধিবাসী, বর্তমানে কানাডায় ইমিগ্রেন্ট। এক অফিসে চাকরী করেন। সেখানে আমার যাতায়ত ছিল, সেই সূত্রে পরিচয়। চমৎকার হাসিখুশি স্বভাব। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম : তোমার এই Amma নামের কি কোন অর্থ আছে? বলল : আছে, এর মানে হলো আমার জন্মদিন শনিবার। বললাম : বুঝলাম না, আরো বুঝিয়ে বল। তখন সে আমাকে জানাল : আমার দেশ ঘানাতে Twi ভাষাভাষী ছেলেমেয়েদের নাম রাখার এটা বাঁধাধরা পদ্ধতি আছে। সেই পদ্ধতি অনুসারে বাচ্চাদের নামের অংশ হিসেবে তার জন্মবারের নামটাও ঢুকিয়ে দেয়া হয়, ছেলেদের বেলা একরকম, মেয়েদের বেলা অন্যরকম, কিন্তু অর্থ একই। আমি এখন সেই পদ্ধতিটা বলছি, তুমি লিখে নাও। লিখে শেষ করার পর যা পাওয়া গেল সেটা হলো এই :

লেখা শেষ হলে মহিলা বলল : আমার নাম Amma (উচ্চারণ এম্মা) কারণ আমি শনিবার দিন জন্মগ্রহণ করেছিলাম, আমি ছেলে হলে আমার নাম রাখ হতো Kwame (কোয়ামে)। আরো জেনে রাখ যে United Nations এর Secretary General Kofi Annan (সাবেক) একজন ঘানাইয়ান এবং তাঁর জন্মদিন ছিল শুক্রবার।

এবার ঘানা ছেড়ে চলুন কেনিয়াতে যাই।

হাসপাতালের Intensive Care Unit এ এক পেশেন্টকে দেখতে এল একজন ভিজিটর। সে পেশেন্টের ছোট ভাই, নাম Joseph. সে আরো বলল যে ওর আরো এক ছোট ভাই Paul রোগীকে দেখতে আসবে। তোমার বড় ভাইয়ের (অর্থাৎ রোগীর) লাস্ট নেম কি? জানতে চাইলাম আমি, কারণ পেশেন্টস্ লিস্ট লাস্ট নেম ধরেই তৈরী করা হয়। সে বললো : Munkoh. লিস্টে খুঁজে পেলাম Peter Heavens Munkoh.

একটু কৌতুহল বশতঃ জোসেফকে জিজ্ঞাসা করলাম : তোমার বড় ভাইয়ের নামে তো দেখতে পাচ্ছি Heavens লেখা রয়েছে। এখন বল তোমাদের দুই ছোট ভাইয়ের নামেও কি Heavens লেখা আছে? এটা কি তোমাদের ফ্যামিলি নেমের অংশ?

ইতিমধ্যে সবার ছোট ভাই পল-ও এসে উপস্থিত। আমার প্রশ্ন শুনে দুই ভাই একই সঙ্গে সজোরে হেসে উঠল। তারপর জোসেফ বলল : আমার মায়ের কোলে তাদের প্রথম সন্তান যখন এল তাকে দেখে মা-বাবা এত খুশী হলেন যে মনে হল  তারা যেন Heaven থেকে God এর পাঠানো একটা দামী গিফ্ট পেয়েছেন। আমরা খৃষ্টান। তাই মা-বাবা বাইবেল খুঁজে এই আদরের সন্তানের নাম বেছে নিলেন Peter. সঙ্গে জুড়ে দিলেন Heavens এবং তার শেষে আমাদের পারিবারিক নাম Munkoh. সব মিলিয়ে আমার ভাইয়ের নামটা দাঁড়ালো Peter Heavens Munkoh.

কিন্তু পরে যখন আমরা জন্মালাম মা-বাবার আনন্দে তখন ভাটা পড়েছে। আমাদের আগমনটা তাঁদের কাছে স্বর্গীয় আনন্দ বয়ে আনেনি। তাই আমাদের দুই ভাইয়ের নামে তাঁরা আর Hevens কথাটা যোগ করলেন না। ফলে আমরা দুই ভাই সাদামাটা Joseph Munkoh এবং Paul Munkoh হয়ে গেলাম। থামলো জোসেফ।

দুই ভাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি ওদের ICU তে Peter এর সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে গেলাম।

*   *   *

আমার তৃতীয় অভিজ্ঞতা সেই হাসপাতালেই। Maternity Unit এর এক পেশেন্টের স্বামী ছিলেন সেই ভদ্রলোক। বাড়ি আফ্রিকার তানজানিয়া।

স্ত্রীকে অ্যাডমিশন কাউন্টারে রেখে ভদ্রলোক আমার ডেস্কে এলেন গল্প করতে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে গল্প করে নিজের জীবনের অনেক ঘটনা বর্ণনা করে অবশেষে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন। আমাকে দিয়ে গেলেন কিছু মজাদার তথ্য। তার বর্ণনা অনুসারে :

আমি আফ্রিকার তানজানিয়ার অধিবাসী, ওখানে বিজনেস আছে, নিয়মিত যাওয়া আসা করি। তবে গত ২০ বছর ধরে কানাডায় বাস করছি। মূলতঃ আমি ইন্ডিয়ান। আয়-রোজগার ভাল। বর্তমানে তিনটি স্ত্রী-  দু’জন কানাডায়, একজন ইন্ডিয়াতে। ইচ্ছা আছে চতুর্থ স্ত্রী গ্রহণ করার – স্বাস্থ্য ভাল, আর্থিক অনটনও নেই। কানাডার দুই স্ত্রীকে আলাদা আলাদা দু’টি এ্যাপার্টমেন্টে রাখি। ওরা একে অন্যকে চেনা না। কারণ আমি কোনদিন পরিচয় করিয়ে দেইনি। তবে ওরা জানে যে ওদের দু’জন সতীন আছে। আমি আমার ইচ্ছা মত ওদের যে কোন একজনের এ্যাপার্টমেন্টে থাকি, সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখি দু’জনের সঙ্গেই। কিছুই লুকাইনি আমি ওদের কাছে, ওদেরও তাতে কোন অভিযোগ নেই।

আগামী বছর ইন্ডিয়া যাবার ইচ্ছা রাখি, কিছুদিন ওখানে স্ত্রীর সঙ্গে কাটিয়ে আসব। প্রতি মাসে আমি ওকে কিছু টাকা পাঠাই, সে আমার

নিজের বাড়িতেই থাকে। কোন সন্তান নেই, সন্তান ধারণে অক্ষম আমার সেই স্ত্রী।

এখন আমার বয়স মাত্রা ৪৮ বছর। কিন্তু ইতিমধ্যেই গ্র্যান্ডফাদার হয়ে গেছি আমি। আমার প্রথম ছেলের সন্তান হয়েছে। অল্প বয়সে বিয়ে করে তড়িৎ বাবা বনে গিয়েছিলাম। ছেলেকেও অল্প বয়সেই বিয়ে করিয়ে দিয়েছি। কারণ আমি adultery, sex outside marriage কে ঘৃণা করি। আমার ছেলে সেটা করুক সেটাও আমি চাই না।

তানজানিয়া দেশটা খুব সুন্দর। আফ্রিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বত Mount Kilimanjaro তানজানিয়ায় অবস্থিত। অতি জনপ্রিয় tourist attraction সেটা। আপনার তো দেখে থাকার কথা সেই বিখ্যাত ইংলিশ মুভি Snows of Kilimanjaro দেখেছেন? বললাম : দেখেছি। আফ্রিকার গভীরতম হ্রদ খধশব ঞধহমধহুরশধ ও আমাদের সেই দেশেই অবস্থিত। সুযোগ পেলে একবার বেড়িয়ে আসুন। হতাশ হবেন না। তখন আমাকে স্বরণ করবেন প্লীজ। (চলবে)

সাইদুল হোসেন। মিসিসাগা