ধ্বসে পড়ছে হাসপাতালগুলোর জরুরী বিভাগের সেবা কার্যক্রম
নার্সের অভাবে কয়েকটি হাসপাতালে জরুরী বিভাগ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে
জরুরী বিভাগে রোগীদেরকে গড়ে ২০ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে ওয়ার্ডে বেড পেতে
প্রবাসী কণ্ঠ : অন্টারিওতে ভেঙ্গে পড়ছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। প্রধানত নার্স এবং কোথাও কোথাও ডাক্তারের অভাবে সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে হচ্ছে কোন কোন হাসপাতালের জরুরী বিভাগ। ফলে রোগীরা জরুরী স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমনকি ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটেও পর্যাপ্ত নার্স পাওয়া যাচ্ছে না সেবা অব্যাহত রাখার জন্য। ফলে কোন কোন হাসপাতালে বন্ধ রাখা হচ্ছে ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটও। রোগীকে স্থানান্তর করা হচ্ছে অন্য হাসপাতালে।
গত কয়েক সপ্তাহে পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, একে অন্টারিও’র স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে ‘পড়ছে’ না বলে ইতমধ্যেই ভেঙে পড়েছে বলে বিশ^াস করছেন টরন্টোর একটি হাসপাতালের জরুরী বিভাগের ডাক্তার রঘু ভেনুগোপাল। গ্লোবাল নিউজকে তিনি বলেন, ‘অন্টারিও-সহ কানাডার অন্যান্য অঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে জরুরী বিভাগে কর্মরত ডাক্তার ও নার্সরা ব্যাপকভাবে হতাশ হয়ে পড়েছেন এরকম পরিস্থিতির কারণে। রোগীদের জন্য জরুরী বিভাগে অপেক্ষার সময়গুলো অত্যন্ত দীর্ঘ হয়ে উঠেছে। কাজের অস্বাভাবিক চাপে সেবা প্রদানকারী নার্সরা দিশা হারিয়ে ফেলছে।’
গ্লোবাল নিউজ জানায়, কানাডার পশ্চিমের ভ্যাঙ্কুভার থেকে শুরু করে পূবের নিউফাউন্ডল্যান্ড ও ল্যাব্রাডর পর্যন্ত একই অবস্থা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে অনেক হাসপাতালের জরুরী বিভাগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে। আলবার্টায় গত জুন থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ১৯ বার স্বাভাবিক কাজে ব্যাঘাত ঘটেছে জরুরী বিভাগগুলোতে।
তুলনামূলকভাবে ছোট শহরগুলোতে এরকম ঘটনা ঘটছে বেশী। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার মফস্বল শহর ক্লিয়ারওয়াটার এলাকায় অবস্থিত হেলমকেন মেমোরিয়াল হাসপাতালের জরুরী বিভাগ গত ছয় মাসে ২০ বার বন্ধ করে দিতে হয়েছে সাময়িকভাবে। গ্লোবাল নিউজকে এ কথা জানিয়েছেন স্থানীয় মেয়র মারলিন ব্ল্যাকওয়েল।
তবে বড় শহরগুলোর হাসপাতালে কাজের ব্যাঘাত কম হচ্ছে তাও নয়। গত ১৭ জুলাই রবিবার মন্ট্রিয়লের শিশু হাসপাতালে রোগীদের ভিড় অত্যধিক বেড়ে গেলে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয় সাময়িকভাবে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে। তারা নতুন রোগীদের অন্য হাসপাতালে যেতে বলে। ঐ একই সময় ভেঙ্গুভারের চারটি হাসপাতাল জরুরী বিভাগে আসা রোগীদের পার্শ^বর্তী অন্য কোন হাসপাতালে চলে যেতে বলে। এতে করে অনেককেই জরুরী স্বাস্থ্য সেবা নেয়ার জন্য দীর্ঘ সড়ক পথ অতিক্রম করতে হয়।
কেন সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে হাসপাতালের জরুরী বিভাগগুলো?
কানাডিয়ান মেডিকেল এসোসিয়েশন এর সভাপতি ডাক্তার ক্যাথারিন স্মার্ট গ্লোবাল নিউজকে বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হলো, কানাডা জুড়ে এখন চলছে স্বাস্থ্যকর্মীদের অভাব, বিশেষ করে নার্সের অভাব।’
তিনি আরো বলেন, ‘সাধারণত গ্রীষ্মকালে হাসপাতালে রোগীর ভীড় কম দেখা যায়। কিন্তু এখন জরুরী বিভাগে রোগীর ভীড় অনেক বেশী দেখা যাচ্ছে যা শীতকালে ঘটে থাকে। বিষয়টি অস্বাভাবিক। আর এই রোগীদের অনেকেই মহামারীকালে ডাক্তারের কাছে যাননি বা কম গিয়েছেন। এখন তারা আগের তুলনায় বেশী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বা তাদের আরও বেশী যত্নের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশী অস্বাভাকি বিষয় হলো হাসপাতালের জরুরী বিভাগ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া।’
ডাক্তার ক্যাথারিন স্মার্টের মতে আমরা বর্তমানে যা দেখছি তা অভূপূর্ব এবং এই পরিস্থিতির মাত্রা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যা বিগত বছরগুলোতে দেখা যায়নি।
ডাক্তার মেলানিয়া বেচার্ড কাজ করেন পূর্ব অন্টারিও’র একটি শিশু হাসপাতালের জরুরী বিভাগে। গ্লোবাল নিউজকে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে জরুরী বিভাগের কর্মী হিসাবে আমরা আমাদের কাজটিকে এমন ভাবে দেখি যে তা রোগীদের জন্য সপ্তাহে ৭ দিন ২৪ ঘন্টা খোলা। যে কোন পরিস্থিতিতে এবং যে কোন সময়ে। কিন্তু আমরা দেখছি যে, সেই প্রতিশ্রুতি আমরা এখন আর রক্ষা করতে পারছি না। ’
তিনি আরো বলেন, ‘মফস্বল বা গ্রামীন জনপদে হাসপাতালগুলোর জরুরী বিভাগ বন্ধ করে দেয়ার চিন্তাটা খুবই ভীতি-উৎপাদক। কারণ সেখানে বিকল্প ব্যবস্থার সুযোগ খুবই কম। আমি সত্যিই মনে করি এই বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের এবং জনগণের দৃষ্টিতে পড়া উচিৎ। এই জরুরী বিভাগগুলোকে উচ্চমানের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হলে তাদের জন্য সত্যিকার অর্থে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতার সংস্থান করতে হবে।’
এদিকে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে রোগী বেড়ে যাওয়ার পিছনে কভিড-১৯ এর সপ্তম ঢেউকে দায়ী করছেন টরন্টোর একটি হাসপাতালের জরুরী বিভাগে কর্মরত ডাক্তার কাসিফ পীরজাদা। গ্লোবাল নিউজকে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিধি থেকে সরকার এবং জনগণ পিছিয়ে আসায়, বিশেষ করে জনসমাগমে মাস্ক ব্যবহার না করা এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় না রাখায় সংক্রমণ আবার বাড়ছে এবং তার চাপ পড়ছে হাসপাতালের জরুরী বিভাগগুলোতে। অন্যদিকে গত দুই-আড়াই বছরের মাহামারীকালে আমরা দেখেছি অনেক স্বাস্থ্যকর্মী মানসিক ও শারীরিকভাবে সম্পূর্ণভাবে ক্লান্ত বা অবসন্ন হয়ে পড়েছেন অত্যধিক চাপের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে। এ কারণে অনেক স্বাস্থ্যকর্মী পেশা ছেড়ে দিয়েছেন যা বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টির পিছনে কাজ করছে।’
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন আগামী শরৎ ও শীতে কানাডায় কভিড-১৯ পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। কারণ লোকজন তখন বাইরের খোলা পরিবেশে কম যাবে। ঘরে বা বদ্ধ পরিবেশে মেলামেশা বাড়বে। স্কুলগুলোও খুলে যাবে। সুতরাং এখনই যদি জরুরী কোন পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তবে সামনে আরো খারাপ দিন অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। ডাক্তার কাসিফ পীরজাদা বলেন, ‘আমরা বর্তমানে যে চাপ মোকাবেলা করছি সেটা যে কোনভাবেই হোক মোকাবেলা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সঠিক নেতৃত্ব জরুরী। নয়তো আগামীতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।’
‘চিকিৎসরা চান নীতিনির্ধারকরা জরুরী ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নিক সাহায্য-সহযোগিতার সংস্থান করার জন্য। আর তা শুধু হাসপাতালের জরুরী বিভাগের জন্য নয়, অন্যান্য ক্ষেত্র যেমন লং-টার্ম কেয়ার হোম এবং প্রাইমারী কেয়ার প্রভৃতি সেবামূলক কার্যক্রমের দিকেও নজর দিতে হবে। এতে করে লোকজন তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার অনেককিছু সেখানেই পাবে। খুব বেশী প্রয়োজন না হলে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে দৌড়াতে হবে না।’ এই অভিমত ব্যক্ত করেন ডাক্তার ক্যাথারিন স্মার্ট। তিনি আরো বলেন, স্বাস্থ্য সেবা যে সংকটের মধ্যে রয়েছে তাও স্বীকার করতে হবে এবং সরকারকে এই মুহুর্তেই বিবেচনা করতে হবে এই বিষয়টি খুবই জরুরী।
ডাক্তার রঘু ভানুগোপাল গ্লোবাল নিউজকে বলেন, ‘রোগীরা হাসপাতালের জরুরী বিভাগে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করছেন নানারকম অসুস্থতা ও ব্যথা-বেদনা নিয়ে তা আমি অনুভব করি। কিন্তু সাথে আমি হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রচন্ড চাপটাও অনুভব করি। তাদের অনেকেই প্রচন্ড চাপে পড়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে। এমনকি অনেকে নির্যাতনেরও শিকার হচ্ছেন রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে। কেউ কেউ আবার জাতিগত অপবাদ এবং যৌন হয়রানিমূলক আচরণেরও শিকার হচ্ছে। এটি সত্যিই একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি। নীতি নির্ধারক ও রাজনৈতিক নেতাদের উচিৎ এর বিরুদ্ধে কিছু একটা করা।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, এদিকে হাসপাতালের জরুরী বিভাগগুলোতে স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব তীব্র হয়ে উঠেছে আর অন্যদিকে হাজার হাজার নার্স বেকার বসে আছে। ফেয়ারনেস কমিশন এর অতি সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, অন্টারিওতে বর্তমানে প্রায় ২৬ হাজার নার্স রয়েছে যারা অন্যদেশ থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত। এদের মধ্যে ১৪ হাজার নার্স এখানে নিবন্ধিত। বাকিরা এখনো নয়। এদেরকে আত্মীকরণে রয়েছে নানান জটিলতা ও বাধা।
এদিকে গত ২৮ জুলাই সিটিভি নিউজের এক খবরে বলা হয় টরন্টোর পূবে অশোয়ার পরে বোমেনভিলের হাসপাতালে ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিট সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয় হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবে। এছাড়াও অন্টারিওতে আরো ডজন খানেকের বেশী হাসপাতালে বেডের সংখ্যা কমিয়ে আনা হচ্ছে একই কারণে।
অন্টারিও নার্স এসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট ক্যাথরিন হোয় সিটিভি নিউজকে বলেন, ‘লং উইকএন্ডে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে সবসময়ই রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ফলে আসছে লং উইকএন্ডগুলোতে আমরা দেখবো আরো বেশী স্বাস্থ্যকর্মীর সংকট এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর আরো প্রচন্ড চাপ।’
ক্যাথরিনও উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন নার্স সংকটকে। এবং তিনি বলেন ‘এটি একটি বিরাট আকারের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমানে’।
বোমেনভিলের স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সিটিভি নিউজকে জানিয়েছে বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদেরকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে হাসপাতালের ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিট সাময়িকভাবে বন্ধ করার ব্যাপারে। তারা ইনটেন্সিভ কেয়ারের রোগিদেরকে কাছাকাছি এজাক্স, পিকারিং এবং অশোয়ার হাসপাতালগুলোতে পাঠিয়ে দিবে।
অন্টারিও নার্স এসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট ক্যাথরিন বলেন, ‘স্বাস্থ্যকর্মীদের অনেকেই নিজ পেশা ছেড়ে চলে যাওয়াতে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নার্সের পেশা ছেড়ে কেউ কেউ পিজ্জার দোকানে বা কস্টকো সুপার মার্কেটে কাজ নিয়েছে। এই নার্সদের কারো কারো রয়েছে দুই তিন দশকের কর্ম অভিজ্ঞতা।’
স্যাটিসটিকস কানাডার অতি সাম্প্রতিক এক রিপোর্টেও নার্সদের নিজ পেশা ছেড়ে চলে যাওয়ার এক গুরুতর চিত্র ফুটে উঠে। ঐ রিপোর্টে বলা হয় প্রতি চারজনের মধ্যে একজন নার্স আগামী তিনবছরের মধ্যে নিজ পেশা ছেড়ে দিবেন।
হাসপাতালগুলোর বর্তমান অবস্থার বিষয়ে অন্টারিও’র স্বাস্থ্য মন্ত্রী সিলভিয়া জোন্স এর এক সাক্ষাৎকার নিতে চাইলে তাঁর অফিসের এক মুখপাত্র সিটিভি নিউজকে জানান মন্ত্রী এখন ব্যস্ত। তবে সাক্ষাৎকারের বদলে মন্ত্রীর অফিস থেকে একটি বিবৃতি পাঠানো হয় যেখানে বলা হয়, ‘ বিশ^জুড়ে অন্যান্য অনেক এলাকার মত অন্টারিও প্রভিন্সও হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মীর ধরে রাখার জন্য চ্যালেঞ্জের মুখমুখি হয়েছে এবং এর জন্য চাপের মধ্যে রয়েছে।’
নার্স এসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট ক্যাথরিন বলেন, ‘অনেক দেরী হয়ে গেছে সমস্যাটি দ্রুত সামধান করার জন্য। আর বিল-১২৪ এর পর থেকেই আদতে শুরু হয় সংকটটি।’
ঐ বিলে বলা হয় অন্টারিওতে নার্সসহ অন্যান্য সরকারী কর্মচারীদের বেতন বছরে ১% এর বেশী বাড়ানো যাবে না। ক্যাথরিনের মতে, এই আইনটি বাতিল করাই নার্সদেরকে কর্মক্ষেত্রে ধরে রাখার একমাত্র পথ এখন।
উল্লেখ্য যে, অন্টারিও’র যে কোন হাসপাতালের জরুরী বিভাগে গিয়ে ডাক্তারের
দেখা পাওয়ার জন্য যে পরিমান সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয় তা নিয়ে প্রতিটি রোগীরই অভিযোগ রয়েছে। তিন থেকে চার, পাঁচ বা ছয় ঘন্টাও লেগে যায় ডাক্তারের দেখা পেতে। কখানো কখনো আরো বেশী সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়। মাহামারী শুরু হওয়ার বহু আগে থেকেই জরুরী বিভাগগুলোতে এই অবস্থা বিরাজ করছে। এখন পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে আরো বেশী।
অন্টারিও হেলথ এর সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় গত মে মাসে জরুরী বিভাগগুলোতে রোগীদেরকে গড়ে বিশ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে কোন ওয়ার্ডে বেড পাওয়ার আগে। এই অপেক্ষার সময় অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে অন্টারিতে।
জরুরী বিভাগগুলোর এই করুণ অবস্থা সৃষ্টির পিছনে রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকাও রয়েছে যথেষ্ট। ন্যাশনাল পোস্ট পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গত তিরিশ বছর ধরে অন্টরিওতে যে দলগুলো ক্ষমতায় এসেছে তারা স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করেছে সবসময়। রোগীদের সেবার বিষয়টি প্রাধান্য পায়নি তাদের কাছে। অতীতে নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা বব রে যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন তিনি মনে করেছিলেন অন্টারিতে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক ডাক্তার রয়েছে। তখন তিনি মেডিক্যাল স্কুলের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন যা পরবর্তীতে ডাক্তার স্বল্পতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারপর ক্ষমতায় আসেন প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির মাইক হ্যারিস। তিনি অন্টারিওর হাসপাতালগুলোতে বেডের সংখ্যা এবং নার্সের সংখ্যা কমিয়ে দেন। এরপর লিবারেল ক্ষমতায় এসে হাসপাতালের বাজেট হ্রাস করে।’
এভাবে রাজনৈতিক নেতারা হাসপাতালের উপর চালায় তাদের অপরিকল্পিত নিয়ন্ত্রণ যা পরবর্তীতে কোন সুফল বয়ে আনেনি অন্টারিও’র স্বাস্থ্য সেবা খাতে। বরং পরিস্থিতি দিনের পর দিন খারাপের দিকে গেছে। মহামারীর সময়টাতে তা আরো প্রকট হয়ে উঠে। অন্টারিও এর সঙ্গে পেরে উঠেনি। লং-টার্ম কেয়ার হোমগুলোতে প্রচুর সংখ্যক বয়স্ক লোক মৃত্যুবরণ করে কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে। কারণ অন্টারিওর হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা সিস্টেমে মহামারী মোকাবেলায় কোন সামর্থ্য ছিল না। অন্টারিওসহ কানাডার অন্য কোন প্রভিন্সে কভিড-১০ এর ভ্যাকসিন উৎপাদনের কোন সুযোগ ছিল না। ফলে কভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে অন্য দেশের উপর।
এদিকে জরুরী বিভাগের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ফ্যামিলি ডাক্তারদেরকেও দুষছেন কেউ কেউ। তাদের অভিযোগ, মাহামারী শুরু হওয়ার পর অন্টারিওতে অধিকাংশ ফ্যামিলি ডাক্তারই ইনপার্সন রোগী দেখছেন না। টেলিফোনে বা ভিডিও কলে কাজ সারছেন। খুব প্রয়োজন মনে না করলে তারা রোগীকে চেম্বারে ডাকছেন না। এই পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে অনেকেই হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ছুটছেন। জরুরী বিভাগে ভিড় হওয়ার এটিও একটি কারণ। তবে অন্টারিও কলেজ অফ ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানস এর সভাপতি ডাক্তার লিজ মুগাহ সিবিসি নিউজকে বলেন অন্য কথা। তার মতে ইনপারসন দেখতে না চাওয়ার তুলনায় হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ভিড় হওয়ার পিছনে বেশী ভূমিকা রাখছে অন্টরিওতে ফ্যামিলি ডাক্তারের স্বল্পতা। তিনি অবশ্য একথাও বলেন যে, সময়মত ফ্যামিলি ডাক্তারের কাছে এপয়েন্টমেন্ট না পাওয়াটা এক সমস্যাই বটে। তবে সিংহভাগ ফ্যামিলি ডাক্তারই এখন ইনপার্সন রোগী দেখছেন।
সিবিসি নিউজে প্রকাশিত অন্টারিও কলেজ অফ ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানস এর এক সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে একাধিক কারণে ফ্যামিলি ডাক্তারদের উপরও কাজের চাপ অনেক বেড়ে গেছে এই মহামারীর সময়ে। কারণগুলো হলো :
– ফ্যামিলি ডাক্তরগণ লক্ষ করেছেন তাদের রোগীদের মধ্যে কারো কারো অসুস্থতার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ, মহামারীর সময় অনেকে ডাক্তারের কাছে যাননি সংক্রমণের ভয়ে।
– অন্টারিওতে নতুন করে কভিড-১৯ এর ঢেউ শুরু হয়েছে এবং শ^াসযন্ত্রের অসুস্থতা বৃদ্ধি পেয়েছে যা আগে মাস্ক ব্যবহার করার কারণে নিয়ন্ত্রণে ছিল।
– ফ্যামিলি ডাক্তারগণও নার্স ও অফিস সহকারী স্বল্পতার সমস্যায় ভুগছেন যা স্বাস্থ্যখাতের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোতেও দেখা দিয়েছে।
বাস্তবতা হলো, পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখন প্রচন্ড চাপের মধ্যে রয়েছে। ফ্যামিলি ডাক্তারগণ তার বাইরে নয়।
উল্লেখ্য যে, কানাডার অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশী অবদান রাখে অন্টারিওর অধিবাসীরা। কিন্তু অন্টারিও’র ফিনান্সিয়াল একাউন্টিবিলিটি অফিস গত এপ্রিলে তাদের এক রিপোর্টে জানায়, মহামারীর প্রথম বছরে কানাডার অন্যান্য প্রভিন্সের তুলনায় অন্টারিওতে সবচেয়ে কম অর্থ ব্যয় করা হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। সেই রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয় যে, অন্টারিওতে স্বাস্থ্যখাতে মাথাপিছু ব্যয় অন্যান্য প্রভিন্সের তুলনায় সর্বনিন্ম পর্যায়ে রয়েছে গত ২০০৮ সাল থেকেই।