অন্টারিওর শিক্ষাকর্মীদের বিরুদ্ধে কর্মস্থলে সহিংসতার উচ্চ হার বিস্ময়কর

বেশিরভাগ সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়েছে শিক্ষার্থীরাই

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : অন্টারিওর স্কুলগুলোতে কর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার হার বিস্ময়করভাবে বেশি। নতুন এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, সমীক্ষায় অংশ নেয়া ৭০ শতাংশ শিক্ষাকর্মী বলেছেন, তারা কোনও না কোনও ধরণের শারীরিক বলপ্রয়োগের শিকার হয়েছেন। খবর সিবিসি নিউজের। রিপোর্ট করেছেন মুরিয়েল ড্রেইসমা।

ইন হার্মস ওয়ে, টরন্টোর শিক্ষা বিভাগের কর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার মহামারি- শিরোনামের এই রিপোর্ট তৈরি করেছেন অটোয়া ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। এতে বলা হয়, শিক্ষা বিভাগের কর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা স্বাভাবিক ঘটনায় পর্যবসিত হয়েছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, কর্মীরা আঘাত করা, লাথি দেয়া, ঘুষি, চড়-থাপ্পর, গলা টিপে ধরা, আঁচড় দেয়া, থুথু ছিটানো, মাথা ঠেসে ধরা, হাঁটু দিয়ে আঘাত করা এবং অনেক সময় হুমকি দেয়া এমনকি কাঁচি দিয়ে কেটে দেয়ার মতো বিভিন্ন ধরণের সহিংসতার কথা জানিয়েছেন। তারা মানুষের ছুঁড়ে দেয়া বিভিন্ন জিনিসের আঘাত পাওয়ার কথাও জানান।

অন্টারিওর স্কুলগুলোতে কর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার হার বিস্ময়করভাবে বেশি। ছবি : দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

রিপোর্টের সহ-লেখক ব্রিটানি মারিও বলেন, “কিছু অংশগ্রহণকারী যেসব তথ্য দিয়েছেন সেগুলি সত্যিই ভয়াবহ, সত্যিই বেদনাদায়ক, সত্যিই মর্মান্তিক। বলা যেতে পারে যে, তারা আগে এসব স্বীকার করেনি, আর এমনটাই বলেন হাজারও সাক্ষী।”

গবেষকরা কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর আগে ২০২০ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ই মার্চের মধ্যে কানাডার সরকারি কর্মচারী ইউনিয়নের (CUPE) সদস্য ৩,৮৫৪ শিক্ষাকর্মীর ওপর এই সমীক্ষা চালান। কর্মীদেরকে ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষে তারা যেসব হয়রানির মুখোমুখি হন সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়।

গবেষকরা সমীক্ষায় শিক্ষকদের রাখেননি। তারা শিক্ষা সহকারী, শিশুদের শিক্ষাদানকারী এবং স্কুলের সহায়ক কর্মীদের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন।

অটোয়া ইউনিভার্সিটির অপরাধতত্ত্ব বিভাগের ডক্টোরাল গবেষক মারিও বলেন, গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বিদ্যালয়ে সহিংসতার বিষয়টি এখন অন্টারিওর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল ব্যবস্থায় কাজের বাস্তবতার অংশ বলেই বিবেচনা করা হচ্ছে। তিনি শিক্ষাকর্মীদেরকে “সাধারণভাবে উপেক্ষিত দল” বলে উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, “কেউ বলেছেন লুকানো আঁচড়ের বিষয়ে। কেউ বলেছেন অত্যন্ত গুরুতর (মানসিক আঘাতজনিত জটিলতা) থেকে শুরু করে সপ্তাহে দুদিন করে মনস্তÍাত্ত্বিক থেরাপি নেওয়ার প্রয়োজন হওয়া এমনকি চিকিৎসাধীন থাকার ঘটনা পর্যন্ত।”

তিনি বলেন, বেশিরভাগ শিক্ষা সহকারী শিক্ষার্থীদের সাহায্য করার জন্য মাঠে গিয়ে সহিংসতার মুখে পড়েন।

“একজন শিক্ষা সহকারী এটা কোনওভাবেই আশা করেন না।”

মারিও উল্লেখ করেন যে, বেশিরভাগ শিক্ষাকর্মী নারী। তাই এদের বিরুদ্ধে সহিংসতা শুধু শ্রেণীকক্ষের নয়, এটি নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতাও।

রিপোর্টে অন্য যেসব বিষয় উঠে এসেছে তার মধ্যে রয়েছে:

*  সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৮৯ শতাংশ কর্মী ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষে এক বা একাধিক উৎস থেকে হুমকি, শারীরিক সহিংসতা বা তার চেষ্টার মুখোমুখি হয়েছেন। রিপোর্টে বলা হয়, “বেশিরভাগ সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়েছে শিক্ষার্থীরাই।”

*   শিক্ষাকর্মীদের বিরুদ্ধে কর্মস্থলে সহিংসতার হার অন্য যে কোনও পেশার লোকেদের বিরুদ্ধে সহিংসতার হারের চেয়ে সর্বোচ্চ।

*  কর্মস্থলে সহিংসতা মারাত্মক হতে পারে এবং এতে আঘাত পাওয়া, হাড় ভাঙ্গা, অস্থিসন্ধির বিচ্যুতি, পিঠ ও মাথায় ক্ষত হওয়া, সংক্রমণ এবং মাথায় প্রচণ্ড আঘাতের মতো বড় ধরণের জখম হতে পারে।

*    কোনও একক বছরে শ্রেণীকক্ষের এবং সহায়ক কর্মীদের ৯৫ শতাংশ এক বা একাধিক উৎস থেকে বিদ্রƒপ (কাউকে ব্যঙ্গ করা বা সমালোচনা করার উদ্দেশ্যে বিরূপ মন্তব্য), শিক্ষার্থীদের অশালীন ভঙ্গিমা, উপহাসমূলক মন্তব্য, হেয় অথবা অপমান করা এবং মিথ্যা অভিযোগ ছড়িয়ে দেওয়াসহ কোনও না কোনও ধরণের হয়রানির শিকার হন।

*   হয়রানি ও সহিংসতা উপর্যুপরি এবং চলমান অভিজ্ঞতা।

*   কর্মস্থলে হয়রানি ও সহিংসতার স্থায়ী জোরালো প্রভাব থাকে। ৮৭ শতাংশ কর্মী তাদের জীবনে হয়রানি ও সহিংসতার উল্লেখযোগ্য প্রভাবের ইঙ্গিত দিয়েছেন।

*   মানসিক আঘাত-উত্তর চাপের কারণে সৃষ্ট মানসিক বৈকল্যের হার “বিস্ময়করভাবে বেশি।”

*   অংশগ্রহণকারীদের প্রতি ১০ জনে একজন হয়রানির অভিযোগ করার পর কর্মস্থলে প্রতিশোধের মুখে পড়েছেন।

*   নারীদের বিরুদ্ধে কর্মস্থলে হয়রানি ও সহিংসতার পরিমাণ অনেক বেশি এবং তাদের ক্ষেত্রে এর প্রভাবও বেশি।

*    কোনও ধরণের প্রতিবন্ধিতা আছে এমন কর্মীরা তাদের সহকর্মী ও প্রশাসকদের কাছে যারা প্রতিবন্ধী নন তাদের চেয়ে বেশি পরিমাণে হয়রানির শিকার হন বলে জানান।

*   কৃষ্ণাঙ্গ, আদিবাসী ও অন্যান্য অশ্বেতাঙ্গ কর্মীরা হয়রানি ও সহিংসতার বিষয়ে অভিযোগ করার কারণে কর্মস্থলে অধিক পরিমাণে প্রতিশোধের মুখে পড়েন।

অন্টারিও স্কুলবোর্ড ইউনিয়নসমূহের কাউন্সিল সিইউপিই’র প্রেসিডেন্ট লরা ওয়ালটন। তিনি ২০ বছর ধরে শিক্ষা সহকারী হিসাবে কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘শুনুন, সহিংসতা ঘটবে এটা ধরে নিয়ে কেউ কাজে যায় না অথবা যাওয়া উচিৎ নয়। কাজ শেষে সবারই অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফেরার সুযোগ থাকতে হবে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা আলাদা নয়।’ (সিবিসি)

রিপোর্টে যা সুপারিশ করা হয়: শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে সম্পদের যোগান দেওয়া, শিক্ষা খাতের কর্মীদের সহায়তা দেওয়া; এবং বাড়তি প্রশিক্ষণের।

মারিও বলেন, সমস্যাটি কাঠামোগত এবং শিক্ষা খাতে আরও বেশি তহবিলের প্রয়োজন আছে। তিনি যোগ করেন, শিক্ষার্থীরা সহিংস অপরাধী নয়। প্রদেশের উচিৎ সহিংসতার সুরাহা করা, বলেন সাবেক শিক্ষা সহকারী।

অন্টারিও স্কুলবোর্ড ইউনিয়নসমূহের কাউন্সিল সিইউপিই’র প্রেসিডেন্ট লরা ওয়ালটন ২০ বছর ধরে শিক্ষা সহকারী হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, তিনি নিজেও সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছেন।

তিনি বলেন, “শিক্ষা সহকারী হিসাবে আমার কর্মজীবন সামগ্রিকভাবে অত্যন্ত ফলপ্রসু। তবে আমিও কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছি। আমার গায়ে আঁচড়ের দাগ আছে এবং এক পর্যায়ে আমার চোয়াল স্থানচ্যুত হয়েছিলো।”

ওয়ালটন বলেন, যেসব সুপারিশ করা হয়েছে সেগুলি বাস্তবায়ন করা হলে পরিস্থিতি পাল্টাবে।

তার ভাষায়, “এখন আলাপ-আলোচনা করা এবং আমরা আমাদের স্কুলগুলোতে কীভাবে সহিংসতার সমাধান করবো সে বিষয়ে মনোযোগ দেবার সময় এসেছে। ঠিক এই মুহূর্তে আমরা জানি এটি একটি সমস্যা।”