অশ্লীল ও মারমুখী আক্রমণের শিকার জাগমিত সিং : নেপথ্য কারণ কি?
খুরশিদ আলম
সম্প্রতি ফেডারেল নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান জাগমিত সিং এক বিদ্বেষী আক্রমণের শিকার হয়েছেন। আক্রমণকারীরা তাঁকে অশ্রাব্যভাষায় গালাগালি করেছেন, মধ্যমাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছেন। তাঁরা তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বলে গাল দিয়েছেন এবং তাঁর মৃত্যুও কামনা করেছেন।
জাগমিত সিং গত ১০ মে মঙ্গলবার টরন্টোর পূর্বদিকে অবস্থিত পিটাররো-তে গিয়েছিলেন প্রভিন্সিয়াল নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির স্থানীয় প্রার্থী জেন ডেক এর নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে। সেখানেই তিনি এই বিদ্বেষী আক্রমণের শিকার হন। প্রচারণার কাজ শুরু করার আগে এবং পরে কয়েক দফায় তাঁর উপর আক্রমণ চালানো হয়। তিনি যখন চলে আসছিলেন তখনও আক্রমণকারীরা তাঁর পিছু নেন এবং গাড়ি পর্যন্ত তাঁকে অনুসরণ করে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করেন। এক ভিডিও ফুটেজে আক্রমণকারীদেরকে চিৎকার করে বলতে শুনা যায়- ‘You’re a f–king piece of s–t” and “You lying piece of s–t’।
আক্রমণের সময়টাতে জাগমিত সিং শান্ত থেকেছেন। তবে পরবর্তীতে তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘পিটারবরোতে আমার উপর আক্রমণের যে ঘটনা ঘটেছে তা ছিল আমার রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে বড় কষ্টকর ও যন্ত্রণাপ্রদ ঘটনা।’
তিনি আরো বলেন, ‘আক্রমণের এই ঘটনা কানাডার রাজনীতিতে আগ্রাসন এবং মেরুকরণের ক্রমবর্ধমান প্রবণতাকে প্রতিফলিত করছে। আমরা কোন বিষয়ে অসম্মতি জানাতে পারি সম্মানের সাথে। এমনকি রাগান্বিত হয়েও। কিন্তু তা নিশ্চই এমন হওয়া উচিত নয় যেখানে মানুষের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে নিপতিত হয়।’
আক্রমণের ঘটনার জন্য জাগমিত সিং কিছু বিভেদসৃষ্টিকারী রাজনীতিবিদদের দোষারোপ করেন। তবে কারো নাম উল্লেখ করেননি তিনি।
উল্লেখ্য যে, জাগমিত সিং গত ফেডারেল নির্বাচনের আগে তাঁর নিজের নিবার্চনী প্রচারণা চালানোর সময়ও বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছিলেন। জনৈক ব্যক্তি তাঁর সভাস্থলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর প্রতি উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘Go back to where you came from’ অর্থাৎ তাঁকে তাঁর পিতৃভূমি বা মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে বলা হয়েছে। কিন্তু জাগমিত সিং এর জন্ম কানাডায়।
এ কথা আমরা সবাই জানি যে, কানাডার জাতীয় রাজনীতিতে দলীয় প্রধানের পদে শুরু থেকেই চলে আসছে শ্বেতাঙ্গদের একচ্ছত্র আধিপত্য। সেখানে কালো বা বাদামী বর্ণের কোন ব্যক্তির স্থান ছিল না। কিন্তু সেই অচলায়তন ভেঙ্গেছিলেন বাদামী বর্ণের জাগমিত সিং। তিনি কানাডার তৃতীয় বৃহত্তম ফেডারেল রাজনৈতিক দল নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি’র (এনডিপি) নেতা নির্বাচিত হন ২০১৭ সালে। সেদিন জাগমিত সিং এর এই বিজয়কে অনেকেই ঐতিহাসিক ঘটনা হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। কারণ, ফেডারেল পর্যায়ের কোন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা হওয়া সহজ কাজ নয়। তিনি একটি অলিখিত নিষেধাজ্ঞাকে ডিঙ্গিয়ে এমন একটি দলের প্রধান নেতা নির্বাচিত হতে পেরেছেন যেই দলটি গত ২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতা দখল করতে যাচ্ছিল। নির্বাচন শুরুর কয়েক মাস আগে থেকে পরিচালিত বিভিন্ন জরিপে দেখা গিয়েছিল এনডিপি জয়ী হতে চলেছে। অবশ্য নির্বাচনের দিন এগিয়ে আসার সাথে সাথে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। এবং নির্বাচনের দিন ভোট গননার পর দেখা যায় এই দল তৃতীয় স্থান দখল করে। প্রথম স্থান দখল করেছিল জাস্টিন ট্রুডোর লিবারেল পার্টি। এনডিপি’র সেই সময়কার নেতা ছিলেন টম মুলকেয়ার। মুলকেয়ারের পরাজয়ের পরই দলের নেতা হিসাবে দায়িত্ব পান জাগমিত সিং।
জাগমিত সিং এর জন্ম ১৯৭৯ সালে টরন্টোর স্কারবরোতে। শৈশব কেটেছে তাঁর ‘সেন্ট জন্স’ এবং ‘নিউফাউন্ডল্যান্ড এ্যান্ড ল্যাবরাডর’ এ। পরে অন্টারিও’র উইন্ডসরে-ও তাঁর শৈশবের কিছুটা সময় কেটেছে। হাই স্কুল শেষ করেছেন ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে অবস্থিত ডেট্রয়েট কাউন্টি ডে স্কুল থেকে। বাইয়োলজীতে ব্যাচেলর অব সাইন্স ডিগ্রী অর্জন করেন অন্টারিওর ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে এবং ব্যাচেলর অব ল ডিগ্রী অর্জন করেন ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০৫ সালে।
পেশায় তিনি ছিলেন একজন ক্রিমিনাল ডিফেন্স ল’ইয়ার। ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ, হিন্দী এবং পাঞ্জাবী ভাষায় তাঁর রয়েছে দক্ষতা। তাঁর বাবা জাগতারান সিং এবং মা হারমিত কাউর ভারতের পাঞ্জাব থেকে কানাডা আসেন অভিবাসী হিসাবে। তাঁর দাদা সেওয়া সিং ঠিকরীওয়ালা ছিলেন বৃটিশ ভারতে একজন বিপ্ল্বী কর্মী। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
জাগমিত সিং তাঁর রাজনৈতিক কর্মজীবন শুরু করেন ফেডারেল নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষে এমপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মাধ্যমে। ২০১১ সালে টরন্টোর নিকটবর্তী ব্রামেলিয়া-গোর-মল্টন রাইডিং থেকে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি ঐ বছর নির্বাচনে কনজার্ভেটিভ প্রার্থী বাল ঘোষাল এর কাছে ৫৩৯ ভোটে পরাজিত হন।
পরে ঐ একই সালে জাগমিত সিং অন্টারিও প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনে এমপিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে লিবারেল প্রার্থী কুলদীপ কুলারকে ২২৭৭ ভোটে পরাজিত করেন এবং এমপিপি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। পরে তিনি নিজ দলের ডেপুটি হাউজ লিডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৭ সালে ফেডারেল এনডিপি’র কনভেনশনে তৎকালীন নেতা টম মুলকেয়ার লিডারশীপ রিভিউতে দলের আস্থা হারালে জাগমিত সিং এর সম্ভাবনা উজ্জল হয়ে উঠে। পরে দলের নানান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি ফেডারেল এনডিপি’র নেতা হিসাবে নির্বাচিত হন ২০১৭ সালের ১ অক্টোবর। এবং কানাডার রাজনীতিতে তৈরী হয় নতুন ইতিহাস।
কিন্তু কানাডার রাজনীতিতে রাজনীতিকদের পথ চলা খুব মসৃণ নয়। জাগমিত সিং এর বেলায় সেটা আবার প্রমাণিত হলো। তবে শুধু দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক বলে যে তিনি বিদ্বেষী আক্রমণের শিকার হয়েছেন সেটা বলা যাবে না। আমরা গত বছর ফেডারেল নির্বাচনের আগে দেখেছি শে^তাঙ্গ সম্প্রদায়ের জাস্টিন ট্রুডোও চরম বিদ্বেষী আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। সেপ্টেম্বর মাসের গোড়াতে লন্ডন অন্টারিও-তে একটি নির্বাচনী প্রচারের কাজ শেষ করে গাড়িতে উঠার সময় তাঁর উপর পাথড়ের নুড়ি নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ঐ ঘটনায় তিনি অবশ্য আহত হননি। তবে হতে পারতেন। সেই সময় নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হবার পর ভ্যাকসিন বিরোধী একটি গোষ্ঠির সদস্যরা যে রকম অশ্লীল ও অশোভন স্লোগানসম্বলিত ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে লিবারেল পার্টির শীর্ষ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিলেন তা নোংরামির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। এই ভ্যাকসিন বিরোধী গোষ্ঠির সদস্যরা স্থানে স্থানে জাস্টিন ট্রুডোর নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা সৃষ্টি করেছেন অশ্লীলতায় ভরপুর ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও প্রচারণায় আসা জনগণের নিরাপত্তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছিল কোথাও কোথাও এই ভ্যাকসিন বিরোধী গোষ্ঠির লোকদের আক্রমণাত্নক বিক্ষোভের কারণে। ফলে কয়েকটি স্থানে নির্বাচনী প্রচারণার কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন জাস্টিন ট্রুডো। পরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনী প্রচারণার সময় এমন তীব্র আক্রোশ তিনি অতীতে আর কখনো দেখেননি।
উল্লেখ্য যে, প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও তাঁর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্যদের বিরুদ্ধে হুমকির ঘটনা ২০১৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। আরসিএমপি’র তথ্যে এমনটাই বলা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা হলো অটোয়ার রিদাও হলে গেট ভেঙ্গে অস্ত্রধারী এক ব্যক্তির অনুপ্রবেশ। ঐ ব্যক্তির নাম কোরে হুরেন। তিনি কানাডার নিরাপত্তা বাহিনীর সাবেক রিজার্ভিস্ট। পুলিশ জানায়, ঘটনার সময় তিনি ভারী অস্ত্রে সজ্জিত ছিলেন। তাঁর কাছে ছিল একটি আধা-স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, দুটি শটগান এবং চারটি ছুরি। সিবিসি নিউজ জানায়, তাঁর কাছে বেশ কিছু পরিমাণ গুলিও ছিল। এই রিদাউ হল এলাকায় গভর্নর জেনারেলের আবাসিক ভবন রয়েছে এবং ঐ সময় প্রধানমন্ত্রীর পরিবারও সেখানে বাস করছিলেন। পরে হুরেনকে গ্রেফতার করা হয়। ছয় বছরের সাজাও হয় তাঁর।
কৌতুহলের বিষয় হলো, এতগুলো অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে সাবেক এই রিজার্ভিস্ট রিদাউ হলে ঢুকলেও তাঁর নাকি কোন উদ্দেশ্য ছিল না কাউকে আঘাত করার। পুলিশের কাছে তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মী করে কভিড-১৯ বিষয়ে সরকারের নেয়া পদক্ষেপ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদানে বাধ্য করা ছিল তাঁর আসল উদ্দেশ্য। তাঁর এই ‘কাহিনী’ পুলিশ ও আদালত বিশ^াস করেছে। কিন্তু ব্যক্তিটি যদি শে^তাঙ্গ না হয়ে কৃষ্ণাঙ্গ বা বাদামাঙ্গ হতেন তবে বোধ করি পুলিশ ও আদালতের বিশ^াসের ক্ষেত্রে বেশ ভালই ঘাটতি দেখা দিত।
আসলে এরকম কোন ঘটনা ঘটতে পারে বলে ইতিপূর্বে আভাস দিয়েছিলেন প্রিভি কাউন্সিলের প্রাক্তন শীর্ষ আমলা মাইকেল ওয়েরনিক। হাউজ অব কমন্স কমিটির এক সভায় তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছিলেন, কানাডার রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এতটাই তলিয়ে গেছে যে এখানে গুপ্ত হত্যার চেষ্টা পর্যন্ত ঘটে যেতে পারে। ইতিপূর্বে সিবিসির ‘দি হাউস’ অনুষ্ঠানে এক সাক্ষাৎকারে ওয়েরনিক বলেছিলেন, ‘দায়িত্বে থাকার সময়ে কানাডার রাজনীতিকরা যে অসদাচরণ ও সহিংস হুমকির মুখোমুখি হন তার প্রকৃত পরিমাণ কত তা জানলে কানাডাবাসীরা মর্মাহত ও শঙ্কিত হবেন।’
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কারা এই সকল অশোভন ও অসভ্য আচরণ করছেন রাজনীতিবিদদের সঙ্গে? কি তাঁদের পরিচয় এবং দেশে-বিদেশে কানাডার ভাবমূর্তি নষ্ট করার পিছনে উদ্দেশ্যই বা কি তাঁদের?
কানাডার শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, করোনা মহামারী চলাকালে দেশে রাজনীতিবিদ ও সরকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক চরমপন্থার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এর কারণ হিসাবে দায়ী করা হচ্ছে করোনা সম্পর্কে ভুল তথ্যের প্রচারণাকে। গত ১২ মে পার্লামেন্ট সদস্যদের দ্বারা গঠিত ‘পাবলিক সেফটি এ্যান্ড ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিটি’র সামনে এই তথ্য তুলে ধরেন শীর্ষ নিরাপত্তা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের একটি দল। সিবিসি নিউজের এক খবরে এই কথা বলা হয়।
কর্মকর্তারা বলেন, পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো চরমপন্থীদের শনাক্ত করতে এবং তাঁদের হামলা প্রতিহত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তবে একই সাথে সরকারকেও এ সকল উগ্রবাদকে মোকাবেলায় সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে বলে তাঁরা অভিমত ব্যক্ত করেন।
করোনা মহামারী শুরু হওয়ার সময় থেকে কানাডায় বিভিন্ন সংস্থা ও সরকারের বিরুদ্ধে ‘আদর্শগতভাবে অনুপ্রাণিত সহিংস চরমপন্থা’র কার্যকলাপ বৃদ্ধির পিছনে ইন্ধন যুগিয়েছে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রবক্তারা। পাবলিক সেফটি এ্যান্ড ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিটি’র সামনে এ কথা বলেছেন কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস এর সহকারী পরিচালক চেরি হেন্ডারসন। তিনি আরো বলেন, সরকারী কর্মকর্তা ও নির্বাচিত এমপিদের বিরুদ্ধে সহিংস হুমকি প্রদানের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
উল্লেখ্য যে, সরকারী কর্মকর্তা ও নির্বাচিত রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে নানারকম অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ও বক্তব্য প্রকাশ করতে দেখা গেছে অটোয়াসহ দেশের আরো কয়েকটি অঞ্চলে লরি চালকদের অবোরোধ চলাকালীন সময়েও। পুলিশ এবং সাংবাদিকদের উপর চড়াও হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে ঐ সময়। দশ মিলিয়ন ডলারের বেশী চাঁদাও উঠিয়েছিলেন অবরোধকারীরা সরকার বিরোধী কর্মকান্ড চালিয়ে যাবার জন্য।
অবরোধ কর্মসূচিতে বর্ণবাদী পতাকা প্রদর্শন করেছিলেন তাঁরা। সেখানে তাঁদের কয়েকজনের হাতে চরম অশ্লীল ভাষা সম্বলিত প্ল্যাকার্ড দেখা গেছে যার টার্গেট ছিলেন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। অন্যদিকে বিশ^যুদ্ধে নিহত কানাডিয়ান সৈন্যদের সম্মানে নির্মিত স্মৃতিসৌধে উঠে নাচানাচি করতেও দেখা গেছে লরি চালকদের কয়েকজনকে। এমনকি স্মৃতিসৌধের গোড়াতে মূত্রত্যাগ করতেও দেখা গেছে তাঁদেরকে!
এছাড়াও ভ্যাকসিন বিরোধী বিক্ষোভ চলাকালে কানাডিয়ান ক্রীড়াবিদ, মানবতা কর্মী ও ক্যান্সার রিসার্স এ্যাক্টিভিস্ট টেরি ফক্স এর ভাস্কর্যের গায়ে ভ্যাকসিন বিরোধী পোস্টার সেঁটে দিতে দেখা গেছে তাঁদেরকে। কানাডার জাতীয় পতাকাকে অবমাননা করার জন্য সেটি মাস্তুলে উল্টো করে বেধে টেরি ফক্স এর ভাস্কর্যের সাথে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। এতে নিন্দার ঝড় উঠেছিল দেশজুরে। করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সমাবেশ করতে গিয়ে তাঁরা অচল করে দেন রাজধানী অটোয়াসহ আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান যার মধ্যে ছিল উইন্ডসরে অবস্থিত কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার এ্যাম্বেসেডর সেতু। ফলে এক সপ্তাহেরও বেশী সময় ধরে দুই দেশের মধ্যে পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ঐ সময় পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে তখন সরকার বাধ্য হয়েছিল দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে।
আর এ সবই আসলে এক সূত্রে গাঁথা। কানাডার অতি রক্ষণশীল ভাবধারায় যাঁরা বিশ^াসী তাঁরাই একসকল কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত। অটোয়া অবরোধ, জাস্টিন ট্রুডোর উপর হামলা, জাগমিত সিং এর উপর হামলা, বর্ণবাদের প্রতীক ‘কনফেডারেট পতাকা’ উড়ানো, কুইবেক সিটি ও লন্ডন অন্টারিওতে মুসলিম হত্যাযজ্ঞ এ সবই।
এবং আশ্চার্য হয়ে আমরা সেদিন লক্ষ্য করেছিলাম রাজধানী অটোয়া অবরোধকারী লরি চালক ও তাঁদের সমর্থকদের সঙ্গে হাত মিলাতে গিয়েছিলেন বর্তমান পার্লামেন্টে প্রধান বিরোধী দল কনজার্ভেটিভ পার্টি অফ কানাডার অন্তবর্তীকালীন প্রধান নেত্রী ক্যান্ডিস বার্গেন। অতিমাত্রায় রক্ষণশীল চিন্তা ভাবনার কিছু লোক ছাড়া বাকি সবাই সেদিন লরি চালকদের অবরোধ কান্ডে চরম তিক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। আর তাঁদের সঙ্গেই হাত মিলাতে গিয়েছিলেন ক্যান্ডিস।
এই লরি চালকদের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের একটি সুগভীর যোগসাজস রয়েছে যাঁরা সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতা ও সরকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে আসছেন। গ্লোবাল নিউজ এর এক প্রতিবেদনে এরকমই একটি ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যায়। ঐ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, লরি চালকরা যখন অটোয়া অভিমুখে যাত্রা শুরু করে তখন একটি লরিতে ‘কনফেডারেট’ পতাকা উড়াতে দেখা গেছে। এই কফেডারেট পতাকা হলো যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের প্রতীক। এন্টি-হেট বা ঘৃণা-বিরোধী বিশেষজ্ঞরা বলেন, লরি চালকদের মিছিলটি শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ও ইসলাম বিরোধীদের প্রতিনিধিত্ব করছে। আর এই মিছিলের যারা সংগঠক তাঁরাও সেই দলেরই।
‘কানাডিয়ান এন্টি-হেট নেটওয়ার্ক’ এর নির্বাহী পরিচালক ইভান বালগর্ড গ্লোবাল নিউজকে বলেছিলেন, ‘ অবরোধের সংগঠকরা প্রথম থেকেই অতি ডানপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। তাঁরা অতীতেও অতি ডানপন্থীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং ইসলাম বিরোধী মন্তব্যও করেছেন।’
স্মরণ করা যেতে পারে যে, ২০১৭ সালে ফেডারেল পার্লামেন্টে এন্টি-ইসলামোফোবিয়া প্রস্তাব পেশ করায় তখন এমপি ইকরা খালিদকে হত্যার হুমকী দিয়েছিলেন রক্ষণশীল চিন্তাভাবনায় বিশ^াসী হোয়াইট সুপ্রীমেসিস্টরা। অন্টারিও প্রভিন্সিয়াল পার্লামেন্টে এন্টি-ইসলামোফোবিয়া প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হলেও এই একই প্রস্তাব ফেডারেল পার্লামেন্টে পেশ করে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিলেন পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত লিবারেল এমপি ইকরা খালিদ। এই প্রস্তাব পেশ করায় তাঁকে হত্যার হুমকী দিয়ে ইমেইল পাঠানো হয়েছিল। সিবিসি নিউজ তখন জানিয়েছিল, এমপি ইকরা খালিদ এন্টি-ইসলামোফোবিয়া প্রস্তাব পেশ করার পর বিদ্বেষী মেইলের প্লাবন দেখা দেয় তাঁর ই-মেইলে। এর মধ্যে হত্যার হুমকীও আছে।
ইকরা খালিদ সেদিন বলেছিলেন, ইউটিউবেও তাঁর বিরুদ্ধে বিষোদগার করে বলা হয়েছে সে একজন জঙ্গী সমর্থক এবং নিদারুণ বিরক্তিকর ব্যক্তি। ঐ ভিডিওতে আরো বলা হয়েছে, ‘আমি তোমাকে গুলি করার জন্য তাঁদেরকে সহায়তা করবো না। তবে আমি সেখানে উপস্থিত থাকবো মাটিতে পড়ে তুমি যখন কান্না করবে তার ভিডিও করার জন্য। হ্যা, আমি সেখানে উপস্থিত থাকবো আমার স্টোরী লেখার জন্য মুখভরা হাসি নিয়ে। হা হা হা। একজন এমপি গুলি খেয়েছেন কানাডিয়ান একজন দেশপ্রেমীর হাতে।’
এমপি খালিদের প্রস্তাবিত মোশনটি ছিল সবরকমের বর্ণবাদ এবং ধর্মীয় বৈষম্য দূরীকরণ এবং ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা জানানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান।
কিন্তু এই প্রস্তাবটি পার্লামেন্টে পেশ করার পর এর বিরোধীতাকারী কনজারভেটিভ পার্টির এমপিগণ বলেছিলেন এটি কানাডায় স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য হুমকী হয়ে দাঁড়াতে পারে এবং দেশটিতে শরীয়া আইন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে দিতে পারে। তবে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, অন্টারিও’র পার্লামেন্টে এই একই ধরণের মোশন পাশ করানোর জন্য বিনা বাক্যব্যয়ে প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যরা ভোট দিয়েছিলেন।
সাম্প্রতিক সময়ে চরম ডানপন্থী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী লোকদের হাতে আরো কয়েকজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে হেনস্থার শিকার হতে দেখেছি আমরা। কিন্তু লক্ষ্যণীয় যে, হেনস্থার শিকার এই জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলের প্রায় কেউ-ই নেই। অবশ্য চরম বর্ণবাদী রাজনৈতিক দল পিপল’স পার্টি অফ কানাডা’র দলীয় প্রধান ম্যাক্সিম বার্নিয়ারের মাথায় গত বছর সেপ্টেম্বরে এক ব্যক্তি একটি ডিম ভেঙ্গেছিলেন। সাচকাচুয়ানে ঘটেছিল এই ঘটনা। তবে ঐ ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয় বা বিশ^াস কি ছিল তা জানা যায়নি। আর ম্যাক্সিম বার্নিয়ার তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে কোন নালিশও করেননি।
কানাডা বিশে^র মধ্যে একটি অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশ এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অতিমাত্রায় রক্ষণশীল চিন্তাধারায় বিশ^াসী ও শে^তাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা সেই গণতন্ত্রকে হুমকীর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন এ কথাও জোর দিয়েই বলা যায়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উপর হামলা করা, তাঁদেরকে বিব্রত করা, অপদস্থ বা নাজেহাল করা এগুলো গণতান্ত্রিক মন-মানসিকতার পরিচয় নয়। এই অবস্থার পরিবর্তন জরুরী। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারেরও উচিত হবে এদের বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ নেয়া। নয়তো পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ