তাসের আড্ডা-২৩
শুজা রশীদ
“ভাই, আরোও এক মাস পেরিয়ে গেল, অথচ ইউক্রেনের অবস্থার কোন পরিবর্তন হল না এখনও,” জালাল হাতের তাস তুলতে তুলতে মন খারাপ করে বলল। “রাশিয়া কি দেশটাকে একবারে ধ্বংস করে দেবার পায়তারা কষছে? অজাচারে বোমা মারছে। কত মানুষ মরছে তার কোন খবরও নেই। শহরে শহরে গণ কবর।”
আজ মঙ্গলবার রাত। রনির বাসায় ইফতার পার্টি। ইফতার পর্ব সারা হয়ে গেছে। একটু বিরতি দিয়ে ডিনার দেয়া হবে। যারা নামাজ পড়বার পড়ে এসেছে। লিভিংরুমে বসে আড্ডা চলছে। তাস খেলাও হচ্ছে।
রনি বলল, “এই যুদ্ধে পুটিন ইতিমধ্যেই হেরে গেছে-যা করতে এসেছিল তা করতে পারে নি। কিয়েফ দখল করতে পারে নি। ইউক্রেনে পুতুল সরকার বসাতে চেয়েছিল, হয় নি। এখন মুখ রক্ষা করবার জন্য বলছে যুদ্ধের প্রথম পর্যায় স্বার্থক হয়েছে, এবার দ্বিতীয় পর্যায়। রাশিয়ান মিলিটারি কমান্ডার মিন্নেকায়েভ তাদের পরবর্তি পদক্ষেপ সম্বন্ধে খানিকটা আঁচ দিয়েছে। তারা এখন ডনবাস থেকে মল্ডোভা পর্যন্ত একটা ল্যান্ড করিডোর সৃষ্টি করতে চায়। ফলে দক্ষিণ ইউক্রেনের উপর তাদের থাকবে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। ইউক্রেনের সমস্ত সমুদ্র সীমাও নিয়ন্ত্রন করবে তারা। এই ল্যান্ড করিডোর তাদেরকে ক্রিমিয়াতে যাবারও পথ করে দেবে। সব মিলিয়ে ইউক্রেন দখল করতে না পারলেও তার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে চায়। ”
জিত বলল, “মলদোভার ট্রান্সনিস্ট্রিয়া অঞ্চলে আরেকটা বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ আছে যারা অবশ্য এখন পর্যন্ত এই যুদ্ধে যোগদান করেনি যদিও সেখানে ১৯৯০ সাল থেকে রাশিয়ান একটা মিলিটারি বেস আছে।”
কবীর বলল, “পুটিন কি মনে হয় মল্ডোভাও আক্রমণ করবে?”
রনি বলল, “আমার তো ধারনা ওর প্ল্যান হচ্ছে ছোট ছোট দেশগুলোকে একে একে আক্রমণ করা। মল্ডোভাও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কিংবা নাটোর মেম্বার না, হবার তাদের কোন আগ্রহও নেই। তারা কোন দেশকে তাদের সীমানের মধ্যে অস্ত্র মজুদ করতে দেবে না। কিন্তু যদি সত্যি সত্যিই আক্রান্ত হয় তখন কি করবে কে জানে?”
সাইদ বলল, “কি আর করবে? আমেরিকার দিকেই তাকিয়ে থাকবে যদিও বলছে কারো সাহায্যের তাদের দরকার নেই। কিন্তু মুখে যাই বলুক, এই সব দেশই একে একে নাটোতে যোগ দেবে শুধুমাত্র রাশিয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য। মল্ডোভাতে আবার মানুষ জন অর্ধেক পশ্চিমাপন্থী, বাকী অর্ধেক রাশিয়াপন্থী।”
লাল ভাই কাষ্ট কন্ঠে বলল, “কবে যে এই সমস্যা মিটবে। সব কিছুর দাম বাড়ছে। তেলের দাম দুই ডলার হয়ে যাবে মনে হয়।”
জালাল বলল, “আপনি জিনিষপত্রের দাম নিয়ে ভাবছেন, ইউক্রেনে যে সব বর্বরতা চালাচ্ছে রাশিয়ান সৈন্যরা সেই সব দেখলে ভালো লাগে না। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক সেনারা যেমন করেছিল ঠিক একই রকম চলছে এখন ইউক্রেনে। মেয়েদেরকে ধর্ষনের পর হত্যা করে গণ কবরের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।”
সবাই কয়েক মুহুর্তের জন্য নিশ্চুপ হয়ে যায়। যে পরাশক্তিই করুক, যে স্থানেই করুক, নির্মমতার রূপ সব সময়েই এক। কোন যুক্তিতেই তাকে সমর্থন করা নীতিগত ভাবে সঠিক হতে পারে না।
এক হাত খেলা হবার পর সাইদ বলল,“ইলান মাস্কের কান্ডটা দেখেছ? টুইটার কিনে বসে আছে!”
জিত বলল, “ওর প্ল্যান যে কি বোঝা যাচ্ছে না। ৪৪ বিলিয়ন ডলার দিয়ে একটা সফটয়ার প্লাটফর্ম কিনেছে। বাংলাদেশের ২০২১-২২ সালের জাতীয় বাজেট ৭১ বিলিয়ন ডলার। চিন্তা করা যায়? শেয়ারের মার্কেটে যা দাম তার চেয়ে অনেক বেশী দাম অফার দিয়েছে ফলে কম্পানীর বোর্ড অব ডিরেকটরদের বিক্রী করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।”
কবীর বলল, “এতো টাকা তুলল কি করে? ওর নিজের কি এতো টাকা আছে?”
সাইদ হেসে বলল, “ওর টেসলা আর স্পেসএক্স আছে না! ওকে টাকা দেবার অভাব আছে। টেসলা থেকে ওর নিজের একুইটির ২১ বিলিয়ন দিচ্ছে আর বাকীটা ঋণ নিয়েছে টেসলা স্টেকের বিনিময়ে। বিভিন্ন ব্যাংকরাই দিয়েছে নিশ্চয়। এখন পর্যন্ত সব ব্যবসাতেই সফল হয়েছে। ফলে ওর উপর তাদের ভরসা আছে। যদিও টুইটারকে পাবলিক থেকে প্রাইভেটে নিয়ে গিয়ে কিভাবে সে ব্যবসা করবে সেটা দেখবার বিষয়। শুনছি তো বলছে নানা ধরনের পরিবর্তন করবে। তবে মোদ্দা কথা হল, তার নিজেরই রয়েছে ৮৪ মিলিয়ন ফলোয়ার। সে একটা কথা বললেও শেয়ার মার্কেটে ঝড় উঠে যায়। যদি ঠিক মত ব্যবহার করতে পারে তাহলে ওর হাতে থাকবে একটা মারাণাস্ত্র।”
রনি বলল, “ব্যাটা ফালতু ফ্রি স্পিচ – ফ্রি স্পিচ করছে। প্রথমেই ট্রাম্প আর ওর চ্যালা চামুন্ডা যারা টুইটারে মিথ্যাচার করছিল আর গুজব ছড়াচ্ছিল তাদেরকে ঢুকতে দেবে। এটা দেখা যাবে ডানপন্থীদের ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছড়ানোর প্লাটফর্ম হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যেই প্রচুর বামপন্থী মানুষ জন টুইটার ছেড়ে চলে যাচ্ছে।”
সাইদ বলল, “ফ্রি স্পিচ কি সেটা ও বোঝে বলে মনে হয় না। ওর ধারনা আইন বিরোধী কিছু না বললেই হল। কোন রকম সেন্সরশীপ করার প্রয়োজন নেই। মানুষ জন যদি মনে করে তারা সেন্সরশীপ চায় তাহলে সরকারকে বলবে নতুন আইন তৈরী করতে। এই জাতীয় কথাবার্তা থেকেই বোঝা যায় ব্যাবসায়িকভাবে সফল হলেই কেউ মননশীলতায় উন্নত হয়ে যায় না। আইন দিয়ে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা কখন যায়? প্রতিটা প্লাটফর্ম যদি কিছু সাধারণ নিয়ম নীতি না মেনে চলে তাহলে যে কেউ যা ইচ্ছা বলতে পারে, ঘৃণা এবং বিদ্বেষ ছড়াতে পারে, ভিত্তিহীন বিষয় নিয়ে ঝড় তুলে দিতে পারে। রনি তুমি ঠিকই বলেছ। মাস্কের হাতে পড়ে এটা হয়ে যাবে ডান পন্থীদের আখড়া। মার্জরি টেইলর গ্রিনের টুইটার ফলোয়ার ইতমধ্যেই ৬৫ হাজার বেড়ে গেছে। সেটা থেকেই খানিকটা আঁচ পাওয়া যায়। ।”
জিত বলল, “মাস্ক নিজেও কিছু কম যায় না। ইউ এস সেকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জের সাথে এখনও তো ওর কেস চলছে। ২০১৮ তে ইনভেস্টরদেরকে প্রভাবিত করবার জন্য মিথ্যে টুইট করেছিল টেসলাকে পাবলিক থেকে প্রাইভেট করবার মত ফান্ডীং ও নাকি জোগাড় করেছে। তারপর দুই পক্ষ একটা এগ্রিমেন্টে এসেছিল যে মাস্ক বিশেষ ধরনের টুইট করবার আগে সেকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জের উকিলদের অনুমতি নেবে। সেটা তার পছন্দ না। নভেম্বরে আবার টুইট করেছে, উকিলের অনুমতি না নিয়েই, সে টেসলাতে তার হোল্ডিঙয়ের একটা বিশাল অংশ বেঁচে দেবে।”
রনি বলল, “২০১৮ র ঐ ঘটনার পর টেসলার বোর্ডের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে আসতে হয়েছিল ওকে। যাই বলেন, ব্যাটা আসলে ধুরন্ধর। ”
লাল ভাই বলল, “ধুরন্ধর না হলে কি আর এতো টাকাপয়সা বানাইছে। কিন্তু এই টেসলা আর টুইটার নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই। আমি ইলেক্ট্রিক গাড়িও চালাই না, কখন টুইটও করি না। তবে একাউন্ট আছে। মাঝে মাঝে পুলিশ টুইট করে। সেগুলো বেশ কাজে দেয়। আচ্ছা, বাদ দেন এইসব টুইট-ফুইট। ঈদ তো আসছে। এবার আবার সোমবারে। সবার ছুটি নিতে হবে। আমার তো মনে হয় কানাডায় এখন এতো মুসলমান। ঈদতো সরকারী ছুটি হওয়া উচিৎ?”
রনি বলল, “সরকারী ছুটি হলে তো ভালোই হত। কিন্তু আমাদের খুঁটির জোর এখনও তেমন শক্ত নয়। শেষ সেনসাস অনুযায়ী কানাডাতে খ্রীষ্টান ছিল ৬৭ %, ধর্মহীণ ২৪% আর মুসলমান ৩.২%, হিন্দু ১.৫%, ইহুদী এবং বুদ্ধিস্ট ১% করে। কিন্তু প্রায় ১০% কানাডিয়ান দেশের বাইরে থাকে। অধিকাংশই তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যায়। সুতরাং মুসলমানদের মধ্যেও অনেকেই হয়ত এখানে থাকেই না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ৩% মানুষের জন্য কি পুরো একটা দিনকে সরকারী ছুটির দিন বলে ঘোষণা করা যায়?”
সাইদ বলল, “প্রত্যেক ঈদে এতো হিসাব কিতাব করতে ভালো লাগে না। যদিও ছুটি নেয়া যায় কিন্তু সব সময় আবার সেটা সম্ভব হয় না। অফিসে গুরুত্বপূর্ণ কিছু থাকলে তখন ছুটি নিতে খারাপ লাগে।”
কবীর বলল, “অধিকাংশ মানুষই ছুটি নিতে পারে না। রাতে প্রোগ্রাম করতে হয়।”
জিত বলল, “একটা পিটিশন হয়েছে দেখলাম। সেখনে ১৪০০০ ভোট পড়েছিল। এখন সেটা জাস্টিন ট্রুডোর অফিসে পাঠানো হয়েছে। আরেকটা এখন চলছে। আপনারা সবাই সেখানে গিয়ে সাইন করেন। দেখেন কি হয়?”
রনি বলল, “অধিকাংশ কম্পানীই ঈদের জন্য ছুটি দিতে সাধারণত পিছপা হয় না।”
জালাল তাস বাটতে বাটতে বলল, “আচ্ছা, একটা ভিন্ন বিষয় তুলছি। পাকিস্তানের ইমরান খান। ওর এই পরিণতির কারণ কি? মনে তো হচ্ছিল সব ভালোই যাচ্ছে। তাকে একেবারে ক্ষমতা থেকেই বের হয়ে যেতে হল কেন?”
রনি বলল, “মনে হচ্ছিল সে মোটামুটি সৎ ভাবে দেশ চালানোর চেষ্টা করছিল। তার হঠাৎ এই পরিনতি দেখে একটু অবাকই হয়েছি। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর পুটিনের সাথে এতো হাসাহাসি করাটা আদৌ বুদ্ধিমানের কাজ হয় নাই। পাকিস্তান আর্মি আমেরিকা ঘেঁষা, তাদের মনে হয় না ব্যাপারটা পছন্দ হয়েছে।”
সাইদ বলল, “পুরোটাই রাজনৈতিক। ইমরান খানের পার্টি তেহরেক-ই-ইসলাম কোয়ালিশোন করেছে আরোও ৭টা পার্টির সাথে। পার্লামেন্টে তার সাথে যারা আছে তারাই তার বিরুদ্ধে চলে গেছে এবং নো কনফিডেন্স ভোটে তাকে হারিয়ে দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের এই জাতীয় উদ্যোগের পেছনে আর্মির কোন হাত আছে কিনা। বিরোধী পার্টির মতে ২০১৮র ইলেকশনে ইমরান খান জিতেছিল পাকিস্তান মিলিটারির সমর্থনে। কিন্তু ইদানীং আর্মির কিছু পজিশনে নিয়োগ সংক্রান্ত ব্যাপারে তার সাথে আর্মির গোলমাল হয়েছে। বিশেষ করে ইন্টেলিজেন্স এজেন্সীর ডিরেক্টর পদ নিয়োগে চিফ অফ আর্মি স্টাফ কামার জাভেদ বাজোয়ার সাথে তার বেশ মন কষাকষি হয়। অনেকেই ধারনা করছে তার পর আর্মি তার পেছন থেকে সরে গেছে। পার্লামেন্টে কনফিডেন্স ভোটে হারাটা তারই ফল।”
জিত বলল, “পাকিস্তানের প্রধান দুই অপজিশন পার্টি পাকিস্তান পিপলস পার্টী এবং পাকিস্তান মুসলিম লিগ। তারা ইদানীং খুব জোরসে লেগেছিল ইমরান খানকে সরানোর জন্য। যেভাবে দেশ চালাচ্ছিল সেটা তাদের পছন্দ হয়নি। বিশ্ব বাজারে গ্যাস আর তেলের দাম বাড়ছে, কিন্তু সে ভর্তুকি দিয়ে মূল্য কমিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল। এতে পাকিস্তানের ডেফিসিট আরোও বেড়েছে, রুপির মান ঐতিহাসিকভাবে কমে গেছে ইউ এস ডলারের তুলনায়। পাকিস্তান স্টেট ব্যাংক ইন্টেরেস্ট রেট বাড়িয়ে দেয় হঠাৎ করে। সব মিলিয়ে জগা খিচুড়ি।”
সাইদ বলল, “কিন্তু দোষটা ইমরান খানের একার নয়। কিছু কিছু সমস্যা আগের থেকেই ছিল। ওর ভাগ্য খারাপ কিছু করবার আগেই ওকে ভাগিয়ে দিল ক্ষমতা থেকে।”
জালাল বলল, “এখন এসেছে নওয়াজ শরীফের ছোট ভাই শেহবাজ শরীফ। সে তো এসে শুনলাম সব নাকি ওলোট পালোট করে দিচ্ছে।”
রনি বলল, “সে তো পাঞ্জাবের চীফ মিনিস্টার ছিল বার তিনেক। তার বেশ খ্যাতি আছে কর্মঠ বলে। প্রথম দিন প্রাইম মিনিস্টার হিসাবে অফিসে এসেছিল সকাল ৭টায়। এসেই অফিসে কাজের সময় বাড়িয়েছে, কাজের দিনও করেছে ছয় দিন। সে নিজে যেমন খাটে বাকী সবাইকেও নাকি সেই রকম খাটিয়ে নেয়। দেখা যাক, পাকিস্তানের মানুষ কয় দিন এই সব বেয়াদপি সহ্য করে।”
সবাই হাসল। সাইদ বলল, “আমাদের ঐ সমস্ত এলাকায় সরকারী চাকুরেদেরকে দিয়ে বেশী কাজ করানো কতখানি সম্ভব সেটা নয়ে আমার সন্দেহ আছে। তবে সে পাঞ্জাবে বেশ সফল হয়েছিল। প্রচুর অভিজ্ঞতাও আছে সরকার পরিচালনায়। সুতরাং প্রধান মন্ত্রী হিসাবে সফল হতেও পারে। ইমরান খানের তো কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না। অনেক কিছু করতে চেয়েছে কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে সমর্থন পায়নি। যাইহোক, এই বছরের শেষের দিকে ভোট হবে। ইমরান খানের আবার ফিরে আসার সুযোগ আছে। যদিও আর্মি সমর্থন না করলে সেটা হবে কিনা বলা কঠিন। বিশেষ করে পাকিস্তানের ফরেইন পলিসি এক রকম আর্মিই নিয়ন্ত্রণ করে। ইমরান খানের বেশী খোলামেলা এটিচুড তাদের খুব একটা পছন্দ হচ্ছিল না। তারা আবার ওকে সমর্থন দেবে বলে মনে হয় না।”
জিত বলল, “ইমরান খানের কথা যখন উঠলই তখন একটা ছোট্ট জোক বলেই ফেলি। মুনমুন সেনের সাথে তার খুব দহরম মহরম ছিল সেটোতো সবাই জানেনই। ইমরান খানকে গভর্নমেন্ট থেকে বের করে দিয়েছে শুনে মুনমুন সেন নাকি বলেছে, ‘আমি জানতাম ও বেশীক্ষণ ধরে রাখতে পারবে না’।”
সবাই এক চোট হাসল।
বেলা টেবিলে খাবার দিচ্ছিল। লতা তাকে সাহায্য করছে। তারা হাসাহাসি শুনে এগিয়ে এলো।
“কি ঘটনা? এতো হাসির কি বললেন জিত দা?” বেলা জানতে চাইল।
“ইমরান খানকে নিয়ে কথা হচ্ছিল ভাবী।” জিত কাটিয়ে গেল।
বেলা চাপাচাপি করল না। বলল, “আপনারা ইন্ডিয়ান কোর্টের হিজাব সংক্রান্ত রায়টা দেখেছেন?”
জালাল বলল, “নাতো। খুলে বলেন তো একটু।”
বেলা বলল, “আপনি কিছুই শোনেন নি এই ব্যাপারে? ভারতের কর্নাটকায় উদিপি শহরে একটা সরকারী কলেজে মুসলিম হিজাব এবং বোরখা পরিহিত ছাত্রীদেরকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। কলেজ প্রিন্সিপাল বলেছে হিজাব কলেজের ইউনিফর্মের নিয়মের সাথে যায় না। সব ছাত্রীদেরকে একই ইউনিফর্ম পরতে হবে। মুসলিম ছাত্রীরা এই ব্যাপারে কোর্টে পিটিশন করে। হাই কোর্ট রায় দিয়েছে ইসলামে হিজাব এসসেনশিয়াল নয়। সুতরাং বিদ্যালয়ে মুসলিম নারীদের হিজাব না পরলেও সেটা ভারতের ধর্মীয় স্বাধীনতার কন্সটিটিউশনাল রাইটকে ভংগ করে না। শিক্ষার্থীদের যুক্তি ছিল ভারতের কন্সটিটিউশান অনুযায়ী মুসলিম নারীদের অধিকার আছে ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী ধর্ম পালন করবার।”
রনি বলল, “ভারতে মোদি সরকার এসে হিন্দু প্রথম নীতি করে এই জাতীয় সমস্যার সৃষ্টি করছে। কর্নাটকা হচ্ছে হিন্দু ন্যাশানালিস্ট ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার। এই সবের পেছনে তাদেরই কারসাজি।”
লাল ভাই বলল, “মুসলিম মেয়েরা যদি স্বেচ্ছায় বোরখা কিংবা হিজাব পরতে চায় তাহলে ভারতীয় সরকারের কেন সমস্যা থাকবে? এটা তো খুবই অন্যায়।”
সাইদ বলল, “ব্যাপারটা তো সরকারের সমস্যা হিসাবে বলা হচ্ছে না। স্কুল কলেজের নিজস্ব পোশাক থাকার নিয়ম আছে। তারা নিয়ম করছে যে সবাইকে সেই পোশাক পরেই আসতে হবে। ব্যাতিক্রম করা যাবে না। প্রশ্ন হচ্ছে এটা কি সত্যি সত্যিই পোশাক সংক্রান্ত নাকি তার চেয়েও অনেক বড় কিছু। ভারতে এখন উগ্রপন্থী হিন্দুদের অনেক দাপট। কেউ কেউ মুসলমানদেরকে হত্যা করবার হুমকি দিচ্ছে। এটা হচ্ছে মুসলমানদেরকে ছোট করে রাখার, তাদের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ধারাগুলোকে ধীরে ধীরে সমাজ থেকে সরিয়ে ফেলার একটা উদ্যোগ। কোর্ট যে রায় দিয়েছে সেটা কোন পরিপ্রেক্ষিতে দিয়েছে বলা কঠিন কিন্তু এটাও সত্য হিজাব পরার বাধ্য বাধকতা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে। বহু দেশেই এটাকে সাংস্কৃতিক প্রথা হিসাবে দেখা হয়। হয়ত কোর্ট সেই দিকটাই বিবেচনা করেছে।”
জিত বলল, “মাঝে মাঝে ভাবি, ধর্ম এসেছিল মানুষকে শান্তিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকতে সহায়তা করবার জন্য, স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করবার জন্য, তার উপাসনা করবার জন্য। কিন্তু আজ ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের কাছে একটা অস্ত্রের মত। একে ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে অনার্থক বিভেদ তৈরী করা হচ্ছে। ভারতে দশ কোটি মুসলমান থাকে। সেখানে এই জাতীয় ধর্ম ভিত্তিক বৈষম্যমূলক ঘটনা ঘটতে পারে বিশ্বাস করা যায়? কানাডাতে কত অল্প মুসলমান আছে কিন্তু এখানেও তো তার চেয়ে বেশী ধর্মীয় স্বাধীনতা আছে। জানি কুইবেকে কিছু নিয়ম কানুন হয়েছে সরকারী স্থানে ধর্মীয় পোষাক-আষাক পরার বিরুদ্ধে কিন্তু সেটা তো নিদেন পক্ষে সকলের জন্যই প্রযোজ্য।”
বেলা বলল, “আমার কথা হচ্ছে কেউ পরতে চাইলে কেন সরকার কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বাঁধা দেবে? তারা এখন নিয়ম কানুনের দোহাই দিচ্ছে কিন্তু কর্নাটকার মুসলমানেরা যারা বোরখা কিংবা হিজাব পরে তাদের কেউ কেউ অস্বঃস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। তারা যেখানে যায় সেখানেই সবাই তদের দিকে নাকি এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যে চিড়িয়া দেখছে। অথচ তাদের অনেকেই সারা জীবন ধরে পরে আসছে। এখন সেখানে নাকি অনেক মেয়েরাই স্কুল কলেজে যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে।”
রনি বলল, “আফগানিস্তানের চেয়ে অন্তত ভালো। সেখানে তো তালেবানেরা মেয়েদেরকে পড়াশুনা করতে দিতেই রাজী না।”
বেলা গম্ভীর মুখে বলল, “জানি। আমরা মেয়েরা যতই এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছি এক দল মানুষ ততই আমদেরকে পিছিয়ে দেবার চেষ্টা করছে, কখন ধর্মের নামে, কখন সংস্কৃতির বাহানায়। কবে যে এই চক্রের শেষ হবে কে জানে। যাই হোক, খেতে আসেন সবাই।”
জিত বল্ল,”ভাবী, এই প্রসঙ্গে ছোট্ট একটা জোক বলি।”
এক সাংবাদিক দ্বিতীয়বারের মত আফগানিস্তানে গেছে তালেবান সরকারের পতনের পর। প্রথমবার গিয়ে দেখেছিল স্ত্রীরা স্বামীদের চেয়ে দশ পা পেছন পেছন হাঁটে। এবার গিয়ে দেখল সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। স্ত্রীরা স্বামীদের চেয়ে দশ পা আগে আগে হাঁটছে। সে তো মনে মনে খুবই খুশী হল। ভাবল আফগানিস্তানের তাহলে বেশ উন্নতি হয়েছে। তার সঙ্গী স্থানীয় সাংবাদিককে প্রশ্ন করতে সে সংক্ষেপে উত্তর দিল, “তালেবানরা যাবার আগে চারদিকে ল্যান্ড মাইন পুতে গেছে। সেই জন্যই আর কি।”
শুজা রশীদ
কথা সাহিত্যিক ও কলামিস্ট
টরন্টো