টরেটক্কা টরন্টো
চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -১৭
কাজী সাব্বির আহমেদ
১৯৭৬ সালে প্রাইম মিনিস্টার লি কুয়ান ইউ তার প্রথম বেইজিং সফরের মাধ্যমে চীনের সাথে সিঙ্গাপুরের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্ককে আগের তুলনায় আরো গভীরতর করে তুলেন। ১৯৭৯ সালে লি কুয়ান ইউ এবং দেং শিয়াওপিং-এর মাঝে এক বাণিজ্য চুক্তি হয় এবং সেই চুক্তির ধারাবাহিকতায় ১৯৮১ সালে সিঙ্গাপুরে চীনের এবং চীনে সিঙ্গাপুরের ট্রেড সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার হয়ে উঠতে শুরু করে। তবে চীন এবং সিঙ্গাপুরের এই সম্পর্ক ছিল সম্পূর্ণভাবে অনানুষ্ঠানিক। কারণ সিঙ্গাপুর তখন আনুষ্ঠানিকভাবে তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দিয়ে রেখেছে। চীনের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রথম শর্ত হচ্ছে তাইওয়ানের সাথে সম্পর্ক ছেদ। কিন্তু চীন তার নিজের স্বার্থের জন্য তাইওয়ানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকা সত্বেও সিঙ্গাপুরকে বিশেষ ছাড় দিয়েছিল। সেই বিশেষ ছাড়ের প্রভাবে লি কুয়ান ইউ ধীরে ধীরে চীনের প্রতি আরো বেশী আকৃষ্ট হন এবং তার জীবনে মোট তেত্রিশবার সরকারিভাবে চীন সফর করেন। তার শেষ সফর ছিল ২০১১ সালে। এর ভেতর ১৯৮৮ সালে অর্থাৎ ১৯৮৯ সালের থিয়েনআনমেন ম্যাসাকারের ঠিক আগের বছর যখন তিনি চীন সফর করেন তখন তার সাথে চীনের প্যারামাউন্ট লীডার দেং শিয়াওপিং-এর শেষ বারের মতন সাক্ষাৎ হয়। উল্লেখ্য যে থিয়েনআনমেনের ঘটনায় জাপানসহ সারা পশ্চিমা বিশ্ব যখন চীনের কঠোর সমালোচনায় মুখর তখন সিঙ্গাপুর ছিল নিশ্চুপ। কারণ তারা তখন চীনের সাথে পাকাপাকিভাবে গাঁটছাড়া বাঁধার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে এবং সেই উদ্দেশ্যে নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছে। সিঙ্গাপুর তখন অপেক্ষা করছিল আসিয়ান-এর অন্যান্য দেশগুলির জন্য বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়ার সাথে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক চূড়ান্ত হওয়ার জন্য। সেই অপেক্ষার পালা শেষ হয় যখন ১৯৯০ সালের ৮ই অগাস্ট তারিখে ইন্দোনেশিয়া চীনের সাথে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। সেই বছরের ৩রা অক্টোবরে নিউ ইয়র্কের ইউএন হেড কোয়ার্টারে চীন এবং সিঙ্গাপুরের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এই কূটনৈতিক সম্পর্কের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন সিঙ্গাপুরের ফরেন মিনিস্টার ওং কানসেং এবং চীনের ফরেন মিনিস্টার ছিয়েন ছিচেন। আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পরপরই দুই দেশ তাদের পুর্বের ট্রেড সেন্টারকে দূতাবাসে রূপান্তরিত করে ফেলে। চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন সিঙ্গাপুরের জন্য ছিল একটি বড় লক্ষ্য অর্জন তাই ঠিক দুই সপ্তাহের মাথায় প্রাইম মিনিস্টার লি কুয়ান ইউ চীন সফরে যান এবং এটি ছিল তার পঞ্চম চীন সফর তবে সিঙ্গাপুরের প্রাইম মিনিস্টার হিসেবে তার শেষ সফর। কারণ ২৬ শে নভেম্বর ১৯৯০ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে গিয়ে ‘সিনিয়র মিনিস্টার’-এর পদে অধিষ্ঠিত হন। ২০১১ সালে তিনি যখন শেষ বারের মতন চীন সফর করেন তখন তিনি সিঙ্গাপুরের ‘মিনিস্টার মেন্টর’ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৯০ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ালেও তিনি প্রথমে ‘সিনিয়র মিনিস্টার’ এবং পরবর্তীতে ‘মিনিস্টার মেন্টর’ পদে অধিষ্ঠিত থেকে আড়াল থেকে সিঙ্গাপুরকে শাসন করতেন। তিনি এ ব্যাপারে এতটাই প্যারানয়েড ছিলেন যে ১৯৮৮ সালে ন্যাশনাল ডে র্যালি-র বক্তৃতাতে উল্লেখ করেন যে তিনি যদি দেখেন সিঙ্গাপুর সঠিক পথে পরিচালিত হচ্ছে না তবে তিনি কবর থেকে উঠে এসে হলেও সিঙ্গাপুরের হাল ধরবেন।
চীনের সাথে সিঙ্গাপুরের যখন কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলো তখন আমি ‘বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব পোস্টস এন্ড টেলিকম্যুনিকেশনস’-এর থার্ড ইয়ারের ছাত্র। ঠিক সেই সময়ে বহুল প্রতীক্ষিত এবং আলোচিত একাদশ এশিয়ান গেমস মাত্র শেষ হয়েছে যার রেশ রয়ে গেছে সারা বেইজিং শহর জুড়ে। সাফল্যজনকভাবে এই গেমসের আয়োজন এবং সমাপন করার মাধ্যমে থিয়েনআনমেন ম্যাসাকার পরবর্তী চীন আবারও বিশ্বমঞ্চে নিজেদের পজিটিভ ইমেজ তুলে ধরতে সমর্থ হয়। বলা যেতে পারে চীন আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে নতুন উদ্যমে তার যাত্রা শুরু করেছে। মাও সেতুং-এর চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে এসে দেং শিয়াওপিং-এর নেতৃত্বে চীনের কম্যুনিস্ট সরকার তখন মনোযোগ দিয়েছে কিভাবে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা যায়। ইতিমধ্যেই দেং শিয়াওপিং-এর যুগান্তকারী ‘ওপেন ডোর’ পলিসির কারণে চীনের অর্থনীতিতে একটি জোয়ার বেশ ভালোভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান যে আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে সেটা তাদের বসন-ভূষণ এবং বিলাস-ব্যসনে প্রকটভাবে প্রকাশ পাওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমি বেইজিং-এ পড়তে এসেছিলাম ১৯৮৭ সালে। তিন বছরের ব্যবধানে ১৯৯০-এ চাইনিজ জনগণের জীবনযাত্রায় যে পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি তাতে বেশ বোঝা যাচ্ছিল যে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে লক্ষ্য করে দেখেছি যে চীনের জনগণ মাও-এর আমলে প্রবর্তিত ‘থিয়ে ফান ওয়ান’ বা ‘আয়রন রাইস বৌল’-এর মায়া কাটিয়ে নিজ উদ্যোগে স্বল্প পুঁজির ব্যবসা করতে কিংবা উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে বেশী আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কম্যুনিস্ট চীনের সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে ‘আয়রন রাইস বৌল’ বলতে সেই সব চাকরিকে বুঝায় যেখানে রয়েছে আজীবনের জন্য ‘জব সিকিউরিটি’। কম্যুনিস্ট সরকারের ‘সিভিল সার্ভিস’-এ বেতনের টাকা কম হলেও ছিল পেনশনসহ নানা ধরণের সুযোগ সুবিধা। একবার এই চাকরিতে বহাল হতে পারলে সারা জীবনের জন্য আর ভাত-কাপড় কিংবা বাসস্থানের চিন্তা করতে হত না অর্থাৎ হাতের কব্জায় চলে আসত ‘থিয়ে ফান ওয়ান’। তবে এই ‘সিভিল সার্ভিস’-এর চাকরি পাওয়াটা সহজসাধ্য ছিল না যদি না পার্টির সাথে ভালো ‘কুয়ান শি’ বা ‘নেট ওয়ার্কিং’ না থাকত। তাই একবার এই চাকরি জুটে গেলে কেউ সহজে তা ছাড়তে চাইত না। কিন্তু ১৯৯০ সালে প্রথম টের পেয়েছি যে চীন আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে। সেই পালা বদলের যাত্রাতে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির যেমন দূরদর্শী নেতৃত্বের কৃতিত্ব রয়েছে তেমনি রয়েছে চীনের জনগণের নিরলস প্রচেষ্টা এবং অন্তহীন উদ্যমের কীর্তিগাঁথা। আর চাকরির চেয়ে ব্যবসাতে আয় অনেক বেশী এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ‘আয়রন রাইস বৌল’-এর ট্যাবু ভেঙে বেরিয়ে আসাটাও ছিল এই পালা বদলের একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। ১৯৯০ সালে দেখেছি জনগণকে উদ্যমী হয়ে উঠতে – কেউ ছোট খাট মুদি-দোকান (শিয়াও মাই পু) কিংবা রাস্তার পাশে রেস্টুরেন্ট (ফান কুয়ান) খুলে বসল, কেউ বা সেভেন সিটার মাইক্রোবাসকে ট্যাক্সি (বেইজিং-এর কোলোকিয়েল ল্যাঙ্গুয়েজে এইসব ট্যাক্সিকে ‘তা-ফা’ বলত সেই সময়) বানিয়ে চালানো শুরু করে দিল। আমি মাঝ বয়সী এক এমবিবিএস ডাক্তারকে সরকারি হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে সেই ট্যাক্সি চালাতে দেখেছি সেই সময়ে। তার ট্যাক্সি সারাদিনের জন্য ভাড়া করে আমরা বেইজিং থেকে প্রায় তিনশত কিলোমিটার দূরে ‘বেই তাই হ’ বীচে বেড়াতে গিয়েছিলাম একদিন। সেই সময়ে (১৯৯৪ সালে) হাংট্রৌ নরম্যাল ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েট এবং ‘হাংট্রৌ তিয়েন-জ’ ইউনিভার্সিটির ইংরেজীর লেকচারার জ্যাক মা চাকরি ছেড়ে ই-কমার্স ব্যবসার সাথে যুক্ত হন। তবে এই ব্যবসাতে আসার আগে তিনি হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে ভর্তির জন্য ক্রমাগত দশবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তার নিজ শহর হাংট্রোর কেএফসি-তে চাকরির ইন্টারভিউতে মোট তেত্রিশ জন প্রার্থীর তিনি একাই প্রত্যাখ্যাত হন। এতসব ব্যর্থতা কিন্তু তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। কালক্রমে তিনি ১৯৯৯ সালে ‘আলী বাবা’ প্রতিষ্ঠা করে আজকে অনেকটা জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। আজকের ‘আলী বাবা’-র জ্যাক মা-এর উত্থানের শুরুটা কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শুরুর সেই সময়টায় যখন থিয়েনআনমেন ম্যাসাকারের কলঙ্করেখাকে মুছে চীন দেং শিয়াওপিং-এর প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে নতুন করে যাত্রা শুরু করেছিল। অর্থাৎ সেই সময়টা ছিল চীনের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট, যেখান থেকেই চীন আজকের এই শক্তিশালী চীন পরিণত হয়েছে।
১৯৯২ সালের ১৭ই জানুয়ারীতে ৯০ বছরের বৃদ্ধ চীনের প্যারামাউন্ট লীডার দেং শিয়াওপিং পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে যখন শেনট্রেন যাওয়ার জন্য উহানগামী ট্রেনে চেপে বসলেন তখন সবাই অনুমান করেছিলো যে বেইজিং-এর শীতের প্রকোপ থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য অপেক্ষাকৃত গরম দক্ষিণ চীনে ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন তারা। কিন্তু পরদিন সকালে উহানে পৌঁছে যখন দেং শিয়াওপিং সেখানকার কম্যুনিস্ট পার্টির স্থানীয় নেতাদের সাথে মিলিত হলেন তখন বোঝা গেল তার এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য নিছক ছুটি কাটানো নয়। পরবর্তীতে দেখা যায় যে তার এই ‘দক্ষিণ চীন ভ্রমণ’ বা ‘সাউদার্ন ট্যুর’ চীনের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক রোডম্যাপ নির্ধারণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তার এই ট্যুরটিকে প্রাচীন চীনের ছিং ডাইনেস্টির প্রখ্যাত সম্রাট কাংসি-এর ১৬৮৪ সালের ইতিহাস খ্যাত ‘সাউদার্ন ইনসপেকশন ট্যুর’-এর সাথে তুলনা করা হয়। সম্রাট কাংসি তার বিরোধীদের দমন করার জন্য গোপনে দক্ষিণ চীন ভ্রমণ করেন তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য। পরবর্তীতে তিনি তাদেরকে দমন করতে সমর্থ হন। ধারণা করা হয় তিনি সম্রাট কাংসি-এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই দেং শিয়াওপিং অনুরূপভাবে পার্টির ভেতর তার বিরোধী মতের লীডারদের নির্মূল করার জন্যই অনেকটা গোপনেই দক্ষিণের এই ভ্রমনে বের হয়েছিলেন। এই ট্যুর শুরু করার মাত্র সপ্তাহ তিনেক আগে গর্বাচেভ প্রবর্তিত পেরেস্ত্রয়িকা এবং গ্লাসনট-কে অকার্যকর প্রমাণ করে পতন হয়েছিল কম্যুনিস্ট রাশিয়ার। ফলে দেং শিয়াওপিং-এর ‘কায় গ খায় ফাং’ (রিফর্ম এন্ড ওপেনিং আপ, যা কিনা ওপেন ডোর পলিসি নামে অধিক পরিচিত) সম্পর্কে কিছুটা সন্দিহান হয়ে পড়ে ট্রোংনানহাই (চীনের সেন্ট্রাল গভর্মেন্টের কার্যালয়) -এর লীডাররা। তাই তিনি মনে মনে ঠিক করলেন যে চীন যেন ‘ওপেন ডোর পলিসি’ থেকে সরে না যায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি প্রটোকলের বাইরে থেকে এক মাসব্যাপী এই ভ্রমণের সময় সাউদার্ন চায়নার অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর বা প্রভিন্সগুলি (স্পেশাল ইকনোমিক জোন) যেমন কুয়াংতোং, শেনট্রেন, ট্রুহাই এবং সাংহাই-তে যান এবং সেখানকার পার্টি নেতাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেন অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তার প্রস্তাবিত ‘কাই গ খায় ফাং’ বা ওপেন ডোর পলিসি-কে পূর্ণমাত্রায় প্রয়োগ করার জন্য। এই ট্যুর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাকে লজিস্টিক সাপোর্ট দেয় তার অনুগত পিপলস লিবারেশন আর্মি এবং তাকে মোরাল সাপোর্ট দেয় ‘স্পেশাল ইকনোমিক জোন’-এর স্থানীয় পার্টি নেতারা। এই দুই পক্ষের সমর্থন নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি পিপলস লিবারেশন আর্মির দুইজন টপ জেনারেল ইয়াং শাংখুন এবং ইয়াং পাইপিং-কে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, যারা ‘কায় গ খায় ফাং’-এর বিরোধিতা করবে তাদেরকে যেন লীডারশীপ পজিশন থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। প্রকারান্তে এই মেসেজটি ছিল পার্টির জেনারেল সেক্রেটারী ‘চিয়াং জ-মিন’-এর জন্য। ‘চিয়াং জ-মিন’ এই মেসেজটির মর্ম সঠিকভাবে অনুধাবন করেন এবং টেলিফোনে দেং শিয়াওপিং-কে তার পূর্ণ সমর্থন প্রদান করেন। এই ট্যুরের সময় দেং শিয়াওপিং ‘কুয়াংতোং’ প্রভিন্সকে আগামী ২০ বছরের ভেতর এশিয়ার চার টাইগারের (হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান এবং সিঙ্গাপুর) পাশাপাশি পঞ্চম টাইগার হিসেবে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি সিঙ্গাপুরের উন্নতির ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন যে সিঙ্গাপুরের কাছ থেকে চীনের অনেক কিছু শেখার আছে। দেং শিয়াওপিং-এর এই স্তুতিবাক্যে সিঙ্গাপুর উৎসাহিত হয়ে উঠে চীনের সাথে ‘হ জো’ বা জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রজেক্ট করার ব্যাপারে। এর কয়েক মাস পরেই আমরা দেখতে পাই সিঙ্গাপুর এবং চীনের জয়েন্ট ভেঞ্চারে গড়ে উঠেছে ‘সু ট্রৌ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ যাকে সংক্ষেপে ‘এসআইপি’ বলেও উল্লেখ করা হয়।
১৯৯০ সালের অক্টোবরে চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পরপরই বেইজিং শহরে চোখে পড়ার মতন সিঙ্গাপুরিয়ান ব্যবসায়ীদের আগমন লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন হোটেলের লবিতে তাদেরকে দেখা যেত চাইনিজ ব্যবসায়ীদের সাথে বসে সম্ভাব্য ‘হ জো’ বা জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলছে। সিঙ্গাপুর এবং চীন, দুই দেশই তাদের জনগণকে উৎসাহিত করছিল একসাথে ব্যবসা করার জন্য। চীন সরকার জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানীর জন্য ট্যাক্স মওকুফ সহ নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা দেয়ার কথা ঘোষণা করে। ফলে চীনের জনগণের ভেতর নতুন এক জোয়ার এলো – বিদেশীদের সাথে ব্যবসা করে উন্নতি করতে হবে। এই সময় অনেক ফরেন স্টুডেন্টও যোগ দিল এই সুযোগের সন্ধানে। আমার রুমমেট শমশের পুরোপুরি কাজে লাগাল এই সুযোগ, সাংহাই থেকে সে বাংলাদেশের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির জন্য কাপড় যোগান দেয়ার ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ল ১৯৯২ সালে আন্ডারগ্রাজুয়েট ডিগ্রী কমপ্লিট করার সাথে সাথেই। অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে আজ সে সাংহাইতে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। এক সময় আমি দেখলাম যে আমার ফাইনাল ইয়ার প্রজেক্টের সুপারভাইজার সিঙ্গাপুর টেলিকম (সিং টেল)-এর বিলিং সিস্টেমের সফটওয়্যারকে এনহ্যানস করার একটি প্রজেক্ট নিয়ে এসেছেন তার ল্যাবের গ্রাজুয়েট ছাত্রদের দিয়ে করানোর জন্য। সিঙ্গাপুর সরকার তার দেশের দ্বার মেইনল্যান্ড চাইনিজদের জন্য ধীরে ধীরে উন্মোচন করছিল এই সময়। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর পোস্ট গ্রাজুয়েট পর্যায়ে গবেষণা বৃত্তি চালু করল চাইনিজ গ্র্যাজুয়েটদের জন্য। অবশ্য এই বৃত্তি শুধুমাত্র যে চাইনিজ ন্যাশনালের কিংবা চায়না থেকে গ্রাজুয়েটদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা কিন্তু না। বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান এমন কি নেপাল থেকেও ছাত্ররা এই বৃত্তি নিয়ে সিঙ্গাপুরে আসা শুরু করে, তবে মেইনল্যান্ড চাইনিজ ছাত্রদের সংখ্যা ছিল সবার চেয়ে বেশী। আমি ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টিতে রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেই এবং ২০০৬ সাল পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে বসবাস করি। আমার প্রায় এক দশকের সিঙ্গাপুরের জীবনে বিভিন্ন ক্যাটেগরির চাইনিজ ন্যাশনালদের আগমনে তাদের সমাজে কি রকম প্রভাব পড়েছে তা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়।
সিঙ্গাপুর একটি মাল্টি রেসিয়াল দেশ। যদিও এথেনিক চাইনিজরা সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু ‘মালয়’ হচ্ছে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ল্যাংগুয়েজ। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল এনথেম যেমন ‘মালয়’ ভাষায় তেমনি সিঙ্গাপুরের সব জাতিকে এক করে রেখেছে যে ন্যাশনাল সার্ভিস সেখানেও ব্যবহার করা হয় ‘মালয়’ ভাষা অর্থাৎ সিঙ্গাপুর আর্মির কমান্ড হচ্ছে ‘মালয়’ ভাষায়। এছাড়া ন্যাশনাল ডে র্যা লি-তে প্রাইম মিনিস্টার জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দেন সেটা তাদের ন্যাশনাল ল্যাংগুয়েজ ‘মালয়’ ভাষায়, পরে অবশ্য ইংরেজী এবং ম্যান্ডারিনে তিনি একই বক্তৃতা রিপিট করেন। ‘মালয়’ ভাষার পাশাপাশি ইংরেজী, ম্যান্ডারিন এবং তামিল হচ্ছে অফিসিয়াল ল্যাংগুয়েজ। তবে ইংরেজী হচ্ছে সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা। রাস্তাঘাটে কিংবা মার্কেটে সিঙ্গাপুর স্টাইলের ইংলিশ যা কিনা সিংলিশ নামেও পরিচিত সেটাই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সিংলিশের বিশেষত্ব হচ্ছে প্রচুর মালয় এবং হক্কেইন শব্দ ইংরেজীর সাথে ব্লেন্ড হয়ে গেছে। সিঙ্গাপুরের সব জাতিই তাদের নিজস্ব ভাষার বাইরে স্বচ্ছন্দে এই সিংলিশে কথা বলতে পারঙ্গম। ফলে সিংলিশই হচ্ছে সিঙ্গাপুরের ন্যাচরাল ল্যাংগুয়েজ। কিন্তু ১৯৯০ সালে চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার পর থেকে সিঙ্গাপুর সরকার নিরলস ভাবে চাইনিজ সিঙ্গাপুরিয়ানদেরকে ম্যান্ডারিন শেখার জন্য অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছে। প্রতি বছর এই ম্যান্ডারিন শেখার ক্যাম্পেইনে নতুন নতুন স্লোগান ব্যবহার করে সরকার যা কিনা টিভি সহ বিভিন্ন মিডিয়াতে গুরুত্বের সাথে প্রচার করা হয়। ১৯৯৩ সালের স্লোগান ছিল, ‘স্পিক ম্যান্ডারিন, ইউ উইল বেনিফিট গ্রেইটলি ফ্রম ইট’। স্কুলে ইংরেজী ভাষার পাশাপাশি সিঙ্গাপুরিয়ানদেরকে তাদের নিজ নিজ ‘মাদার টাং’ শিখতে হয়। চাইনিজ সিঙ্গাপুরিয়ানদেরকে মাদার টাং হিসেবে শিখতে হয় ম্যান্ডারিন। কিন্তু তারপরও চাইনিজ সিঙ্গাপুরিয়ানদের জন্য ম্যান্ডারিন শেখাটা একটা চ্যালেঞ্জ কারণ তাদের কারও মাদার টাং ম্যান্ডারিন না। বাসায় তারা হয় সিংলিশে কিংবা হক্কেইন বা অন্য কোন ডায়ালেক্টে কথা বলে। সিঙ্গাপুর যখন মেইনল্যান্ড চাইনিজদের ‘পার্মেনেন্ট রেসিডেন্ট’ হিসেবে আনা শুরু করে তখন সিঙ্গাপুরিয়ান চাইনিজরা তাদেরকে সহজভাবে নিতে পারেনি। সম্ভবত তাদের এথনিসিটি এক হলেও ‘কালচার’-এর ভিতর ছিল অনেক পার্থক্য। তাই ১৯৯১ সালে সরকারের স্লোগান ছিল, ‘লার্ন ম্যান্ডারিন, লার্ন দ্য কালচার’। ‘কালচার’-এর এই পার্থক্যের কারণে শিক্ষিত ইংলিশ স্পিকিং চাইনিজ সিঙ্গাপুরিয়ানরা নিজেদেরকে মেইনল্যান্ড চাইনিজদের চেয়ে আলাদা ভাবতে শুরু করে। নিজদেরকে ‘চাইনিজ’ আর মেইনল্যান্ড চাইনিজদেরকে ‘চায়নাম্যান’ বলে অভিহিত করে তারা একটা সামাজিক বিভাজন তৈরি করে। এমন কি সিঙ্গাপুরের জাতীয় দৈনিকে মেইনল্যান্ড চাইনিজদের ক্ষেত্রে ‘চায়নাম্যান’ শব্দ ব্যবহৃত হতে দেখেছি আমি। কিন্তু তারপরও সরকারের ‘প্রো চায়না’ পলিসির কারণে সিঙ্গাপুরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেইনল্যান্ড চাইনিজ মাইগ্রেট করে সিঙ্গাপুরিয়ান হয়েছে এবং চাইনিজ সিঙ্গাপুরিয়ানরাও ‘ম্যান্ডারিন’ ভাষাকে তাদের মাদার টাং হিসেবে শিখে যাচ্ছে। মাঝখানে সিঙ্গাপুরের অন্য রেসের নাগরিকদের কাছে দিনকে দিন তাদের চেনা দেশটাই অচেনা হয়ে যাচ্ছে অধিকহারে ম্যান্ডারিন ভাষার প্রচলনের কারণে। আমি ২০০৬ সালে সিঙ্গাপুর থেকে কানাডাতে চলে আসি। এরপর বারো বছর পর ২০১৮ সালের জানুয়ারীতে সিঙ্গাপুরে বেড়াতে যাই। তখন একদিন পাবলিক বাসে করে ‘ক্লেমিন্টি’ নামক স্থানে যাওয়ার জন্য যখন চাইনিজ ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম ‘উইল ইউ গো টু ক্লেমেন্টি?’ সে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। আমি বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি ম্যান্ডারিনে জিজ্ঞেস করলাম ‘নি ছুই পু ছুই চিন-ওয়েন-থাই?’ – ড্রাইভারের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ‘স্পিক ম্যান্ডারিন, ইউ উইল বেনিফিট গ্রেইটলি ফ্রম ইট’।
ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গও বুঝতে পেরেছিলেন ম্যান্ডারিন ভাষার গুরুত্ব। তাই তিনি ২০১৫ সালের অক্টোবরে চীনের সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস ইউনিভার্সিটি ‘ছিং হুয়া’-তে ২০ মিনিটের একটি বক্তৃতা এবং বক্তৃতা পরবর্তী প্রশ্নোত্তর পর্ব সম্পূর্ণ ম্যান্ডারিনে কন্ডাক্ট করেন। এর আগে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি যখন আমেরিকার সিয়াটলে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন তখন প্রেসিডেন্টের সাথে ম্যান্ডারিনে আলাপ করেন। তারপরও জাকারবার্গের ক্ষেত্রে ম্যান্ডারিনে এই কথোপকথন ‘বেনিফিসিয়াল’ হয়নি। কারণ চীন ২০০৯ সাল থেকে ‘ফেসবুক’-কে নিষিদ্ধ করে রেখেছে। (চলবে)
কাজী সাব্বির আহমেদ
কলাম লেখক । টরন্টো