টরেটক্কা টরন্টো
চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -১৬
কাজী সাব্বির আহমেদ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সিঙ্গাপুরের ফরেন মিনিস্টার ডঃ ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণান গত মাসে (১৭ই জুন, ২০২৩ সাল) ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিং-ট্যাঙ্ক ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন’-এর আমন্ত্রণে আমেরিকা সফর করেন। সেখানে তিনি ইউএস সেক্রেটারি অব স্টেট এন্টনি ব্লিনকেন-এর সাথে আলোচনাকালে জানান যে আসিয়ান অঞ্চলের সাথে আমেরিকার বর্তমানে যে স্ট্র্যাটেজিক এনগেইজমেন্ট রয়েছে সিঙ্গাপুর চায় সেটা যেন অটুট থাকে। একই সাথে সিঙ্গাপুর আশা করে আমেরিকা যেন নতুন পরাশক্তি চীনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত না হয়ে সহাবস্থান নীতি গ্রহণ করে। বিষয়টি আরো খোলাসা করে ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি বলেন যে, সিঙ্গাপুর সাউথ-ইস্ট এশিয়াতে ‘ওভারল্যাপিং সার্কেলস অব ফ্রেন্ডস’-এর উপস্থিতি আশা করে, কোল্ড-ওয়্যার চলাকালীন ‘পরস্পর বিচ্ছিন্ন আমেরিকা-চায়না’-কে নয়। কারণ সেটা হলে অনেক সাউথ ইস্ট এশিয়ার দেশগুলি বাধ্য হবে যে কোন একটি পক্ষকে বেছে নিতে। এর কিছুদিন আগে (১৩ই জুন, ২০২৩ সাল) সিঙ্গাপুরের সিনিয়র মিনিস্টার থারমান সংমুগারাত্নাম লন্ডন ভিত্তিক থিং-ট্যাঙ্ক ‘চ্যাটহ্যাম হাউজ’-এর সাথে আলোচনাকালে উল্লেখ করেন যে, চীন এবং আমেরিকার উভয়েরই উচিৎ হবে যে নিজেদের রাজনৈতিক কৌশলের ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ সম্পর্কে ‘হিউব্রিস’ (অত্যাধিক গর্ব কিংবা আত্মবিশ্বাস) পরিহার করে নিজেদের স্বার্থেই একে অপরের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। এই দুই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর বয়ান থেকে চীন-আমেরিকার ভিতর চলমান শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে সিঙ্গাপুরের অবস্থান কি সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। এই সাথে এও অনুমেয় যে, সিঙ্গাপুর কোন অবস্থাতেই চীনের সাথে কোন রকম বিরোধে জড়াতে চায় না। আর আমেরিকার সাথে তো নয়ই। কারণ অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বর্তমান বিশ্বের উদীয়মান পরাশক্তি চীনের সাথে সিঙ্গাপুর তার বর্তমানের কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছে। কোন অবস্থাতেই সিঙ্গাপুর সেটা হারাতে চায় না। এর কারণ অনুসন্ধান করতে হলে আমাদেরকে নজর দিতে হবে সিঙ্গাপুরের ইতিহাসের দিকে।
দেশ হিসেবে ‘রিপাবলিক অব সিঙ্গাপুর’ এবং ‘পিপলস রিপাবলিক অব চায়না’ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই দক্ষিণ চীনের ফুচিয়েন, কোয়াংতোং এবং হাইনান প্রদেশ থেকে এথেনিক চাইনিজরা মাইগ্রেট করেছিল বৃটিশ শাসিত মালেয়া এবং বোর্নিও-তে। সাইনো-জাপানিজ যুদ্ধ যা কিনা এক সময় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অংশ হয়ে দাঁড়ায়, সেই সময়ে এই মাইগ্রেটেড চাইনিজেরা জাপানিজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ‘কোয়ামিনতাং’ এবং ‘চাইনিজ কম্যুনিস্ট পার্টি’ উভয় দলকেই সমর্থন করে। সাউথ ইস্ট এশিয়াতে জাপানি আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য এই মাইগ্রেটেড চাইনিজরা মালেয়াতে (আজকের মালেয়শিয়া) গঠন করে ‘মালেয়ান পিপলস এন্টি জাপানিজ আর্মি’ (১৯৪১-১৯৪৫) মূলত ছিল একটি কম্যুনিস্ট গেরিলা দল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানিদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বৃটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠা এই দলই এক সময় বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ‘মালেয়ান ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি’-এর সাথে যোগ দেয়। উল্লেখ্য যে ‘মালেয়ান ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি’ হচ্ছে ‘মালেয়ান কম্যুনিস্ট পার্টি’ দ্বারা সৃষ্ট একটি সশস্ত্র বাহিনী যারা কিনা ‘মালেয়ান ইমার্জেন্সি’ ঘটনার কারণে মালেয়া থেকে বৃটিশ রাজত্বের অবসানের জন্য লড়াই শুরু করে। এই লড়াই চলে ১৯৪৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত। ‘মালেয়ান কম্যুনিস্ট পার্টি’ মূলত এথেনিক চাইনিজদের দ্বারা পরিচালিত হত এবং চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রেখে চলত। ফলে মালেয়শিয়া যখন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয় তখন মালেয়শিয়ান সরকারের একটি মাথাব্যাথা ছিল কিভাবে এই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা যায় কারণ এথেনিক মালেয়রা কখনই চায়নি মালেয়শিয়াতে কম্যুনিস্ট চীনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হোক। ১৯৭৪ সালে মালেয়শিয়া যখন অফিসিয়ালি চীনের সাথে ডিপ্লোম্যাটিক সম্পর্ক স্থাপন করে কেবল তখনই চীন মালেয়ান কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে তার সম্পর্ক ছেদ করে। ১৯৮৯ সালে অবশ্য মালেয়ান কম্যুনিস্ট পার্টি মালেয়শিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বৃটিশ কলোনি সিঙ্গাপুরকে দখল করে নেয় জাপান (১৯৪২-১৯৪৫)। কিন্তু যুদ্ধ শেষে জাপানের আত্মসমর্পনের পর বৃটিশরা আবার সিঙ্গাপুরের কর্তৃত্ব ফিরে পায়। কিন্তু জাপানের হাত থেকে সিঙ্গাপুরকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে জনগণ বৃটিশদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং ধীরে ধীরে এন্টি কলোনিয়াল সেন্টিমেন্ট দানা বাঁধতে শুরু করে। একই সময় ‘ফেডারেশন অব মালেয়া’-তে বৃটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন (মালেয়ান ইমার্জেন্সি ১৯৪৮-১৯৬০) তীব্র আকার ধারণ করে। ফলে ডিপ্লোম্যাটিক নেগোশিয়েশনের মাধ্যমে ৩১শে অগাস্ট, ১৯৫৭ সালে ‘ফেডারেশন অব মালেয়া’ অর্জন করে তাদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত ‘মারদেকা’ বা স্বাধীনতা। ১৯৬৩ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বরে ‘ফেডারেশন অব মালেয়া’-এর সাথে সিঙ্গাপুর, সারাওয়াক এবং নর্থ বোর্নিও বা সাবাহ-কে এক্ত্র করে গঠন করা হয় ‘ফেডারেশন অব মালেয়শিয়া’। কিন্তু সিঙ্গাপুরের ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দল ‘পিপলস অ্যাকশন পার্টি’-এর সাথে ‘ফেডারেশন অব মালেয়া’-এর রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে মতবিরোধের কারণে সিঙ্গাপুরকে ‘ফেডারেশন অব মালেয়শিয়া’ থেকে বের করে দেয়া হয়। ফলে ১৯৬৫ সালের ৯ই অগাস্ট পৃথিবীর বুকে ‘রিপাবলিক অব সিঙ্গাপুর’ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যার চার ভাগের তিনভাগই হচ্ছে এথেনিক চাইনিজ। এর ফলে ‘মালেয়ান কম্যুনিস্ট পার্টি’-র প্রভাব ছিল রয়ে যায় সিঙ্গাপুরে। বিশেষ করে চাইনিজ মিডল স্কুলগুলি এবং নানইয়াং ইউনিভার্সিটি ছিল এথেনিক চাইনিজ কম্যুনিস্টদের আখড়া। কিন্তু সিঙ্গাপুরের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ‘পিপলস অ্যাকশন পার্টি’ ছিল পুরোপুরি কম্যুনিস্ট বিরোধী। কারণ তারা মনে করত যে সিঙ্গাপুর যদি কম্যুনিস্ট পন্থী নীতি গ্রহণ করে তবে এক সময় তারা ‘পিপলস রিপাবলিক অব চায়না’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। তাই সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রাইম মিনিস্টার লি কুয়ান ইউ বহির্বিশ্বে সিঙ্গাপুর যেন কোনক্রমেই ‘থার্ড চায়না’ হিসেবে পরিচিত না হয় সেই দিকে বিশেষ নজর দিয়ে সিঙ্গাপুরের ফরেন পলিসি প্রণয়ন করেন। উল্লেখ্য যে, এখানে প্রথম ও দ্বিতীয় চায়না বলতে তিনি ‘পিপলস রিপাবলিক অব চায়না’ (চীন) এবং ‘রিপাবলিক অব চায়না’ (তাইওয়ান)-কে বুঝিয়েছিলেন। তবে সিঙ্গাপুর ‘পিপলস রিপাবলিক অব চায়না’-কে স্বীকৃতি না দিয়ে তাইওয়ানকে দিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই কম্যুনিস্ট চীন তখন সিঙ্গাপুরকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া থেকে বিরত থাকে এবং লি কুয়ান ইউ-এর চীন বিদ্বেষী মনোভাবের কারণে সিঙ্গাপুরকে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার ‘রানিং ডগ’ বলে উল্লেখ করে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে চীন কিন্তু বর্তমানে কানাডাকে প্রকাশ্যেই হরহামেশা আমেরিকার ‘রানিং ডগ’ বলে উল্লেখ করে থাকে।
১৯৬৫ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর সিঙ্গাপুরের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল নিজেদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে সিঙ্গাপুর ছিল প্রায় নিঃস্ব। তবে সুবিধাজনক ভৌগলিক অবস্থান ছিল সিঙ্গাপুরের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। সেই ভৌগলিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে ‘গভীর সমুদ্র বন্দর’ তৈরি করে এবং তার সাথে স্ট্রেইট অব ম্যালাক্কা-এর যোগসূত্র স্থাপন করে সাউথ ইস্ট এশিয়ার জন্য বাণিজ্যের দুয়ার খুলে দেয়ার মাধ্যমে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অর্জন করার পথটিই ছিল সিঙ্গাপুরের জন্য একমাত্র সুযোগ। কোনক্রমেই যেন সেই সুযোগ হাত ফস্কে না যায় সেটা মাথায় রেখেই তারা খুব সতর্কতার সাথে তাদের ফরেন পলিসি গঠনের দিকে মনোনিবেশ করে। সিঙ্গাপুর যখন স্বাধীন হয় তখন ‘কোল্ড ওয়ার’ বা ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-এর প্রভাবে গোটা বিশ্ব তখন দুইটি শিবিরে বিভক্ত। ঠান্ডা যুদ্ধের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকা এবং রাশিয়ার উভয়ের দৃষ্টি তখন সাউথ ইস্ট এশিয়ার প্রতি যেখানে সিঙ্গাপুরের ভৌগলিক অবস্থান। যদিও আমেরিকা তখন যুদ্ধ করছে নর্থ ভিয়েতনামের কম্যুনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে, অনবরত বোমা বর্ষণ করে চলেছে লাওসের উপর, তারপরও সাউথ ইস্ট এশিয়াতে আমেরিকার উপস্থিতিকে সিঙ্গাপুর স্বাগত জানাতে ভুল করেনি। কারণ তাদের উপস্থিতি সাউথ ভিয়েতনামকে দিয়েছে নিরাপত্তা এবং অন্যান্য দেশগুলিকে রক্ষা করেছে কম্যুনিস্টদের আগ্রাসন থেকে। তবে কোল্ড ওয়ারের মাঝে জড়িয়ে পড়ে সিঙ্গাপুর যেন তার অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অর্জনে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় তাই স্বাধীনতা অর্জনের দুইদিনের মাথায় ফরেন মিনিস্টার রাজারাত্নাম ঘোষণা করেন তাদের নন-এলায়েন্স নীতি। এই নীতি অনুসারে সিঙ্গাপুর ঠান্ডা যুদ্ধের কুশীলবদের কোন পক্ষের সাথে হাত মিলাবে না। বিশেষ করে কম্যুনিস্ট চীনের সাথে তো নয়ই। তবে সবার সাথেই বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলবে। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন না করেও সিঙ্গাপুর তার জন্মলগ্ন থেকেই চীনের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছে এবং কালের পরিক্রমায় সেই সম্পর্ক উত্তরোত্তর জোরদার হয়েছে।
ষাট দশকের গোড়া থেকেই রাশিয়া চেষ্টা করে আসছিল সাউথ ইস্ট এশিয়াতে আমেরিকার পাশাপাশি তাদের নিজেদের উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে। প্রথমে তারা চেষ্টা করেছে ইন্দোনেশিয়ার ক্ষমতাসীন কম্যুনিস্ট সরকারের সাথে জোট বেঁধে তাদের এই লক্ষ্যের দিকে এগুতে। কিন্তু ইন্দোনেশিয়াতে কম্যুনিস্ট সরকারের আকস্মিক পতনের পর রাশিয়া খুঁজতে শুরু করে তাদের নতুন পার্টনার। ঠিক সেই সময়েই মঞ্চে আগমন ঘটে সিঙ্গাপুরের। সিঙ্গাপুরের ভৌগলিক অবস্থানের কারণে রাশিয়া সিঙ্গাপুরের সাথে জোট বাঁধতে আগ্রহী হয়। তাছাড়া সিঙ্গাপুর ছিল সদ্য গঠিত ‘অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস’ বা আসিয়ান-এর ফাউন্ডিং মেম্বার। চীন অবশ্য শুরু থেকেই ‘আসিয়ান’-কে এন্টি-চাইনিজ, এন্টি-কম্যুনিস্ট এ্যাসোসিয়েশন এবং আমেরিকা ও রাশিয়ার হাতের পুতুল বলে চিহ্নিত করে এর বিরোধিতা করে আসছিল। চীনের এই বিরোধিতাকে প্রশমিত করার জন্য ‘আসিয়ান’-এর সদস্য দেশগুলি চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বিবেচনায় এনেছিল কারণ চীনের সাথে বিবাদে জড়ানো মানে হচ্ছে জলে বাস করে কুমিরের সাথে বিবাদে জড়ানো। তারপরও সিঙ্গাপুর ১৯৬৭ সালে রাশিয়ার সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রকল্পে শুরু করে ‘সিঙ্গাপুর-সোভিয়েট শিপিং এজেন্সি’। কারণ স্ট্রেইট অব ম্যালাক্কা-তে মালেয়শিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার আধিপত্যের পাশাপাশি সিঙ্গাপুর তার আধিপত্য বিস্তার করতে আগ্রহী ছিল। এই উদ্দেশ্যেই সিঙ্গাপুর রাশিয়ার সাথে যৌথভাবে শিপিং এজেন্সির ব্যবসা শুরু করে। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৮ সালে রাশিয়ার সাথে পূর্ণমাত্রায় কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলে। কিন্তু সেই বছরেই চীন এবং রাশিয়ার মধ্যে দূরত্ব তৈরি হওয়াতে ঠান্ডা যুদ্ধের গতিপথে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। ১৯৬৯ সালে রাশিয়ার সুপ্রিম লীডার ব্রেজনেভ প্রস্তাব করেন যে এশিয়াতে রাশিয়া তথা কম্যুনিস্ট ব্লকের স্বার্থ রক্ষার্থে একটি ‘নিরাপত্তা জোট’ গড়ে তোলা জরুরী, কিন্তু চীন সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। একই সাথে সিঙ্গাপুর যাতে রাশিয়ার প্রস্তাবিত ‘নিরাপত্তা জোট’-এ যোগ দেয়া থেকে বিরত থাকে সেই উদ্দেশ্যে চীন সিঙ্গাপুরের প্রতি আগের চেয়ে অনেক নমনীয় নীতি গ্রহণ করে। কোল্ড ওয়ারের এই অস্থিতিশীল সময়ে রাশিয়ার সাথে চীনের তিক্ততাপূর্ণ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহ প্রকাশ করেন যা চীনের জন্য ছিল একটি লোভনীয় প্রস্তাব। একই সাথে প্রেসিডেন্ট নিক্সন সাউথ ইস্ট এশিয়াতে আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি হ্রাস করার কথা ঘোষণা দেন যা ইতিহাসে ‘নিক্সন ডক্ট্রিন’ নামে অধিক পরিচিত। এই নিক্সন ডক্ট্রিনের কারণে সিঙ্গাপুরের ন্যাচারাল চয়েজ ছিল সোভিয়েট বলয় থেকে বেরিয়ে এসে চীনের সাথে সম্পর্ক সহজ করা। সেই কারণেই ১৯৭১ সালে সিঙ্গাপুর সরকার ‘সিঙ্গাপুর চাইনিজ চেম্বার অব কমার্স’-এর একটি প্রতিনিধিদলকে সিঙ্গাপুরের প্রতি আগের চেয়ে অধিকতর বন্ধুত্বপূর্ণ চীনে এক শুভেচ্ছা সফরে পাঠায়। তার কিছুকাল পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে নিক্সনের চীন সফর ছিল সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য ‘আসিয়ান’-এর সদস্য দেশগুলির সাথে চীনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে ত্বরান্বিত করার জন্য একটি বড় প্রভাবক। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে মালেয়ান চাইনিজ কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে বেইজিং সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে মালেয়শিয়া চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে সিঙ্গাপুরের ফরেন মিনিস্টার এস. রাজারাত্নাম ‘সিঙ্গাপুর গুডউইল মিশন ভিজিট’-এর ব্যানারে একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে চীন সফরে যান যা কিনা এই দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দীর্ঘদিনের ‘কূটনৈতিক নীরবতা’ ভঙ্গ করে নতুন এক সম্ভবানার দিগন্ত উন্মোচিত করে। চীন সরকারের উষ্ণ আতিথেয়তা সিঙ্গাপুরের প্রতিনিধিদলকে বিমোহিত করে। বিশেষ করে সফরের মাঝে কোন রকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ একদিন মধ্যরাতে সিঙ্গাপুরের ফরেন মিনিস্টারকে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় চীনের মুমূর্ষু প্রিমিয়ার ট্রৌ এনলাই-এর বাস ভবনে। সেখানে ট্রৌ এনলাই রাজারাত্নামকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, চীন মনে করে যে সিঙ্গাপুর কোনভাবেই ‘থার্ড চায়না’ নয়, বরং সিঙ্গাপুর হচ্ছে ‘রিপাবলিক অব সিঙ্গাপুর’। ট্রৌ এনলাই-এর মুখের এই কথা দিয়ে চীন সরকার বুঝিয়ে দেয় তারা সিঙ্গাপুরের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে কতখানি উদগ্রীব। চীনের এই আগ্রহকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে ১৯৭৬ সালের মে মাসে সিঙ্গাপুরের প্রাইম মিনিস্টার লি কুয়ান ইউ দশ দিনের সফরে চীন যান এবং চীনের বিভিন্ন শহর ঘুরে দেখেন। তবে লি কুয়ান ইউ কঠোরভাবে শর্তারোপ করেন যে এই সফরে কম্যুনিকেশনের মিডিয়াম হবে শুধুমাত্র ইংলিশ যাতে কেউ সিঙ্গাপুরকে ‘থার্ড চায়না’ হিসেবে ভুল বুঝতে না পারে। চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির উচ্চ পর্যায়ের নেতারা বিশেষ আগ্রহ নিয়ে লি কুয়ান ইউ-কে অভ্যর্থনা জানান, এমন কি মুমূর্ষু চেয়ারম্যান মাও সেতুং লি কুয়ান ইউ-এর সাথে আগ্রহ নিয়ে সাক্ষাৎ করেন। ১৯৭৬ সালের লি কুয়ান ইউ-এর এই সফর চীন এবং সিঙ্গাপুরের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রথম কার্যকরী বুনিয়াদ রচনা করে যা কিনা বাস্তবে রূপ নেয় ১৯৯০ সালে।
চেয়ারম্যান মাও-এর মৃত্যু এবং ‘গ্যাং অব ফোর’-এর পতনের পর দেং শিয়াওপিং চীনের সিনিয়র ভাইস প্রিমিয়ার পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই কিছু গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সফরে বের হন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৯৭৮ সালের নভেম্বর মাসে সাউথ ইস্ট এশিয়ার থাইল্যান্ড, মালেয়শিয়া এবং সিঙ্গাপুর ভ্রমণ। তার এই ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়া এবং ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে চীনের অবস্থানের পক্ষে এই তিন দেশের সহযোগিতা অর্জন। কিন্তু সিঙ্গাপুর সফরের সময় লি কুয়ান ইউ কৌশলে দেং শিয়াওপিং-কে বলেন যে, চীন আজ আসিয়ান দেশগুলিকে ‘রাশিয়ান ভালুক’-এর ভয় দেখাচ্ছে, কিন্তু আসিয়ান দেশগুলি ইতিমধ্যেই ‘চাইনিজ ড্রাগন’-এর ভয়ে ভীত। তিনি আসিয়ান দেশগুলিতে চলমান সরকার বিরোধী কম্যুনিস্ট বিদ্রোহতে চাইনিজ কম্যুনিস্ট পার্টির পরোক্ষ প্রভাবকে ইঙ্গিত করে এই মন্তব্য করেন। চীন সরকার তার ইঙ্গিত ধরতে পেরে দুই বছরের ভেতর আসিয়ান দেশগুলির কম্যুনিস্ট দলগুলির সাথে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে। এই সফরের আগেও দেং শিয়াওপিং তার যৌবনকালে আরো একবার সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করেছিলেন। সেটা ছিল ১৯২০ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য ফ্রান্সে যাওয়ার পথে তার জাহাজটি তখনকার বৃটিশ শাসিত সিঙ্গাপুর পোর্টে দুইদিনের জন্য নোঙ্গর করেছিল। সেই দুইদিনে তিনি জরাজীর্ণ সিঙ্গাপুর এবং সিঙ্গাপুরের দুর্ভাগা জনগণকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান। আটান্ন বছর পর সেই ফিশিং ভিলেজ সিঙ্গাপুরকে আধুনিক একটি দেশে রূপান্তরিত হতে দেখে তিনি বিমোহিত হন। এ প্রসঙ্গে লি কুয়ান ইউ তাকে বলেন যে, সাউথ চায়না থেকে আগত অশিক্ষিত চাইনিজ ইমিগ্র্যান্টরা যদি সিঙ্গাপুরকে গড়ে তুলতে পারে তবে চীনের সুশিক্ষিত বিশাল জনগোষ্ঠী কম্যুনিস্ট পার্টির সঠিক নির্দেশনায় চীনকেও গড়ে তুলতে পারবে সিঙ্গাপুরের মতন আধুনিক এক দেশে। দেং শিয়াওপিং তখন থেকেই মনে মনে ঠিক করলেন যে সিঙ্গাপুর থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং সিঙ্গাপুরের মডেলের ভিত্তিতে নয়াচীনকে গড়ে তুলতে হবে। এই সফরের মাধ্যমে দেং শিয়াওপিং এবং লি কুয়ান ইউ-এর সাথে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। ফলে তাইওয়ানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকা সত্বেও চীন সিঙ্গাপুরের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে। এমন কি তাইওয়ান এবং আমেরিকার সাথে চীন মেসেজ আদান প্রদানের ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। সিঙ্গাপুর স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই প্রথম প্রাইম মিনিস্টার লি কুয়ান ইউ তার পার্টি ‘পিপলস অ্যাকশন পার্টি’-এর মাধ্যমে সেখানে কঠিন হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন এবং অথরিটারিয়ান শাসন কায়েম করেন। দেং শিয়াওপিং সব সময়ই লি কুয়ান ইউ-এর এই অথরিটারিয়ান শাসনকে অনুমোদন করে এসেছেন এবং ১৯৮৯ সালে সিঙ্গাপুরের উদাহরণ দিয়ে তিনি থিয়েনআনমেনে তার ক্র্যাকডাউনের প্রয়োজনীয়তাকে জাস্টিফাই করেন। (চলবে)
কাজী সাব্বির আহমেদ
কলাম লেখক । টরন্টো