কানাডায় পারিবারিক সহিংসতা উপর্যুপরি পঞ্চম বছরেও বেড়েছে। এই প্রবণতার কারণ কি?
২০২১ সালে পুলিশে রিপোর্ট করা হয়েছে এমন পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন এক লাখ ২৭ হাজার ৮২ জন কানাডীয়
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : পুলিশের রিপোর্টে কানাডায় পারিবারিক সহিংসতা উপর্যুপরি পঞ্চম বছরেও বেড়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত নতুন এক রিপোর্টে এ তথ্য জানা গেছে। কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, কোভিড-১৯ মহামারি ও এজন্যে আরোপিত লকডাউন এর অন্যতম কারণ। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার বরাত দিয়ে এই খবর প্রকাশ করে আয়া আল-হাকিম – গ্লোবাল নিউজ।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা ২০২২ সালের ১৯ অক্টোবর এক রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ২০২১ সালে পুলিশে রিপোর্ট করা হয়েছে এমন পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন এক লাখ ২৭ হাজার ৮২ জন কানাডীয়। এসব সহিংসতার ঘটনায় জড়িত স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা, সন্তান, ভাইবোন অথবা বর্ধিত পরিবারের সদস্যরা। অর্থাৎ প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ৩৩৬ জন সহিংসতার শিকার হন।
রিপোর্টে বলা হয়, “পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যাবার এটি হলো উপর্যুপরি পঞ্চম বছর।” সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের দুই-তৃতীয়াংশই নারী ও মেয়েরা (৬৯ শতাংশ)।
স্ট্যাটক্যান আরও উল্লেখ করে, “পুরুষ ও বালকদের তুলনায় নারী ও মেয়েদের ক্ষেত্রে সহিংসতার ঘটনা দ্বিগুণেরও বেশি (শিকার হয়েছে ৪৫৭ জন পুরুষ বা বালক অর্থাৎ প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ২১২ জন)।”
লিউকস প্লেস সাপোর্ট অ্যান্ড রিসোর্স সেন্টার ফর উইমেন-এর আইন বিষয়ক পরিচালক পামেলা ক্রস বলেন, সহিংসতা বেড়ে যাবার সবচেয়ে বড় কারণ কোভিড-১৯ মহামারি ও এর সাথে আরোপিত লকডাউন।
ক্রস বলেন, “এর অর্থ হলো, নিপীড়ক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কিত নারীদেরকে হঠাৎ করেই সেই পুরুষের সঙ্গে সারাক্ষণ অবস্থান করতে হচ্ছে।”
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ এর সময় পরিবারগুলোর ওপর চাপ বেড়ে যায় এবং বেসরকারী খাতে কর্মরত অনেক নারী চাকরি ছেড়ে দিতে থাকেন।
“তারা ঘরে বসে চাকরি করতে এবং স্কুলগামী শিশুদের দেখাশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি, সুতরাং পরিবারের ওপর অর্থনৈতিক চাপও ছিল।”
এছাড়াও, ক্রসের মতে, অন্য অনেকের সঙ্গে কাছাকাছি অবস্থানে থাকতে হবে এমন বিবেচনা থেকে নারীরা আশ্রয় কেন্দ্রে যাবার ব্যাপারে অনিচ্ছুক ছিলেন। তাদের মধ্যে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হবার শঙ্কাও ছিল।
উপর্যুপরি সপ্তম বছরে বেড়েছে পুলিশে রিপোর্ট হওয়া অন্তরঙ্গ সঙ্গীর সহিংসতার ঘটনা
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে পুলিশে রিপোর্ট হওয়া অন্তরঙ্গ সঙ্গীর সহিংসতার (বর্তমান ও প্রাক্তন স্বামী বা স্ত্রী, কমন ল পার্টনার বা সঙ্গী, ডেটিংয়ের সঙ্গী এবং অন্যান্য অন্তরঙ্গ অংশীদারের হাতে) শিকার হন ১২ বছর বা তার বেশি বয়সের এক লাখ ১৪ হাজার ১৩২ জন নারী ও মেয়ে (প্রতি লাখে ৩৪৪ জন)। এটি ছিল এধরণের সহিংসতা বেড়ে যাবার উপর্যুপরি সপ্তম বছর। এ ধরণের সহিংসতার প্রতি ১০টির মধ্যে আটটিতেই (৭৯%) শিকার হন নারী বা মেয়ে সঙ্গীটি। আর নারী ও মেয়েদের শিকার হবার ঘটনা পুরুষ ও বালকদের (৫৩৭ বনাম ১৪৭) তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি।
অন্তরঙ্গ সঙ্গীর সহিংসতার ঘটনা ২০২০ এর তুলনায় ২০২১ সালে ২% বাড়ে। অন্যদিকে অন্তরঙ্গ নয় এমন সঙ্গীদের মধ্যে সহিংসতা বাড়ে ৬%। অবশ্য মহামারির আগে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২১ সালে অন্তরঙ্গ সঙ্গীর সহিংসতা ৪% বেশি হলেও অন্তরঙ্গ নয় এমন সঙ্গীদের সহিংসতা ছিল ২% বেশি।
অন্তরঙ্গ সঙ্গীর সহিংসতার ঘটনা ২০২০ এর তুলনায় ২০২১ সালে ২% বাড়ে। অন্যদিকে অন্তরঙ্গ নয় এমন সঙ্গীদের মধ্যে সহিংসতা বাড়ে ৬%। অবশ্য মহামারির আগে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২১ সালে অন্তরঙ্গ সঙ্গীর সহিংসতা ৪% বেশি হলেও অন্তরঙ্গ নয় এমন সঙ্গীদের সহিংসতা ছিল ২% বেশি।
২০০৯ থেকে ২০২১ সময়কালে নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে অন্তরঙ্গ সঙ্গীর সহিংসতা ৩% হ্রাস পেলেও পুরুষ ও ছেলেদের ক্ষেত্রে একই সময়ে তা বেড়ে যায় ৬%। এসময় যেসব প্রদেশে অন্তরঙ্গ সঙ্গীর সহিংসতা সবচেয়ে বেশি বেড়ে যায় তার মধ্যে ছিল নিউ ব্রুনসউইক (+৩৯%) ও কুইবেক (+২৮%); অন্যদিকে সবচেয়ে কমে যায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া (-২৮%) এবং প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডে (-১৯%)।
কানাডীয়দের নিরাপত্তা (ভিকটিমাইজশন) সম্পর্কিত সর্বশেষ প্রকাশিত সাধারণ
সামাজিক জরিপের তথ্য অনুসারে, এসব প্রদেশের ৩.৫% কানাডীয় পূর্ববর্তী পাঁচ বছরে স্বামী বা স্ত্রীর সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যা ২০০৯ সালের ৬.২% শতাংশের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে কম। ওই জরিপে কানাডীয়দের নিজে থেকে রিপোর্ট করা সহিংসতার তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে।
পামেলা ক্রস বলেন, মনে রাখতে হবে, স্ট্যাটক্যান যে তথ্য-উপাত্ত দিয়েছে তার ভিত্তি শুধুই পুলিশের রিপোর্ট। তিনি যোগ করেন, “সহিংসতার শিকার নারীদের মাত্র ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পুলিশে রিপোর্ট করেন।
“সুতরাং, পুলিশে রিপোর্ট হওয়া সহিংসতার পরিমাণ বেশি হলে রিপোর্ট না করা সহিংসতার ঘটনাও বেশি হবে।”
অটোয়ায় কানাডিয়ান সেন্টার ফর উইমেনস এমপাওয়ারমেন্ট (CCFWE) এর নির্বাহী পরিচালক মেসেরেত হেইলেইয়েসাস বলেন, অনেক কারণেই নারীরা নিপীড়নমূলক পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। এর মধ্যে অর্থনৈতিক দিক অন্যতম প্রধান।
তিনি বলেন, “নিপীড়নের সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নারীদের প্রথম প্রয়োজন একটি নিরাপদ জায়গা, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, দেখা যায় এসব নারীর বেশিরভাগেরই সেরকম অর্থনৈতিক সঙ্গতি থাকে না।”
তিনি অর্থনৈতিক সহিংসতাকে “সহিংসতার লুকানো রূপ” বলে অভিহিত করেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, অটোয়ার ৮০% নারী জানিয়েছেন যে, “কোভিড-১৯ শুরুর পর থেকে তাদের বর্তমান অথবা প্রাক্তন সঙ্গী আর্থিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে অধিকতর নিয়ন্ত্রক, কৌশলী ও জবরদস্তিমূলক আচরণ করেছে।” হেইলেইয়েসাস-এর সংস্থার মহামারীর সময় চালানো জরিপে এই তথ্য প্রকাশ পায়।
অর্থনৈতিক পীড়নের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে পরিচালিত CCFWE তাদের গবেষণা জরিপের ভিত্তিতে ১৭ মার্চ কেন্দ্রীয় মহিলা বিষয়ক কমিটিকে একটি সুপারিশমালা পেশ করে।
সুপারিশমালার মধ্যে ছিল, প্রমাণ-নির্ভর, ট্রমা বা মানসিক আঘাতজনিত বিষয়ে অবহিতিমূলক, বেঁচে যাওয়াদের প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষাগত সংস্থান সম্প্রসারণ, সামাজিক পরিষেবা দানকারীদের প্রশিক্ষণ, আশ্রয়কেন্দ্র, পুলিশ, স্বাস্থ্য-প্রযত্ন ও আইনী পরিষেবা; বেঁচে যাওয়াদের জন্য বিনামূল্যে ও সুলভে ঋণ সংস্কার (credit repair) ও ঋণ প্রতিকার পরিষেবা দান এবং অর্থনৈতিক নিপীড়নের শিকারদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে শিশুপ্রযত্ন ব্যবস্থার উন্নয়ন।
হেইলেইয়েসাস বলেন, “আমাদের দরকার সেইসব নারীদের জন্য একটি তহবিল কর্মসূচি যারা নিপীড়নমূলক পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসতে চায়… কিন্তু আমাদের আছে আশ্রয়কেন্দ্র, সমাজ সেবার অধীন সামাজিক সহায়তা কর্মসূচি অথবা হয়তো প্রতিবন্ধিতার সুবিধা, অথচ আমাদের, নারীদের এসবের বাইরেও কিছু দরকার… যেটা হতে পারে স্কলারশিপের তহবিলের মত কিছু।”
হেইলেইয়েসাস ও ক্রস উভয়েই একমত যে, পারিবারিক সহিংসতার যথাযথ সমাধানের জন্য বড় ধরণের পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে এবং সেই পরিবর্তন যথেষ্ট দ্রুত ঘটছে না।
পুলিশে রিপোর্ট হওয়া অন্তরঙ্গ সঙ্গীর যৌন পীড়ন বড় আকারে বেড়েছে
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে বড় বৃদ্ধি ঘটে লেভেল-১ ধরণের পীড়নের হার (ব্যক্তির যৌন অধিকারের সীমা লংঘন) (যা ২০২০ সালের তুলনায় +১৯% বেশি)। অন্যদিকে পুলিশে রিপোর্ট হওয়া সার্বিক সহিংসতার হার বেড়েছে সামান্যই (+৫%)। নির্দিষ্ট করে অন্তরঙ্গ সঙ্গীর হাতে নিপীড়নের ঘটনার ক্ষেত্রেও লেভেল-১ ধরণের নিপীড়নের হারে ২০২০ সালের তুলনায় বড় বৃদ্ধি ঘটে (+২২%)।
অন্তরঙ্গ সঙ্গীর হাতে লেভেল-২ শ্রেণীর যৌন পীড়নও (সশস্ত্র হামলা বা শারীরিক ক্ষতি) ২০২০ এর তুলনায় বেড়ে যায় (+৬%)। একই সময়ে লেভেল-৩ ধরণের যৌন পীড়নের ঘটনা (উত্তেজনার বশে যৌন পীড়ন) কমে (-১২%)।
ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর সহিংসতার শিকার হবার ঘটনাও ২০২১ সালে বেশি ঘটে। যেমন, ২০২০ ও ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২১ সালে অপরাধমূলক হয়রানির ঘটনা ছিল ১০% বেশি, আর অশালীন এবং হয়রানিমূলক যোগাযোগ ২০২০ থেকে বেড়ে যায় ১১% এবং ২০১৯ এর চেয়ে ২৯% বেশি। হুমকি দেয়ার মত ঘটনা ২০২০ এর তুলনায় ২০২১-এ অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল ছিল (-০.৫%) তবে ২০১৯ এর তুলনায় ছিল ৩% বেশি।
২০২১ সালে হত্যার শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে ৯০ জন ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর হাতে নিহত হন। এদের তিন-চতুর্থাংশ (৭৬%) নারী অথবা মেয়ে। ২০২১ সালে ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর হাতে হত্যার ঘটনা ২০২০ (৮৪জন) এবং ২০১৯ সালের (৭৭জন) চেয়ে বেশি।
পামেলা ক্রস বলেন, “লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা জরুরী। অন্তরঙ্গ সঙ্গীর সহিংসতার বিষয়টিকে আমাদের একটি জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা হিসাবে, মহামারি হিসাবে বিবেচনা করা দরকার।”
“পরিবারে যে সহিংসতা ঘটে তার বাস্তবতা সমাজকে উপলব্ধি করতে হবে।”
কানাডায় প্রতি আড়াই দিনে একজন নারী নিহত হয়
উল্লেখ্য যে, কানাডায় গড়ে প্রতি আড়াই দিনে একজন নারী বা মেয়ে নিহত হয়। ইতিপূর্বে নারীহত্যা সম্পর্কিত এক রিপোর্টে এ কথা বলা হয়েছে।
ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি বিষয়ক কানাডার নারীহত্যা পর্যবেক্ষণ সংস্থার (Canadian Femicide Observatory for Justice and Accountability) ২০২০ সালের রিপোর্টে বলা হয়, ওই বছর কানাডায় মোট ১৬০ জন নারী ও মেয়ে হত্যার শিকার হয়েছেন। ওই বছরের এপ্রিল মাস ছিলো নারী ও মেয়েদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ মাস। ওই মাসে মোট ২৬ জন নিহত হয় বলে রিপোর্টে জানানো হয়। সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল সিটিভি নিউজে।
রিপোর্ট সংকলনকারী দলের একজন সদস্য অনুরাধা ডুগাল সিটিভি নিউজ চ্যানেলকে বলেন, “কানাডায় প্রতিবছর সার্বিকভাবে যত নারী বা মেয়ে হত্যার শিকার হয় সেই সংখ্যা গত কয়েক বছরে তেমন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেনি।” তিনি বলেন, “এটি একটি অনঢ় সংখ্যা যাতে আজকের দিনে কানাডাজুড়ে শুধু লিঙ্গের কারণে কীভাবে নারীরা হত্যার শিকার হচ্ছে তারই প্রতিফলন ঘটে।”
#কলইটফেমিসাইড, শিরোনামের ওই রিপোর্টে বলা হয়, হত্যাকারী চিহ্নিত হয়েছে এমন ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে হত্যাকারী ছিলো পুরুষ। হত্যার শিকার নারীদের বয়স বিভিন্ন। তবে নিহতদের অর্ধেকেরও বেশি সংখ্যকের বয়স ২৫ থেকে ৬৪ বছর।
ডুগাল বলেন, “নারী ও মেয়েরা তাদের খুনীদের চেনে। তারা হলো তাদেরই পরিবারের সদস্য, জীবনসঙ্গী, তাদের প্রাক্তন জীবনসঙ্গী।”