টরন্টোবাসী কেন গাড়ি চুরির ‘বিস্ময়কর’ হিড়িকের মুখে – পুলিশ কী করছে
২০২২ সালে গাড়ি চুরির ঘটনা গত বছরের চেয়ে প্রায় ৪৫ শতাংশ বেড়ে গেছে
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : প্যাট্রিসিয়া লি’র বছরটা শুরু হয়েছিল তার টরন্টোর বাড়ি থেকে লেক্সাস এনএক্স ৩০০ গাড়ি চুরি যাবার ঘটনা দিয়ে- কিন্তু সেটি ছিল তার সঙ্কটের সূচনামাত্র।
পাঁচ মাস পর রাতের মধ্যভাগে চোরেরা আবারও ফিরে আসে তার অন্য গাড়ি লেক্সাস আরএক্স ৪৫০ এর লোভে- কিন্তু এবার তাদের ভাগ্য তেমন ভালো ছিল না।
ফেব্রুয়ারিতে প্রথম চুরির ঘটনার পর লি একটি ভিডিও ক্যামেরা বসান যা তার গাড়ি ভাঙার চেষ্টারত তিন ব্যক্তির ফুটেজ ধারণ করে। সিবিসি নিউজকে লি বলেন, “এটা ছিল সত্যিই ভীতিকর, কারণ তারা ছিল খুব কাছে। কে জানে কী ঘটতে পারতো… যদি আমি রাতের বেলা জেগে উঠতাম, আর তাদের দেখে এগিয়ে যেতাম?”
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, এক ব্যক্তি গাড়ির দরজার হাতল ভাঙার চেষ্টা করছে, আর অন্য দুজন সামনের হেডলাইটের ওপর এক ধরণের তোয়ালে বিছিয়ে দেয়। লি বলেন, কয়েক মিনিটের মধ্যে গাড়ির ইঞ্জিন ইমোবিলাইজারের (ভিন্ন চাবি দিয়ে ইঞ্জিন চালু করা প্রতিরোধক যন্ত্র) সাথে যুক্ত অ্যালার্ম বন্ধ হয়ে যায়। ভিডিওতে দেখা যায়, গাড়ির লাইটগুলো জ¦লতে শুরু করলে লোক তিনটি দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
লি বলেন, “ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এ বিষয়ে কিছুই করা হয়নি, কারণ, বহু গাড়ি চুরি হচ্ছে।”
লি হলেন হাজার হাজার টরন্টোবাসীর একজন যারা চলতি বছর গাড়ি চুরি নাটকীয়ভাবে বেড়ে যাবার ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত। গত ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টরন্টো পুলিশের কাছে ৬,৪৯৭ টি গাড়ি চুরির ঘটনা জানানো হয়েছে। ২০২১ সালে গাড়ি চুরির ঘটনা সারা বছরে ছিল ৪,৪৯৮ টি, ফলে দেখা যাচ্ছে, এবার বছরের তিন মাস বাকি থাকতেই তা প্রায় ৪৫ শতাংশ বেড়েছে।
এদিকে, গাড়ি ছিনতাইয়ের ঘটনাও বেড়েছে ২০৯ শতাংশ। ৫৮টি গাড়ি ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭৯টিতে। এগুলোর আলাদা হিসাব রাখা হয় এবং পুলিশের একটি আলাদা টিম গাড়ি ছিনতাইয়ের তদন্ত করে।
সিবিসি নিউজ তদন্ত করে দেখছে, কী কারণে টরন্টোর বাসিন্দারা ক্রমবর্ধমান হারে গাড়ি চুরির শিকার হচ্ছেন এবং বাড়তে থাকা অপরাধের জোয়ার রোধ করতে সামাজিক গ্রুপ, রাজনীতিক ও পুলিশ কী ধরণের প্রয়াস চালাচ্ছে।
সরবরাহ ও চাহিদা
শুধু টরন্টোই নয়- সিবিসি নিউজের সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, ৩১ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিবেশি পিল অঞ্চলে গাড়ি চুরি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৪ শতাংশ বেড়েছে। অটোয়ায় গত বছরের চেয়ে এবছর এখন পর্যন্ত বেড়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ। এদিকে মন্ট্রিলে ২০২১ সালের চেয়ে গাড়ি চুরি বেশি হবার দিকেই যাচ্ছে।
টরন্টোর গাড়ি চুরি প্রসঙ্গে ডেপুটি সার্জেন্ট পিটার ওয়েবি বলেন, “এটা বিস্ময়কর। সংখ্যাটা খুব, খুব বড়।” তিনি নবগঠিত সংগঠিত অপরাধ তদন্ত সহায়তা টিমের সদস্য। এই টিম সেইসব ঘটনা নিয়ে তদন্ত করে যেগুলি তাদের ভাষায় জটিল তদন্ত। এজন্যে টিমটি পুলিশের বিভিন্ন বিভাগ এবং অন্য অঞ্চল, শহর এমনকি ভিন্ন দেশের পুলিশের সঙ্গে লিয়াজোঁর মাধ্যমে কাজ করে।
তিনি বলেন, “গাড়ির চাহিদার ক্ষেত্রে কোনওরকম পরিবর্তন ঘটেছে বলে আমি মনে করি না। আমার মনে হয়, পরিবর্তন ঘটেছে গাড়ির সরবরাহের ক্ষেত্রে।”
ওয়েবি বলেন, ২০২০ ও ২০২১ সালে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে উদ্ভূত সরবরাহ ব্যবস্থার জটিলতায় নতুন গাড়ি এসেছে অনেক কম। সেই সময়ের অর্ডারের গাড়ি এ বছর এসেছে এবং গাড়ি দিয়ে বাজার ভরে গেছে।
তিনি বলেন যে, কিছু গাড়ি অন্য কোনও অপরাধ সংঘটনের কাজে ব্যবহারের জন্য এবং কিছু অভ্যন্তরীণভাবে বিক্রির জন্য চুরি করা হলেও বেশিরভাগ চুরির পেছনে এগুলোই কারণ নয়।
তিনি বলেন, “রফতানির জন্যও গাড়ি চুরি করা হয় এবং তাতে বৃহত্তম মুনাফা হয় বলে আমার ধারনা।”
“আপনার গাড়ি যদি চুরি যায়… আর সেটি যদি হয় চোরদের কাক্সিক্ষত গাড়ি, তাহলে খুব বেশি সম্ভাবনা থাকে যে, চোরেরা সেটি যত দ্রুত সম্ভব বিদেশে পাচার করার চেষ্টা করবে।”
শুধু টরন্টো পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এখন পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে প্রতি ঘণ্টায় একটি গাড়ি চুরি হয়েছে। চুরি যাওয়া এসব গাড়ির দাম কয়েক ’শ মিলিয়ন ডলার।
কাঙ্খিত গাড়ি
টরন্টোর মত শহরগুলিতে শুধু বিলাসবহুল গাড়িই চুরি করা হচ্ছে তা নয়। সম্প্রতি তার গাড়ি চুরির পর সারাহ কঠিন পরিস্থিতিতে এই জ্ঞান অর্জন করেছেন। তিনি তার নামের শেষ অংশ উল্লেখ না করার জন্য সিবিসি নিউজকে অনুরোধ করেন কারণ, চোরেরা আবারও তার গাড়ি চুরির মতলব আঁটতে পারে ভেবে তিনি উদ্বিগ্ন।
২৪ সেপ্টেম্বর সারাহর স্বামী খেয়াল করেন যে, তার বাড়ির একপাশের ড্রাইভওয়ে থেকে তাদের লিজ নেয়া ২০২১ মডেলের হোন্ডা সিআর-ভি গাড়িটি চুরি হয়ে গেছে।
সিবিসি নিউজকে সারাহ বলেন, “আমরা রীতিমত বিস্মিত হয়েছি। কারণ, সাধারণত মনে করা হয় যে, বিলাসবহুল গাড়ি চুরি হয় – মার্সিডিজ ও লেক্সাস এবং এধরণের গাড়ি। হোন্ডা সিআর-ভি চুরির জন্য কাঙ্খিত গাড়ি বলে কেউ ভাবে না।” কিন্তু তিনি বলেন, পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর তিনি আরও বেশি কিছু শিখতে পেরেছেন।
তিনি বলেন, “আমরা পুলিশে রিপোর্ট লিখি। সেদিন পরের দিকে পুলিশের একজন অফিসার বাড়িতে আসেন। তিনি আমাদের জানান যে, গত দুদিনে চুরি হওয়া ছয়টি সিআর-ভির মধ্যে আমাদেরটা একটা। সারাহ আরও বলেন, পুলিশ জানায়, ওই সব সিআর-ভি চুরি গেছে তার মহল্লা থেকেই।
সারাহ চুরি যাওয়া গাড়ির বীমার অর্থ পাবেন কিন্তু গাড়িতে যা কিছু ছিল তা খোয়া গেল। যেমন গাড়িতে বাচ্চাদের বসানোর আসন, তাদের স্ট্রলার এবং দোলনা ইত্যাদি। স্ট্রলার ও দোলনা তার বীমার আওতায় পড়ে না।
গাড়ি চুরি নিয়ে তদন্তকারী সংগঠনগুলো বলছে, বিদেশে চাহিদা থাকায় চুরির লক্ষ্য হয় অনেক গাড়ি।
ইকুইটি অ্যাসোসিয়েশনের তদন্ত বিষয়ক ভাইস-প্রেসিডেন্ট ব্রায়ান গ্যাস্ট বলেন, “সংগঠিত অপরাধী গ্রুপ এবং পেশাদার অপরাধীরা ভিন্ন দেশে চাহিদার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট ধরণের গাড়ি চুরির জন্য টার্গেট করে।
সেজন্যেই দেখা যায়, বিভিন্ন ধরণ, মডেল ও কোম্পানির গাড়ি চুরি হচ্ছে।” ইকুইটি অ্যাসোসিয়েশন বীমাসংশ্লিষ্ট প্রতারণা ও অপরাধ নিয়ে তদন্ত ও বিশ্লেষণ করে।
মি. গ্যাস্ট বলেন, গাড়ি চুরির উচ্চ হারের কারণে সাধারণভাবে কেবল বীমার প্রিমিয়ামের হার বাড়ছে তা-ই নয়, বরং এমন প্রশ্নও উঠছে যে, চুরি যাওয়া গাড়ির বিক্রি থেকে আসরে কারা লাভবান হচ্ছে।
তিনি বলেন, “আমি যেটা মনে করছি তা আরও বেশি উদ্বেগের.. সেটা এই যে, এসব চুরি সংগঠিত অপরাধী চক্রকে অর্থ যোগাচ্ছে।”
সরকারি সহায়তা
সমস্যাটি বহু-কর্তৃপক্ষীয় হওয়ায়, স্থানীয় কিছু রাজনীতিক বলেন, এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় সরকারের পক্ষ থেকে আরও সমর্থন দরকার।
টরন্টোর একজন কাউন্সিলর মাইক কোল বলেন, “এটি নিছক স্থানীয় অপরাধ নয়, এটি আন্তর্জাতিক সংগঠিত অপরাধ, যাতে কোটি কোটি ডলারের লেনদেন রয়েছে এবং গাড়িগুলি মন্ট্রিল, হ্যালিফ্যাক্সের মত বন্দরগুলিতে চলে যাচ্ছে। মি. কোল গত ডিসেম্বরে পার্লামেন্টে একটি বিল পেশ করেন যেটি পাশ হয়। সে আইনে অন্টারিও সরকারকে গাড়ি চুরি বৃদ্ধির মোকাবেলায় একটি টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশনা দেয়।
প্রাদেশিক টাস্কফোর্স প্রতিষ্ঠা করা হয়নি, তবে সিবিসি নিউজের কাছে পাঠানো এক বিবৃতিতে অন্টারিওর আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় বলেছে, কেন্দ্রীয় সরকারে এটি এরই মধ্যে এ বিষয়ে কাজ করছে, যা আগ্নেয়াস্ত্র ও অপরাধ গ্যাংয়ের মোকাবেলায় ২০ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করছে। মন্ত্রণালয় দাবি করে যে, ওই সংস্থার কার্যক্রম অনেক গাড়ি চুরির ঘটনার সঙ্গেও সম্পর্কিত। এতে চুরি যাওয়া গাড়ি চিহ্নিতকরণে সহায়তারর লক্ষ্যে পুলিশ বাহিনীর প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি কেনার জন্য অর্থ বরাদ্দেরও দাবি জানানো হয়।
কেন্দ্রীয় জননিরাপত্তা মন্ত্রী মার্কো মেন্ডিসিনোর মুখপাত্র সিবিসি নিউজকে বলেন, ‘বিপজ্জনক’ এই সমস্যা মাকাবেলার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠনের লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় সর্বস্তরের সরকারি ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে একত্রিত করার কাজ করছে।
প্রেস সেক্রেটারি আন্দ্রে শ্যামপাউক্স বলেন, “গ্রেটার টরন্টো এলাকায় গাড়ি চুরি বেড়ে যাওয়া গভীর উদ্বেগের।”
এদিকে প্যাট্রিসিয়া লি’র প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদী। লি’র যে গাড়িটি চুরির চেষ্টা হয়েছিল সেটি তিনি গত জুলাই মাসে ডিলারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, “ঘটনাটি আমাকে এতটাই ভীত করেছে যে, আমি গাড়িটি আর রাখতে চাইনি।”
– সূত্র : পিটার জিমোনিক/ সিবিসি নিউজ