মানুষের কথা

সাইদুল হোসেন

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

কিছু ঘটনা, কিছু কাহিনী

হাসপাতালের বেশ বড় একটা রুমে একটা Chapel (Prayer Room) আছে, রাতদিন ২৪ ঘন্টা সেটা খোলা থাকে। হাসপাতালের পেশেন্ট, এমপ্ল­য়ি অথবা ভিজিটর সে যেকোন ধর্মাবলম্বীই হোক না কেন সেই Chapel-এ সে আপন বিশ্বাস অনুযায়ী তার গডের কাছে প্রার্থনা জানাতে পারে। বেশ কিছু চেয়ার পাতা আছে, একটা stage-এর উপর চেয়ার-টেবিলও পাতা রয়েছে আলোচনার সুবিধার্থে। একটা ছোট টেবিলে রাখা আছে কিছু বাইবেল, কিছু কুরআন ও ইসলামী বই, আছে সেখানে হিন্দুদের গীতা-ও। আরো আছে দু’টি কার্পেটের জায়নামায, মুসলিম মহিলাদের নামায পড়তেও দেখেছি সেখানে। মুসলিমদের জন্যে কিবলা (Qibla) ও নির্দেশ করা রয়েছে। হাসপাতালের স্টাফের অনেকেই তাদের নিজ নিজ অফিসে কাজ শুরু করার আগে Chapel-এর ভেতরে ঢুকে অথবা দরজাতে দাঁড়িয়েই বুকে Cross এঁকে নেয়। এক গায়ানীজ হিন্দু মহিলাকে নিয়মিতই দেখি Chapel-এর কার্পেটের উপর পদ্মাসনে বসে চোখ বুঁজে ডাইনে-বামে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তার আংগুলে হিসাব রেখে ভগবানের নাম জপ করছে। সেই মহিলার সংগে হাসপাতালের ভেতরেও মাঝেমধ্যে দেখা হয়, হাই-হেল্লো হয়।

সেই মহিলা একদিন আমাকে বলল  : আপনার সংগে আমি একটা বিষয়ে পরামর্শ করতে চাই।

বললাম : কি সেই পরামর্শ?

মহিলা : এক মুসলিম ভদ্রলোক আমাকে বিয়ে করতে চায়, আমিও তাকে পছন্দ করি। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে আমি কিছু পড়াশুনাও শুরু করেছি। এই বলে সে তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা বই টেনে বের করল, বইটার নাম ISLAM: A Brief Outline . (কুরআন ও ইসলামী বই আমিও নিয়মিত Chapel-এ donate করে থাকি)। হেসে বললাম : বইটা আমার লেখা। শুনে সে বললো : তবে তো আরো ভালো হলো। এখন আমার সমস্যাটা বলি।

লোকটাকে বিয়ে করতে আমার কোন আপত্তি নেই, he is a good guy. কিন্তু সে বলছে যে তাকে বিয়ে করতে হলে আমাকে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে, কালিমা পড়ে মুসলিম হতে হবে। নামায-রোযা ইত্যাদি করতে হবে। আমি তা করতে রাজী নই। ভালোবাসা এবং বিয়ের সংগে ধর্মের যোগাযোগ থাকবে কেন? আমি হিন্দুই থাকতে চাই, আমার ধর্মকর্ম আমি করে যেতে চাই। তাতে তার স্ত্রী হতে বাধাটা কোথায় একটু বুঝিয়ে বলবেন, প্ল­ীজ?

আমি বললাম : ইসলাম ধর্মের বিয়ে-শাদীর বিধানটা হলো এই যে একজন মুসলিম পুরুষ একজন খৃষ্টান অথবা ইহুদি নারীকে ধর্মান্তরিত না করে, ইসলাম ধর্মে দীক্ষা না দিয়েও বিয়ে করতে পারে তবে আগে ইসলামের শাহাদাহ পড়িয়ে পরে বিয়ে করাটাই প্রচলিত রীতি। কিন্তু অন্য ধর্মাবলম্বী নারীদের বিয়ে করতে হলে সেই নারীকে বিয়ের আগে অবশ্যই কালিমা পড়িয়ে, ইসলাম ধর্মে তার ঈমানের (দৃঢ় আন্তরিক বিশ্বাসের) প্রমাণ স্বরূপ শাহাদাহ গ্রহণ করিয়ে মুসলিম বানিয়ে তবে তাকে বিয়ে করতে হবে। এবং সেই শাহাদাহ গ্রহণ করার প্রমাণ স্বরূপ কোন মসজিদের ইমামের অফিস থেকে একটা সার্টিফিকেটও নিতে হবে। তা না হলে সেই বিয়ে ইসলামী শারীয়ত অনুসারে অসিদ্ধ, অগ্রহণযোগ্য।

সব শুনে সে বললো : তাহলে তো বিষয়টা বেশ জটিল। ভেবে দেখতে হবে ভালো করে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

(দুই)

Angela ইটালিয়ান মেয়ে। বিবাহিতা। বেশ হাসিখুশী মেজাজের, helpful nature এর মেয়ে। এক multicultural assistance agency-তে ভলানটিয়ার হিসেবে কাজ করার সময় ওর সংগে পরিচয় হয়েছিল ৫-৬ বছর আগে। আমাকে খুব পছন্দ করতো Angela. সেই agency ছেড়ে দেয়ার পর ওর সংগে আর দেখা হয়নি। ২০১২ সনের মার্চ মাসে হাসপাতালের Fracture Clinic-এ হঠাৎ করে আবার দেখা। আমাকে দেখে খুব খুশী। আমার পেছনের চেয়ারে বসে অনেকক্ষণ ধরে অতীত-বর্তমানের নানা গল্প শোনালো। এক পর্যায়ে জিজ্ঞাসা করলাম : ইতিমধ্যে মা হয়েছ নিশ্চয়ই?

মলিন মুখে বলল : নাহ! আর হলাম কই! ডাক্তার বলছে আমরা স্বামীস্ত্রী দুজনেই নরমাল, আমার pregnant হওয়াতে কোন সমস্যা নেই, কিন্তু অবিরাম চেষ্টা চালিয়েও তো আগের মতই নিষ্ফলাই রয়ে গেলাম আজো! এদিকে বয়সতো ৩৫ ছাড়িয়ে ৪০ এর দিকে ধাওয়া করেছে।

সন্তান কোলে আত্মীয়া ও বান্ধবীদের দেখলে নিজেকে বড় অভাগিনী বলে মনে হয়। কখনো কখনো মনে ঈর্ষাও জাগে ওদের সৌভাগ্য দেখে। আমার হাজব্যান্ড যদিও এনিয়ে আমাকে কোন গঞ্জনা দেয় না তথাপি নিজেকে একজন good for nothing wife এবং অপরাধী বলে মনে হয় সব সময়। বলে ছোট্ট একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো  Angela.

(তিন)

২০১০ সাল। টরন্টো শহরের ড্যানফোর্থ এভিনিউতে একটা মসজিদের সামনে একটা টেবিল পেতে বই বিক্রি করছিলাম একদিন। সবই ইসলামী বই- বাংলা, আরবী ও ইংরেজী। এমন সময় টুপি মাথায় ছোট একটি ছেলে এসে একটা আরবী বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে আমাকে বলল : ‘এই বইখান আমি buy খরতাম ছাই, frice খত?’

বললাম : দুই ডলার মাত্র।

পাশে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোক বললেন : ওর বড় ভাইটা ১৩-১৪ বছর বয়স, হাফীযে কুরআন হয়েছে।

সেই ছেলেটাকে বললাম : তোমার বড় ভাই কুরআন হিফয করেছে শুনে খুব খুশী হলাম। তুমিও কি কুরআন হিফয করতে চাও? তোমার ভাইয়ের উস্তাদ কে? তোমার বয়স কত?

সে বলল : ‘আমার বয়স এখন আট অইছে। আমার বা-ই (ভাই) আমার আম্মার খাছে খুরান memorize র্খছে। আম্মাও খুরান memorize র্খছে। আমি তিন ফারা memorize র্খছি।’

এই প্রসংগে মনে পড়ে গেল যে ২০০৯ সনে অন্য একটি মসজিদে একটি অল্পবয়সি (১০-১১) সোমালী ছেলে সংগে দেখা এবং আলাপ হয়েছিল। সেও জানিয়েছিল যে ওর মা হাফীযে কুরআন এবং ওরা দুই ভাই ওদের মায়ের তত্ত্বাবধানে কুরআন হিফ্য করে যাচ্ছে- সে আছে ৮ পারাতে, ওর বড় ভাই ১৭ পারাতে।

(চার)

২০১২ সাল। বই বিক্রি করছিলাম এক মেলাতে বসে বসে। একজন ৩০-৩২ বছর বয়সী ভদ্রলোক এসে আমার কাছ থেকে কিছু বই কিনলেন, সংগে তার বৃদ্ধা শাশুড়ি। মূল্য পরিশোধ করে তারা চলে গেলেন। অল্পক্ষণ পর সেই বৃদ্ধা ফিরে এলেন, আমাকে বললেন : আপনি তো ইসলামী বইপত্র লেখেন, বিক্রি করেন, ইসলাম ধর্মে আপনার ‘ইলিম’ আছে। আপনি আমার একটু উপকার করবেন?

আমার মেয়ে অথবা জামাই কেউই নামায-রোযার ধার ধারে না, ধর্মকর্মে ওদের কারোই কোন উৎসাহ নেই। আমি ওদের বারবার তাগাদা দিই নামায-রোযা করার জন্যে, কুরআন শরীফ পড়ার জন্যে। এতে ওরা আমার উপর খুবই বিরক্ত। তবু আমি বলা বন্ধ করিনি, বলেই যাচ্ছি। এখন ওরা আমাকে ভয় দেখাচ্ছে যে যদি আমি নামায-কালাম নিয়ে নিয়ে বারবার তাগাদা দেয়া বন্ধ না করি, তাহলে ওরা আমাকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবে! বলুন তো, আমি অন্যায়টা কি করলাম? তোমরা মুসলমান হয়ে জন্মগ্রহণ করেছ অথচ তোমরা আল্ল­াহ-রাসূলের নাম শোনালে বিরক্ত হও, রাগ কর, আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার ভয় দেখাও, এটা কেমন কথা? তোমাদের কি মরণের ভয় নাই?

আপনি ওদের ডেকে এনে একটু বুঝিয়ে বলুন যে আমি তো অন্যায় বা অন্যায্য কোন কথা বলছি না। ওরা যেন আমাকে দেশে ফেরত না পাঠায়। আমি বিধবা মানুষ, দেশে পাঠালে আমাকে দেখবে কে?

সাজিদের বিয়ে

সাজিদ কিছুতেই রাজী হলো না ফরিদাকে বিয়ে করতে বরং প্রস্তাবটা সে নাকচ করে দিল আলোচনার শুরুতেই।

তোমার এ বিয়েতে আপত্তিটা কোথায়? জানতে চাইলেন ওর বাবা রাইহান চৌধুরী। মা আমিনা বেগমও উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকালেন।

ফরিদা আমার চাচাতো বোন; ওর দেহে এবং আমার দেহে একই রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। সে তো আমার ছোট বোনের মত। ওকে আমি বিয়ে করি কেমন করে? তাছাড়া আজীবন চেনাজানা একজন পুরুষ অথবা নারীকে স্বামী অথবা স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার মাঝে নূতনত্বই বা কোথায়? বলল সাজিদ।

কাজিনদের মাঝে বিয়ে তো মুসলিম সমাজে নূতন কিছু নয়, এমনটাতো যুগযুগ ধরে চলে আসছে, বললেন ওর বাবা।

একটা প্রথা চলে আসছে বলেই বিনা বিচারে সেটাকে মেনে নিতে হবে এটা খুব একটা জোরালো যুক্তি বলে আমি মনে করি না, বাবা। আমার তো মনে হয় এই প্রথাটা চালু করা হয়েছিল নিজেদের পারিবারিক সম্পত্তি যাতে পরিবারের হাতেই সীমাবদ্ধ থাকে সেই উদ্দেশ্যে, বাবা-মার সম্পত্তি যেন তাদের অবর্তমানে ওয়ারিস সূত্রে বিবাহিত মেয়েদের হাতে অন্য পরিবারে চলে না যায়, এই ছিল মূল উদ্দেশ্য। তাছাড়া অনাত্মীয় পরিবারে ছেলের জন্যে বউ এবং মেয়ের জন্যে জামাই খোঁজার কষ্ট এড়ানোটাও ছিল অপর একটা কারণ, থামল সাজিদ।

রাইহান চৌধুরী : ধরে নিলাম তোমার কথায় যুক্তি আছে কিন্তু শুধু এগুলোই কি তোমার আপত্তির কারণ?

সাজিদ : না, আরো আছে। প্রচলিত এই প্রথায় ছেলেমেয়ের রুচি-পছন্দের কোন মূল্য দেয়া হয় না। বিয়েটা পারিবারিক স্বার্থে ছেলেমেয়েদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়। মা-বাবা অথবা গার্ডিয়ানের উপর নির্ভরশীল ছেলেমেয়েরা অসহায়, তাই ওরা এই ধরনের জবরদস্তিমূলক বিয়েটা নিরুপায় হয়ে মেনে নেয়। এটাকে আমি এক ধরনের অত্যাচার বলে মনে করি। যুগ বদলে গেছে, মানুষের শিক্ষায়, ব্যবহারে, চিন্তাধারায় আমূল পরিবর্তন এসেছে, তাই মা-বাবা ও গার্ডিয়ানদেরও ধারণা, ব্যবহার এবং সিদ্ধান্ত বদলানো প্রয়োজন। তবে ছেলেমেয়েরা যদি আপত্তি না করে অথবা একে অন্যকে পছন্দ করে, ভালবেসে বিয়ে করতে চায়, তাহলে অবশ্য বলার কিছু নেই।

সাজিদের কথা শুনে হেসে দিয়ে বাবা বললেন, তুমি কি তাহলে বলতে চাও যে আমরা তোমাদের দু’জনের উপর অত্যাচার করছি?

আমিনা বেগম এবার মুখ খুললেন। বললেন, আমরা যে ফরিদার বাবামাকে কথা দিয়ে ফেলেছি তার কি হবে?

সাজিদ এবার একটু উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলো, তোমরা তো দেখছি আমার পছন্দ-অপছন্দ বা ইচ্ছা -অনিচ্ছার খোঁজ না নিয়েই ফরিদার সংগে আমার বিয়ে পাকা করে ফেলেছ! আশ্চর্য লাগে ভাবতে, এটা তোমরা কি করে পারলে! আমি তোমাদের এক উচ্চ শিক্ষিত ছেলে, ভাল বেতনের একটা চাকরিও করছি। তোমাদের উপর মোটেই নির্ভরশীল নই। তোমাদের বাড়িতে থাকি বটে কিন্তু বিয়ের পর ওয়াইফকে নিয়ে আলাদা বাড়িতে অথবা এপার্টমেন্টে উঠে যাবো। তোমাদের সংগে যোগাযোগ অবশ্যই বজায় রাখবো, আমি তোমাদের অকৃতজ্ঞ সন্তান নই। কিন্তু আমার ইচ্ছা বা পছন্দেরও তো মূল্য দিতে হবে তোমাদের, থামলো সাজিদ।

শুনলাম তো সবই। তোমার আর কোন বক্তব্য আছে? জানতে চাইলেন চৌধুরী সাহেব।

আছে, বলল সাজিদ।  Close cousin-দের মাঝে বিয়ে হলে তাদের দু’জনের রক্তে একই genes (জীন্স) থাকাতে তাদের সন্তানেরা বিকলাঙ্গ হয়ে অথবা অন্য ধরণের দৈহিক ও মানসিক সমস্যা নিয়ে জন্মাতে পারে, learning disabilities-এ ভুগতে পারে, হাবাগোবা হয়ে জন্মাতে পারে, কেউ কেউ ক্রমশঃ অন্ধও হয়ে যেতে পারে, এ ধরনের দৃষ্টান্ত বহু পরিবারেই আছে। ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের ছেলেমেয়েদের মাঝে বিয়ে হলে ওদের জীন্স ভিন্ন থাকে বলে ওদের সন্তানেরা তুলনামূলকভাবে অধিকতর স্বাস্থ্যবান ও বুদ্ধিমান হয়। মেডিকেল সাইন্স এসব কথা প্রমাণ করেছে। তাছাড়া দুটি অপরিচিত পরিবারের মাঝে বিয়েটা হলে একটা নূতন আত্মীয়তার বন্ধনও গড়ে উঠে। শেষ করলো সাজিদ।

সাজিদের কথা শেষ হলে রাইহান চৌধুরী জানতে চাইলেন, তুমি যে ফরিদাকে বিয়ে করতে রাজী নও সেকথা কি সে জানে?

জানে, জানালো সাজিদ। এ বিষয়ে আমাদের দু’জনের মাঝে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। আমরা বর্তমানে যেমন ভবিষ্যতেও তেমনি ভাইবোনই থাকতে চাই, স্বামীস্ত্রী হিসেবে নয়। ফরিদাও তো ইউনিভার্সিটি পাস করা মেয়ে, ওরও তো নিজস্ব রুচি-পছন্দ কিছু একটা থাকতে পারে একথাটাও তো ভুলে গেলে চলবে না, থামলো সাজিদ।

ছেলের স্পষ্ট মতামত ও সিদ্ধান্ত শুনে মা আহত দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চৌধুরী সাহেব নিজেও ব্যাপারটা খুব সহজভাবে গ্রহণ করেছেন বলে মনে হলো না। চেয়ার ছেড়ে উঠে বেডরুমের দিকে পা বাড়ালেন তিনি।

বাংলাদেশী সংস্কৃতি

বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে বিভিন্ন আদিবাসী ছাড়াও হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ এবং খৃষ্টান এই চারটি ধর্মের লোকের বাস। প্রতিটি ধর্মেরই নিজস্ব ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান রয়েছে। যথা মুসলিমদের রোযার ঈদ, কুরবানীর ঈদ, মিলাদুন্নবী; হিন্দুদের রয়েছে দেবদেবীর পূজা, হোলি, দিওয়ালি, নাচগান-বারো মাসে তেরো পার্বণ; বৌদ্ধদের বৈশাখী পূর্ণিমা এবং খৃষ্টানদের ইষ্টার, গুড ফ্রাইডে, Christmas। কিন্তু এসব তো হলো তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ধর্মীয় সংস্কৃতি।

অন্যদিকে দেশ বা জাতির ধর্মীয় সংস্কৃতির বাইরেও জনসাধারণের স্বতস্ফুর্ত আনন্দ ও মনোরঞ্জনের জন্যে অন্য ধরনের বহু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও প্রচলিত আছে, যেমন আছে পৃথিবীর অন্যান্যদেশেও। বাংলাদেশ একটি পুরাতন দেশ, প্রাচীন হিন্দু ভারতের বিশিষ্ট একটি অংশ, তাই এই দেশের ঐতিহ্যও (tradition) অতি প্রাচীন যাতে দেশের জনসাধারণ অস্তিমজ্জায় নিমজ্জিত। বছরের বিভিন্ন সময়ে/ঋতুতে নারীপুরুষের সম্মিলিত নাচগান-সঙ্গীত, অভিনয়, বাংলা ভাষার চর্চা, নাটক, কথকতা, কবিগান, নববর্ষ বরণ, নৌকাবাইচ, মেলা, ভেড়ার/ষাঁড়ের/মোরগের লড়াই, বাঁদর নাচ,পুতুল নাচ, পুঁথিপাঠ, বসন্ত উৎসব ইত্যাদি। আধুনিক কালে সিনেমাও একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এসব হচ্ছে বাঙালী জাতির রুচির এবং বিকাশের একটি পরিচয়। ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে দেশে বিদেশে আমাদের যে পরিচিতি সেটা হলো জাতিগতভাবে (ethnically) আমরা বাঙালী, আমাদের একটি ভিন্ন জাতীয় পরিচয় বা identity রয়েছে, একটি আলাদা ঐতিহ্যের ধারা ও কৃষ্টি রয়েছে যা হাজার হাজার বছরের পুরানো দেশজ/লোকজ ঐতিহ্য ও কৃষ্টি, যা অন্যান্য দেশ অথবা জাতির ঐতিহ্য ও কৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে বিভিন্ন আদিবাসী ছাড়াও হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ এবং খৃষ্টান এই চারটি ধর্মের লোকের বাস। কিন্তু তা সত্বেও তাদের লোকসংস্কৃতি প্রায় এক। এরকমই এক লোকসংস্কৃতি হলো নৌকা বাইচ। শত শত বছরের ঐতিহ্য হিসাবে এখনো টিকে আছে এটি। ছবি: বিডিনিউজ২৪.কম

সংস্কৃতির বাংলা প্রতিশব্দ হলো কৃষ্টি যার অর্থ কোন জাতির/দেশের/সমাজের অনুশীলনদ্বারা লব্ধ বিদ্যাবুদ্ধি, রীতিনীতি ইত্যাদির উৎকর্ষ (ভারতীয় সংস্কৃতি,বঙ্গ সংস্কৃতি)। ভাষা, পোশাক, খাদ্য, ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, সমাজে প্রচলিত ও আচরিত রীতিনীতি, ভাবের আদানপ্রদানের ভংগী সব কিছুই এই সংস্কৃতির আওতায় পড়ে। ইংরেজীতে একে বলা হয়  culture, practice, tradition and refinement, কখনো বা civilization।

বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বাসভূমি বাংলাদেশের সংস্কৃতিটা তাই একটি মিশ্র সংস্কৃতি যাতে দেশবাসী হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃষ্টান সবারই অবদান রয়েছে, কারণ শতশত বছর ধরে এই ভূমিতে সবার বাস যার ফলশ্রুতিতে একে অন্যেরটার কিছু গ্রহণ কিছু বর্জন করে সাংস্কৃতিকভাবে সবাই একাত্ম হয়ে গেছে। সবাই হয়ে গেছে বাঙ্গালী।

কোন দেশের বিশেষ কোন ধর্মীয় সংস্কৃতি (religious culture and tradition) এবং দেশবাসী বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের আবহমান কালের অনুসৃত সম্মিলিত ও জাতিগত

বিনোদনমূলক ও শিক্ষামূলক সংস্কৃতি (ethnic culture) সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি জিনিস এবং একই দেশে এই দুই ধরনের সংস্কৃতির সহাবস্থান অস্বাভাবিক নয়।

উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে যে আরব দেশগুলোতে তাদের ধর্ম ইসলাম হওয়া সত্বেও সেখানে নাচগান, সঙ্গীত অতি জনপ্রিয় বিনোদনমূলক সংস্কৃতি হিসেবে প্রচলিত। এমনকি সেখানে নারীদের belly dance অবাধে প্রদর্শিত হচ্ছে। পৃথিবীর সর্বাধিক মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়াতেও ইসলামী সংস্কৃতির পাশাপাশি জাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে মিশ্র সংস্কৃতি প্রচলিত রয়েছে।

একটি জাতির কালচারের প্রধান পরিচয় হলো তার ভাষা, তারপর তার পোশাক, তারপর তার খাদ্য ও খাদ্যাভাস। আমাদের ভাষা বাংলা প্রাচীন সংস্কৃত ভাষা থেকে উদ্ভুত যেমন ভারতের গুজরাটি, তামিল, হিন্দি, মারাঠি, মালয়ালম ইত্যাদি। হিন্দি ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার প্রচুর মিল, শুধু দুই ভাষার উচ্চারণ ভংগীটা সম্পূর্ণ ভিন্ন যদিও শব্দগত বানানের ধারাটা প্রায় একই। বহু শতাব্দী মুসলিম শাসনের অধীনে থাকার কারণে আরবী, উর্দু,ফার্সী ও তুর্কি ভাষার অসংখ্য শব্দ বাংলা ভাষা গ্রহণ করে নিয়েছে (যার সংখ্যা ৬ হাজারের কাছাকাছি)। হিন্দি ভাষাও সেগুলো গ্রহণ করে আপন করে নিয়েছে। ফলে নিজেদের ভাষা না হওয়া সত্ত্বেও বাঙালীরা অতি সহজেই হিন্দি ভাষাটা বুঝতে পারে, এবং ভুলে ভরা হলেও খানিকটা বলতেও পারে। ভারতীয় হিন্দি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তা তাই বাঙালীদের মাঝে খুব লক্ষ্যণীয়। হিন্দি চলচ্চিত্র দেখা তাই বাঙালীদের  একটি ট্রাডিশন ১৯৩০ দশকে ইন্ডিয়ার বোম্বেতে সবাক চলচ্চিত্র প্রচলন হওয়ার যুগ থেকেই যার ধারা আজো অব্যাহত রয়েছে।

বাঙালীদের জাতীয় কোন পোশাক নেই যদিও লুংগী, গেঞ্জী, শার্ট সবাই পরে থাকে। হিন্দুরা ধুতি পরেন, তবে সেটা পশ্চিম বঙ্গে, বাংলাদেশে ধুতির প্রচলন উঠে গেছে বললেই চলে। শার্ট-প্যান্টই শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব বাঙালীরই পোশাক এখন, যদিও নারীদের বেলায় শাড়ি-ব্লাউজ সমান প্রতাপে বিরাজমান।

এখানে লুংগী সম্বন্ধে একটু বলা দরকার। বাংলাদেশে লুংগীর আগমন ঘটেছে বার্মা মুল্লুক থেকে, লুংগী বার্মার জাতীয় পোশাকের  বিশিষ্ট একটি অংশ। ওদেশে এটার নাম ‘লাউন্জি’- এই কথাটাই বাংলা ভাষায় লুংগীতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। একই লুংগী ইন্দোনেশিয়াদেরও জাতীয় পোশাকের অংশ- ওদেশে এর নাম সারং (sarong)। ভারত এবং শ্রীলংকার তামিলদেরও পোশাকের অংশ এই লুংগী। তামিল ভাষায় এর নাম সারম (sarom), যদিও একই সংগে লুংগী কথাটাও প্রচলিত আছে।

আমরা বাঙালীরা মাছের ভক্ত, তাই বিগত পাকিস্তানী আমলে উর্দুওয়ালারা আমাদের বলত ‘মছলিখোর বাঙালী’। কিন্তু আমাদের মাছ-প্রীতি যে সুদূর ইরান মুল্লুকেও সুবিদিত তার প্রমাণ পেলাম ২০০৯ সনের জুন মাসে। যে হাসপাতালে ভলানটিয়ারিং কাজ করি, সেখানে। এক ইরানী পেশেন্ট ও তার দুই সংগিনীর সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ে যেই বললাম যে আমি একজন বাংলাদেশী, সেই তক্ষুনি এক তরুণী তার সুন্দর হাসিভরা মুখটি তুলে বললো : You Bangladeshis love fish so much, is it right?

আমি বললাম : Yes, madam, we do.

আমাদের প্রিয় খাদ্য মাছটিকে মুবারকবাদ জানাতে হয় : মছলি জিন্দাবাদ!!!

সাইদুল হোসেন

মিসিসাগা