হ্যামিলটন এলাকার বাড়িতে উড়ছে কনফেডারেট পতাকা, ঘৃণার প্রতীক সম্পর্কিত আইন পাল্টানোর তাগিদ
পুলিশ বলছে, তারা ওই পতাকা নামিয়ে দিতে পারে না, বাড়ির মালিক বলছেন, মানুষ কী ভাবলো তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : অ্যামি আর্চিবল্ড-ভার্লে বলেন, হ্যামিলটনের পল্লী এলাকায় তার মহল্লার একটি বাড়িতে যখন কনফেডারেট পতাকা উড়তে দেখেন, তখন তার ভয় হয়, সংশয়ের দোলায় দুলতে থাকেন।
আর্চিবল্ড-ভার্লে একজন জ্যামাইকান কানাডীয়। হ্যামিলটনের সিবিসি নিউজকে তিনি বলেন, “আমার ছোট বাচ্চা আছে … তারাও অশ্বেতাঙ্গ… এটা উদ্বেগজনক কারণ, ‘আমার সন্তানকেও কি এধরণের ঘৃণার শিকার হতে হবে? আমার সন্তানকেও ঘৃণ্য N-word এ সম্বোধন করা হবে অথবা এ ধরণের ভীতির মধ্যে বাস করতে হবে?’”
আর্চিবল্ড-ভার্লে বলেন, তিনি ও তার পরিবার ওই বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে বসবাস করেন।
কনফেডারেটদের যুদ্ধের পতাকা ওড়ানো হতো আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময়। কুখ্যাত জেনারেল রবার্ট লির সৈন্যবাহিনী যারা দাসপ্রথা টিকিয়ে রাখার জন্য লড়াই করেছে এটি হলো তাদের পতাকা। সে সময় এটি বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজ্যগুলোর সমার্থক হয়ে ওঠে।
কৃষ্ণাঙ্গদের সমান অধিকার দেয়ার বিরোধিতা করে পরে যে নাগরিক অধিকার আন্দোলন শুরু হয় সে সময় এই পতাকা বা প্রতীকটির পুনরুজ্জীবন ঘটানো হয়। তখন থেকে এটি শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী গ্রুপগুলোর প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত।
গত গ্রীষ্মে হ্যামিলটন নগর পরিষদ সদস্যরা পৌরসভার সম্পত্তিতে এই পতাকা এবং নাৎসিদের প্রতীক সয়েসটিকা প্রদর্শন নিষিদ্ধ করার পক্ষে ভোট দেন। এগুলোকে ঘৃণার প্রতীক হিসাবে অভিহিত করে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তখন পুলিশ স্বীকার করে যে, কারো নিজের সম্পত্তিতে কনফেডারেট পতাকা ওড়ানো ফৌজদারি অপরাধ নয়। তাদের ভাষায়, যদি তদন্তে প্রমাণিত হয় যে, এই পতাকা ওড়ানোর সঙ্গে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য কাজ করেছে তাহলেই কেবল এটা অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে।
আর্চিবল্ড-ভার্লে বলেন, তিনি এই পতাকা ওড়ানোর বিষয় নিয়ে টুইট করেছিলেন মূলত গত ফেব্রুয়ারি মাসে। গত রবিবার তিনি আরেকটি টুইটার বার্তা শেয়ার করেন যেটিতে কানাডার ঘৃণাবিরোধী নেটওয়ার্ক (সিএএইচএন), হ্যামিলটনের আঞ্চলিক বর্ণবাদবিরোধী কোয়ালিশন (এইচএএআরসি) এবং হ্যামিলটনের নাগরিক অংশীদারিত্ব কেন্দ্রের (এইচসিসিআই) দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, “কোনও ব্যক্তি কেন এমন ধারণা করছেন যে, এটা গ্রহণযোগ্য?”
হ্যামিলটন শহর এরই মধ্যে ঘৃণার জন্য পরিচিতি অর্জন করেছে। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার পরিসংখ্যানে দেয়া যায়, ২০১৪, ২০১৬, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে দেশে মাথাপিছু সর্বোচ্চ সংখ্যক ঘৃণাজনিত অপরাধ ঘটেছে এই শহরে।
বাড়ির লোকেরা বলছে কারও উদ্বেগ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই
মঙ্গলবার হ্যামিলটন শহরের কেন্দ্র থেকে দক্ষিণ-পূর্বদিকে বিনব্রুকের সেই বাড়িতে যায় সিবিসি হ্যামিলটন। বাড়ির সামনে কনফেডারেট পতাকা উড়ছিলো।
বাড়ির যে বাসিন্দা দরজা খুলে সিবিসি সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেন তিনি চাননি তার নাম উল্লেখ করা হোক। লোকটি বলেন, “অন্যরা কী ভাবছে তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই।” আর এই পতাকা বর্ণবাদী বলেও তারা মনে করেন না।
তারা একথাও বলেন যে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা এই পতাকা ওড়াচ্ছেন, এর আগে কোনও অভিযোগ আসেনি। তারা বলেন, এখানকার অন্য লোকেরাও এই পতাকা ওড়ায়।
বাড়ির ওই বাসিন্দা বলেন, “আমি এটা ওড়াই আমার স্বাধীনতা আছে বলে। এটা আমার পছন্দ। আমি এক স্বাধীন দেশে বাস করি।”
তিনি বলতে থাকেন, “আমি একজন ব্যক্তি এবং আমার অধিকার আছে … এটা কোনও আক্রমণাত্মক কিছু নয়, আপনি এটিকে কিভাবে দেখছেন সেটাই মূল বিষয়…।”
সিএএইচএন, এইচএএআরসি এবং এইচসিসিআই বলেছে, এই পতাকা স্বাধীনতার প্রতিনিধিত্ব করে না। আর এ বিষয়ে কোনও অস্পষ্টতা নেইÑ এটি স্পষ্টতই বর্ণবাদী।
সিএএইচএন-এর উপ-পরিচালক এলিজাবেথ সিমন্স বলেন, “এই পতাকা দাসপ্রথা এবং কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যার উদযাপনমাত্র। আসলে বাক-স্বাধীনতার আবরণে যে যুক্তি দেখানো হচ্ছে তা আমাদের বিস্মিত করেনি… ওই বাড়িওয়ালা এভাবে চিন্তা করছেন এটাই দুর্ভাগ্যজনক।”
এইচএএআরসির নির্বাহী পরিচালক লিন্ডন জর্জ বলেন, পরিস্থিতি আমাদের জন্য একটি কঠিন বার্তা মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরও অনেক কিছু করার বাকি আছে।
তিনি বলেন, “এই পতাকা ও প্রতীকগুলো যাদের ওপর সুগভীর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে তাদের জীবন্ত অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের সমাজ স্পষ্টতই সংযোগহীন।”
“আমাদের বসবাসের জায়গায় এটি দেখা খুবই তিক্ত একটি বিষয়।”
পুলিশ বলছে তারা এটা নামাতে পারে না
হ্যামিলটন পুলিশের মুখপাত্র জ্যাকি পেনম্যান বলেন, সামাজিক মাধ্যমে এ সংক্রান্ত পোস্ট দেখে তারা সংশ্লিষ্ট বাড়িতে গেছেন।
ওই বাড়ির বাসিন্দা সিবিসিকে জানান, পুলিশ সোমবার সন্ধ্যায় এসেছিল। পেনম্যান বলেন, পুলিশ ওই বাড়ির মালিকের সঙ্গে দেখা করেছে তাকে কনফেডারেট পতাকা ওড়ানোর সামাজিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য।
পেনম্যান বলেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বর্তমানে এমন কোনও আইন নেই যার ভিত্তিতে পুলিশ ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে অথবা তাকে পতাকা নামিয়ে ফেলতে বাধ্য করতে পারে।
তিনি বলেন, “এটা করা সম্ভব যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ঘৃণার প্রচার করা অথবা জনগণের মধ্যে ঘৃণা উস্কে দেওয়ার মত ফৌজদারি অপরাধের নমুনা পাওয়া যায়।”
মি. জর্জ এবং এইচসিসিআই-এর নির্বাহী পরিচালক কোজো ডামটে বলেন, এই পরিস্থিতিতে বোঝা যাচ্ছে, ঘৃণার বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইন যথেষ্ঠ জোরালো নয়।
ডামটে বলেন, “প্রথমত, আমাদেরকে দণ্ডবিধি সংশোধন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রাদেশিক আইন থাকতে হবে যাতে ঘৃণাজনিত অপরাধের মানসম্মত সংজ্ঞা থাকবে। একইসঙ্গে পৌরসভার ক্ষেত্রেও তাদের উপবিধিতে এমন নিশ্চয়তা বিধান করতে যেন পৌরসভার অথবা কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে ঘৃণার প্রতীক কেউ প্রদর্শন করতে না পারে।”
রাজনীতিকদের পদক্ষেপ নিতে হবে
আর্চিবল্ড-ভার্লে বলেন, তার পোস্টে শহরের মেয়র ফ্রেড আইসেনবার্গার এবং এমপিপি ডোনা স্কেলিকে ট্যাগ করার পরও কোনও রাজনীতিক তার সঙ্গে কথা বলেননি।
সিবিসি হ্যামিলটন মন্তব্য জানার জন্য মেয়র এবং স্কেলার সঙ্গে যোগাযোগ করে।
শহরের সামাজিক মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট থেকে আর্চিবল্ড-ভার্লের টুইটে সাড়া দেয়া হয়। তাকে বলা হয় এ বিষয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে। তিনি বলেন, এই জবাব যথেষ্ট নয়।
আর্চিবল্ড-ভার্লে বলেন, নির্বাচিত কর্মকর্তাদের উচিৎ ওই বাড়িতে কনফেডারেট পতাকা ওড়ানোর নিন্দা জানানো।
তিনি বলেন, “ঘৃণার বিরুদ্ধে যদি নেতারা কথা বলতে না চান তাহলে হয়তো আমাদেরকে এমন নেতা খুঁজে নিতে হবে যারা এ বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক।” “এখানে প্রচুর সংখ্যক অশ্বেতাঙ্গ মানুষ বসবাস করেন আর আমরা নিঃসঙ্গ বোধ করছি। আমরা অনুভব করছি যে, আমাদের কথা শোনার কেউ নেই। আমার মনে হয়, এর বিরুদ্ধে জনগণের সোচ্চার হবার এখনই সময়।”