কানাডায় পিছিয়ে পড়ছে খ্রীষ্ট ধর্মালম্বীদের সংখ্যা

বাড়ছে মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মালম্বীদের সংখ্যা

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : কানাডায় ধার্মিকতা সর্বকালের নিম্নে নেমে এসেছে। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার সম্প্রতি প্রকাশিত উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের মাত্র ৬৮ শতাংশ কানাডীয় ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা ১৯৮৫ সাল থেকে এ বিষয়টি অনুসরণ করতে শুরু করার পর এই প্রথম সংখ্যাটি ৭০ শতাংশের নিচে নেমে গেল।

জেনে রাখা জরুরি যে, এই ক্রমাবনতি সব ধর্মের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়; মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ ও হিন্দুর সংখ্যা বাড়ছে। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার পূর্বাভাস অনুযায়ী, অখ্রীষ্টিয় ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত কানাডিয়ানদের সংখ্যা ২০৩৬ সালের মধ্যে দ্বিগুণ হতে পারে। গত জানুয়ারীতে গ্লোবাল নিউজ এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, খ্রীষ্ট ধর্মালম্বীদের সংখ্যায় আসলেই বড় ধস নামছে। ২০১১ সালে ৬৭.৩ শতাংশ (প্রায় দুই কোটি ২১ লাখ) কানাডিয়ান বলেছিলো, তারা কোনও একটি খ্রীষ্টিয় ধর্মমতের সঙ্গে যুক্ত। ২০১৯ সালে সেই সংখ্যাটি কমে দাঁড়ায় ৬৩.২ শতাংশে। কানাডার বৃহত্তম ধর্মীয় সম্প্রদায় ক্যাথলিক খ্রীষ্টবাদ। এই মুহূর্তে ১৫ বছরের বেশি বয়সী কানাডিয়ানদের ৩২ শতাংশ এই ধর্মমতের অনুসারী। ১৯৯৬ সালেও এই ধর্মমতে বিশ্বাসীর সংখ্যা ছিল ৪৬.৯ শতাংশ।

এর চেয়েও বেশি অনিশ্চিত অবস্থা দেখা যাচ্ছে ইউনাইটেড চার্চ অব কানাডা এবং অ্যাংলিকান চার্চের পতনে।

২০২১ সালে যিশু খ্রীষ্টের জন্মতিথি বা ক্রিসমাসের মৌসুমে প্রথম রবিবার ছিল ২৮ নভেম্বর যেদিন টরন্টোতে প্রথম তুষারপাত শুরু হয়।

ওইদিন নগরীর ট্যাডল ক্রিক ওয়াইল্ড চার্চের ওয়েবার গ্রিল ঘিরে সমবেত হন মাত্র ছয় জন মানুষ। অথচ ঐতিহ্যবাদী রবিবারের ধর্মসভার চেয়ে এখানে ধর্মসভার আয়োজন অনেক বেশি আধুনিক ও প্রকৃতি-নির্ভর।

এটি একটি পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসাবে এক ঘণ্টা আগে অনুষ্ঠিত রবিবারের প্রচলিত ধর্মীয় সমাবেশের চেয়ে অনেক কম মানুষকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। তবে সেই রবিবারের ধর্মসভায়ও উপস্থিতি ছিল টেনেটুনে ৫০ জনের মত। গুহার মত সেই গির্জায় প্রতি সারিতে দুই থেকে তিনজন মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিলেন।

তবে ইউনাইটেড চার্চ অব কানাডার সদস্য সংখ্যা বেশ কয়েক দশক ধরেÑ তুষার ঝড় বা বৈশ্বিক মহামারি শুরুর অনেক আগে থেকেই কমছিলো।

প্রতি সপ্তাহে একটি করে গির্জা হারিয়ে যাচ্ছে

গ্লোবাল নিউজ জানায়, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সম্প্রদায় ইউনাটেড চার্চ অব কানাডার অনুসারীরা। ১৯৮৫ সালে এই সম্প্রদায়ের অনুসারী ছিল ১৪.৬ শতাংশ কানাডিয়ান। ১৯৯৬ সালে সেই সংখ্যা ৯.৭ শতাংশে এবং ২০১৯ সালে মাত্র ৩.৮ শতাংশে নেমে আসে।

লন্ডন অন্টারিওতে অবস্থিত ১৪৩ বছরের পুরানো এই Trinity Anglican Church-টি সম্প্রতি বিক্রি হয়ে যায়। স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা চার্চটি কিনে নেন। বর্তমানে এটি সেন্ট থমাস ইসলামিক সেন্টার নামে পরিচিত। ছবি: গুগুল স্ট্রিট ভিউ

ইউনাইডেট চার্চ অব কানাডার একজন সম্মানিত ধর্মগুরু জেসন মেয়ারস বলছেন, প্রতি সপ্তাহে ইউনাইটেড চার্চ সম্প্রদায়ের গড়ে একটি করে গির্জা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তিনি ধারণা করছেন এই প্রবণতা আরও দ্রুততর হবে।

তিনি স্বীকার করেন যে, অনেক মানুষ ধর্মীয় শিক্ষা নিয়েই বেড়ে ওঠে, কিন্তু পরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তবে অনেকে জীবনের পরের দিকে তার নিজের ইচ্ছাশক্তির দিকে ফিরে আসে। জেসন মেয়ারস নিজে তেমনটিই করেছেন। দাম্পত্যজীবন ভেঙ্গে যাবার পর বয়স যখন ত্রিশ-এর কোটায় তখন তিনি গির্জায় ফিরে আসেন।

এ কারণেই, তিনি বলেন, সদস্য সংখ্যা কমতে থাকলেও ইউনাইটেড চার্চ কখনই পুরোপুরি বিলুপ্ত হবে না।

প্রজন্মগত ব্যবধান

কিন্তু ধর্মমণ্ডলীর জনসংখ্যার দিকটি উপেক্ষা করা কঠিনÑ সমবেতদের অনেক বড় অংশ হলেন পাকা চুলের মানুষ।

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার উপাত্ত প্রজন্মের এই ব্যবধান নিশ্চিত করে। এতে দেখা যায়, বয়োবৃদ্ধ কানাডিয়ান যাদের জন্ম ১৯৪০ থেকে ১৯৫৯ সালের মধ্যে তাদের ৮৫ শতাংশেরই কেবল ধর্মীয় সম্পৃক্ততা রয়েছে। অন্যদিকে ১৯৮০ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে জন্ম নেয়া কানাডিয়ানদের মাত্র ৩২ শতাংশের ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক আছে।

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্যে অবশ্য এটাও দেখা গেছে যে, কানাডিয়ানদের জীবনে ধর্ম সার্বিকভাবেই অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক বিশ্বাস জীবনে “কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ” অথবা “অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ” বলে যারা জানিয়েছিলেন তাদের সংখ্যা ২০১৯ সালে ছিল ৫৪ শতাংশ। ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝিতে সেই সংখ্যাটি ছিলো প্রায় ৭০ শতাংশ।

অ্যাংলিকান ধর্মমত: ২০৪০ এর মধ্যে বিলীন হবে?

গ্লোবাল নিউজ এর প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যাংলিকান ধর্মমতও একই রকম তমসাচ্ছন্ন অবস্থায় রয়েছে। স্ট্যাটক্যান-এর উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, ১৯৮৬ সালে সব শ্রেণীর কানাডীয়দের মধ্যে ১০.৪ শতাংশ ছিলেন অ্যাংলিকান। ১৯৯৬ সালে সে সংখ্যা হ্রাস পেয়ে ৭.০ শতাংশে এবং ২০১৯ সালে ৩.৮ শতাংশে নেমে আসে।

ওই বছর, কানাডার অ্যাংলিকান গির্জার পরিসংখ্যান ও গবেষণা বিষয়ক কর্মকর্তা নিল ইলিয়ট একটি রিপোর্ট পেশ করেন। উল্লেখিত পরিস্থিতি গির্জার ভবিষ্যতের জন্য কী অর্থ বহন করে গির্জার মুরুব্বিদের সামনে সেটি তুলে ধরাই ছিলো তার রিপোর্টের লক্ষ্য।

১৯৬১ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে গির্জার সদস্য সংখ্যা ৫০ শতাংশ হ্রাস পাওয়া এবং ১৯৯১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে একইরকম অবনতির পর নিল ইলিয়ট ধারণা করেন যে, ২০৪০ সালের মধ্যে অ্যাংলিকান গির্জার আর কোনও সদস্যই থাকবে না।

ইলিয়টের রিপোর্টে বলা হয়, ‘ব্যাপ্টিজম ও কনফার্মেশন’ এর হার থেকে দেখা গিয়েছিলো যে, গির্জাগুলি “যথেষ্ট সংখ্যক নতুন সদস্য টানতে পারছে না” আর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সংখ্যা থেকে বোঝা যায়, “আমরা কেবল সদস্যদের হারাচ্ছিই না, নতুন সদস্য আকর্ষণের সুযোগও হারাচ্ছি, আমাদের সম্প্রদায়ের সঙ্গে বন্ধন হারিয়ে ফেলছি।”

রিপোর্টে বলা হয়, “সুতরাং এসব পরিসংখ্যান আগামী দশকে আরও অবনতির পক্ষেই কথাই বলে,” এতে আরও বলা হয়, “পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবো এমন সম্ভাবনা নেই।”

দুই বছর পর ইলিয়টের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা হলেও পরিবর্তিত হয়েছে। তিনি বলেন, মহামারি একটি পরিবর্তনের প্রেরণা নিয়ে এসেছিলো, তবে দেখতে হবে এই প্রেরণা নতুন সদস্য প্রাপ্তিতে জোয়ার বয়ে আনে কিনা।

তিনি বলেন, আধুনিক সংস্কৃতি “মানুষকে গির্জা থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে:” বেশ কয়েক দশক ধরেই।

লন্ডন অন্টারিওতে অবস্থিত Trinity Anglican Church-টি বর্তমানে সেন্ট থমাস ইসলামিক সেন্টার নামে পরিচিত। কয়েকজন মুসল্লিকে এখানে নামাজ আদায় করতে দেখা যাচ্ছে। ছবি: ফেসবুক

তিনি বলেন, “আধুনিকতার ধারণা, যা বিজ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত, একদিক থেকে অন্তর্নিহিতভাবেই ধর্মের বিরোধী। এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত আছে যে, বিজ্ঞান ও ধর্ম কখনও মিলতে পারে না। যদিও এই মতের সঙ্গে আমি নিজে একমত নই।”

ইলিয়ট বলেন, অ্যাংলিকান গির্জাকে অবশ্যই টিকে থাকার জন্য মানিয়ে নিতে হবে। তিনি বলেন, তার ভূমিকা হলো এই বিষয়টি সারা কানাডার যাজকদের মনে সঞ্চারের চেষ্টা করা।

ইলিয়ট বলেন, “আমি এটিকে দেখি একেবারেই জলবায়ু পরিবর্তন এবং এ বিষয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়ার মত করে।”

“জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে তিনটি প্রধান প্রতিক্রিয়া আছে: অস্বীকৃতি আছে… আবার এমন মানুষ আছে যারা বলেন, আমরা এটি বন্ধ

করতে পারি। এছাড়া এমনও মানুষ আছেন যারা বলেন, আমরা এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারি…. ঠিক সেটাই আমি অ্যাংলিকান গির্জার ক্ষেত্রে করার চেষ্টা করছি, যে আমরা কীভাবে এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারি।”

তিনি বলেন, গির্জার ধর্মসভার অনুষ্ঠান আরও আধুনিক উপায়ে পরিবেশনার বিষয়টি এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা ভবিষ্যৎ অস্তিত্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কানাডায় নিজেদেরকে ধর্মপ্রাণ বলে মনে করেন এমন মানুষই শুধু কমে যাচ্ছে তাই নয়, বরং ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণও কমছে।

৫০% মানুষ কখনও কোনও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে যোগ দেননি

স্ট্যাটক্যান-এর সমীক্ষায় সমবেত ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের পরিমাণ বিষয়ক প্রশ্নের জবাবে যারা “একেবারেই না” বলে জবাব দিয়েছেন তাদের সংখ্যাই ব্যাপকভাবে বেশি, ৫৩ শতাংশ। মাত্র ২৩ শতাংশ কানাডিয়ান বলেন, তারা মাসে অন্তত একবার সমবেত কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। ২০০০ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে এমন লোকের সংখ্যা ছিলো প্রায় ৩০ শতাংশ।

অবশ্য, কিছু ধর্মীয় সম্প্রদায় এই গড়ের চেয়ে অনেক ওপরেই রয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে প্রধানত ইভাঞ্জেলিক্যাল গ্রুপগুলো। যেমন জেহোভনস উইটনেসেস ধর্মসম্প্রদায়ের (৮৬ শতাংশ) লোকেদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সর্বোচ্চ হারের কথা জানা যায়।

কানাডিয়ান জেহোভনস উইটনেসেস-এর মুখপাত্র জেমস ডুমেইগনিল গ্লোবাল নিউজকে বলেন, তাদের সদস্য প্রতি বছরই বাড়ছেÑ ২০২০ সালের চেয়ে ২০২১ সালে সদস্য সংখ্যা ছিলো ৩০০০ জন বেশি। স্ট্যাটক্যানের উপাত্তে অবশ্য এই গ্রুপের সদস্য কমার পরিসংখ্যানই দিয়েছে। ১৯৯১ সালে কানাডায় তাদের সদস্য ছিল ১৬৮,৩৭০ জন যা এখন কমে ১৩৭,৭৭৫ জনে দাঁড়িয়েছে।

ডুমেইগনিল বলেন, তাদের ধর্মসভায় যোগদানের হার এত বেশি হবার কারণÑ তাদের ধর্ম পবিত্র ত্রিত্ববাদের (পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা) পরিবর্তে নিজেকে পৃথক হিসাবে সনাক্ত করে তার ঈশ্বরের একত্ববাদ অর্থাৎ জেহোবার ওপর বিশ্বাস-ভিত্তিক খ্রীষ্টবাদের মাধ্যমে।

ড্যানফোর্থের বাঙ্গালী অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থিত বায়তুল মোকাররম মসজিদ। এটিও এক সময় চার্চ ছিল। ছবি: প্রবাসী কণ্ঠ

কিছু খ্রীষ্টান ধর্মসম্প্রদায়ও বলে যে, তারা এই প্রবণতার বিষয়টি সমর্থন করে। গ্রেটার টরন্টো এলাকার ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের কেন্দ্র টরন্টোর আর্চডায়োসিজ-এর এক মুখপাত্র বলেন, নগরের গির্জাগুলোয় জনসমাগম না হলেও অপেক্ষাকৃত ছোট শহর ও কমিউনিটির গির্জাগুলিতে এখনও বড় জনসমাগম হয়।

ব্রাম্পটনের ক্যাথলিক গির্জা সেন্ট ম্যারি’স-এর যাজক ফাদার লিবোরিও আমারাল বলেন, তার ৮০০ জন ধারণক্ষমতার গির্জায় রবিবারে ৭৫ শতাংশের কম জনসমাগম হয়েছে এমনটা বিরল। আমারাল ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, তার গির্জায় জনসমাগম ক্রমশ বাড়ছে, বিশেষ করে তরুণদের ক্ষেত্রে।

তিনি বলেন, “এখন স্বাভাবিকভাবেই, যখন কনফেশন করার জন্য সারিবদ্ধ লোকদের দেখবেন তখন তাদের মধ্যে তরুণই বেশি দেখা যাবেÑ যাদের বয়সে টিন এজার বা সদ্য বিশ-এ পড়েছে। গত ১০ বছর বা এরকম সময়ের মধ্যে কিছু একটা ঘটে চলেছে যেজন্যে যুবসমাজ উপলব্ধি করছে যে, ঈশ্বরকে তাদের দরকার আছে। তিনি বলেন, আমার মনে হয়, এই বিষয়টি হলো, কখনও মানুষ যেটিকে নিজেদের জন্য আনন্দ বয়ে আনবে বলে মনে করে- যেমন, চাকরি, ক্যারিয়ার, বাড়ি, গাড়ি ইত্যাদির মধ্যে যে অগভীরতা এবং অন্তঃসারশূন্যতা আছে সেটি।”

“তরুণ বয়সে লোকেরা তাদের বাবা-মার বিশ্বাস লালন করে। কিন্তু তারা যখন একটি নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছে, তখন সেটি আর বাবা-মার বিশ্বাস থাকে না। এটা হয়ে যায় তার নিজের বিশ্বাস।”

‘ইহুদি হবার জন্য ধর্মপ্রাণ হবার দরকার নেই’

ইউনাইটেড ও অ্যাংলিকান গির্জা এবং ইহুদি ধর্মের লোকদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে মাসে অন্তত একবার অংশগ্রহণকারী লোকের সংখ্যা সর্বনিম্নÑ যথাক্রমে ১৯ শতাংশ, ১৯ শতাংশ এবং ২৪ শতাংশ।  গ্লোবাল নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইহুদীধর্ম রয়েছে অভিনব চ্যালেঞ্জের মুখে। উদাহরণস্বরূপ, সাবাথ-এর কথা বলা যায়। (এটি ইহুদি ধর্মে বিশ্রামের দিন, যেটি পালিত হয় শুক্রবার সূর্যাস্ত থেকে শুরু করে শনিবারের সূর্যাস্তের পর পর্যন্ত) যখন স্কুলগুলোতে অনেক ক্রীড়ানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর ফলে তরুণ বয়স থেকেই তাদেরকে ধর্ম অথবা পাঠ্যসূচিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হয়।

টরন্টোর বেথ শোলোম সিনাগগের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান কমিটির চেয়ারম্যান স্ট্যান গ্রসম্যান বলেন, “যে সমাজে আমরা বসবাস করি সেটি ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরণে নিরুৎসাহিত করে।”

কানাডায় ইহুদি ধর্মের লোকেদের অনুপাত অনেক বছর ধরে ক্রমাগত কমছে। স্ট্যাটক্যানের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৫ সালে ১.৬ শতাংশ কানাডীয় ছিলো ইহুদি। ১৯৯৬ সালে সেটি কমে ১.১ শতাংশে এবং ২০১৯ সালে প্রায় ০.৮ শতাংশে নেমে যায়।

গ্রসম্যান বলেন, অর্থোডক্স নয় এমন ইহুদি কমিউনিটিতে কোভিড-১৯ এর আগের সময়েও সাপ্তাহিক ও দৈনিক ধর্মসভায় অংশগ্রহণ ছিলো, “অনেকটাই অদৃশ্য”।

“পুরো প্রজন্মটি বেড়ে ওঠার সময়ে এমনকি আমরা বোর্ডের সদস্যরাও প্রভাবিত হয়েছি। আর ধর্ম এই প্রজন্মের জীবনযাপনের উপায় হয়ে ওঠেনি।”

গ্রসম্যান বলেন, পাঁচ বছর আগে সাবাথ-এর ধর্মসভায় দেড়শ’ থেকে দুইশ’ মানুষ যোগ দিতো। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে চানুকাহ’র সময় প্রায় ৮০ জন সুবেশধারী লোক সুবিস্তৃত ‘বেথ শোলোম সিনাগগে’ ছড়িয়ে ছিটিয়ে জড়ো হয়। কিন্তু এদের প্রায় অর্ধেকই সিনাগগের সদস্য নয়Ñ তারা এক কিশোরীর বন্ধবান্ধব ও পরিবারের লোকজন। মেয়েটি তার ব্যাট মিৎজবাহ (১৩ বছর পূর্তিতে সাবালিকা হওয়ার ধর্মীয় উৎসব) উদযাপন করছিলো।

গ্রসম্যান বলেন, এখনকার দিনে ইহুদি ছেলেমেয়েদের সিনাগগে যাবার ব্যাপারে নিজেকে পছন্দ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যে সুযোগ আগের প্রজন্মগুলোর জন্য ছিলো না।

তবে গ্রসম্যান মেনে নেন যে, সদস্য ও ধর্মসভায় অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার বিষয়টিকে সরাসরি কানাডায় ইহুদির সংখ্যা কমে যাওয়া অর্থে নেওয়া ঠিক না।  

তিনি বলেন, “ইহুদি হবার জন্য কারও ধর্মপ্রাণ হবার প্রয়োজন নেই।”

জীবন আর গির্জা ঘিরে আবর্তিত হয় না কেন

ওয়াটারলু ইউনিভার্সিটির সমাজতত্ত্বের শিক্ষক সারাহ ইউলকিনস-লাফলেম কানাডায় ধর্মের চালচিত্র অনুসরণ করেন বেশ কয়েক বছর ধরে। তিনি অবশ্য ধর্মের অধঃপতনের প্রশ্নটিকেই পাল্টে দেন: “‘কেন এত সামান্য সংখ্যক মানুষ এখন খ্রীষ্টবাদের সঙ্গে জড়িত’ এ কথা না বলে আমি বরং বলি, ‘কেন এত বিপুল জনগণ খ্রীষ্টবাদের সঙ্গে ছিলো?”

ইউলকিনস-লাফলেম গ্লোবাল নিউজকে বলেন, কানাডার পশ্চিমী খ্রীষ্টবাদ তার বিস্তারের জন্য ইসলাম, হিন্দু বা শিখ ধর্মের মত নতুন অভিবাসীদের জোয়ার পাচ্ছে না।

সামাজিক পরিবর্তনও কানাডাকে ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে চালিত করছে, সেটি এমন এক জগৎ যেখানে দৈনন্দিন জীবন “এখন আর গির্জা ঘিরে আবর্তিত হয় না।”

তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে বহু সংখ্যক ধারাবাহিক উপাদান সক্রিয় রয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে অথবা বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, যখন খ্রীষ্টান গির্জা অন্য আরও কিছু সামাজিক উপাদান নিয়ে কাজ করতো, তখন আমরা যে ধরণের সমাজে বাস করতাম এখন আর ঠিক সে ধরণের সমাজে বাস করি না। ঊনবিংশ শতাব্দীর কথা চিন্তা করুন, সে সময় সামাজিক জীবনের কেন্দ্র ছিলো গ্রাম এবং গ্রামের কেন্দ্র ছিলো একটি বা একাধিক গির্জা।”

“আমরা একটি ভিন্নতর সমাজে পাল্টে গেছি যেখানে আরও বিকল্প আছে। কারা সামাজিক পরিষেবা দিচ্ছে সেই বিবেচনায় বিভিন্ন বিকল্প আছে- স্কুল, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বিনোদন ইত্যাদি।”

তিনি বলেন, গত কয়েক দশক ধরে সারাদেশে ছিলো “অস্থিতিশীল সংখ্যক গির্জাকে” “একীভূত” করার সময়।

“টরন্টোর কেন্দ্রস্থলে বহু গির্জা ছিলো। এর মধ্যে অনেকগুলি বিক্রি হয়ে গেছে এবং কন্ডো বা অভিজাত রেস্তোরাঁয় পরিণত হয়েছে। এটিই আমাদের সমাজ, এই জায়গাগুলি কীসে পাল্টে যাচ্ছে সেই তথ্য সমাজ সম্পর্কে অনেক কথা বলে দেয়। আমরা উপাসনালয় নিয়ে নয় বরং আবাসন নিয়ে মরিয়া।”

ইউলকিনস-লাফলেম বলেন, ধর্মের সঙ্গে সমাজের তরুণতর অংশের সম্পৃক্ততা সবচেয়ে কম, এর কারণ নিহিত রয়েছে তাদেরকে যেভাবে বড় করা হয়েছে তার মধ্যে।  

তিনি বলেন, “বর্তমানে আমরা এমন এক সমাজে আছি যেটি খুব বেশি মূল্য দেয় ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়গুলিকে… যেখানে লোকেরা কোনও ধর্মীয় নেতা বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর না করে বরং সম্পূর্ণ নিজের পথ বেছে নিতে পারে।”

“তাহলে ইউনাইটেড/অ্যাংলিকান গির্জা কি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে? সম্ভবত না, কোনও আঙ্গিকে হয়তো অবশিষ্ট থেকে যাবে, তবে তা হবে খুবই ছোট আকারের। গির্জাগুলি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে।”

কানাডায় ৯০০০ গির্জা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে!

এদিকে সিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী এক দশকের মধ্যে কানাডার ৯০০০ ধর্মালয় হারিয়ে যাবে। এই সংখ্যাটি কানাডায় বিদ্যমান ধর্মালয়ের মোট সংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর কানাডা রিজেনারেশন প্রজেক্টের নেতা রবার্ট প্যাজট সিবিসি নিউজকে বলেন, কানাডার প্রতিটি কমিউনিটিই পুরনো গির্জা ভবনগুলো বন্ধ করে দেওয়া, বিক্রি করা অথবা ধ্বংস করে দেওয়ার ঘটনার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে।

প্যাজট বলেন, “একেকটি মহল্লায় একাধিক গির্জা বন্ধ হতে যাচ্ছে। অনেকে এটিকে একটি সঙ্কটজনক পরিস্থিতি বলছেন এবং আমিও তাতে এক অর্থে সায় দিই। এই ঘটনা প্রত্যেককে আহত করবে।”

এটি কেবল কিছু সুন্দর ও ঐতিহাসিক ভবন হারানো নয় বরং উপাসনালয় যে সামাজিক অনুভূতির জন্ম দেয় সেই অনুভূতিই হারিয়ে ফেলা। গির্জা কেবল রবিবারের প্রার্থনার জন্য নয় বরং এটি গার্লস গাইড ও রাজনৈতিক সমাবেশ, বিয়ে ও অন্তেষ্ট্যিক্রিয়ার স্থান, পিয়ানো বাজাতে শেখার এবং গৃহহীনদের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নেরও জায়গা এটা।

প্যাজট বলেন, “এটি নিছক কিছু ভবনের ব্যাপার নয়। এটা হলো প্রকৃতপক্ষে সমাজের একটি ঐতিহ্যগত ভবন হারানোর ফলে সৃষ্ট প্রভাবের চেয়েও বেশি কিছু। মানুষের বিশ্বাসের জায়গাটা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ছিলো সামাজিক জীবনের সত্যিকারের কেন্দ্রস্থল। এগুলো কার্যত সামাজিক মিলনকেন্দ্র ও সামাজিক সেবা কার্যক্রমের কেন্দ্র হিসাবে ভূমিকা পালন করেছে।

অনেক ধর্মীয় সমাবেশে এই পরিবর্তনের আগমনবার্তা জানানো হয়েছে এবং পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে পুরনো ভবনগুলোর এমনভাবে ভিন্নতর ব্যবহার করার যাতে তাদের ব্যয় তারা নিজেরাই বহন করতে পারে।”

পল্লী এলাকায় ধর্মীয় সমাবেশে লোক সমাগত সঙ্কুচিত হয়ে আসছে কারণ অনেকে বয়ঃবৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন এবং নতুনরা ভিন্ন স্থানে চলে গেছে। শহর অঞ্চলে সমাজের ক্রমবর্ধমান হারে ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে পড়া এবং সেইসঙ্গে নতুন নতুন আধ্যাত্মিকতার অনুশীলন পুরনো ঐতিহ্যগত খ্রিস্টীয় গির্জায় লোকসমাগম কমিয়ে দিয়েছে। নতুন যে অভিবাসীরা আসছে তাদের দিয়েও এই প্রবণতা রোধ করা যাচ্ছে না। প্রার্থনার সারিতে লোকের স্বল্পতা এবং তহবিলে অর্থস্বল্পতা আর পুরনো ভবনের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি অনেক ধর্মসভাম-লিতে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয়। 

বন্ধের সুপারিশ

২০০৯ সাল পর্যন্ত কানাডা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানায় উপাসনা, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য ২৭,৬০১টি ভবন ছিলো। ন্যাচারেল রিসোর্সেস কানাডা এনার্জির অডিটে এই পরিসংখ্যান চাপা পড়ে ছিলো।

বন্ধ হয়ে যাবে এমন গির্জার সংখ্যা দেশজুড়ে বাড়তে থাকার প্রেক্ষাপটে ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর কানাডা পূর্বাভাস দেয় যে, এক দশকের মধ্যে পুরনো ভবনগুলোর এক-তৃতীয়াংশ বিক্রি হয়ে যাবে বা ভেঙ্গে ফেলা হবেÑ২০০৯ সাল থেকে এপর্যন্ত অনেক ভবনই পরিত্যক্ত হয়েছে, বিক্রি হয়ে গেছে বা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। বিভিন্ন্ সমীক্ষা প্রতিবেদন এবং গণমাধ্যমের রিপোর্টের ভিত্তিতে এই হিসাব করা হয়েছে।

উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, পূর্বাঞ্চলীয় নিউ ব্রান্সউইকে রোমান ক্যাথলিক আর্চ বিশপের দপ্তর পূর্বাভাস দেয় যে তাদের ধর্মসভা বা কর্তৃপক্ষ বাড়তি অর্থের সংস্থান করতে না পারলে তাদের ৫৩টি বিভাগীয় ধর্মসভার মধ্যে ২০টিই বন্ধ করে দিতে হবে।

একইভাবে, মন্ট্রিয়লের কাছে ৫৪টি ক্যাথলিক গির্জার মধ্যে ৩০টির বেশি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে Diocese of St-Jérôme এর এক রিপোর্টে এই তথ্য জানানো হয়। স্থানীয় গির্জা কর্তৃপক্ষ এখন ওই গির্জাগুলোর ভাগ্য নির্ধারণের জন্য কাজ করছে।

প্রেইরি অঞ্চলজুড়ে ছোট ছোট শহরগুলোতে গির্জা কর্তৃপক্ষ ক্রেতার সন্ধান করছে। সাসকাচুয়ানের গোভান শহরে সাতটির মত গির্জা সক্রিয় ছিলো। এর মধ্যে পাঁচটিই এখন বন্ধ হয়ে গেছে আর লুথারান ও ক্যাথলিক গির্জায় খন্ডকালীন উপাসনা চালু আছে এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করা হয়। শহরটির মোট জনসংখ্যা মাত্র ১৯৭ জন।

কানাডার ন্যাশনাল ট্রাস্ট টরন্টোর একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ফেইথ অ্যান্ড দ্য কমন গড-এর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে যাতে ধর্মসভার জন্য প্রশিক্ষণ অনুশীলনের ব্যবস্থা করা যায়। গির্জাগুলোকে প্রার্থনা ও সামাজিক কর্মকান্ডের জন্য সংরক্ষণ করার জন্য কীভাবে জমিজমা সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা করা যায় সেই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তারা আশা করছে যে গির্জাগুলোর অবলুপ্তি রোধ করা সম্ভব হবে।

প্যাজট বলেন, এই জায়গাগুরি নিছক প্রার্থনার জায়গার চেয়েও বেশি কিছু। এগুলি হলো একেকটি সমাজের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমন্ডিত স্থান। -তথ্যসূত্র : অ্যাশলে স্ট্যুয়ার্ট  – গ্লোবাল নিউজ / বনি অ্যালেন -সিবিসি নিউজ।