বাফেলোর বর্ণবাদী গুলিবর্ষণের ঘটনার পর কানাডাকে অবশ্যই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী জঞ্জালের মোকাবেলা করতে হবে
সাবা আজিজ ও এবিগেইল বিম্মান
কয়েক সপ্তাহ আগে যুক্তরাষ্ট্রে জনগণের ওপর মারাত্মক গুলিবর্ষণের ঘটনার পর কানাডায় কৃষ্ণাঙ্গবিরোধী বর্ণবাদ এবং ঘৃণাজনিত অপরাধ নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। কানাডার সরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী গ্রুপগুলোকে কঠোর হাতে দমন করার জন্য জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানিয়েছেন।
নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের বাফেলোতে গত ১৪ মে বিকালের গুলিবর্ষণে ১০ ব্যক্তির নিহত হবার ঘটনাটি সে দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের ঘৃণাজনিত অপরাধ এবং জাতিগত চেতনায় উদ্বুদ্ধ সহিংস চরমপন্থী হামলা হিসাবে ধরেই তদন্ত করা হচ্ছে।
কানাডার এমপিরা বলছেন, বাফেলোর রক্তপাতের ঘটনা সীমান্তের দক্ষিণের দেশে বর্ণবাদের উপস্থিতি সামনে নিয়ে এসেছে বটে তবে কানাডাতেও একই রকমের ঘৃণা-বিদ্বেষের অস্তিত্ব রয়েছে।
জননিরাপত্তামন্ত্রী মার্কো মেন্ডিসিনো বলেন, “আমাদের আমেরিকান বন্ধুদের বলতে চাই, তারা একা নন, কানাডাও এই চ্যালেঞ্জ থেকে মুক্ত নয়।”
সোমবার অটোয়ায় গ্লোবাল নিউজকে তিনি বলেন, “এজন্যেই আমাদেরকে সশস্ত্র সহিংসতা নির্মূলে আরও অনেক কিছু করতে হবে। আর আমাদেরকে বর্ণবাদ মুছে ফেলার জন্যও আরও কিছু করতে হবে। আমাদের সমাজে এগুলোর কোনও স্থান নেই।”
ক্রাউন-আদিবাসী সম্পর্ক বিষয়ক মন্ত্রী মার্ক মিলার বলেন, যদিও কানাডার আগ্নেয়াস্ত্র বিষয়ক আইন অধিকতর কঠোর এবং আমেরিকার চেয়ে এদেশে মানুষের হাতে বন্দুকের সংখ্যাও কম তবু তিনি কানাডার মাটিতে সম্ভাব্য হুমকির বিষয়ে উদ্বিগ্ন।
গ্লোবাল নিউজকে তিনি বলেন, “এদেশে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী চরমপন্থী গ্রুপগুলো অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসের সবচেয়ে বড় হুমকি। অথচ আমরা এখনও তাদের পক্ষে অজুহাত দাঁড় করাচ্ছি। সুতরাং আমি মনে করি, এটা এমন এক চ্যালেঞ্জ যে বিষয়টিকে আমাদের সার্বক্ষণিক গুরুত্ব দিতে হবে।”
কানাডায় হেট ক্রাইম
পুলিশে রিপোর্ট করা হয়েছে এমন ঘটনার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কানাডায় হেট ক্রাইম বাড়ছে।
মার্চে প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার এক রিপোর্ট অনুযায়ী, কোভিড-১৯ মহামারির প্রথম বছরে কানাডায় হেট ক্রাইম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ।
স্ট্যাটক্যান-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, কানাডায় সবচেয়ে বেশি ঘৃণাজনিত অপরাধের শিকার হয়েছেন ইহুদি ও কৃষ্ণাঙ্গরা। কানাডায় সংঘটিত মোট হেট ক্রাইমের যথাক্রমে ২৬ শতাংশের শিকার হন ইহুদিরা এবং ১৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গরা।
২০১৪ সাল থেকে এপর্যন্ত কানাডার মাটিতে সংঘটিত সাতটি হামলার ঘটনায় ২৬ ব্যক্তি নিহত এবং ৪০ জন আহত হন। মার্চে প্রকাশিত কানাডার নিরাপত্তা গোয়েন্দা সার্ভিসের (CSIS) সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, ওইসব হামলা ছিল আদর্শিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ সহিংস চরমপন্থী হামলা।
সেনেকা কলেজের জননিরাপত্তা বিষয়ের প্রফেসর এবং কাউন্টার-এক্সট্রিমিজম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মুবিন শেখ বলেন, কট্টর ডানপন্থী সন্ত্রাসবাদ একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলন এবং তাতে কানাডার বিভিন্ন গ্রুপও জড়িত।
গ্লোবাল নিউজকে তিনি বলেন, “অন্য যে কোনও জায়গার তুলনায় এক্ষেত্রে কানাডা অনেক বেশি ভালো অবস্থানে আছে, তবে… অন্য দেশগুলোর মত আমাদের দেশেও ওই জঞ্জাল আছে।”
সন্ত্রাসবাদ, নিরাপত্তা ও সমাজ বিষয়ক গবেষণা সংক্রান্ত কানাডীয় নেটওয়ার্কের গবেষক বারবারা পেরি বলেন, ২০১৫ সালের পর থেকে চরম-ডানপন্থী সক্রিয়তাবাদের “সত্যিই নাটকীয় বিকাশ” ঘটেছে।
তিনি বলেন, তার দল কানাডায় ৩০০টি সক্রিয় ডানপন্থী হেট গ্রুপ চিহ্নিত করেছে, তবে এমনও হাজার হাজার মানুষ রয়েছেন যারা কোনও গ্রুপের সঙ্গে জড়িত না হয়েও এই আন্দোলনের সাথে আছেন।
“এটা সত্যিই ভীতিকর একটি বিষয়, আর আমার মনে হয়, একইসঙ্গে সমান বিস্ময়কর যে, আমরা যদি গ্রুপগুলোর সংখ্যার দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে এটা রীতিমত যুক্তরাষ্ট্রের সংখ্যার অনুরূপ।”
তিন সপ্তাহ ধরে দেশের রাজধানী অচল করে দিয়েছিল তথাকথিত “ফ্রিডম কনভয়” নামের যে গ্রুপটি তার কিছু সংগঠকের যে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে সে বিষয়ে যথেষ্ট নথিপত্র আছে। আর ওই তিন সপ্তাহের বিক্ষোভকালে জনতার মধ্যে অনেক ব্যক্তি সয়েস্টিকা আঁকা নাৎসি পতাকা, কনফেডারেট পতাকা এবং কানাডীয় পতাকা ওড়াচ্ছে এমন বেশ কিছু ঘটনাও ঘটে।
এদিকে, অন্টারিও এবং কুইবেকের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে, ইসলামভীতি, মুসলিম-বিরোধী হেট ক্রাইমও বৈষম্য উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে।
২০২১ সালের জুন মাসে অন্টারিওর লন্ডনে এক ব্যক্তি বৈকালিক ভ্রমণে বেরুনো একটি পাকিস্তানী মুসলিম পরিবারের সদস্যদের ইচ্ছাকৃতভাবে ট্রাকচাপা দেয়। এতে পরিবারটির চার সদস্য নিহত হন। নয় বছর বয়সী একটি বালক শুধু বেঁচে যায়।
২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে কুইবেক সিটিতে একটি মসজিদে গুলি বর্ষণে ছয় ব্যক্তি নিহত ও ১৯ জন গুরুতর আহত হন।
‘মহা প্রতিস্থাপন তত্ত্ব’
“মহা প্রতিস্থাপন তত্ত্ব” বাফেলোর গুলি বর্ষণের ঘটনার উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।
এটি হলো একটি বর্ণবাদী এবং সেমিটিকবিরোধী (সাধারণভাবে ইহুদিবিরোধী) ষড়যন্ত্র তত্ত্ব যাতে ধরে নেয়া হয় যে, অভিবাসনের মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গদের প্রভাব খর্ব করা হচ্ছে।
এই তত্ত্বে বিশ^াসীদের মধ্যে যারা খুব বেশি বর্ণবাদী তারা মনে করে, তথাকথিত এই মহা প্রতিস্থাপন পরিকল্পনার পেছনে আছে মূলত ইহুদিরা।
অটোয়া কনভয়-এর সংগঠক প্যাট কিং আগে অনলাইনে পোস্ট করা বিভিন্ন ভিডিওতে এই তত্ত্ব সমর্থন করেছেন।
২০২১ সালটি ছিল কানাডায় ইহুদিবিরোধী ঘটনার আরেকটি রেকর্ড করা বছর। কানাডায় ইহুদিদের পক্ষে কর্মরত বি’নাই বার্থ কানাডার সাম্প্রতিক এক রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী ওই বছর সহিংস ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে ৭৩৩ শতাংশ।
স্ট্যাটক্যানের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সালে কানাডায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হেট ক্রাইমের সবচেয়ে বড় লক্ষবস্তু ছিল ইহুদিরা।
বি’নাই বার্থ-এর মানবাধিকার বিষয়ক পরিচালক মারভিন রোট্রান্ড বলেন, এ বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
গ্লোবাল নিউজকে তিনি বলেন, “এটা স্পষ্ট যে, কানাডাকে অনলাইনে ঘৃণা ছড়ানোর বিষয়ে এবং তা কী উপায়ে ভালভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সে বিষয়ে নজর দিতে হবে।”
লিবারেল দল ২০২১ সালের জুন মাসে পার্লামেন্ট অধিবেশনের একেবারে শেষদিকে ঘৃণাবিরোধী একটি আইনের খসড়া, বিল -৩৬ উপস্থাপন করে। কিন্তু এর দুমাস পর ফেডারেল সরকারের নির্বাচন ঘোষিত হলে ওই বিল তামাদি হয়ে যায়।
রোট্রান্ড বলেন, ঘৃণাবিরোধী আইনের দিক থেকে ইউরোপের দেশগুলোর চেয়ে কানাডা পিছিয়ে পড়ছে।
তার ভাষায়, “আমরা পেছনের সারিতে বসে থাকতে এবং একথা বলতে পারি না যে, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে আলাদা, আমরা ওইরকম ঘটনা এখানে ঘটতে দেবো না।”
তিনি বলেন, “এমন ঘটনা এখানেও ঘটতে পারে এবং… আমাদের সতর্ক থাকা দরকার।”
সিএসআইএস বলছে, তারা আদর্শিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ সহিংস চরমপন্থী হুমকির তদন্ত ও বিশ্লেষণের কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে অর্থ যোগাড় করছে।
চলতি মাসের শুরুর দিকে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে এক বক্তৃতায় সিএসআইএস-এর পরিচালক ডেভিড ভিগনল্ট কোভিড-১৯ মহামারি, সামাজিক গণমাধ্যমের সর্বকালের সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠা এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিস্তারের মত সমাজের অগ্রগতি ব্যাহতকারী গুরুতর ঘটনাবলির বিষয়ে সতর্ক করেন। তার ভাষায়, এই বিষয়গুলি এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যার সুযোগ নিতে পারে প্রভাব বিস্তারকারী ও চরমপন্থীরা।
সম্প্রতি হাউজ অব কমন্সে এনডিপি দলের এমপি পিটার জুলিয়েন বাফেলোর গুলিবর্ষণের ঘটনার নিন্দা জানিয়ে একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত প্রস্তাব (consent motion) উত্থাপন করেন। এতে বাফেলোর হামলাকারীর নিন্দা, হতাহতদের প্রতি শোক জানানো হয় এবং বর্ণবাদ ও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের মোকাবেলার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়। এরপর কিছু সময় নীরবতা পালন করা হয়।
এটি ছিলো একটি প্রতীকী উদ্যোগ, তবে এমপিরা সমস্যার মূল কারণ দূর করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি স্বীকার করেন।
পরিবহন মন্ত্রী ওমর আলঘাবরা বলেন, “আমাদেরকে এই বিষয়টি আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।”
সূত্র : গ্লোবাল নিউজ (অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস ও দি কানাডিয়ান প্রেসের ডেভিড ব্যাক্সটারের নথিসহ উপস্থাপিত।)