কানাডার অশ্বেতাঙ্গ অধিবাসীরা বেশি শিক্ষিত, তা সত্বেও শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় তাঁদের আয় কম
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : কানাডায় শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অশ্বেতাঙ্গ লোকেরা বেশি শিক্ষিত। কিন্তু শিক্ষা শেষে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় একই পরিমাণ বেতন ও সুবিধাসম্পন্ন চাকরি খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা তাঁদের ক্ষেত্রে কম। গত জানুয়ারী মাসে প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিকস কানাডার এক সমীক্ষায় এ কথা বলা হয়।
বিশেষ করে, স্নাতক হওয়ার দুই বছর পর, অশ্বেতাঙ্গ স্নাতকরা তাঁদের শ্বেতাঙ্গ সমকক্ষদের তুলনায় কর্মক্ষেত্রে কম উপার্জন এবং ইউনিয়নে কম অন্তর্ভুক্তি এবং পেনশন পরিকল্পনার সুবিধা কম পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। যাই হোক, দেখা গেছে, জাতিগত গোষ্ঠীভেদে এবং নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা যথেষ্ট ভিন্ন।
চলতি সালের জানুয়ারী মাসে প্রকাশিত দুটি নতুন গবেষণা থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। এ দুটি গবেষণা হলো, “২০২১ সালে জাতিগত জনসংখ্যার মধ্যে শিক্ষাগত অর্জন এবং পেশাগত ফলাফলের চিত্র” এবং “২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়া কানাডার জাতিগত জনগোষ্ঠীর লোকেদের কর্মজীবনের শুরুর দিকের কাজের মান।”
২০২১ সালের আদমশুমারি থেকে ডেটা ব্যবহার করে, প্রথম গবেষণাটি কানাডায় জাতিগত কর্মক্ষম জনসংখ্যার শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের পার্থক্যগুলি পরীক্ষা করে। পরীক্ষার ক্ষেত্রে অভিবাসী এবং প্রজন্মের অবস্থান, অভিবাসনের পর থেকে কানাডায় অবস্থানের সময়, জন্মস্থান এবং কোথায় লেখাপড়া করেছে এমন বৈশিষ্ট্যগুলি বিবেচনায় নেয়া হয়।
দ্বিতীয় গবেষণায় মাধ্যমিক উত্তর শিক্ষার্থীদের তথ্যভাণ্ডার, ২০১৬ সালের আদমশুমারি এবং T1 Family File এর সমন্বিত ভাণ্ডার থেকে ডেটা ব্যবহার করে, দৃশ্যমান সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর স্নাতক এবং শ্বেতাঙ্গ স্নাতকদের মধ্যে শিক্ষাজীবন শেষে দুই বছরের মাধায় তারা চাকরিতে কী পরিমাণ আয় করছে, ইউনিয়নভুক্ত হওয়ার হার এবং পেনশন প্ল্যানের সুবিধা প্রাপ্তির হারের পার্থক্য পরীক্ষা করা হয়।
অশ্বেতাঙ্গদের প্রায়শ জাতীয় গড়ের তুলনায় উচ্চতর শিক্ষা থাকে
“২০২১ সালে জাতিগত জনসংখ্যার মধ্যে শিক্ষাগত অর্জন এবং পেশাগত ফলাফলের চিত্র” শীর্ষক গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, কোরিয়ান, চীনা, দক্ষিণ এশীয়, পশ্চিম এশীয়, জাপানি, আরব এবং ফিলিপিনো জনসংখ্যাসহ অনেক দৃশ্যমান সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর শিক্ষার স্তর জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেকটাই উপরে ছিল।
অবশ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় লোকদের শিক্ষার স্তর কিছুটা নিম্নতর ছিল, এর একটি করণ হতে পারে এই যে তাদের মধ্যে অনেকেই উদ্বাস্তু হিসেবে কানাডায় এসেছেন। তার পরও দ্বিতীয় প্রজন্মের দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় লোকেদের (যারা কানাডায় বিদেশী বংশোদ্ভূত বাবা-মার কাছে জন্ম নিয়েছে) শিক্ষার স্তর তাদের বাবা-মার তুলনায় অনেক উঁচু স্তরের।
ল্যাটিন আমেরিকান এবং কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর শিক্ষাগত অর্জনে উল্লেখযোগ্য তারতম্য দেখা যায়। ল্যাটিন আমেরিকান অভিবাসী যারা ২০০১ বা তার পরে এসেছেন তাদেরও সামগ্রিকভাবে কানাডিয়ানদের তুলনায় স্নাতক বা উচ্চতর ডিগ্রি থাকার সম্ভাবনা বেশি দেখা যায়। একই অবস্থা দেখা যায় প্রথম এবং দ্বিতীয় প্রজন্মের কালো কানাডিয়ানদের ক্ষেত্রে যারা আফ্রিকায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন অথবা যাদের বাবা-মায়ের মধ্যে অন্তত একজন আফ্রিকায় জন্মেছিলেন।
সেই তুলনায়, ২০০১ সালের আগে আসা ল্যাটিন আমেরিকান অভিবাসী এবং তৃতীয়-প্রজন্ম-বা তারও পরবর্তী প্রজন্মের কৃষ্ণাঙ্গ কানাডিয়ানদের (যাদের বাবা-মা উভয়েরই জন্ম কানাডায় এবং নিজেরাও কানাডায় জন্মেছেন) সামগ্রিকভাবে কানাডিয়ানদের তুলনায় স্নাতক ডিগ্রি বা উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার সম্ভাবনা কম।
স্নাতক ডিগ্রিধারী দৃশ্যমান সংখ্যালঘু লোকেদের বড় অংশ হলো দক্ষিণ এশীয়, চীনা এবং কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী
“২০১৪ থেকে ২০১৭ সমন্বিত কানাডিয়ান স্নাতকদের প্রারম্ভিক কর্মজীবনের কাজের মান” শীর্ষক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ৩৯৫,০০০ শিক্ষার্থী কানাডার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
থেকে স্নাতক হয়েছে। এসব স্নাতকের মধ্যে, ১১৮,৫০০ জন শিক্ষার্থী ছিলেন অশ্বেতাঙ্গ জাতিগোষ্ঠীর, যারা মোট গ্রাজুয়েটের এক-তৃতীয়াংশ (৩০%)।
স্নাতক ডিগ্রিধারী অশ্বেতাঙ্গ গ্রাজুয়েটদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক হলো চীনা, দক্ষিণ এশীয় এবং কৃষ্ণাঙ্গ স্নাতকরা, কানাডিয়ান জনসংখ্যার তাদের প্রতিনিধিত্বের প্রতিফলন ঘটে যে, প্রতি তিনজন স্নাতকের মধ্যে প্রায় দুইজনই (৬৭%) অশ্বেতাঙ্গ।
স্নাতকদের গড় বয়সে পার্থক্য আছে। সাধারণভাবে, এশিয়ানরা কিছুটা কম বয়সে গ্র্যাজুয়েশন নেয়। উদাহরণস্বরূপ, চীনা, দক্ষিণ-পূর্ব এশীয়, দক্ষিণ এশীয় এবং ফিলিপিনো স্নাতকরা প্রায় ২৫ বছর বয়সে তাদের স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। সেই তুলনায় শ্বেতাঙ্গর গড়ে ২৬ বছরে, ল্যাটিন আমেরিকান এবং আরবরা ২৭ বছরে এবং কৃষ্ণাঙ্গরা ২৯ বছর বয়সে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি নেয়।
লিঙ্গভেদেও পার্থক্য ছিল। স্নাতক জনসংখ্যায় মহিলাদের অনুপাত দক্ষিণ এশীয়দের জন্য ৫১% থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য ৬৪% পর্যন্ত। শ্বেতাঙ্গদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত ৬১%।
অশ্বেতাঙ্গ গ্র্যাজুয়েটরা যেসব বিষয়ে লেখাপড়া করেন তাতেও জাতিগত গোষ্ঠী এবং লিঙ্গভেদে তারতম্য দেখা যায়। মহিলা স্নাতকদের মধ্যে, ভৌত ও জীববিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয় যেমন গণিত, কম্পিউটার ও তথ্য বিজ্ঞান; এবং স্থাপত্য, প্রকৌশল এবং এর সাথে সম্পর্কিত প্রযুক্তিগত বিষয়গুলি সচরাচর বেশি পড়তে দেখা যায় আরব (১৯%), চীনা (১৬%) এবং কোরিয়ান (১৬%) গ্র্যাজুয়েটদের। শ্বেতাঙ্গ (৮%) এবং কৃষ্ণাঙ্গ (৭%) গ্র্যাজুয়েটরা এগুলো কম পড়েন। অন্যদিকে শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ে লেখাপড়া করা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় শ্বেতাঙ্গ (১৮%) এবং আরব (১৫%) নারী গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে। বেশিরভাগ জাতিগত গোষ্ঠীর গ্র্যাজুয়েটরা শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়গুলি কম পড়েন।
অশ্বেতাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গ পুরুষ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞান এবং ব্যবসা, ব্যবস্থাপনা ও জনপ্রশাসনের মত বিষয়গুলি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। অবশ্য এই দুটি ক্ষেত্র সম্মিলিতভাবে শ্বেতাঙ্গ স্নাতকদের (৫৮%) তুলনায় বেশি জনপ্রিয় আরব (৭৬%), দক্ষিণ এশীয় (৭৩%), চীনা (৭১%) এবং পশ্চিম এশীয় (৭১%) স্নাতকদের মধ্যে।
সাধারণভাবে, স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের দুই বছর পর কর্মসংস্থান থেকে দৃশ্যমান সংখ্যালঘু স্নাতকদের আয় শ্বেতাঙ্গ স্নাতকদের তুলনায় কম। আবার পুরুষের তুলনায় নারীদের চাকরির আয় কম। দৃশ্যমান সংখ্যালঘু মহিলারা যেখানে বছরে আয় করেন ৪৫,৭০০ ডলার সেখানে শ্বেতাঙ্গ মহিলাদের আয় বছরে ৪৭,৮০০ ডলার। শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের আয় যেখানে বছরে ৫৪,১০০ ডলার, সেই তুলনায় দৃশ্যমান সংখ্যালঘু পুরুষদের আয় বছরে ৫১,৬০০ ডলার।
দৃশ্যমান সংখ্যালঘু স্নাতক এবং শ্বেতাঙ্গ স্নাতকদের মধ্যে আয়ের ব্যবধান অনেক ক্ষেত্রেই বিদ্যমান, এমনকি যখন গ্র্যাজুয়েশনের বৈশিষ্ট্যগুলি বিবেচনায় নেয়া হয় সেখানেও। মহিলাদের মধ্যে, পশ্চিম এশীয় এবং আরব স্নাতকদের আয়ের ব্যবধান ছিল সবচেয়ে বেশি। শ্বেতাঙ্গ মহিলাদের তুলনায় পশ্চিম এশীয় মহিলা স্নাতকরা ১৬% কম এবং আরব মহিলা স্নাতকরা ১৫% কম উপার্জন করেন। এর ধারা চলে এসছে কৃষ্ণাঙ্গ, কোরিয়ান, দক্ষিণ এশীয় এবং ল্যাটিন আমেরিকান মহিলা স্নাতকদের ক্ষেত্রেও। এদের চাকরির আয় শ্বেতাঙ্গ মহিলা সমকক্ষদের তুলনায় ৮% থেকে ৯% কম।
পুরুষদের মধ্যে, কৃষ্ণাঙ্গ, দক্ষিণ-পূর্ব এশীয়, ফিলিপিনো, চীনা এবং কোরিয়ান গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির আয় সবচেয়ে কম। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, তারা শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় ১১% থেকে ১৩% কম উপার্জন করেন। এর পরে রয়েছে দক্ষিণ এশীয় এবং আরব পুরুষ স্নাতকরা, যারা শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের তুলনায় গড়ে ৬% কম উপার্জন করেন।
দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্নাতকরা সাধারণত শ্বেতাঙ্গ স্নাতকদের তুলনায় কমই ইউনিয়নভুক্ত হতে পারেন এবং নিয়োগকর্তার পেনশনের সুবিধা পান
দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গ্র্যাজুয়েটরাও তাদের শ্বেতাঙ্গ সমকক্ষদের তুলনায় ইউনিয়নভুক্ত হওয়া এবং নিয়োগকর্তার পেনশন প্ল্যানের সুবিধা কম পান বলে জানান। এই বঞ্চনার হার সাধারণত পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে বেশি। উদাহরণস্বরূপ, মহিলাদের মধ্যে, কৃষ্ণাঙ্গ স্নাতক ছাড়া সব দৃশ্যমান সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর স্নাতকদেরই, ইউনিয়নবুক্ত হবার হার ছিল শ্বেতাঙ্গ গ্র্যাজুয়েটদের (৫৩%) তুলনায় কম।