অশ্বেতাঙ্গরা বলছেন, দেশে ফেরার সময় কানাডার সীমান্ত রক্ষীরা বৈষম্যমূলক আচরণ করে
সিবিএসএর রিপোর্টে বলা হয়, প্রতি চারজন অফিসারের মধ্যে একজন তার সহকর্মীকে পর্যটকদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করতে দেখেছেন
অশ্বেতাঙ্গ কানাডীয়রা বলেন, তারা সীমান্তে বৈষম্যের শিকার হন এবং তাদের জাতিগত পরিচয়ই এই বৈষম্যের কারণ বলে তারা মনে করেন।
উইনিপেগের বাসিন্দা ৩৩ বছরের এক নারী বলেন, তিনি জাতীয় নিরাপত্তা এবং এ সংক্রান্ত সীমান্ত রক্ষীদের কাজ সম্পর্কে বোঝেন। কিন্তু তার বিশ্বাস, জাতিগত পরিচয়ের কারণেই সীমান্ত রক্ষীদের সঙ্গে তার মোকাবিলাটা নেতিবাচক হয়েছে। সিবিসি ওই নারীর পরিচয় প্রকাশ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
সীমান্তের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ওই নারী বলেন, “এই অভিজ্ঞতা কেবল কারও দেশের সঙ্গে একাত্মতার অভাব বোধই বাড়িয়ে তোলে। আমি একজন কানাডীয় নাগরিক। এখানেই আমার জন্ম হয়।”
“যখনই আমি গাড়িতে শ্বেতাঙ্গ বন্ধুদের নিয়ে সীমান্ত পেরুতে যাই, আমি সব সময়ই স্তম্ভিত হই এটা দেখে যে, ব্যাপারটা কত সহজ হয়ে যায়।”
কানাডা বর্ডার সার্ভিস এজেন্সির (CBSA) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, এক সমীক্ষায়, প্রতি চারজন সীমান্ত রক্ষীর মধ্যে একজন বলেছেন, তারা গত দুই বছরে তাদের অন্তত একজন সহকর্মীকে পর্যটকদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করতে সরাসরি দেখেছেন।
সমীক্ষায় সাক্ষ্য দাতাদের ৭১ শতাংশই মনে করেন, ওই বৈষম্যমূলক আচরণের কারণ আংশিক অথবা পুরোপুরি পর্যটকের জাতিগত পরিচয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর চার ভাগের তিনভাগ জবাবদাতাই (৭৫%) বলেছেন, মূলত পর্যটকের জাতীয়তা অথবা জাতিগত উৎসই এর কারণ।
উইনিপেগের সেই নারী বলেন, তিনি লক্ষ্য করেছেন, যখন একা বা অন্য অশ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে ভ্রমণ করেন তখনই সীমান্ত পেরুনোর প্রক্রিয়াটি শ্বেতাঙ্গ বন্ধুদের সঙ্গে ভ্রমণের সময়ের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন হয়ে যায়।
একটি ঘটনা তার স্মৃতিতে গেঁথে আছে। সেটি হলো, যখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সপ্তাহান্তের সফর শেষে তার মা ও বন্ধুর সঙ্গে কানাডায় ফিরছিলেন। তার মা ক্যারিবীয় অঞ্চল থেকে আসা একজন অভিবাসী এবং বন্ধুটি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।
তিনি বলেন, আমাদেরকে টেনে হিঁচড়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ধরে নেয়া হয় যে, আমরা তাকে (বন্ধুটিকে) পাচার করছি।
তাদেরকে আলাদা করা হয় এবং সীমান্ত রক্ষীরা ওই নারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। রক্ষীরা তার কথা বিশ্বাস করছিল না।
আমি ছিলাম ১৭ বছর বযসী এবং আমার আর বলার কিছু ছিল না, শুধু এইটুকু ছাড়া যে, আমরা একসঙ্গে আছি কারণ সে আমার বন্ধু। সে আমার শহরে আমাকে দেখতে এবং আমার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং দেশে ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়।
পুরনো সেই অভিজ্ঞতা মনে করার সময়ও তিনি ভীষণ রাগান্বিত বোধ করেন। তিনি বলেন, এটি ছিল সীমান্তে তাকে লক্ষ্যবস্তু করার বহু ঘটনার একটিমাত্র।
এখন তিনি সীমান্তে আর তেমন বিড়ম্বিত বোধ করেন না বলে জানান মহিলাটি। তবে এর কারণ সম্ভবত এই যে, সীমান্ত রক্ষীরা তার কাছ থেকে কেমন আচরণ আশা করে সেটি তিনি ধরতে পেরেছেন এবং তিনি ঠিক সেভাবেই আচরণ করেন।
তিনি বলেন, সীমান্ত রক্ষীদের সঙ্গে কথা বলার সময় এখন তার পুরো ভাবভঙ্গিই পাল্টে যায়।
“কেউ যখন আপনাকে প্রশ্ন করে, কেউ আপনাকে এমন বিষয়ে অভিযুক্ত করে যে অভিযোগ ঠিক নয় বলে আপনি জানেন, তখন এমন বোধ করবেন না যে আপনি একজন মানুষ (আপনার রাগান্বিত হওয়ার অধিকার আছে)।
“এমন পরিস্থিতিতে আপনাকে একদম শান্ত থাকতে হবে… এটা এমন যে, অন্য সবারই স্বাভাবিক মানবিক প্রতিক্রিয়া দেখানোর অনুমতি আছে, শুধু আমাদের নেই।”
‘মৌলিক পরিবর্তন’
সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়াটা তার জন্য সব সময়ই প্রচণ্ড উদ্বেগের কারণ হলেও তিনি বিশ্বাস করেন, কানাডীয় বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সি এবং সীমান্ত রক্ষী উভয়েরই উচিৎ অশ্বেতাঙ্গ পর্যটকদের সঙ্গে তাদের আচরণের পুনর্মূল্যায়ন করা।
তার বিশ্বাস, কানাডায় আসা পর্যটকদের পরীক্ষা করার প্রক্রিয়াটি খতিয়ে দেখা এবং তা হালনাগাদ করা দরকার।
“আর লক্ষ্য নির্ধারণ করাই হলো এ কাজের কঠিনতম অংশ, কিন্তু অন্তর্গতভাবে আমি মনে করি, সীমান্তরক্ষী অফিসারদের নিজেদের মধ্যে এবং আমার মত অশ্বেতাঙ্গ লোকদের কী নজরে দেখা হবে সে বিষয়ে মৌলিক পরিবর্তন আনা দরকার।”
২৫ বছর ধরে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করছেন অভিবাসন বিষয়ক আইনজীবী আলেস্টেয়ার ক্লার্ক। তিনি বলেন, রিপোর্টের ফলাফলে তিনি অবাক হননি।
“আমি বলবো, কানাডায় আসা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে যথাযথভাবে পেশাদারী আচরণ করা হয়। অবশ্য এমন ঘটনাও আছে যেখানে অফিসাররা আরও ভালো, আরও সংবেদনশীলতার সঙ্গে আচরণ করতে পারেন।
তিনি বলেন, “তাদেরকে কানাডার সুরক্ষা, বৈধ গবেষণা, বৈধ অনুসন্ধান এবং অন্যদিকে মানুষের সঙ্গে পেশাদার ও সৌজন্যমূলক আচরণের প্রয়োজনীয়তার মধ্যে ভারসাম্য করতে হবে।”
ক্লার্কের প্রতিষ্ঠান ‘ক্লার্ক ল’তে এমন মক্কেলরা আসতেন যাদের সঙ্গে সীমান্তে সম্ভাব্য বর্ণবাদী আচরণের কাহিনী জড়িয়ে আছে। তিনি মক্কেলদের পক্ষে এসব অভিযোগ নিয়ে বিভিন্ন সীমান্ত বন্দরের সুপারন্টেন্ডেন্টদের সঙ্গে এবং সিবিএসএর সঙ্গে দেন-দরবার করতেন। তিনি বলেন, সিবিএসএ এসব অভিযোগ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিতো।
সিবিএসএ হলো কানাডার একমাত্র জননিরাপত্তা সংস্থা, জনগণের অভিযোগ খতিয়ে দেখার মত কোনও স্বাধীন কাঠামো যার নেই। তবে একটি প্রস্তাবিত আইন আনা হয়েছে যার আওতায় পর্যটকদের সীমান্তের অভিজ্ঞতা সম্পর্কিত অভিযোগ সিবিএসএ বরাবর পেশ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বিল সি-২০ নামের ওই প্রস্তাবিত আইন পাশ হলে কানাডার ফেডারেল পুলিশ ও বিসিএসএতে জনগণের অভিযোগ শোনা ও ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একটি স্বতন্ত্র কমিটি গঠন করা হবে। বিলে অভিযোগ দায়েরের জন্য একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সৃষ্টি এবং ছয় মাসের মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, “খোদ ওই বিলেই পদ্ধতিগত বর্ণবাদের উল্লেখ করা হয়েছে, সুতরাং কানাডার বিভিন্ন স্তরের অফিসারদের মধ্যে যে পদ্ধতিগত বর্ণবাদ বিদ্যমান এবং এটি যে নিছক কল্পকাহিনী নয় সেকথা স্বীকার করার জন্য আমি সরকারের প্রতি সাধুবাদ জানাই। এগুলো নেতিবাচক অভিজ্ঞতার মুখে পড়া মানুষের সত্যিকারের কাহিনী। আমি আশা করি, আইনটি পাশ হয়ে নজরদারির কমিটি তৈরি হবে এবং এটি হবে আমাদের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে অধিকতর আস্থা তৈরির অনুকূল সমাধানের অংশ।
শ্রীলঙ্কা থেকে আসা ৫৩ বছর বয়সী একজন কানাডীয় নাগরিক বলেন, সীমান্তে মানুষের সঙ্গে আরও সম্মানজনক আচরণ করা উচিৎ, বুঝতে হবে যে, অনেকেরই ইংরেজিটা প্রথম ভাষা না-ও হতে পারে।
সিবিসি এই শ্রীলঙ্কান নারীর নাম উহ্য রাখতে সম্মত হয় কারণ তার পরিবারের অনেকে প্রায়ই কানাডা সফর করেন এবং ভবিষ্যতে তারা প্রতিহিংসার শিকার হতে পারেন বলে তিনি আশঙ্কা করেন।
তিনি বলেন, তিনি শ্রীলঙ্কা থেকে আসা তার পরিবারের কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানাডায় ফিরছেন। তিনি পর্যটন ভিসায় এক বছর ধরে ইউনিপেগে বসবাস করছেন। তার ভিসা ছয়মাস পর নবায়ন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে তাদের কথাবার্তা শুরু থেকেই ছিল নেতিবাচক।
“তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আপনারা কোথা থেকে?’ আমি বলি, ‘উইনিপেগ।’ তারপর আমরা পাসপোর্ট এগিয়ে দিলে তিনি আমাকে চটকে দিলেন, বললেন, ‘আপনি মিথ্যা বলছেন, আপনি উইনিপেগের মানুষ ঠিক, কিন্তু ওই দুজন উইনিপেগের নন, তারা শ্রীলঙ্কা থেকে আসা।’
আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি যে, আমি তার প্রশ্ন বুঝতে ভুল করেছি। মনে করেছি যে তিনি জানতে চাইছেন, যুক্তরাষ্ট্রে যাবার আগে আমি কোথায় ছিলাম।
“তাই আমি বললাম, ‘স্যার, তারা এখানে এক বছর ধরে বাস করে, তাই আমি আপনাকে বলতে ভুলে গেছি যে, তারা আসলে শ্রীলঙ্কান, আর সেটা তাদের পাসপোর্টে লেখাই আছে।”
পরিবার ভীত হয়ে পড়ে
তিনি বলেন, এসময় তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েন একারণে যে, তিনি ঠিকমত প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি। তার পরিবারের সদস্যরাও ভীত হয়ে পড়েন। তার কানাডায় ঢুকতে পারবে না ভেবে তিনি উদ্বিগ্ন বোধ করতে থাকেন।
শেষ পর্যন্ত তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। তবে তার আগে সীমান্তরক্ষীরা তাকে সতর্ক করে দেয় যে, ভবিষ্যতে সীমান্ত পেরুবার সময় তাকে সত্য কথা বলতে হবে।
তিনি বলেন, “যখন কেউ বলে, আপনি মিথ্যা বলেছেন বা এমন কিছু তখন এটা খুবই কষ্টদায়ক, বিশেষ করে এমন মানুষদের সামনে যখন আপনি উপহাসের, লজ্জার মুখে পড়বেন।”
তিনি বলেন, সীমান্ত রক্ষীদের আচরণে তাদের পুরো সফরটাই বরবাদ হয়ে যায়, উইনিপেগে ফেরার সময়টুকুতে সবাই ছিল মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।
“মনে হয়েছে, আমাদের কোনও অধিকার নেই, আমরা এখনও অভিবাসন নিয়ে শঙ্কিত, এমনকি আমিসহ, যদিও আমি নাগরিকত্ব পেয়েছি।”
“কাগজপত্র বলছে, আপনি এখানকার লোক, কিন্তু যাদের সঙ্গে আপনার কথা হচ্ছে তারা আপনাকে সেটা অনুভব করতে দেবে না।”
সিবিএসএ-র একজন মুখপাত্র এক ই-মেল বার্তায় বলেন, তারা সব ধরণের বর্ণবাদ ও বৈষম্যের কঠোর নিন্দা জানান।
সিবিএসএকে অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক, সম্মানজনক ও বৈচিত্র্যময় করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এসব উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে একটি বর্ণবদবিরোধী কৌশল যাতে বর্ণবাদ ও পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে কোর্স সম্পন্ন করা বাধ্যতামূলক।
মুখপাত্র বলেন, সিবিএসএ দুর্ব্যবহারের প্রতিটি অভিযোগের তদন্ত করবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্তা নেবে। ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে শৃক্ষলাভঙ্গের শাস্তি থেকে অপসারণ পর্যন্ত।
তিনি বলেন, “প্রতিটি ঘটনা ধরে ধরে শৃক্সক্ষলা রক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং অভিযোগ কতটা গুরুতর তার ভিত্তিতে এবং উত্তেজক ও প্রশমনের উপাদানগুলোর বিবেচনায় শৃক্সক্ষলাবিধান করা হয়।
সূত্র : জোয়ান রাবার্টস – সিবিসি নিউজ