জন টরি’র পরকীয়া
খুরশিদ আলম
জন টরি’র তরী ডুবলো তীরে এসে। চাকরী, ব্যবসা ও রাজনৈতিক জীবনে যিনি ছিলেন একজন পারফেক্ট জেন্টলম্যান, টরন্টোর মেয়র হিসাবে যার ছিল আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা, সেই তিনিই কিনা হাটুর বয়সী এক মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে সারা জীবনের অর্জিত যশ, খ্যাতি, সম্মান, বিশ্বাস, পদ এ সবই হারালেন জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে!
রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে জন টরি অবশ্য তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারেন নি। তবে শেষের দিকে এসে তিনি সাফল্য অর্জন করেছেন। এবং বেশ ভালভাবেই। টরন্টোর মেয়র হিসাবে তিন তিনবার জয়ী হয়েছেন তিনি। গত বছর অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত সিটি নির্বাচনে তিনি আগের বারের চেয়ে আরো বেশী ভোটে টরন্টোর মত একটি বিশ্বমানের সিটির মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু ধরে রাখতে পারলেন না তার এই সাফল্যের ধারাবাহিকতা ও সম্মান। বিদায় নিলেন পরকীয়ার জটিল জালে জড়িয়ে পরে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি (২০২৩) সম্মানজনক সিটি মেয়রের পদ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেন তিনি। তার অধস্তন ৩১ বছর বয়স্ক এক নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে তার এই করুণ পরিণতি ঘটে।
জন টরি’র সংসার আছে। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, নাতি, নাতনী সবই আছে তার। কিন্তু তারপরও তিনি কেন এমন কর্মটি করে বসলেন এই বুড়ো বয়সে এসে! জন টরি’র বয়স বর্তমানে ৬৮। বয়সে ৩৭ বছর ছোট এক নারী প্রেমে পড়ে তিনি কি এতটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে এর পরিণতি কি হতে পারে তা নিয়ে একবারও ভাবেন নি?
ভেবেছিলেন হয়তো। কিন্তু প্রেম এবং সেটা যদি পরকীয়া প্রেমও হয়, তা এমনই অন্ধ থাকে যে ধর্ম, বর্ণ, সমাজ, বয়স এসব কিছুই সে চোখে দেখে না। এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে এক মহাকর্ষীয় শক্তি। কদিন আগে ঢাকার প্রথম আলো পত্রিকায় এক খবরে পড়লাম, ভালবাসা দিবসে (ভ্যালেনটাইনস ডে) পটুয়াখালতে এক জামাই বাবু নিজের শাশুড়িকে নিয়ে পালিয়েছেন! কি ভয়াবহ এবং সাংঘাতিক রকমের প্রেম! খবরে বলা হয়, বিয়ের পর সেই জামাই বাবু স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতেই থাকতেন। শ্বশুর কাজের সুবাদে বেশীরভাগ সময়ই গ্রামের বাইরে থাকতেন। আর সেই সুযোগে সবার অগোচরে জামাই আর শাশুড়ি অবৈধ প্রেমের অথৈ সাগরে ডুব দেন। পরিণতির কথা না ভেবে দু’জনেই বাড়ি থেকে ভালবাসা দিবসে পালিয়েও যান। পরে অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাদেরকে না পেয়ে বেচারা শ্বশুর আদালতে মামলা করতে বাধ্য হন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে জামাই ও শাশুড়ির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। কিন্তু তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে কি? হয়তো যাবে অথবা যাবে না।
কানাডায় অবশ্য পরকীয়া প্রেম আইনের চোখে অপরাধ নয়। কেউ পরকীয়ায় জড়িয়ে ধরা পড়লে বা পালিয়ে গেলে আদালত গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করবে না। জেল জরিমানাও হবে না। কিন্তু লোক নিন্দা হবে। বিশেষত রাজনৈতিক ক্ষমতাধর কোন ব্যক্তি যদি পরকীয়ায় জড়িয়ে পরেন এবং তা কোন ভাবে ফাঁস হয়ে যায় তখন লোক নিন্দার একটা ঝড় উঠে। তবে পরকীয়ায় জড়িত কোন নারী যদি সংশ্লিষ্ট পুরুষটির বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের অভিযোগ তুলেন তখন ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়। আইনের চোখে সেটি তখন অপরাধ হিসাবে গণ্য হয় এবং ঐ পুরুষটিকে বিচারের মুখমুখি হতে হয়।
জন টরি’র বিরুদ্ধে টরন্টো সিটির ঐ সাবেক মহিলা কর্মী এখন পর্যন্ত যৌন হয়রানী বা ধর্ষণের অভিযোগ তুলেননি। সেই মহিলার কোন পরিচয়ও এখন পর্যন্ত কেউ প্রকাশ করেনি। জন টরি নিজেই বলেছেন ঐ মহিলার সঙ্গে তিনি কভিড-১৯ মহামারী শুরু পর পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। তবে সম্প্রতি তারা দুজনেই আলোচনার মাধ্যমে পরকীয়ার এই সম্পর্কের অবসান ঘটান। অর্থাৎ ধরে নেয়া যেতে পারে ঐ মহিলা জন টরি’র বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির কোন অভিযোগ উঠাচ্ছেন না।
তবে কৌতুহলের বিষয় হলো, টরন্টোর অর্ধেকের বেশী অধিবাসী টরি’র পরকীয়াকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতেই দেখছেন বলে মনে হচ্ছে। কারণ তারা মত দিয়েছিলেন, টরির পদত্যাগ করা উচিত নয়। ‘ফোরাম রিসার্স’ এর এক জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। জন টরি আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগের আগে পরিচালিত ঐ জরিপে দেখা গিয়েছিল ৪৫% টরন্টোবাসী চাননি তিনি পদত্যাগ করুক। ৪৩% টরন্টোবাসী অবশ্য চেয়েছিলেন তিনি পদত্যাগ করুক। আর ১১% টরন্টোবাসী কোন মতামত দেননি। আর যারা গত নির্বাচনে জন টরি-কে ভোট দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ৬৩% চাননি তিনি মেয়রের পদ থেকে পদত্যাগ করুক। আবার যারা অন্টারিও’র প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের সমর্থক, তাদের মধ্যেও দেখা গেছে বেশীর ভাগই বলেছেন জন টরি’র পদত্যাগ করা উচিত নয়। জন টরি নিজে রক্ষণশীল দল অন্টারিও কনজারভেটিভ পার্টির প্রধান ছিলেন এক সময়। সেই দলের সমর্থকদের মধ্যে ৫১% তার পদত্যাগের পক্ষে ছিলেন না। আর বিরোধী দল অন্টারিও লিবারেল পার্টির সমর্থকদের মধ্যে জন টরির পদত্যাগের পক্ষে ছিল না ৬০%।
বিচেস-ইস্ট ইয়র্ক এলাকার কাউন্সিলর ব্রেড ব্রেডফোর্ড ইতিপূর্বে সিটিভি নিউজকে বলেন, ‘জন টরি মাত্র কয়েক মাস আগে বিপুল ভোট পেয়ে টরন্টোর মেয়র নির্বাচিত হন। কমিউনিটিতে দেখেছি বিপুল সংখ্যক লোক চাচ্ছেন তিনি মেয়র পদে বহাল থাকুক। তবে ব্যক্তিগতভাবে জন টরি কি সিদ্ধান্ত নিবেন সেটা তিনিই জানেন।
উল্লেখ্য যে, অন্টারিও’র প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ডও জন টরি-কে তার পদে বহাল থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু কানাডার উপপ্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড টরন্টো স্টারকে বলেছিলেন জন টরি’র পদত্যাগ করা অত্যাবশ্যক।
তবে সত্যিই কি আবশ্যক ছিল তার পদত্যাগ করা? একেবারেই নয়। এমনটাই বলেছেন সিবিসি নিউজের কলামিস্ট জোয়ান চিয়ানেলো তার এক বিশ্লেষণে। কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, টরন্টো বা অন্টারিও’র অন্য কোন পৌরসভার মেয়র বা কাউন্সিলরগণ কর্মস্থলে তাদের সহকর্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবেন না এমন কোন বিধিনিষেধ নেই। মেয়র বা কাউন্সিলরদের সাধারণ আচরণ কি হবে পৌরসভাগুলোর কোড অব কন্ডাক্টে বা আচরণবিধিতে সে কথা বলা আছে। কিন্তু সহকর্মী কারও সাথে পরকীয়া বা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবেন কি পারবেন না সে বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি।
তবে তিনি একথাও বলেন যে, ‘জন টরির সঙ্গে আলোচিত সেই মহিলার বয়সের ব্যবধান, সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়ে উভয়ের সম্মতির কথা বাদ দিলেও আরেকটি বিষয় সামনে চলে আসে। সেটি হলো টরি’র বৈবাহিক অবস্থা। তিনি বিবাহিত।’
আলোচিত ঐ মহিলা বিবাহিত না অবিবাহিত সেটি অবশ্য জানা যায়নি। তবে যে বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো, ‘ঐ মহিলার বস ছিলেন জন টরি। তাকে কর্মস্থলে নিয়োগ প্রদান বা চাকুরীচ্যুত করার কর্তৃত্ব ছিল তার হতে, ছিল পদোন্নতি বা বোনাস দেয়ার কর্তৃত্বও। ফলে এরকম একটি পরিস্থিতে বা পরিবেশে মেয়র হিসাবে জন টরি কর্তৃক ঐ মহিলার সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোটা সুসংগত বা মানানসই ছিল না।’
অটোয়ার সাবেক ‘ন্যায়পরায়ণতা কমিশনার’ রবার্ট মারলেউ সিবিসি নিউজকে বলেন, ‘কর্মস্থলে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে পরার ঘটনা মোটেও নতুন কোন বিষয় নয়। তবে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া দুইজনের মধ্যে যখন ক্ষমতার ব্যাপক ভারসাম্যহীনতা বিদ্যমান থাকে তখন এটি নিশ্চিত হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে যে অধিনস্থ ব্যক্তিটি সম্পর্কে জড়ানোর ক্ষেত্রে কোন চাপ অনুভব করেছিলেন কিনা।’
এ বিষয়ে অবশ্য জন টরি’র সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পরা সেই মহিলার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তিনি যাতে বিব্রত না হন সে কারণে এখন পর্যন্ত তার পরিচয় কঠিন ভাবে গোপন রাখা হয়েছে মিডিয়াতে।
তবে ঐ মহিলার সঙ্গে জন টরি’র সম্পর্কের কথা ফাঁস হওয়ার পর একটি বিষয়ে নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সেই প্রশ্নটি হলো, কানাডিয়ানদের মধ্যে অধিকাংশ লোকই কি পরকীয়ার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে নেই? কিংবা অধিকাংশ লোকেরই কি মৌন সমর্থনও রয়েছে পরকীয়ার প্রতি?
অন্যদিকে আমরা দেখছি, কানাডার আইনেও একথা বলা নেই যে পরকীয়া অপরাধ।
তাহলে কি এই কারণেই টরন্টোর আরেক মেয়র পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। তার কাহিনীটি ছিল জন টরি’র চেয়ে বহুগুণে নাটকীয়। ঘরে স্ত্রী রেখে দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর লাগিয়ে তিনি চুটিয়ে প্রেম করেছিলেন তারই অধিনস্থ এক মহিলা কর্মচারীর সঙ্গে। শুধু তাই নয়, ঐ মহিলা কর্মচারীর গর্ভে দু-দুটি সন্তানের জন্মও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিষয়টি দীর্ঘকাল গোপন ছিল।
আলোচিত সেই মেয়র মহোদয় ছিলেন মেল লাস্টম্যান। তার নামেই নর্থ ইয়র্ক সিভিক সেন্টারের সামনের চত্বরের নাম করণ করা হয় ‘মেল লাস্টম্যান স্কোয়ার’ হিসাবে। প্রথমে তিনি নর্থ ইয়র্কের মেয়র ছিলেন। পরে গ্রেটার টরন্টোর মেয়র হিসাবেও নির্বাচিত হন। এবং বেশ জনপ্রিয় মেয়র ছিলেন তিনি। তবে পরকীয়া ছাড়াও অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন লাস্টম্যান। সুবৃহৎ ও নামকরা ফার্নিচার স্টোর ‘বেড বয়’ এর প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। আর সেই বেড বয় এর একজন কর্মচারী ছিলেন গ্রেস লুই নামের একজন মহিলা যার সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন মেল লাস্টম্যান।
তাদের এই পরকীয়ার কাহিনী এবং দুই সন্তানের জন্মের বিষয়টি অনেক কাল পরে মিডিয়াতে আসে যখন একটি মামলার ঘটনা ঘটে। গ্রেস লুই ও তার গর্ভে জন্ম নেয়া দুই সন্তান মিলে লাস্টম্যানের বিরুদ্ধে ৬ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ চেয়ে একটি মামলা করেছিলেন। সেটি ছিল ২০০০ সালের ঘটনা। লাস্টম্যান তখন টরন্টোর মেয়র। ছেলে দুটির বয়সও তখন অনেক হয়ে গিয়েছিল। একজনের বয়স ছিল ৪১ এবং অপরজনের ৩৮। তাদের অভিযোগ ছিল তারা মেল লাস্টম্যানের অবৈধ সন্তান এবং তারা তার কাছ থেকে কোন চাইল্ড সাপোর্ট পাননি। চরম দারিদ্রতার মধ্যে তাদেরকে দিন কাটাতে হয়েছে। তারা এখন লাস্টম্যানের সম্পত্তির ভাগ চান।
তবে লাস্টম্যান এই দুই সন্তানের দায়িত্বের বিষয়টি অস্বীকার করেন এবং মামলায় লড়াই করে জিতে যান। কিন্তু ইতিমধ্যে এটি প্রমাণিত হয়ে যায় যে তিনিই ঐ দুই সন্তানের জন্মদাতা পিতা। আর তাদের একজনের সঙ্গে লাস্টম্যানের চেহারার মিল ছিল অবিকল। লাস্টম্যান অবশ্য সেই সময়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পরকীয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নেন। এই সময় তার পাশে তার স্ত্রীও ছিলেন। লাস্টম্যান ঐ সংবাদ সম্মেলনে দাবী করেন যে পরকীয়ার এই বিষয়টি নিয়ে তিনি তার স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং তারা তাকে শর্তহীনভাবে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
মেল লাস্টম্যান মারা যান গত ২০২১ সালের ১১ ডিসেম্বর। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।
জন টরি পদত্যাগের আগে অবশ্য স্বীকার করেছেন পরকীয়ায় জড়ানোর বিষয়টি ছিল একটি গুরুতর ভুল সিদ্ধান্ত। ৪০ বছর ধরে এক সাথে সংসার করছেন স্ত্রী বারবারা হ্যাকেট এর সাথে। বেলা শেষে এমন গুরুতর একটি ভুল তাকে আকাশ থেকে জমিনে নামিয়ে এনেছে। তিনি এখন রাজনীতি, সমাজ এ সব কিছু থেকেই সম্ভবত নিজেকে দূরে রাখবেন। কিন্তু যে কলংকের ভাগীদার তিনি হলেন সেটা থেকে তার মুক্তি মিলবে না কোন দিন। যেমনটা মিলেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের। জন টরি’র পরিচিতি তো স্থানীয় পর্যায়ে। কিন্তু বিল ক্লিনটনের পরিচয় ছিল বিশ^ব্যাপী। মনিকা নামের এক মেয়ের সঙ্গে তার পরকীয়ার কাহিনী ফাঁস হবার পর বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠেছিল। পত্র পত্রিকায় দীর্ঘ দিন ধরে তার পরকীয়ার কাহিনী ছাপা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও বিল ক্লিনটন ক্ষমতা ছাড়েননি। তবে জন টরি ক্ষমতা ছেড়েছেন। নিতান্তই ভদ্রলোক বলে? হবে হয়তো। কিংবা অন্য কোন কারণও থাকতে পারে। অবশ্য কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন যে, ভদ্রলোকেরা পরকীয়া করে নাকি? পরকীয়া তো এক ধরণের প্রতারণা। হ্যা, অবশ্যই প্রতারণা। তবে সম্ভবত এই একটা জায়গায় এসে ভদ্র অভদ্র সবাই সমান হয়ে যান।
আগেই উল্লেখ করেছি যে, মেয়র বা কাউন্সিল মেম্বারগণ তাদের কর্মস্থলে কারো সঙ্গে রোমান্টিক সম্পর্কে জাড়াতে পারবেন না এমন কথা সুষ্পষ্টভাবে সিটি অব টরন্টোর কোড অব কন্ডাক্টে এ উল্লেখ নেই। আর শুধু সিটি কর্পোরেশনেই নয়, কানাডার আরো অনেক প্রতিষ্ঠানেই এ বিষয়ে একেবারেই কোন নীতিমালা বা নির্দেশিকা নেই। একথা বলেছেন টরন্টোর একজন এমপ্লয়মেন্ট লইয়ার হারমি আব্রাহাম। এভোকেশন নামের ল ফার্মের স্বত্বাধিকারী এই মহিলা লইয়ার সিবিসি নিউজকে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না যে একজন অধস্তন কর্মকর্তা বা কর্মচারী সর্বদা সম্মতি দিতে অক্ষম। আর সবাই পরিস্থিতির শিকার হয়ে তার থেকে বয়সে বড় বা উর্ধ্বতন কারো সাথে রোমান্টিক সম্পর্কে জড়ান এ কথাও বলা যাবে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি মনে করি দুজনের মধ্যে পদাধিকারের ব্যবধান থাকলেও তারা একটি সম্পর্কে জড়াতে পারেন যদি উভয়ের মধ্যে সম্মতি থাকে।’
জন টরি এবং তার অধিনস্থ মহিলা কর্মীর মধ্যে পারস্পরিক সম্মতি ছিল সম্পর্কে জড়ানোর ব্যাপারে। এটি জন টরির বক্তব্য। কিন্তু তার অধিনস্থ ঐ মহিলার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা যায় সম্মতি ছিল হয়তো। না থাকলে এই সুযোগে সেই মহিলা যৌন হয়রানীসহ অন্যান্য অভিযোগ নিয়ে আদালতে হাজির হতেন নিশ্চই।
কেউ কেউ অবশ্য প্রশ্ন তুলছেন এই বলে যে, জন টরি’র মত বৃদ্ধ বয়সেও কি মানুষের চারিত্রিক স্খলন ঘটতে পারে?
হ্যা, ঘটতে পারে। তার ভুড়ি ভুড়ি প্রমাণ আছে সমাজে। বরং গবেষণায় দেখা গেছে বয়স বাড়ার সাথে সাথে পরকীয়ায় জড়ানোর প্রবণতা বৃদ্ধি পায়! ‘ইনস্টিটিউট ফর ফ্যামিলি স্টাডিজ’ পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের বয়স যত বাড়ে তার মধ্যে জীবন সঙ্গীর সাথে প্রতারণার প্রবণতাও তত বাড়ে। মূলত বয়স ৫৫ পার হলেই জীবন সঙ্গীর সঙ্গে প্রতারণার মাত্রা বাড়তে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে এই বয়সী লোকদের মধ্যে ২০% বিবাহিত ব্যক্তি পরকীয়ার সঙ্গে জড়িত। আর বয়স যাদের পঞ্চান্নের নিচে তাদের মধ্যে ১৪% ব্যক্তি পরকীয়ার সঙ্গে জড়িত। এই হিসাবটি যুক্তরাষ্ট্রের। কানাডার হিসাবটাও প্রায় একই হওয়ার কথা। এর প্রমাণ দেখা যায় টরন্টো সান পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। ঐ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, কানাডায় ক্রমবর্ধমান সংখ্যক বয়স্ক মহিলা পরকীয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। এবং এ জন্য তারা অপরাধবোধে আক্রান্ত হচ্ছেন না। জেন্ডার এক্সপার্ট ও লেখক সুসান শাপিরো বারাশ এ বিষয়ে এক গবেষণা পরিচালনা করেন। টরন্টো সান এর প্রতিবেদক ডেনেট উইলফোর্ড সেই গবেষণার সূত্র ধরে এই তথ্য প্রকাশ করেন। ঐ গবেষণায় দেখা যায় কানাডায় বয়স্ক মহিলাদের মধ্যে ডিভোর্সের মাত্রা ও পরকীয়ায় জড়ানোর হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। যারা এই পথ বেছে নিচ্ছেন তাদের বয়স পঞ্চাশ ও ষাটের কোঠায়। এবং এই মহিলাদের অনুভূতি হলো, স্বামী আর পরকীয়া প্রেমিক এই দুয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ।
অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে কানাডায় প্রতি ছয় জনের মধ্যে একজন পরকীয়া প্রেমের পক্ষে। তারা বলেন পরকীয়া প্রেম নৈতিকভাবে গ্রহাণযোগ্য। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘জবংবধৎপয ঈড়’ সম্প্রতি এই তথ্য প্রকাশ করে। তাদের জরিপে দেখা গেছে ১৬% কানাডিয়ান ইঙ্গিত দিয়েছেন এই বলে যে, একজন বিবাহিত ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক থাকা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। তবে ৭১% মনে করেন এটি নৈতিকভাবে ভুল। আর ১৩% বলেছেন তারা নিশ্চিত নন এই সম্পর্ক নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নাকি অগ্রহণযোগ্য।
গবেষণায় বলা হয়, পরকীয়া নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য এ কথা যারা বিশ্বাস করেন তাদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশী।
তাহলে দেখা যাচ্ছে কানাডায় জন টরি বা মেল লাস্টম্যান এর অনুসারীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। তবে এই পরকীয়ার ঘটনা শুধু মূল ধারার কানাডিয়ানদের মধ্যেই ঘটছে সেটা ভাবার কোন অবকাশ নেই। কানাডায় বসবাসকারী সাউথ এশিয়ানদের মধ্যেও এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর এই সাউথ এশিয়ানদের মধ্যে আছে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ আরো চারটি দেশ। ভ্যাঙ্কুভার ভিত্তিক একজন রেজিস্টার্ড ক্লিনিক্যাল কাউন্সিলর পল বেইনস স্থানীয় উবংর ঞড়ফধু পত্রিকাকে বলেন দেশটিতে ইন্দো-কানাডিয়ানদের মধ্যে পরকীয়া সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, নতুন সম্পর্ক অন্বেষণ করা, নতুন বন্ধু তৈরী করা এবং অন্যের কাছ থেকে মানসিক সমর্থনের সন্ধান করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু বিবাহিত দম্পতিরা যখন তাদের বিয়ের বাইরে বিপরীত লিঙ্গের সাথে রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তখন নৈতিকতার প্রশ্নটি সামনে এসে দাঁড়ায়।
ক্লিনিক্যাল কাউন্সিলর পল বেইনস প্রায় দুই দশক ধরে কাজ করছেন সাউথ এশিয়ান কমিউনিতে। তিনি উবংর ঞড়ফধু পত্রিকাকে আরো বলেন, যে সকল ইন্দো-কানাডিয়ান পরিবারে পরকীয়ার ঘটনা ঘটছে সেখানে শুধু যে ডিভোর্স হচ্ছে তা নয়। আরো বড় সমস্যা দেখা দিচ্ছে ঐ পরিবারগুলোতে। আর সেটি হলো মানসিক স্বাস্থ্য। পরকীয়ার পর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে মহিলারা উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং অন্যান্য মানসিক রোগে ভোগেন। অনেকে আবার তাদের স্বামীর পরকীয়ার ঘটনা কারো কাছে প্রকাশ করেন না পরিবারের সম্মানের কথা চিন্তা করে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যান। দেখা দেয় মনোরোগ।
পল বেইনস আরো বলেন, এই প্রবণতা বেশী দেখা যাচ্ছে বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে। তার কাছে পঞ্চাশ ও ষাটের কোঠায় যাদের বয়স সেই সব মহিলাদের অনেকেই কাউন্সিলিং নিতে আসেন। আর সেই বয়স্ক মহিলাদের অনেকেরই অভিযোগ, তাদের স্বামী তাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই প্রতারণা করে আসছেন।
কিন্তু কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, খোদ ভারতেই এখন পরকীয়া আর আপরাধ হিসাবে গণ্য নয়। কেউ পরকীয়ায় জড়ালে তার কোন শাস্তি হবে না। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যুগান্তকারী এক রায়ে জানায় পরকীয়া আর ফৌজদারি আপরাধ নয়। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র তাঁর রায়ে জানান, ‘ভারতের মাটিতে ১৫৮ বছরের পুরোনো এ আইনের কোনো দরকার নেই। এটা অসাংবিধানিক। এই আইন স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। নারীদের স্বাতন্ত্র খর্ব করে।’ তিনি আরো বলেন, ‘স্ত্রী কখনো স্বামীর সম্পত্তি হতে পারে না। কোনো ব্যক্তি যদি কোনো বিবাহিত নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হন, তবে সেটা কোনো অপরাধ নয়।’
ভারতে ১৮৬০ সালে তৈরি হওয়া ৪৯৭ ধারায় পরকীয়া ছিল অপরাধ। যে পুরুষ বা নারী এ ধরনের সম্পর্কে যুক্ত থাকবেন বলে আদালতে প্রমাণিত হবে, তার কারাভোগ এবং জরিমানা ছিল কার্যত অবশ্যম্ভাবী।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ঐ যুগান্তকারী রায়ের পর বিবিসি’র পক্ষ থেকে বাংলাদেশের আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একজন আইনজীবী নীনা গোস্বামীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশের আইন কি বলে পরকীয়ার বিষয়ে। নীনা বলেন, ‘এ সংক্রান্ত আইন খুব বেশী নেই। তবে ৪৯৭ ধারায় বলা হয়েছে যে কোন বিবাহিত ব্যক্তি যদি অন্য কোন বিবাহিত নারীর সাথে জেনেশুনে যৌন সম্পর্ক করেন তাহলে সেটি ব্যভিচার বলে গণ্য করা হবে। এ ক্ষেত্রে সেই পুরুষটির পাঁচ বছরের কারাদন্ড, অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডের বিধান আছে। তবে যে নারীর সাথে ব্যভিচার করা হয়েছে তার ক্ষেত্রে আইনে কোন শাস্তির বিধান নেই।’
পরকীয়ার ব্যাপারটি আসলে মানব সমাজে নতুন কোন বিষয় নয়। যুগ যুগ ধরেই চলছে পরকীয়ার এই চর্চা। তবে ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে এবং রাষ্ট্রের আইন-কানুনের কারণে সিংহভাগ নারী-পুরুষ সাধারণত নিজেদেরকে বিরত রাখেন এ ধরণের সম্পর্ক থেকে। এর সাথে আছে শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাব, পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখার প্রতিশ্রুতি ইত্যাদিও। পরকীয়ার কারণে সংসার ভাঙ্গতে পারে এবং তার বিরুপ প্রভাব সন্তানদের উপর পড়তে পারে এই আশংকা থেকেও নারী-পুরুষ পরকীয়া থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু দাম্পত্য জীবনে যখন সংকট তৈরী হয় নানা কারণে, তখন পরিস্থিতি বদলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সংকটের কারণ অনেক কিছুই হতে পারে। এর মধ্যে আছে পারিবারিক কলহ, একঘেয়ে সম্পর্ক, অপূর্ণ প্রত্যাশা, সঙ্গীর প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলা, পুরনো অভ্যাস, সঙ্গীর উদাসীনতা, পেশা বা ব্যবসার কারণে উভয়ের মধ্যে অবস্থানগত দূরত্ব তৈরী ইত্যাদি।
তবে সব কথার শেষ কথা হলো, পরকীয়া যে কোন অর্থেই সঙ্গীর সঙ্গে প্রতারণা। এই প্রতারণা পুরুষ করুক আর নারী করুক, তার মূল প্রভাবটা গিয়ে পড়ে সেই পরিবারে যদি কোন সন্তান থেকে থাকে তাদের উপর।
সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যত প্রতিটি বাবা মা-ই কামনা করেন। তাই পরকীয়া সম্পর্কে বলা যায়, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিওনা’। জন টরি ‘ভাবিয়া’ কাজটি করেননি। ‘করিয়া’ ভেবেছেন কাজটি সঠিক হয়নি।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক, প্রবাসী কণ্ঠ