অথঃ বিদেশ সমাচার
জসিম মল্লিক
বিদেশ জীবনটা কেমন? বিদেশে আমরা কেমন আছি? যারা দেশে থাকেন তাদের বিদেশ সম্পর্কে অনেক কৌতুহল আছে। বলে রাখি বিদেশে বেড়াতে যাওয়া আর স্থায়ীভাবে থাকা সম্পূর্ণ আলাদা। কানাডা আসার আগেও আমি বেশ কয়েকবার বিদেশে গিয়েছি। প্রথমবার যখন আমেরিকা বা ইংল্যান্ডে যাই তখন মনে হয়েছিল এরচেয়ে সুখ আর নাই। কি চমৎকার ঝকঝকে রাস্তাঘাট, বড় বড় হাইওয়ে, হাজার হাজার গাড়ি, বড় বড় বিল্ডিং, ফাষ্টফুডের দোকানে বড় বড় বার্গার, একজনে খেয়ে শেষ করা যায় না। রেষ্টুরেন্টে খাবার অর্ডার দিলে প্লেট উপচে খাবার আসে। কফির সাইজ দেখে মাথা নষ্ট হয়ে যায়। ম্যাকডোনালসে একবার পে করে বারবার রিফিল করা যায় কোক, স্প্রাইট, ফান্টা। দোকানপাটে থরে থরে জিনিস সাজানো। রাস্তায় সবাই নিয়ম মানে, কোনো ট্রাফিক পুলিশ নাই, দুই চার টাকা ঘুষ খাওয়া নাই, দোকানপাটে সবাই লাইন দিয়ে কেনা কাটা করে, আজব সব কান্ড! সবকিছু নিয়মে বন্দী। সুন্দর সুন্দর নারী পুরুষ খিল খিল করে হাসতে হাসতে রাস্তা দিয়ে যায়। বাসে, সাবওয়েতে বই পড়ে, কানে ওয়াকম্যান লাগিয়ে মাথা দুলিয়ে গান শোনে, নাভীর নিচে জীন্স পড়ে, প্রেমিক প্রেমিকারা পরষ্পরকে আলিঙ্গন করে, চুমু খায়। বুকের মধ্যে হু হু করে উঠে আমার। আহা কত সুখী এরা! সব আছে এদের। কি নাই এই হতাশায় অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে। এসব দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম আমিও বিদেশে যাব।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। ২০০৩ সালে ইমিগ্রেশন নিয়ে স্থায়ীভাবে কানাডা চলে আসলাম। এর আগে ২০০০ সালে একবার আমেরিকা এসেছিলাম বেড়াতে। তখন আমেরিকা অংশ থেকে নায়াগ্রা ফলস এসেছিলাম। ওপারেই কানাডা। তখনই মনটা হু হু করে উঠেছিল। নিজেকে বলে রেখেছিলাম একদিন আমি ঠিক ঠিক ওপার থেকেও নায়াগ্রা ফলস দেখব। যদিও কানাডা সম্পর্কে আগে থেকে কিছুই জানতাম না। কোনো গবেষনাও করিনি। আমেরিকার উপরে অনেক বই পড়েছি। ভ্রমন কাহিনী পড়েছি। কিন্তু কানাডা সম্পর্কে ছিলাম অজ্ঞ। শুধু জানতাম কানাডা ঠান্ডার দেশ, আট মাস ঠান্ডা থাকে, হাঁটু সমান বরফ পড়ে। তবে খুবই শান্তির দেশ, মানবাধিকার আছে, চিকিৎসা পদ্ধতি ভাল, পড়াশুনাও বিশ্বমানের এবং টাকার ছড়াছড়ি। একবার পা রাখতে পারলে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাব। পায়ের উপর পা ফেলে খাব। ঢাকার ইমিগ্রেশন এজন্সিগুলো তেমন ধারানাই দিয়ে থাকে অবশ্য।
কানাডা এসে বুঝলাম আমি যা ভেবেছি মোটেও তা না। জীবন এতো সহজ না। প্রতিমুহূর্তে রয়েছে লড়াই। অনন্ত লড়াই। সবাই ছুটছে। কাজ, কাজ আর কাজ। কাজ ছাড়া কোনো গতি নাই। স্বাচ্ছন্দ নাই, সমাজে মূল্য নাই। কাজ ছাড়া কোনো ভবিষ্যত নাই। বিশেষকরে যারা ফ্যামিলি নিয়ে আসে তাদের জন্য বিদেশ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জটা নিলাম আমি। আমার সারা জীবনই একটা চ্যালেঞ্জ। বরিশাল থেকে ঢাকা আসা, ঢাকা থেকে টরন্টো। সবটাই এক লড়াই। টিকে থাকার লড়াই।
বিদেশে যারা থাকে তারা সবই করে। চাকরি করে, ঘরের কাজ করে, লন্ড্রি করে, বাজার করে, কাপড় ইস্ত্রি করে, বিউটি পার্লারে যায়, রান্না করে, দাওয়াত দিয়ে খাওয়ায়, অনুষ্ঠানাদি করে, কবিতা লেখে, উপন্যাস লেখে, নাচ করে, গান করে, শহিদ মিনারে ফুল দেয়, ঘটা করে বিয়ের অনুঠান করে, রোজা রাখে, তারাবি পড়ে, পূজো মন্ডপে পূজো করে, ঈদের জামাত হয়, ইফতার পার্টি করে, বেড়াতে যায়, টিভি করে, পত্রিকা প্রকাশ করে।
দেশ থেকে মেহমানরা আসলে তাদের নিয়ে ঘোরে, দাওয়াত খাওয়ায়, গিফট দেয়। দেশে যখন যায় তখন উইথাউট পে ছুটি নেয়, বাক্সভরে আত্মীয় স্বজনের জন্য গিফট নিয়ে যায়। আত্মীয় স্বজনের দাবী একটাই বিদেশ থেকে কি নিয়ে আসল। তারা ব্যাক্তির দিকে তাকায় না, বাক্সের দিকে তাকায়। কিন্তু যতই আপনি করেন না কেনো কাউকেই খুশী করতে পারবেন না। আপনার প্রতি কারো কোনো মমতা নাই। মানুষকে খুশী করা অনেক কঠিন কাজ। মনে করে বিদেশে যারা থাকে তাদেরই দ্বায়িত্ব দেওয়ার। এটাই যেনো নিয়ম। অবশেষে খালি বাক্স আর বিষন্ন মন নিয়ে ফেরত আসবেন। বছর ঘুরলেই আবার দেশে যাওয়ার জন্য মন আনচান করবে আপনার। আমার ক্ষেত্রে তাই হয়। যারা একদমই দেশে যায় না তারাই প্রকৃতপক্ষে সুখী।
প্রসঙ্গ ফরেন স্টুডেন্টঃ
যারা বিদেশে পড়তে আসে তাদের কথা একটু বলি। কানাডায় যারা পড়তে আসে তাদের অবস্থা বেশ কঠিন। যাদের কেউ নেই তারা শুরুতে একটা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে। একটা নতুন দেশে খাপ খাইয়ে নেওয়াটা বিরাট বড় চ্যালেঞ্জ। নতুন ভাষা, নতুন কালচার, নতুন একসেন্ট, নতুন সিস্টেম। আঠারো উনিশ বছরের একটা ছেলে বা মেয়ে যে কিনা বাবা মায়ের আদরে ছিল, কিছুই করেনি ঘরে, বাস্তবতা সম্পর্কে কোনো ধারানাই নাই তারা একটা অথৈ সুমদ্রে পড়ে। যাদের কেউ নাই তাদের ডর্মে বা বাসা ভাড়া করে থাকতে হয়। আগে থেকেই বাসা ভাড়া করে আসতে হয়। তাঁকে পড়াশুনা ও ক্লাস করার পাশাপাশি বাজার করতে হয়, রান্না করতে হয়, কাপড় লন্ড্রি করতে হয়। ঘর ক্লিন করা, বাথরুম ক্লিন করা, হাড়ি পাতিল ধোওয়া থেকে ঘাস কাটা সবই করতে হয়। বাবা মায়ের কাছে যখন ছিল ছুটির দিনে দুপুর বারোটায় ঘুমে থেকে উঠেছে, সারা রাত জেগে মুভি দেখেছে। বিদেশে সেটা সম্ভব হয় না।
যারা কানাডায় জন্ম নেয় বা বড় হয় তারা বাস্তবতা শিখে ফেলে ছোট থাকতেই। স্কুল থেকে শেখানো হয়। আমার ছেলে মেয়ে হাই স্কুলে থাকতেই কাজ শুরু করে। কাজ করাটা এদেশে এডুকেশনের পার্ট। নিজেদের খরচ নিজেরাই চালাত ওরা। তখন থেকেই ওরা নিজেদের মতো চলতে শিখে ফেলেছে। অর্ক অরিত্রি দুজনই ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর সেন্ট জর্জ ক্যাম্পাসে পড়ত। পুরো শিক্ষা জীবনই তারা জব করেছে, একদিনও বিরতি দেয়নি, আমার উপর চাপ তৈরি করেনি। আমিও ওদের স্বাধীনতা দিয়েছি। ওদের জন্য সব করেছি আবার বাস্তবতাও শিখিয়েছি। অর্ক বা অরিত্রি যখন স্কুলে পড়ত, বরফের মধ্যে কোনোদিন বলেনি বাবা, গাড়িতে স্কুলে নামিয়ে দাও। হেঁটে স্কুলে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করেই যে যার মতো ফুলটাইম চাকরিতে ঢুকে পড়েছে। এখন তারা নিজেদের সংসার করছে, গাড়ি বাড়ি করেছে, ক্যারিয়ার করছে।
কিন্তু যারা বাইরে থেকে পড়তে আসে তাদের লড়াইটা ভিন্ন। তাদের অবস্থা আমি অনুধাবন করি। তাদের অনেকের সাথেই আমার কথা হয়। বিশেষকরে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা এখানে এসে অমানবিক কষ্ট করে। দিনের পর দিন রেষ্টুরেন্টের খাবার খায়, কালে ভদ্রে ঘরে রান্না করার সুযোগ পায়। একটা আইটেম দিয়ে চালিয়ে দেয়। কাপড় লন্ড্রি করার সময় পর্যন্ত পায় না, সাজ সজ্জা করার সময় নাই, ওয়াশরুমে এক ঘন্টা পার করার সময় নাই। মেস করে যারা থাকে তাদের ওয়াশরুমের টাইম রেশন করা থাকে, লিপস্টিক মাখার সময় নাই, হেয়ার ড্রায়ার করার সময় নাই, রুপচর্চা করার সময় নাই। অড জব করে চলতে হয়, রাত দুইটায় কাজ শেষে ঘরে ফিরতে হয় বাসে। যাদের গাড়ি আছে তাদের ইন্সুরেন্স দিতে হয়, ফোনের বিল দিতে হয়। ওদের কষ্ট দেখে আমার চোখে পানি এসে যায়। তারপর একদিন তারা প্রতিষ্ঠিত হয়। কষ্টের অবসান ঘটে।
আমি আর জেসমিন আজও লড়াই করছি। জেসমিন এমনই একটা মেয়ে যার কোনো কিছু নিয়ে কোনো অভিযোগ নাই, বিরাট চাহিদা নাই। সে যথেষ্ট সচ্ছল পরিবারের সন্তান হয়েও আমার সাথে জড়িয়ে এক অনন্ত লড়াইয়ে অবতীর্ন হয়েছে। দেশে যেমন তেমনি বিদেশে এসেও সে লড়াই থামেনি। আমরা শূন্য থেকে সংসার শুরু করেছিলাম। আমাদের জন্য কেউ কিছু করে দেয়নি। তারপর থেকে এতোদূর পথ পারি দিয়েছি। জেসমিন পাশে ছিল বলেই আমি টিকে গেছি, লেখালেখিটা নির্বিঘ্নে করতে পারছি। ঘুরে বেড়াতে পারছি, দেশ বিদেশে যেতে পারছি। সে কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। কোনোদিন টাকা পয়সা নিয়ে কথা বলেনি। এমনকি আমাদের জয়েন্ট একাউন্ট হলেও সে ব্যাংকের হিসাব রাখে না। ব্যালেন্স শীট দেখে না। যদি দেখত তাহলে আমি এতো অপচয় করতে পারতাম না, সাহায্য করতে পারতাম না। গাড়ি, বাড়ি, সম্পদ নিয়ে সে কখনও মাথা ঘামায়নি। তার মধ্যে কখনও কোনো অহংকার দেখিনি।
আমরা দুজনেই মানুষের জন্য করার চেষ্টা করি। অপেক্ষাকৃত কম ভাগ্যবানদের জন্য করি। আত্মীয়দের জন্য করি। বিনিময়ে কারো কাছে কিছু চাই না। আমরা যাই করি মানবিক কারনে করি, দ্বায়িত্ববোধ আর এক ধরণের মাইন্ড সেট থেকে করি। আমাদের কারো কাছে কোনো অবলিগেশন নাই। কারো কাছে মাথা নত করে চলি না আমরা। টাকা দিয়ে আমাদের কেনা যায় না। মানবিক হওয়াই বড় ধর্ম বলে মনে করি। আমার সন্তানদের আমি তাই শিখিয়েছি। মানবিক হতে শিখিয়েছি।
ভালবাসার রয়েছে অপরিসীম শক্তি
আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন থেকেই গল্প, উপন্যাস পড়তে শুরু করি। ক্লাস সেভেন থেকে যাত্রা শুরু। পাঠ্য বইয়ের চেয়েও গল্প উপন্যাস পড়া আমার কাছে আরাধ্য ছিল। পাঠ্য পুস্তক হচ্ছে চরম বাস্তবতা, কষ্টকর এবং প্রচুর মাথা খাটাতে হয়। আর গল্প উপন্যাস হচ্ছে একটা ইলিউশন, একটা কল্পনার জগত। বোঝার জন্য তেমন মাথা ঘামাতে হয় না। প্রচুর মেধার দরকার হয় না। এই কল্পনার জগতটাই আমার প্রিয় হয়ে উঠে। কল্পনার জগতে ডুব দিয়ে থাকতে ভাল লাগত। কলেজে উঠে আমি আরো বেশি বই পোকা হয়ে উঠি। ক্লাসের পড়া আমার কাছে অসহ্য লাগত। মনে হতো এরচেয়ে জঘন্য আর কোনো কাজ নাই। পাঠ্য বইয়ের তলায় থাকত গল্পের বই। সব ধরণের বই পড়তাম আমি। এমনও হয়েছে একদিনে দুইটা উপন্যাস পড়ে শেষ করেছি। ক্লাসের দুই তিন জন বন্ধু ছিল ওদের সাথে
প্রতিযোগিতা করতাম কে কত দ্রুত পড়তে পারে, কে কত বেশি বই পড়তে পারে। ধার নিয়ে বই পড়তাম। লাইব্রেরি থেকেও আনতাম। কখনও কিনে পড়িনি। কেনার পয়সাও ছিল না। পয়সা দিয়ে শুধু বিচিত্রা, চিত্রালী, পূর্বানী এসব কিনতাম। ছাত্র হিসাবে মাথা ভরা ছিল গোবর। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও মন দিয়ে লেখাপড়া করিনি। ক্লাসও করতাম না ঠিকমতো।
কিন্তু অবাক কান্ড আমার ছেলে মেয়েরা আমার মতো হয়নি। ওরা প্রচন্ড মেধাবী হয়েছে। অর্ক তো রীতিমতো এনসাইক্লোপেডিয়া। যা পড়ে সব মনে থাকে। সব বিষয়ে ইন্টারেষ্ট। ওরা পড়াশুনার জন্য যে সুযোগ সুবিধা পেয়েছে আমি তার কিছুই পাইনি। অর্কর কখনও টিউটর লাগেনি। আমার খরচ বেঁচে গেছিল। আর অরিত্রির কোনো সমস্যা হলে অর্কর হেল্প পেতো। আমি টিউটরের কাছে যাইনি টাকার অভাবে। নিজে নিজেই চেষ্টা করতাম। অংকে ছিলাম গরু। আজও আমি টাকা পয়সার হিসাব গুলিয়ে ফেলি। ক্লাসে বসতাম পিছনের বেঞ্চে। স্যারদের দৃষ্টি থেকে আড়ালে থাকতে চাইতাম। স্যাররা কি বলত শুনতাম না। ক্লাসেও লুকিয়ে গল্পের বই পড়তাম। স্কুলে পড়া না পারার জন্য কতদিন বেতের বাড়ি খেয়েছি। বাতেন স্যারের সামনে হাত পেতে দিতাম আর স্যার সপাং সপাং বেতের বাড়ি মারত। এখনকার দিনে এসব ভাবা যায়! তখনকার শিক্ষকরা ছাত্রদের আদর্শ শিখাতেন। সততার গল্প করতেন। ন্যায় নীতির কথা বলতেন। বড়দের ভক্তি ও পিতা মাতার প্রতি দ্বায়িত্ব কর্তব্যের কথা বলতেন।
গল্প উপন্যাস পড়তে পড়তেই এক সময় আমারও লেখার প্রতি আগ্রহ জন্ম নিল। আমি অবাক হয়ে লেখার অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। লেখকদের মনে হতো অন্য কোনো গ্রহের মানুষ। তখন থেকেই আমি ভাবতাম কখনও কি লেখকদের কাছ দেখে দেখতে পাব! মনে হতো আমি কোনো লেখকের সামনে গিয়ে কথাই বলতে পারব না। কথা হারিয়ে যাবে। কিভাবে একজন লেখক তার লেখনির মাধ্যমে মানুষকে কাঁদায়, হাসায়, অন্য এক জগতে নিয়ে যায়! অবাক কান্ড! কিভাবে এটা সম্ভব! আজও লেখকদের দেখলে আমার মধ্যে একটা শিহরন জাগে।
আমি কখনোই সামাজিক মানুষ ছিলাম না। আমার মধ্যে নানা ধরনের কমপ্লেক্স ছিল। হীনমন্যতা ছিল। মানুষের সামনে আমি যেতেই পারতাম না। আমার পা আড়ষ্ট হয়ে যেতো। সবসময় মনে হতো আমি অন্যদের মতো না। আামি আলাদা। আমার মধ্যে আলাদা এক আমি আছে। যে খুবই কিম্ভুত, খুবই মিসফিট একজন মানুষ। তার দুঃখ কষ্ট, আনন্দগুলোও আলাদা। সবসময় একটা কল্পনার জগতে ছিল আমার বসবাস। সেই কল্পনা থেকেই একদিন আমি লিখতে শুরু করলাম। এক লাইন দুই লাইন দিয়ে শুরু হয়েছিল। ব্যাক্তিগত বিজ্ঞাপন, চিঠিপত্র, পত্র মিতালী, সাংবাদিকতা এবং তারপর ৩০০/৪০০/৫০০ পৃষ্ঠার বই। সেই কল্পনা নিয়ে আজও আমি পথ চলছি।
এখনও অনেক কমপ্লেক্স আমার মধ্যে। অনেক দ্বিধা, ভয়। এখনও আমি কোথাও গেলে সহজ হতে পারি ন্।া নিজের মধ্যে শক্ত হয়ে থাকি। কেউ কিছু বললে প্রতিউত্তর করতে পারি না। কেউ কিছু চাইলে না বলতে পারি না। কঠিন হতে পারি না। কেউ অভিযোগ করলে পাল্টা অভিযোগ করতে পারি না। এজন্য আমি কারো কাছে কিছু চাইতেও পারি না। চেয়ে নিতে এখনও আমার আড়ষ্ঠ লাগে। কারো কাছ থেকে কিছু সুবিধা নিতে দ্বিধা ভর করে। সুবিধা নিলেও কোনো না কোনোভাবে তার শোধ করে ফেলি।
টাকা পয়সা জিনিসটার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নাই। যখন আমার অনেক অভাব অনটন ছিল তখনও টাকা পয়সার কোনো মোহ ছিল না। এখন যে আমি স্বচ্ছল, যা খুশী কিনতে পারি, আইসক্রিম খেতে পারি, যে কেনো জায়গায় যেতে পারি অথচ যখন আমি এসব কিছুই পারতাম না তখনও আমি যেমন ছিলাম এখনও আমি তাই আছি। আমার ছেলে মেয়েরাও আমার মতো। অনেক বড় চাকরি করার পরও তাদের আচরন বদলায়নি একটুও। এটা একটা বোধের ব্যাপার। এই প্রজন্ম এটা জানেও না।
আমার অনেক পরিচিত জনকে দেখেছি টাকা পয়সা হওয়ায় আত্মঅহংকারে বুদ হয়ে থাকে। ভাল বাড়িতে থাকে, ভাল বাজার করে, ভাল কাপড় পরে, দেশ বিদেশে যায় সেজন্য একটা অহমিকা চলে এসেছে। তাদের আচরনে তার প্রকাশ ঘটে। দেশের মানুষের মধ্যে এই প্রবনতা বেশি। যাদের নতুন পয়সা হয়েছে তারাই অতীতকে ভুলে যায়। গরীব আত্মীয়কে করুনার চোখে দেখে। বাবা মা, ভাই বোনকে অবহেলা করে। এসব আমাকে পিঁড়া দেয়। অসামাজিক মানুষ হয়েও এই যন্ত্রণা থেকে সহজে পরিত্রান পাই না আমি। আমার একজন বন্ধু সেদিন ফোন করে বলেছেন, জসিম ভাই, লেখকদের এতো সামাজিক হতে নেই। লেখকরা আলাদা মানুষ। বেশি লৌকিকতা, পরিবার ও আত্মীয়দের সাথে বেশি মাখামাখি তাদের লেখক স্বত্ত্বার জন্য বিরাট বড় ক্ষতি। লেখকরা নিজের জগতে ডুব দিয়ে থাকবে। সামাজিক আচারে তারা যোগ দেবে না।
কিন্তু আমি নিজেকে অসামাজিক দাবী করলেও আমি আসলে তা না। আমি বড় বেশি সামাজিক, বড় বেশি দ্বায়িত্ববোধে আক্রান্ত। এটা আমার লেখক স্বত্ত্বার জন্য ক্ষতিকর। আমি যে এতো অন্যদের নিয়ে ভাবি, আত্মীয়, বন্ধু, পরিচতিজন বা অপেক্ষাকৃত কম ভাগ্যবানদের কথা ভাবি এর জন্য কোনো পুরষ্কার নাই আমার ভাগ্যে, আছে সমালোচনা, আছে তিরষ্কার। তারপরও আমি নিজেকে বদলাতে পারি না। মানুষ নিজেকে বদলাতে পারে না। আমার প্রতি কিছু মানুষের ভালবাসাই আমাকে শক্তি জোগায়। যাদের জন্য আমি কিছুই করি না তারাই আমাকে অকুন্ঠ ভালবাসা আর সমর্থন দেয়।
স্বপ্ন নিয়ে বাঁচা
এই যে এক একটা দিন বেঁচে আছি এটাকে বোনাস মনে হয়। এক একটা দিন সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকা বিরাট বড় ঘটনা। বিরাট বড় ব্লেসিংস। লটারি পাওয়ার মতোই সৌভাগ্যের। একসময় এসব নিয়ে ভাবতাম না। এখন ভাবি। যখন মানুষ সুস্থ্য থাকে, তারুণ্য থাকে, শক্তি থাকে তখন সবকিছু অজেয় মনে হয়, সবকিছু নিজের মনে হয়। কিন্তু পৃথিবীতে কিছুই অজেয় না, কিছুই নিজের না। সবকিছু ক্ষনস্থায়ী, ভঙ্গুর। এই আছে এই নাই। তবুও আশা বেঁচে থাকে, স্বপ্ন বেঁচে থাকে, সৃষ্টির যন্ত্রণা থাকে। এটাই সভ্যতা। এভাবেই পৃথিবী, সমাজ সামনের দিকে এগিয়ে যায়। একদিন চলে যেতে হবে। সবাইকেই। যে কোনো সময়, যে কোনো মহুর্তে ডাক আসবে। কিন্তু সেটা ভেবে তো আর জীবন থেমে থাকবে না। জীবন থেমে থাকে না। জীবন চলমান। এই যে আমার বন্ধু ডাবলু ক্যান্সারে ভুগে চলে গেলো। যতদিন পৃথিবীতে ছিল কত আশা ছিল, স্বপ্ন ছিল, প্রেম ছিল, সংসারের জন্য মায়া ছিল। সব ছিল। চলে যাওয়ার সাথে সাথে সব স্বপ্ন, সব আশার সমাপ্তি ঘটেছে। আপনজনেরা একসময় মেনে নেবে এই চলে যাওয়া, এই শূন্যতা। মেনে নিতে হয়। কষ্ট না ভুলতে না পারলে মানুষ বাঁচতে পারত না। ডাবলুর মতো অনেকেই চলে গেছে। চলে যাবে। আপনজনরা চলে গেছে, বন্ধুরা চলে গেছে। ওপারে তারা কেমন আছে জানা যায় না। কখনও ফিরে এসে বলবে না কেমন ছিল।
এইসব ভাবি আজকাল। ভাবতে না চাইলেও ভাবনা এসে যায়। চলে যাওয়াই সত্য। অবশ্যম্ভাবি এই সত্যকে এড়ানো যায় না। কিন্তু আমরা এড়িয়ে যেতে চাই। চলে যেতে হবে এই চরম সত্য মানতে পারি না। কিন্তু মানতেই হবে। প্রস্তুতি থাকতে হবে। জাগতিক বিষয়াবলি নিয়ে আমরা বুদ হয়ে থাকি। নিজের সুখের জন্য, স্বাচ্ছন্দের জন্য, পরিবারের জন্য সন্তানের জন্য সব করি আমরা। অন্যের দুঃখ কষ্ট, অভাব অনটন আমাদের স্পর্শ করে না সহজে। অন্যের বিপদ দেখলে মনে করি বিপদটা আমার না, তার। নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে সিরিয়ে নেই। বর্তমান আত্মসুখসর্বস্ব পৃথিবীতে সবাই নিজেকেই বেশি ভালবাসে। নিজের স্বার্থটা আগে দেখে। স্বার্থ আদায় হয়ে গেলে ফুটুস করে কেটে পড়ে। মায়া মমতার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ক্রমে। কারো অসুস্থ্যতায়, দুঃখে, অভাবে একটু সহানুভূতি দেখানো, একটু পাশে থাকা অনেক দরকার। মানুষইতো সব। মানুষের প্রতি মানুষের মমতটাই আসল। একে অপরকে হিংসা করা, ক্ষতি করা, ঠকানোর মানসিকতা পরিহার করতে পারলে জীবন হয়ে উঠতে পারে মধুময়। ভোগবাদী পৃথিবীতে আমরা একাই সুখী হতে চাই। এই মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। পরষ্পরের বিপদে ঝাপিয়ে পড়াই মানবতা।
আজকাল মানুষের মধ্যে প্রাণের স্পর্শ দেখি না কোথাও। একটা সময় বন্ধুর জন্য বন্ধু, আত্মীয়র জন্য আত্মীয় ঝাপিয়ে পড়ত। যা আছে তাই নিয়েই এগিয়ে আসত। কিন্তু আজকাল মানুষ গর্তে ঢুকে গেছে। কেউ আর কারো বিপদে এগিয়ে আসে না। সন্তানও মা বাবাকে আপদ মনে করে, বোঝা মনে করে। স্বামী স্ত্রী, ভাই বোন কেউ কাউকে বোঝে না, ভালবাসতে পারে না। লাভ ক্ষতির হিসাব চলে সারাক্ষণ। যান্ত্রিক হয়ে গেছি আমরা। যন্ত্রের সাথে সখ্যতা। এক ঘরে থেকেও যোজন যোজন দূরে। প্রানভরে গল্প করা, আড্ডা দিতে ভুলে গেছি। কোথায় যেনো দ্বিধা, ভয়। হাই টেকের যুগে কোনো প্রাইভেসি নাই। সর্বত্র আতঙ্ক, নিরাপত্তাহীনতা। প্রাণখুলে হাহা হিহি করে হাসা যেনো উঠেই গেছে। দমবন্ধ এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দরকার। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, আস্থা, ভালবাসাই পৃথিবীকে সুন্দর করতে পারে। যত বেশি হাসতে পারা যাবে, ভালবাসতে পারা যাবে তত বেশি জীবন সুন্দর হবে। নির্লোভ, স্বার্থহীন সম্পর্কই দীর্ঘ জীবন লাভের উপায় হতে পারে। চলে তো যেতেই হবে সবাইকে তাই বেঁচে থাকা জীবনটাকে হাসি আনন্দে ভরিয়ে তুলতে হবে। ছোট খাট কষ্ট, অভিমান, ক্ষোভ ভুলে যেতে পারলে জীবন অর্থময় হবে। বেঁচে থাকা জীবনে কষ্ট থাকবে, অসুস্থ্যতা থাকবে, যে কোনো সময় হানা দেবে অপ্রত্যাশিত অসুখ, অপ্যত্যাশিত কষ্ট। সেসব মেনে নেওয়াই সভ্যতা। সংসারে, সমাজে, রাষ্ট্রে, কর্মক্ষেত্রে শান্তিতে থাকতে পারাই মহত্বের পরিচয়। তাই আসুন সহজ জীবন যাপন করি, প্রচুর হাসি, আড্ডা করি, ধর্ম করি, মনখুলে ভালবাসি, মানবতার সেবা করি এবং সুস্থ্য থাকি। এ রকম স্বপ্ন দেখা এমন কিছু কঠিন না। স্বপ্ন নিয়ে বাঁচি।
টরন্টো ২৯ জুন ২০২২