নিউইয়র্ক ও টরন্টো বইমেলা
জসিম মল্লিক
হুমায়ূন আহমেদ, সমরেশ মজুমদার এবং কিছু টুকরো স্মৃতি
নিউইয়র্ক সবসময় আমার অন্যরকম স্মৃতির জায়গা। নিউইয়র্কের মানুষ সবসময় আমাকে যে ভালবাসা দেন তা তুলনাহীন। নিউইয়র্ক যেনো আমার দ্বিতীয় বাড়ি। ২০০৩ সালে কানাডা আসার পর প্রায় প্রতিবছর নিউইয়র্ক বইমেলায় এসেছি। নিউইয়র্ক বইমেলা প্রবাসে বাংলা সংস্কৃতি চর্চার এক অপূর্ব মিলন মেলা। প্রথম এই মেলায় আসি ২০০৫ সালে। কোভিডের দুই বছর বাদে প্রায় প্রতিবছর নিউইয়র্ক বইমেলায় এসেছি। মনে আছে বইমেলার ২৫ বছর পূতির্র কথাও। একটি অনন্য অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেবার। অনেক বরেণ্যে মানুষরা এসেছিলেন দুই বাংলা থেকে। প্রতিবছরই আসেন এভাবে আসেন। উত্তর আমেরিকার লেখক, শিল্পী ও বইপ্রেমিরা সবসময়ই মেলাকে অনন্য সাধারণ করে তুলেছেন তাদের উপস্থিতি দিয়ে। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবাংলার পরই সবচেয়ে বড় বইমেলা নিউইয়র্ক বইমেলা। লেখক পাঠক আর প্রকাশকদের এক অসাধারণ মিলন মেলা। মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের কর্নধার বিশ্বজিত সাহা ছাড়াও এর সাথে যুক্ত একদল নিবেদিতপ্রাণ মানুষ বইমেলাকে স্মরনীয় করে রেখেছেন শুরু থেকেই। তাদের অভিবাদন। নিউইয়র্ক বইমলা এ বছর ৩২ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। এটা একটা বিরাট মাইলস্টোন। আমি নিজেও এর অংশ হতে পেরে গর্ববোধ করছি।
সেটা ২০০৯ সালের কথা। ২৬-২৮ জুন নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের পিএস-৬৯ অডিটরিয়ামে মুক্তধারা ফাইন্ডেশন আয়োজিত তিনদিনব্যাপী আর্ন্তজাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা শেষ হলো। এটা ছিল বই মেলার ১৮ বছর। সেবারের বইমেলার প্রধান আর্কষণ ছিলেন বরেণ্যে কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ, সমরেশ মুজুমদার এবং হাসান আজিজুল হকের উপস্থিতি। এর বাইরেও কানাডা আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আরো অনেক লেখক সাংবাদিক মেলায় যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বাংলা উৎসবের উদ্বোধন ঘোষনা করেন আর বই মেলা উদ্বোধন করেন হাসান আজিজুল হক। মেলায় হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী শাওন ও পুত্র নিষাদকে নিয়ে উপস্থিতি আলাদা মাত্রা যোগ করে। তার ভক্ত পাঠকরা ছুটে আসেন তাকে দেখার জন্য। সে বছর তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ’বলপয়েণ্ট’ প্রকাশিত হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের সাথে দেখা হওয়ার পর আমি বললাম, হুমায়ূন ভাই বলপয়েন্ট আমার খুব চমৎকার লেগেছে। তখন সাপ্তাহিক২০০০এ প্রাকাশিত হচ্ছিল ’কাঠপেন্সিল’। আমি সাপ্তাহিক২০০০ এ কাজ করি। তিনি আমাকে বলপয়েন্ট বইটিতে একটা অটোগ্রাফ দিলেন সেদিন।
২৬ ও ২৭ জুন দুইদিনই হুমায়ূন আহমেদ মেলায় এসেছিলেন। প্রথম দিন মঞ্চে তাকে কিছু বলার জন্য বললে হুমায়ূন আহমেদ তার স্বভাবসুলভ ঢংয়ে বললেন, পৃথিবীতে দুটি বিরক্তিকর জিনিস হচ্ছে বক্তৃতা শোনা ও বক্তৃতা দেয়া। এরপর তিনি একটি মজার গল্প শোনালেন শ্রোতাদের। গল্পটি বলা যাক…
“পুত্র নিষাদকে দিয়ে শুরু করি।
বইমেলা (২০০৮) শেষ হয়েছে। প্রকাশকরা লেখকের প্রাপ্য কপি দিয়ে গেছেন। বন্ধুবান্ধবদের বিলিয়েও ঘরভর্তি বই।
পুত্র নিষাদ প্রতিটি বইয়ের ফ্ল্যাপ খোলে। তার বাবার ছবি বের করে এবং ’এইটা আমার বাবা’ বলে বিকট চিৎকার দেয়। তার এই চিৎকার আমার কানে মধু বর্ষন করে।
দুই বছর বয়সে হঠাৎ এক দুপুরে সে সমালোচকের কঠিন ভূমিকায় অবতীর্ন হলো। আমাকে এসে বলল ’বাবা বই ছিড়ব’। আমাকে বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমি কখনও না বলব না।
আমি বললাম, ঠিক আছে বাবা বই ছেঁড়। সে কয়েকটা বই ছিঁড়ল এবং বুঝতে পারল, বই ছেঁড়া খবরের কাগজ ছেঁড়ার মতো এত সহজ না। তখন সে বলল, বাবা, তোমার বইয়ের ওপর আমি পিসু করব।
আমি আমার বইয়ের স্তুপের ওপর পুত্রকে দাঁড় করিয়ে দিলাম। সে হাসিমুখে পিসাব করল। এখন আমার বন্ধুবান্ধবরা বই নিতে এলে প্রথমেই বলেন, পিসাব ছাড়া কোনও বই আছে? থাকলে দিন”
এদিকে নিষাদ মহা বিরক্ত করছিলো। এক পর্যায়ে কান্না জুড়ে দিলো। সে তার বাবা ছাড়া আর কারো কোলে যাবে না। হুমায়ূন আহমেদ যখন কথা বলছিলেন নিষাদ তখন তার কোলে।
আর একটি গল্প হচ্ছে ইমিগ্রেশন নিয়ে। ”ইমিগ্রেশন অফিসার হুমায়ূন আহমেদের সহকারীকে বললেন, ওপেন ইয়োর পেন। সে তো বুঝতে পারেনি। সে তার প্যান্ট খুলতে শুরু করলো। ইমগ্রেশন অফিসার ঘাবরে গিয়ে বললো প্যান্ট না, পেন, মানে কলম”।
২৮ জুন এক মনোজ্ঞ আলোচনা অনিুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় অংশ নেন হুমায়ূন আহমেদ, হাসান আজিজুল হক এবং সমরেশ মজুমদার। হাসান আজিজুল হক বলেন, বাংলা সাহিত্যের চর্চা এখন সর্বত্রই হচ্ছে। বৃটেনে হচ্ছে, নিউইয়র্কে হচ্ছে। শুধু হচ্ছেনা কলকতায়। পশ্চিমবাংলায় বাংলা প্রসার ছোটো হয়ে আসছে। তাছাড়া প্রিন্ট মিডিয়া কখনও লুপ্ত হবে না। আর জীবন ঘনিষ্ট কথাটা শুনলে আমার গা জ্বলে ওঠে। যা হবার তা হবেই। কিছু করার নেই। সমরেশ মজুমদার বলেন, শতকরা ক’টা লোক কম্পিউটারে বাংলা পড়ে? সমসাময়িককে মানুষ এখনও আন্তরিকভাবে গ্রহন করতে শেখেনি। হুমায়ূন আহমেদ বলেন, বাংলাভাষা অনেক শক্ত। সহজে উঠে যাবে না। আমার যখন যেটা করতে ইচ্ছে করেছে করেছি। টিভি নাটক লিখেছি, সিনেমা বানিয়েছি। বই লিখছি। মানুষ তার ক্ষমতার বাইরে যেতে পারে না। যা হবার তা হবে।
সেই বছর বইমেলায় সমরেশ মজুমদারের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়। আশির দশকে সমরেশের কালবেলা, কালপুরুষ, উত্তরাধিকার এই ট্রিলজি পড়ে আমি খুবই আপ্লুত হয়েছিলাম। সেটা ১৯৯০ সাল। সেই সময় আমার ছেলের জন্ম হয়। কালবেলার অর্কর নামে নাম রাখলাম আমার ছেলের। তখন অনেকেই তাদের ছেলের নাম অর্ক রেখেছিলেন। সমরেশ মজুমদারকে সেই গল্প বললাম। তিনি সাথে সাথে তার কিশোরদের জন্য লেখা একটা বই হাতে নিয়ে অর্কর উদ্দেশ্যে অটোগ্রাফ লিখলেন, অর্ক সূর্যের মতো হও। হুমায়ূন আহমেদ এবং সমরেশ মুজুমদার কেউ না থাকলেও তাদের স্মৃতি আর সৃষ্টি চিরদিন থেকে যাবে।
একবার নিউইয়র্ক বই মেলায় একটি আড্ডার শিরোনাম ছিল পরচর্চ্চা। প্রতি মেলার শেষদিন একটা ব্রেকফাষ্ট আড্ডা হয়। সেখানে শুধু আগত অতিথিরা থাকেন। সেবার আড্ডায় সেলিনা হোসেন, আনিসুল হক, আমীরুল ইসলাম, লুৎফর রহমান রিটন, মোহিত কামাল, হাসান ফেরদৌস সহ অনেক খ্যাতিমান মানুষরা ছিলেন। তারা কথা বলেছেন। পরচর্চ্চার যে একটা বিশাল সৌন্দর্য্য আছে সেদিনের মুক্ত আলোচনায় চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছিল। সেই আলেচানায় আমিও অংশ নিয়েছিলাম। পরচর্চ্চা যে আড্ডার বিষয় হতে পাওে সেদিন জেনেছিলাম। অভিনব আইডিয়া ছিল।
ছোট্ট একটি ঘটনা বলে শেষ করছি। সেটা সম্ভবত ২০১৫ সালের বইমেলা। মেলার দ্বিতীয় দিন। নিউইয়র্ক আপস্টেট থেকে একজন বয়স্ক নারী আসলেন। তিনি আমার সবগুলো বই কিনলেন এবং বললেন, আমি আপনার লেখা খুব পছন্দ করি। আপনি যে আপনার মা, ছেলে মেয়ে এবং সোশ্যাল ইস্যুজগুলো নিয়ে লেখেন আমার খুব ভাল লাগে। আপনার লেখা পড়ে শক্তি পাই। যখন মন খারাপ থাকে বাসে সাবওয়েতে বসে আপনার লেখা পড়ি, মন ভাল হয়। আমি কি আপনার হাতটা একটু ধরতে পারি! আমি দেখলাম তার চোখদুটো ছল ছল করে উঠেছে। আমিও আপ্লুত হলাম। এ রকম অসংখ্যা স্মৃতি আছে নিউইয়র্ক বইমেলা নিয়ে।
টরন্টো বাংলা বইমেলা, সাহিত্যের বিশ্বায়ন এবং কানাডা নিয়ে ভাবনা
এ বছর টরন্টো বইমেলা ১৭ বছর পূর্ণ করছে। বলা যায় টরন্টো বইমেলা গনগনে তারুন্যে পদার্পন করেছে। এখন টরন্টো বইমেলা একটা প্রতিষ্ঠানে দাঁড়িয়ে গেছে। সর্বত্র পরিচিতি অর্জন করেছে। দেশে বিদেশে টরন্টো বইমেলা একটি আলাদা মর্যাদায় দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের বাইরে সবচেয়ে বৃহৎ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উৎসবটি হচ্ছে নিউইয়র্কে। তারপরই টরন্টো বইমেলার নাম উচ্চারিত হয়। বর্হিবিশ্বে বাংলা সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই বইমেলা অনন্য ভূমিকা পালন করছে। বিগত দিনগুলোতে অনেক খ্যাতিমান লেখক, প্রকাশক টরন্টো বইমেলায় অংশ নিয়েছেন। বইমেলাকে মহিমান্বিত করেছেন। বছরে দুইদিন শহরে একটি উৎসবের আমেজ তৈরী হয়। লেখক, প্রকাশক আর পাঠকের একটি মহামিলন ঘটে। সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে বোদ্ধারা আলোচনা করেন। নতুন প্রজন্ম আলোকিত হয়। তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে জানতে পারে। স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীদের জন্য টরন্টো বইমেলা একটি আবগের নাম, একটি শ্রদ্ধার নাম। দুই দেশের সরকারী পর্যায়ে টরন্টো বইমেলা স্বীকৃতি পেয়েছে। ভবিষ্যতে টরন্টো বইমেলা আরো এগিয়ে যাবে, আরো প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদায় অভিষিক্ত হবে, সার্বজনীন হবে এই প্রত্যাশা করি।
আমি বইমেলার একজন সাধারণ কর্মী হিসাবে জড়িত থাকতে পেরে নিজেকে গৌরাবান্বিত মনে করি। বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। আত্মার সাথে আমাদের সম্পর্ক। যেখানেই বইমেলা সেখানেই আমি থাকতে চেষ্টা করি। কখনও ঢাকা, কখনও নিউইয়র্ক, কখনও কোলকাতা, কখনও লন্ডন, কখনও ওয়াশিংটন ডিসি। ফি বছর ছুটে যাই বইমেলার টানে দেশে বিদেশে। লেখালেখি, বই বা বইমেলার জন্য আমি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি। অনন্ত ত্যাগ। এমনকি আমি বরিশালও ছেড়েছিলাম লেখালেখির জন্য। এক অনিশ্চিত জীবন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল। আমি কখনও পিছনে ফিরে তাকাইনি। সাহিত্যকে ভালবেসে আমার সবটুকু শ্রম এর পিছনে দিয়েছি। আজকে টরন্টো বইমেলা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। কিন্তু এর শুরুটা মোটেই সহজ ছিল না। অনেক বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে টরন্টো বইমেলা তার অভিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য দুই বাংলা মিলে সারা পৃথিবীতে এখন প্রায় দেড় কোটির মতো বাঙালি বাস করছে। ভাষা চর্চার ব্যাপারটি সর্বত্র্যই লক্ষ্য করা যায়। বাংলা ভাষা পৃথিবীর ৫ম বৃহত্তম ভাষা। পৃথিবী থেকে অনেক ভাষারই বিলুপ্তি ঘটেছে। আরো বিলুপ্তি ঘটবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু বাংলা ভাষা কোনোদিন হারিয়ে যাবে না। ভাষা আছে বলেই বাংলা সাহিত্যের বিশ্বায়ন ঘটেছে। এখন আর ভৌগলিক সীমার মধ্যে কোনোকিছু বন্দী নেই। অনেক নাম করা সাহিত্যিকরা এখন ছড়িয়ে পড়েছেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে। তারা তাদের অবদান রেখে চলেছেন। রবীন্দ্রনাথের পরে আর কেউ সেভাবে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে না পারলেও নিজের জাতি গোষ্ঠির মধ্যে নিজেদের শ্র্যেষ্ঠত্ব প্রমাণের যথেষ্ঠ প্রতিযোগিতা আছে এবং তা অতি উচ্চ মানের। যা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি।
প্রবাসের কঠিন জীবনের মধ্যে বাস করেও অনেকে মূল স্রোতের সাথে একাত্ম হতে পেরেছেন। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্য সর্বত্রই প্রচেষ্টাটা চলছে। মানের দিক থেকে বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী সাহিত্যিকদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তারাও পুরস্কৃত হচ্ছেন। বিদেশে থাকলেই সে প্রবাসী লেখক এই তকমাটা সেকেলে, জঘন্য। লেখকের কোনো দেশকাল নাই। সে যেকোনো জায়গায় বসে লিখতে পারে। আমেরিকা, কানাডা বা লন্ডনে যতজন কবি সাহিত্যিক বা সাংবাদিক আছেন তার তালিকা অনেক দীর্ঘ। যাদের অনেকেই মূল ধারার খ্যাতিমান লেখক সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক হিসাবে দেদীপ্যমান।
কোনো ভাল কাজই সহজে সম্পন্ন করা যায় না। এর পিছনে থাকে অনেক রক্তক্ষরন, অনেক বাঁধা। কিন্তু মহৎ উদ্দেশ্য কখনও বিফলে যায় না। কেউই ভাল কাজকে দমিয়ে রাখতে পারে না। বাঁধার প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে যেতে হয় লক্ষ্যে। একদল নিবেদিত প্রাণ সাহিত্যকর্মী নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে টরন্টো বইমেলাকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। এই ধরণের কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য দরকার অগাধ সাহিত্যপ্রেম, সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ এবং দেশের প্রতি ভালবাসা। এই মহৎ উদ্যোগের প্রাণ পুরুষ হচ্ছেন টরন্টো বইমেলার আহবায়ক সাদী আহমেদ। তার পান্ডিত্য, পরিশ্রম ও সাহিত্যানুরাগ টরন্টো বইমেলাকে জীবন্ত রেখেছে এবং সবাইকে একসুতোয় বেঁধে রেখেছে। অসম্ভবকে সম্ভব করার কৃতিত্ব তাঁর। বাংলা সাহিত্যের বিশ্বায়নে এই বইমেলা ভূমিকা রাখছে।
এবার কানাডা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। কানাডা দেশটা কেমন এবং কেনে কানাডায় মানুষ আসতে চায়! কানাডায় বাঙ্গালিদের অবস্থান ও নতুন প্রজন্মের কমিটমেন্ট নিয়ে কিছু বলা যাক। কানাডা একটি চমৎকার দেশ। সবকিছুই সুন্দর এই দেশের। এই দেশ নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নাই বরং অনেক মুগ্ধতা আছে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন যুদ্ধকবলিত এলাকা বাদ দিলে বাংলাদেশ বা পৃথিবীর অন্য যে কোনো জায়গা থেকে যারাই এই দেশে আসেন তারা প্রায় প্রত্যেকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে যোগ্যব্যক্তি। সবাই প্রায় উচ্চ শিক্ষিত। এর বাইরে এ দেশে আসার বিশেষ সুযোগ নাই। টরন্টো তথা পুরো কানাডা জুড়ে অসংখ্য প্রতিভাবান বাংলাদেশী আছেন যাদের সবাইকে আমি চিনি না। যখন চেনা জানা হয় তখন অবাক হই, মুগ্ধ হই। কানাডা এই কাজটি করে। তারা বেছে বেছে ইমিগ্রান্ট নিয়ে আসে। যেনো তাদের সন্তান বা পরবর্তী প্রজন্ম মূল ধারায় অবদান রাখতে পারে। কানাডা ইমিগ্রান্টদের দেশ। বাংলাদেশীরা এমনিতেই প্রতিভাবান। আমাদের সন্তানেরা এখন ডমিনেটিং পর্যায়ে চলে যাচ্ছে ক্রমশঃ। বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা পড়ছে। পড়া শেষ করে বড় বড় চাকরি করছে। বাৎসরিক একশ, দুইশ হাজার ডলার বেতনের চাকরি করছে। গাড়ি বাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এমনকি আমেরিকাও তাদের লুফে নিচ্ছে কানাডার চেয়ে ডাবল সুযোগ সুবিধা দিয়ে।
এখানকার নতুন প্রজন্ম ফেরেশতা টাইপ মানুষ হচ্ছে। সৎ, পরিশ্রমী এবং দেশপ্রেমিক। কোনো বিষয় নিয়ে নেগেটিভ কথা তাদের মুখ থেকে উচ্চারিত হয় না। কোনো অভিযোগ করে না। তারা মিথ্যা বলে না, জানেও না। স্কুল থেকেই নৈতিকতা শেখানো হয়। সেলফ ইন্ডিপেনডেন্ট হতে শেখানো হয়। ম্যানারস জানে। এরা কাউকে হিংসা করে না। হিপ্রোক্রসি নাই। সরল এবং বন্ধুবৎসল। যা কিছু সমস্যা আমাদের প্রথম প্রজন্মের মধ্যে। অন্যের কুৎসা করা, জেলাসি, কারো ভাল দেখলে গা জ্বলা এসব আমাদের মধ্যেই বিরাজমান। এই স্বভাব আমরা সাথে করেই নিয়ে এসেছি। সবকিছু বদলালেও স্বভাব সহজে বদলায় না। তা স্বত্ত্বেও জীবন অনেক সুন্দর, বেশিরভাগ মানুষ সুন্দর মনের, তারা গুনিকে সম্মান করতে জানে।
সুশৃঙ্খল, হিউম্যান রাইটস, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ, চিকিৎসা, লিভিং স্ট্যান্ডার্ড, এনভায়রনমেন্ট সবই চমৎকার। নতুন প্রজন্ম দুর্দান্ত হিউম্যানবিয়িং হিসাবে বেড়ে উঠছে। এদের জন্য গর্ব করা যায়। শুধু কানাডা বলেই নয় এই চিত্র ইউরোপ, আমেরিকা অস্ট্রিলিয়া, সুইডেন সর্বত্র। সব দেশেই আমার বন্ধুরা আছে। তাদের কাছ থেকে এসব জানতে পারি। এখন সব খবরই জানা যায়। কানাডা খুবই নিরাপদ দেশ। তাইতো দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে আসছে এই দেশে। সবই সাদা হয়ে আসছে। সব শ্রেণীর লোকই আছে এই দলে। পাচারকারীরা রাজকীয় জীবন যাপন করে এই দেশে। আমরা যারা ইমিগ্রান্ট হয়ে এসেছি আমাদের কাজ করতে হয়। পাচারকারীরা বসে বসে খায়। দামী বাড়িতে থাকে, দামী গাড়িতে চড়ে। এদেশে কিছু সংখ্যক কাজ না করেও আরাম আয়েসে আছে। কায়দা কানুনগুলো জেনে নিলেই হয়। যে যেভাবে জীবন বেছে নেয়। পুরোটাই নির্ভর করে ব্যাক্তির মানসিকতার উপর।
প্রলম্বিত উইন্টারকে মেনে নিতে পারলে খুবই ভাল দেশ কানাডা। এখন সামার এসেছে। এই সময়টা দারুন সুন্দর কানাডা। চারিদিকে সবুজের সমারোহ। মন ভাল করে দেয়। অনেকেই এই দেশে আসতে চায়। প্রতিদিন অনেক ম্যাসেজ আসে আমার কাছে। কানাডার ইমিগ্রেশনের নিয়ম কানুন সম্পর্কে জানতে চায়। আমি যতটা সম্ভব তথ্য দিয়ে সাহায্য করি। তথ্য প্রযুক্তির যুগে এসব জানা কঠিন কাজ না। কানাডার সরকারি ওয়েবসাইটে গেলেই সব তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া টরন্টো বা অন্যান্য জায়গায় অনেক ইমিগ্রেশন কনসালটেন্সি আছে। ঢাকায়ও আছে। তবে অনেক প্রতারনার খবরও পাওয়া যায়। যারাই কানাডা আসতে চান জেনে বুঝে, ভাল ল’ইয়ারের কাছে যাবেন। নিজেরাও ট্রাই করতে পারেন। অনেকে অবশ্য কানাডা নিয়ে বা বিদেশ নিয়ে খুবই নগেটিভ ধারণা পোষন করেন। দিল্লিকা লাড্ডুর সাথে তুলনা করেন। আমি বলব দিল্লিকা লাড্ডু না খেয়ে পস্তানোর চেয়ে খেয়ে পস্তানো ভাল। বিদেশে আসলে আপনার চিন্তার প্রসরতা বাড়বে, পৃথিবী উন্মুক্ত হবে, সর্বোপরি আপনি নিজের দেশকে সহযোগিতা করতে পারবেন। রেমিটেন্সের টাকায় অর্থনীতির চাকা সচল থাকছে। বিদেশে দেশের মুখ উজ্জল করতে পারবেন। বাংলাদেশকে এখন সবাই চেনে। গুরুত্ব দেয়। আমাদের একজন বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন বলেই আমরা সবুজ পাসপোর্ট পেয়েছি। দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়তে পেরেছি। আমাদের সন্তানরা সুন্দর জীবন পেয়েছে। তা না হলে আমাদের কোনো আত্মপরিচয় থাকত না। এই কথাগুলো আমি অগেও বলেছি।
আমার কানাডা আসার গল্প অনেকবার করেছি। গত জুন মাসে বিশ বছর পূর্ন হলো আমার কানাডার জীবন। দুই দশক! সময় কত দ্রুত যায়। মনে আছে এইতো সেদিন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইট থেকে আমরা চারজন পিয়ারসন এয়ারপোর্টে নেমেছিলাম। এখন আমি দেশে ফিরে যেতে চাই। বরিশালে ফিরতে চাই। এ কথা অনেকবার লেখা হয়েছে। তাতে দুই ধরণের প্রতিক্রিয়া পাই আমি। একদল বলে চলে আসো। আর এক দল বলে বিদেশ হচ্ছে ওয়ানওয়ে টিকিট। একবার গেলে আর ফেরা যায় না। অনেকেই কিন্তু ফিরে গেছেন। আবার অনেকেই বিদেশে আসতে চান না। বিদেশের প্রতি তাদের কোনো মোহ নাই। দুই দলের প্রতিই আমি শ্রদ্ধা পোষন করি। দুই পক্ষের কথাই সত্যি। ফিরে যাওয়ার জন্য মনের জোর লাগে। আমিও ফিরতে চাই কিন্তু পারি না। এর কারণ হচ্ছে আমার পরিবার। আমার সন্তানদের রেখে আমি কিছুতেই থাকতে পারব না। ওরা ছাড়া আমার কেউ নাইও।
নিজের দেশকে আমি ভালবাসি। দেশের জন্য, মানুষের জন্য আমি কিছু করার তাগিদ অনুভব করি। কানাডার প্রতিও আমার দ্বায়িত্ব আছে। আমি আমার সন্তানদের বলেছি এই দেশ আমাদের অনেক দিয়েছে। শিক্ষা দিয়েছে, চিকিৎসা দিয়েছে, আশ্রয় দিয়েছে। আমি যদি নাও পারি তোমরা এই দেশের সেবা করবে। আমার সন্তানরা সবসময় আমাকে উৎসাহিত করে। বলে তোমার যেখানে মন চায় সেখানে থাক। জেসমিনকে বলেছি চলো আমরা ফিরে যাই। ভাগাভাগি করে থাকি।
টরন্টো ২০ জুলাই ২০২৩
কানাডা প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক