টরেটক্কা টরন্টো
চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -১৩
কাজী সাব্বির আহমেদ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সামার ভ্যাকেশনের দেড় মাসের ছুটি দেখতে দেখতে এক সময় শেষ হয়ে যায়। চলে আসে চীনে ফিরে যাওয়ার পালা। সেমিস্টার শুরু হবে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি, তাই সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে থাই এয়ারলাইন্সের বিমানে চড়ে ব্যাংককের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম। সাথে রয়েছেন সেই দুইজন সিনিয়র স্টুডেন্ট যাদের সাথে ছুটি কাটাতে দেশে এসেছিলাম। ব্যাংককে এক রাতের স্টপ ওভার, পরদিন ড্রাগন এয়ারলাইন্সে চড়ে চলে এলাম হংকং। হংকং-এর এয়ারপোর্টটি ছিল একদম সাগরের পাড়ে, ফলে ল্যান্ডিং-এর সময় মনে হচ্ছিল বিমান বুঝি সাগরের পানিতেই ল্যান্ড করবে। এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি করে সোজা চলে এলাম আমাদের পুরাতন আস্তানায় চুংকিং ম্যানশনে। আবারও চুংকিং ম্যানশনের ই-ব্লকের সেই একই গেস্ট হাউসে এসে উঠলাম আমরা। হংকং-এ আমাদের দুইদিনের যাত্রা বিরতি। আমাদের প্রত্যেকের হাতে রয়েছে একটি নাতি দীর্ঘ শপিং লিস্ট। গ্রহণযোগ্য মানের যে সব নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র বেইজিং-এ পাওয়া দুষ্কর মূলত সেই জিনিষগুলিই রয়েছে এই লিস্টে। যেমন, কোলগেটের টুথপেস্ট, জিলেটের শেভিং ক্রীম এবং রেজার ব্লেড, নেসক্যাফের ইন্সট্যান্ট কফি ইত্যাদি। চুংকিং ম্যানশনের লাগোয়া ‘ওয়েলকাম’ নামক একটি গ্রোসারী চেইন স্টোর থেকে সহজেই এই জিনিষগুলি কেনা হলো। এছাড়া হাল ফ্যাশনের শীতের পোশাকের জন্য আমরা ঢুঁ মারলাম ‘জিয়োরডানো’-তে। কিন্তু আমাদের শপিং লিস্টে ছিল আরেকটি আইটেম – পিসি কিংবা পারসোনাল কম্পিউটার। এই জিনিষটি কোথায় পাওয়া যাবে সে ব্যাপারে আমার সাথে থাকা সিনিয়র দুই স্টুডেন্টের তেমন কোন অভিজ্ঞতা নেই। শুধু জানা আছে যে আমাদেরকে যেতে হবে ‘গোল্ডেন কম্পিউটার সেন্টার’-এ। চুংকিং ম্যানশন থেকে কিছুটা দূরে ‘শাম সুয়েই পো’ নামক এক স্থানে এই কম্পিউটার মার্কেটটি অবস্থিত।
সকাল সকাল হংকং-এর মেট্রোরেল ‘এমটিআর’-এ করে ‘ছিম ছা সুয়েই’ নামক স্টেশনে চলে এলাম আমরা। স্টেশন থেকে বের হতেই দেখা মিললো ‘গোল্ডেন কম্পিউটার সেন্টার’-এর। ছোট ছোট দোকানে ঠাসা এই মার্কেটটি। প্রতিটি দোকানই আবার ইলেক্ট্রনিক্সের জিনিষ দিয়ে ঠাসা। এই দোকানগুলির কেউ কেউ বিক্রী করছে অ্যাসেম্বলড করা পূর্ণাংগ পিসি আবার কেউ কেউ বিক্রী করছে পিসি-এর বিভিন্ন পার্টস। বিভিন্ন দোকান ঘুরতে ঘুরতে আমি একটা পিসি কিনে ফেললাম আমার সাথে আসা একজন সিনিয়র স্টুডেন্টের সহায়তায়। সাথে একটি মনোক্রম মনিটর। সেই সময় ‘মাউস’-এর ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত থাকায় শুধু মাত্র একটি কীবোর্ড কেনা হলো। হার্ড ডিস্ক সেই পিসি-এর দুইটি ফ্লপি ড্রাইভ ছিল। ফ্লপি ডিস্ক রাখার একটি ডিস্ক ব্যাংকও কিনে ফেললাম। সেই সিনিয়র স্টুডেন্টও তার জন্যও এক সেট পিসি কিনে ফেললেন। অনেক বছর পর আমি যখন সিঙ্গাপুরের ‘সিম লিম স্কোয়ার’-এ কম্পিউটার কেনার জন্য যাই, তখন আমার মানসপটে হংকং-এর এই ‘গোল্ডেন কম্পিউটার সেন্টার’-এর স্মৃতি ভেসে উঠেছিল। হংকং থেকে আমরা আমাদের একেকজনের সাথে থাকা দুই সুটকেস লাগেজ আর এক সেট পিসি নিয়ে বেশ কষ্ট করেই শেনট্রেন বর্ডার পার হলাম। তারপর ট্রেন স্টেশনে গিয়ে দেখি যে ক্যান্টন যাওয়ার সেই দিনের শেষ ট্রেনটিও চলে গেছে। আর কোন উপায় না থাকাতে আমরা গাদাগাদি করে লোকাল বাসে করে ক্যান্টনের পথে রওয়ানা হয়ে গেলাম। আমাদের লাগেজ তারা বাসের ছাদে চালান করে দিল। ঠিক যেমনটি দেখতাম ছোটবেলায় আমরা যখন অনেক মালপত্র নিয়ে ঢাকা থেকে ঈদ করতে লোকাল বাসে করে টাঙ্গাইলে যেতাম। সেই বাস সারা রাত রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় থেমে থেমে ঠিক ভোর রাতে ক্যান্টনে গিয়ে পৌঁছাল। তারপর সেখান থেকে আমরা ট্যাক্সি করে চলে গেলাম ট্রোংশান মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির ফরেন স্টুডেন্ট হোস্টেলের উদ্দেশ্যে। কিন্তু অত ভোরে ইউনিভার্সিটির মূল ফটক খোলা ছিল না। ফলে আমাদেরকে মূল ফটকের সামনে ট্যাক্সি ছেড়ে দিতে হয়। তারপর মূল ফটকের লাগোয়া ছোট গেট দিয়ে ঢুকে সাথে থাকা লাগেজগুলিকে কষ্টেশিষ্টে ঠেলেঠুলে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে গিয়ে পৌঁছালাম ফরেন স্টুডেন্ট হোস্টলে। সেখানে আরেকজন বাংলাদেশী সিনিয়র স্টুডেন্টের রুমে মালপত্র রেখে আমরা চলে গেলাম বেইজিং যাওয়ার ট্রেনের টিকেট কিনতে। ভাগ্য এবার আমাদের অনুকূলে থাকায় আমরা সেই রাতেরই টিকেট পেয়ে গেলাম। দুই রাত একদিন পর আমরা আমাদের গন্তব্য বেইজিং রেলস্টেশনে এসে পৌঁছালাম। স্টেশন থেকে ট্যাক্সি করে আমাদের ইউনিভার্সিটির ফরেন স্টুডেন্ট হোস্টেলে এসে মনে হলো যেন বিরাট রাজ্য জয় করে অবশেষে নিজ ডেরাতে ফিরলাম।
এক সময় আমাদের সেকেন্ড ইয়ারের ফার্স্ট সেমিস্টার শুরু হয়ে গেল। লক্ষ্য করে দেখলাম যে থিয়েনআনমেন ম্যাসাকার পরবর্তী চীন ধীরে ধীরে চোখে পড়ার মতন বদলে যাচ্ছে। প্রথম যেটা আমাদের চোখে পড়ল সেটা হলো আমাদের পুরানো ক্লাসরুমগুলোতে কিছুটা সংস্কার করা হয়েছে, জানালাগুলোতে নতুন ভারী পর্দা লাগানো হয়েছে। তার চেয়েও বেশী যেটা চোখে পড়ল সেটা হলো আমাদের ইউনিভার্সিটির সকল ছাত্রছাত্রীদেরকে এক মাসের ম্যান্ডাটরি ‘চুনশুন’ বা মিলিটারি ট্রেইনিং-এ যেতে হচ্ছে। ফরেন স্টুডেন্টদের জন্য অবশ্য এই ট্রেইনিং প্রযোজ্য নয়। এটা শুধু আমাদের ইউনিভার্সিটির জন্য নয় বরং চীনের সকল ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের জন্য চালু করা হয়েছে। তবে ‘পেই তা’ বা বেইজিং ইউনিভার্সিটির ফ্রেশম্যান বা ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রছাত্রীদের জন্য এই ‘চুনশুন’-এর মেয়াদ হবে এক বছর। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল যে থিয়েনআনমেন ছাত্র আন্দোলনের সূতিকাগার হওয়ার কারণেই বেইজিং ইউনিভার্সিটির উপর এই এক বছরের ‘চুনশুন’-এর শাস্তির খড়গ নেমে এসেছে। তবে অবশ্য ১৯৯৩ সালে যখন দেখা গেল যে বেইজিং ইউনিভার্সিটির কোন গ্রাজুয়েটিং ক্লাস নেই তখন ছাত্র এবং শিক্ষকদের চাপে সরকার এই মিলিটারি ট্রেইনিং-এর মেয়াদ এক বছর থেকে কমিয়ে একমাসে নিয়ে আসে। তবে এখানে উল্লেখ্য যে সিঙ্গাপুর কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ার মতন দেশে প্রত্যেক পুরুষ নাগরিকের জন্য দুই বছর মেয়াদী মিলিটারি ট্রেইনিং বাধ্যতামূলক। আমি প্রায় এক দশককাল সিঙ্গাপুরে কাটিয়েছি, সেখানে দেখেছি এই মিলিটারি ট্রেইনিং কিভাবে সে দেশের জনগণকে একক মিলিটারি কম্যান্ডের আন্ডারে নিয়ে আসার মাধ্যমে একটি রেজিমেন্টাল দেশে পরিণত করে। ফলে সরকার বিনা ক্লেশে এমন একটি রেডিমেড ডিসিপ্লিনড নেশন পেয়ে যায় যারা কিনা সরকারের যে কোন সিদ্ধান্তকে বিনা প্রশ্নে স্বাগত জানায়। সেই কারণে দেশ চালাতে সিঙ্গাপুর সরকারকে কার্যত কোন বাধার সম্মুক্ষীন হতে হয় না। ফলে জন্ম হয়েছে একটি টোটালিটারিয়ান রিজিমের। আমার কাছে মনে হয়েছে চীন এবং সিঙ্গাপুর এই দুইটি দেশেই টোটালিটারিয়ান রিজিম চালু আছে তবে তারা তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে এই রিজিম চালু করেছে। কেউ কাউকে অনুসরণ করে নয়। বরং উত্তর কোরিয়ায় বর্তমানে যে টোটালিটারিয়ান রিজম চালু রয়েছে তা অনেকাংশেই চীনের উপর নির্ভরশীল। চীনে অধ্যয়নকালে বেশ কিছু উত্তর কোরিয়ার ছাত্রছাত্রীদেরকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তাদের জীবনযাত্রা এবং জীবনবোধ দেখে মনে হয়েছে যে তারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন অন্য কোন এক গ্রহের বাসিন্দা। চাইনিজ জনগণ সেই তুলনায় হাজারো গুণে স্বাধীন। তারা অধিকতর স্বাধীনতার জন্য থিয়েনআনমেন স্কয়ারে প্রকাশ্যে সরকারের বিরুদ্ধে সাত সপ্তাহব্যাপী আন্দোলন করতে পেরেছে। যদিও কম্যুনিস্ট সরকার এক সময় নৃশংসভাবে ট্যাঙ্ক দিয়ে পিষে সেই আন্দোলনকে থামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তারা একই সাথে জনগণের ক্ষোভকে প্রশমিত করতে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। সেই সব সংস্কারের কারণেই আজকে আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি শক্তিশালী চীনের অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারি। চীন আজ প্রতিটি ক্ষেত্রে আমেরিকার হেজিমনিকে চ্যালেঞ্জ করার যোগ্যতা অর্জন করেছে। সম্প্রতি তারা সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যেকার দীর্ঘদিনের ফাটল ধরা কূটনৈতিক সম্পর্ককে জোড়া লাগিয়ে ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসনকে থামিয়ে দিতে পেরেছে। ‘পিস-মেকার’ হিসেবে এই সফলতার কারণে চীন এখন মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় ইস্যু ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন-এর ব্যাপারে মধ্যস্থতা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
আমাদের সেকেন্ড ইয়ারের সিলেবাসে লিনিয়ার অ্যালজেব্রা, ফিজিক্স সেকেন্ড পার্ট ইত্যাদি বিষয়ের সাথে ‘প্যাসকেল’ নামক কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর একটি ল্যাংগুয়েজ ছিল। এর বাইরেও আরো একটি বিষয় দেখলাম যুক্ত হয়েছে -‘ট্রাংট্রি সুয়ে’ বা পলিটিক্যাল সায়েন্স। প্রতি সপ্তাহে বুধবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত অর্থাৎ চার ঘণ্টার এই কোর্সটি শুধু মাত্র চাইনিজ ছাত্রছাত্রীদের জন্য। আরও অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে এই ‘পলিটিক্যাল সায়েন্স’ কোর্সটি শুধু মাত্র যে সব ইয়ারের সকল ছাত্রছাত্রীদের জন্য ম্যান্ডাটরি তা নয়, বরং সকল শিক্ষক এবং কর্মচারীরাও এই সময়টাতে তারা তাদের নিজ নিজ কর্মস্থলে এই কোর্সটির পাঠ গ্রহণ করতে হবে। পরে জানতে পেরেছিলাম যে এই ‘পলিটিক্যাল সায়েন্স’ কোর্সটিতে থিয়েনআনমেন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চীনের রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা সম্পর্কে দেং শিয়াওপিং-এর দেয়া বক্তৃতাগুলো এবং সেগুলির অন্তর্নিহিত অর্থ পড়ানো হতো। আমার ক্লাসের চীনা ছাত্রছাত্রীরা যখন দেং শিয়াওপিং-এর বক্তৃতা নিয়ে ব্যস্ত তখন আমি ব্যস্ত আমার সদ্য কেনা পিসি নিয়ে। আমাকে আর কুপন দিয়ে ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার ল্যাবে বসে প্যাসকেলে প্রোগ্রাম লিখতে হয় না, নিজের রুমে বসেই দিনরাত যখন ইচ্ছে তখন কম্পিউটার নিয়ে বসতে পারি। প্রোগ্রাম লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে গেলেও কম্পিউটারকে রেহাই দেয়া হত না। তখন বসতাম ‘ডিগার’ কিংবা ‘টেট্রিস’ নামক গেমস নিয়ে। রাশিয়ান কম্পিউটার প্রোগ্রামার অ্যালেক্সি প্যাজিটনভ ১৯৮৫ সালে ‘টেট্রিস’ গেমটি ডেভেলপ করেন যার মূল লক্ষ্য ছিল তার কর্মস্থলের নতুন কেনা কম্পিউটারের দক্ষতা যাচাই করা। কিন্তু তিনি এবং তার সহকর্মীরা তার তৈরি গেমটিতে আসক্ত হয়ে পড়েন এবং এটার পটেনশিয়াল বুঝতে পেরে তাদের কোম্পানীতে ইন্টার্ন হিসেবে কর্মরত ১৭ বছর বয়স্ক ভাদিম গেরাসিমভ-এর সাহায্যে আইবিএম পিসির জন্য এই গেমের কালার ভার্সান তৈরি করেন যা কিনা ১৯৮৬ সালে রাশিয়ার বাইরে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ১৯৯১ সালে অ্যালেক্সি আমেরিকাতে চলে যান এবং সেখানে ১৯৯৬ সালে ডাচ ভিডিও গেম ডিজাইনার হেঙ্ক রজার্স-এর সাথে পার্টনারশীপে বাণিজ্যিকভাবে ‘টেট্রিস’-কে বাজারজাত করেন। এর ফলে অ্যালেক্সি এই প্রথম ‘টেট্রিস’ থেকে অর্থ উপার্জন শুরু করেন। ‘টেট্রিস’ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আমি ২০০২ সালে মোবাইল ফোনের জন্য একটি গেম তৈরি করি যার নাম দিয়েছিলাম ‘স্পেস ট্র্যাভেল’। সেই গেমটি তখন পাবলিক ডোমেইনে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলাম। ইন্টারনেটে সার্চ দিলে এখনও ‘স্পেস ট্র্যাভেল’ গেমটির খোঁজ পাওয়া যায়। আর সম্প্রতি ‘টেট্রিস’ গেম খেলে বড় হওয়া কানাডার হ্যালিফেক্সের নোয়া পিঙ্ক এই গেমটিকে ভিত্তি করে একটি সফল বায়োপিক মুভি তৈরি করেছেন যার নাম দিয়েছেন ‘টেট্রিস’।
আমার কেনা পিসি-টি ছিল আমার কাছে একটি বিস্ময়কর খেলনা। পিসি-টির কার্যক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একজনের মাধ্যমে হংকং থেকে ‘সি-গেট’ কোম্পানীর একটি চল্লিশ মেগাবাইটের হার্ডডিস্ক কিনে আনাই। সেটা লাগানোর জন্য আমাকে কম্পিউটারের কেসিং খুলতে হলো। সেই হার্ডডিস্ককে অবশ্য আমি হাজার চেষ্টা করেও ইন্সটল করতে পারিনি কিন্তু এই চেষ্টার কারণে আমি চিনেছিলাম কোনটা মাদারবোর্ড, কোনটা ডিস্ক ড্রাইভ, কিভাবে মাদারবোর্ডের জাম্পার সেটিং চেঞ্জ করে হার্ডডিস্ককে ইন্সটল করতে হয়। একই সাথে এই ফল্টি হার্ডডিস্কটি আমাকে টেনে নিয়ে যায় বেইজিং-এর ‘ট্রোং কুয়ান ছুন’ এলাকায় সদ্য গজিয়ে উঠা ইলেক্ট্রনিক মার্কেটটিতে যেখানে বিভিন্ন ধরণের কম্পিউটারের পার্টস পাওয়া যেত। এই ‘ট্রোং কুয়ান ছুন’ বর্তমানে চীনের সিলিকন ভ্যালি বলে পরিচিত। যাই হোক সেই ফল্টি হার্ডডিস্কটি ছিল আমার জন্য একটি ‘ব্লেসিং ইন ডিসগাইজ’, কারণ এর কারণে আমি শিখে যাই কিভাবে কম্পিউটারের বিভিন্ন পার্টস কিনে একটি পূর্নাংগ কম্পিউটার তৈরি করতে হয়। এছাড়াও হাতের নাগালে নতুন কোন সফটওয়্যার এলেই সেটা নিয়ে মেতে উঠতাম। সেই সময় ডকুমেন্ট লেখার জন্য জনপ্রিয় ছিল ওয়ার্ড-পারফেক্ট, স্প্রেডশীটের জন্য লোটাস ১-২-৩ এবং ডেটাবেইজের জন্য ডি-বেইজ। এক সময় সুযোগ আসে বেইজিংস্থ কলম্বিয়ার অ্যাম্বাসীর কর্মকর্তাদেরকে কম্পিউটার ব্যবহার শিখানোর। সেখানে তাদের সাথে আমার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠে। সেই সুবাদে তারা আমাকে শুধু কলম্বিয়ার বিখ্যাত কফি উপহার দিয়ে নয়, বিভিন্ন ল্যাটিন আমেরিকান অ্যাম্বাসীগুলোতেও কম্পিউটার শিখানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে বেশ উপকার করে। এক সময় কলম্বিয়া অ্যাম্বাসীসহ অন্যান্য ল্যাটিন আমেরিকান অ্যাম্বাসীতে নতুন কোন কম্পিউটার কিনতে হলে আমার ডাক পড়ত। আর আমি আমার সদ্য লব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ‘ট্রোং কুয়ান ছুন’ থেকে পার্টস কিনে অ্যাসম্বল করে অ্যাম্বাসীগুলিতে কম্পিউটার সাপ্লাই দেয়া শুরু করলাম। লেখাপড়ার পাশাপাশি আমার ব্যবসাও বেশ জমে উঠতে শুরু করল, সেই সাথে পকেটেও বেশ কিছু ডলার এসে জমা হলো। আন্ডারগ্রেড পাশ করার পর জব খুঁজতে প্রায় তিন মাস হংকং-এ ছিলাম। তখন সেই জমানো ডলার খুব কাজে এসেছিল।
এই কম্পিউটারের কারণেই আমার সামনে ধীরে ধীরে টেকনোলজী দুনিয়ার দ্বার খুলতে শুরু করে। মাইক্রোসফট, আইবিএম কিংবা মটোরোলা এই সব টেক কোম্পানীর পাশাপাশি আরেকটি শব্দের সাথে পরিচিত হলাম – কপি রাইট। চীনে তখন বাজারে প্রচলিত সব ধরণের সফটওয়্যারেরই পাইরেটেড কপি পাওয়া যেত এবং বিভিন্ন সরকারি অফিস আদালতেও সেই পাইরেটেড সফটওয়্যারগুলিই ব্যবহৃত হত। এই সময় পশ্চিমা দেশগুলি চীনের ‘কপি রাইট’ এবং ‘হিউম্যান রাইটস’ নিয়ে বেশ সোচ্চার ছিল। তবে সফটওয়্যারের কপি রাইট প্রসঙ্গে আমার এক চাইনিজ ক্লাসমেট একটি মূল্যবান মন্তব্য করেছিল। তার মতে পশ্চিমা টেক কোম্পানীগুলো আসলে এতে উপকৃত হচ্ছে কারণ তারা বিনা খরচায় বিশাল এক দক্ষ জনশক্তি পাচ্ছে যারা কিনা অদূর ভবিষ্যতে তাদের কোম্পানীগুলোতে কাজ করবে। এই জনশক্তিকে তাদেরকে আর পয়সা খরচ করে ট্রেইনিং দিতে হবে না। পরবর্তীতে আমি তার মন্তব্যের সত্যতা খুঁজে পেয়েছি। আমি দেখেছি চীন থেকে আন্ডারগ্রাজুয়েট করে অনেকেই আমেরিকাতে পোষ্ট গ্রাজুয়েট করতে গিয়েছে। তারাই পরবর্তীতে আমেরিকার বিভিন্ন টেক কোম্পানী সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রিসার্চল্যাবে গুরুত্বপুর্ণ পদে যোগ দেয়। এক সময় অবশ্য এইসব চাইনিজ প্রফেশন্যালদের চীন সরকার পশ্চিমাদেশগুলোর চেয়ে বেশী বেতনে চীনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ দেয়ার জন্য আহ্বান জানায়। তখন থেকে অনেকেই চীনে ফিরে আসা শুরু করেন। আমি যখন ১৯৯৪ সালে মাস্টার্স করার জন্য আবারও ‘বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব পোস্টস এন্ড টেলিকম্যুনিকেশনস’-এ যাই তখন এ রকম একজন প্রফেশন্যালের দেখা পেয়েছিলাম। আমেরিকার বিখ্যাত বেল ল্যাবে অনেক বছর হাইস্পিড নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি আমাদের ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণাগারের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে যোগ দেন। ল্যাবটি ছিল কানাডার বিখ্যাত নরটেল টেলিকম-এর। অর্থাৎ এই ল্যাবের গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে নরটেল বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করবে। সেই ল্যাব প্রধান আমাদেরকে ‘আইএসডিন এন্ড এটিম নেটওয়ার্ক’ টাইটেলে মাস্টার্স লেভেলের একটি কোর্স পড়ান। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতন ক্লাসে তার লেকচার শুনতাম কারণ হাইস্পিড নেটওয়ার্ক সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল ‘স্টেট অব দ্য আর্ট’-এর পর্যায়ের। চীন সরকার যে উদ্দেশ্যে পশ্চিমাদেশগুলো থেকে তার দেশের ট্যালেন্টদেরকে ফিরিয়ে এনেছিল সেই উদ্দেশ্য আজ সফল হয়েছে। একটি প্রজন্মকে তারা জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এমন ভাবে শিক্ষিত করে তুলতে পেরেছে যে চীন আজকে নিজেদের জ্ঞান দিয়েই টেকনোলজীর বিভিন্ন শাখাতে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায়। তার অনন্য উদাহরণ হচ্ছে চীন চাঁদের অন্ধকার পার্শ্বে নিখুঁতভাবে রকেট অবতরণ করিয়েছে যা কিনা নাসা এখনও পারেনি। উল্লেখ্য যে বাংলাদেশের শিক্ষা নীতির একজন নামকরা ব্যক্তিত্ব ডঃ জাফর ইকবাল এক সময় আমেরিকার বেল ল্যাবে ফাইবার অপটিক্স যা কিনা হাইস্পিড নেটওয়ার্কের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেটা নিয়ে গবেষণা করতেন। তিনি তার নাড়ীর টানে এক সময় দেশে ফিরে এসে সিলেট শাহজালাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার বিভাগে অধ্যপক হিসেবে যোগ দেন। হাইস্পিড নেটওয়ার্ক গবেষণায় বাংলাদেশের কি অর্জন তার চাইতে আজকাল দেখি তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়েই বেশী চিন্তিত।
চীনের টেলিকম কোম্পানী ‘হুয়াওয়েই’ যখন অন্যান্য নামকরা প্রতিষ্ঠিত টেলিকম কোম্পানীগুলোকে পিছনে ফেলে পশ্চিমাদেশগুলিতে ফাইভ-জি টেকনোলজীর ইনফ্রাস্টাকচার তৈরির কাজের চুক্তি পেয়ে যাচ্ছিল তখন টনক নড়ে উঠে পশ্চিমাদেশগুলির রাজনৈতিক নেতাদের। তারা তখন ‘হুয়াওয়েই’ বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে গুপ্তচরবৃত্তির। ‘ফাইভ-জি’-এর অন্তরালে নাকি চাইনিজ সরকার পশ্চিমাদেশগুলিতে গোপন গোয়েন্দা কার্যকলাপ চালাবে। এমন কি ফাইভ-জি টেকনোলজীর এই প্রতিযোগিতায় ‘ডার্ক হর্স’ হিসেবে আবির্ভুত ‘হুয়াওয়েই’-কে নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ যে তারা ‘নরটেল টেলিকম’ থেকে টেকনোলজী চুরি করে আজ সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। এই অভিযোগ অবশ্যই গুরুতর। কারণ আমরা জানি যে শুধুমাত্র বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গুপ্তচরদের মাধ্যমেই ‘এসপিওনাজ’ সংঘঠিত হতে পারে। তাহলে কি বিশাল সংখ্যক চাইনিজ প্রফেশন্যাল যারা কিনা আজকে পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন টেক কোম্পানী কিংবা গবেষণাগারে কর্মরত তারা কি কোন না কোন ভাবে চাইনিজ সরকারের গুপ্তচর সংস্থাগুলির সাথে জড়িত? (চলবে)
কাজী সাব্বির আহমেদ
কলাম লেখক । টরন্টো