কুইবেকের ধর্মনিরপেক্ষতা আইন : লঙ্ঘিত হচ্ছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার
অধিকার হরণের এই আইন বাতিলের দবীতে এবার একজোট হয়েছেন টরন্টোর মেয়রসহ আরো কয়েক শহরের মেয়র
খুরশিদ আলম : কুইবেকের বিতর্কিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা আইন’ বাতিলের দাবীতে আবারো সোচ্চার হয়ে উঠেছেন অনেকে। এই দাবীর পক্ষে এবার যোগ দিয়েছে টরন্টোর মেয়র জন টরি, ব্র্যাম্পটনের মেয়র প্যাট্রিক ব্রাউন, মিসিসাগার মেয়র বনি ক্রম্বি, লন্ডনের মেয়র এডউইন অ্যান্টনি হোল্ডার এবং ক্যালগারীর মেয়র জ্যোতি গোন্দেক। ধর্মনিরপেক্ষতার আইন বাতিলে আইনী সহায়তা করার জন্য আর্থিক অনুদানের কথাও ঘোষণা করেছেন মেয়রগণ।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং প্রধান বিরোধী দল কনজার্ভেটিভ পার্টি অব কানাডা’র নেতা এরিন ও’টুল-ও কুইবেকের ধর্মনিরপেক্ষতার আইন বাতিলের বিষয়ে সরব হয়েছেন। তাঁরা অবশ্য সরাসরি আইনী পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে কথা বলেননি। তবে উভয় নেতাই বলেছেন তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে কুইবেকের এই ধর্মনিরপেক্ষতার আইনটি পছন্দ করছেন না। এই আইনটি বাতিল হোক এটাই তাঁরা চান।
কুইবেকে ধর্মনিরপেক্ষাতার এই আইনটি (বিল-২১) পাস হয়ে ২০১৯ সালে। ঐ আইনে বলা আছে কুইবেক প্রভিন্সে সরকারী চাকরীজীবীরা বিশেষত যাঁরা কর্তৃত্বের অবস্থানে আছেন তাঁরা কর্মস্থলে কোন ধর্মীয় পোষাক বা প্রতীক ব্যবহার করতে পারবেন না। এঁদের মধ্যে আছেন শিক্ষক, বিচারক, পুলিশ বাহিনীর সদস্য প্রমুখ। আর পোষাকের মধ্যে আছে হিজাব, বোরখা, পাগড়ী ইত্যাদি।
বিতর্কিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা আইন’টি ২০১৯ সালে পাস হলেও সম্প্রতি এর বিরুদ্ধে নতুন করে প্রতিবাদ শুরু হওয়ার পিছনে কাজ করছে কুইবেকের ‘চেলসি’তে অবস্থিত একটি এলিমেন্টারী স্কুলে ঘটে যাওয়া এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ঐ স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে শিক্ষার্থীদের পড়াতেন ফাতেমা আনোয়ারী নামের এক মুসলিম নারী। ধর্মবিশ্বাসের কারণে তিনি মাথায় হিজাব পরতেন। আর এই হিজাব নিয়েই শুরু হয় সমস্যা। গত ৩ ডিসেম্বর স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁকে জানান, হিজাব পরে তিনি স্কুলে ক্লাস নিতে পারবেন না। পরে তাঁকে ক্লাসরূম থেকে সরিয়ে অন্যত্র বদলি করা হয়। এরপরই ঐ স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিবাকদের একটি অংশের মধ্যে শুরু হয় ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া থেকে বিক্ষোভ। মন্ট্রিয়লের ডাউন টাউনে আয়োজন করা হয় বিক্ষোভ সমাবেশের। এতে অংশ নেন অন্যান্য শিক্ষকরাও। তাঁরা বিতর্কিত এই ধর্মনিরপেক্ষতার আইন বাতিলের জোর দাবী জানান।
বিক্ষোভে অংশ নেয়া ‘No to Law 21’ আন্দোলনের এক সদস্য এহাব লাতয়েফ বলেন, ফাতেমা এই আইনের প্রথম শিকার নন। হয়তো তাঁর বিষয়টি স্পষ্টভাবে সবার নজরে এসেছে। কিন্তু এই আইনের কারণে আরো অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই আইনের কারণে অনেকেই চাকরী পাননি বা প্রভিন্স থেকে অন্যত্র চলে গেছেন। অনেককে বেছে নিতে হয়েছে তাদের জীবকা নয়তো তাদের ধর্ম বিশ^াস এ দুটির একটিকে।
বিক্ষোভে অংশ নেয়া তৃতীয় শ্রেণী’র শিক্ষার্থী জো নেলড্রাম তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে জানায়, ‘আমরা এখানে এসেছি আমাদের শিক্ষিকা ফাতেমাকে প্রতিনিধিত্ব করতে এবং একই সাথে অন্যান্য যাঁরা হিজাব পরেন তাঁদেরকে। আমরা মনে করি এই আইন ভুল এবং অন্যায্য। আমরা ফাতেমাকে আবার আমাদের ক্লসে ফেরত চাই। তিনি খুব ভাল এবং সেরা শিক্ষকদের একজন।
বিক্ষোভ এর আয়োজনকারীদের একজন ডেভিড হ্যারিস সিটিভি নিউজকে বলেন, ‘আমরা এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাই যে সরকার জানুক আমাদের কমিউনিটিতে তারা এ থেকে নিস্তার পাবে না। আমরা এই আইনকে এমনভাবে দেখছি যা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সীমা ছাড়িয়ে গেছে অনেকদূর। আর যখন কমিউনিটিতে কেউ এর শিকার হন তখন আমরা তাঁর পিছনে দাঁড়াতে চাই আমাদের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে।’
কানাডিয়ান মুসলিম ফোরাম এর প্রেসিডেন্ট সামের মাজযৌব সিটিভি নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘কুইবেক একটি বর্ণবাদী সমাজ নয়। কিন্তু আমরা পছন্দ করি আর নাইবা করি, বিল-২১ সরাসরি বা পরক্ষোভাবে বৈষম্যকে অনুমোদন করছে।’
কানাডিয়ান মুসলিম ফোরাম ‘বিল-২১’ এর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছে। এবং অন্ততপক্ষে শিক্ষাখাতকে যেন এই আইন থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় সে দাবী জানিয়েছে।
এদিকে কয়েকজন ফেডারেল আইন প্রনেতা কুইবেকের এই ধর্মনিরপেক্ষতা আইনের উপর কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের আহ্বান জানান। এঁদের মধ্যে একজন হলেন কনজার্ভেটিভ সিনেটর সালমা আতাউল্লাহজান। তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, বিল-২১ ‘বৈষম্যমূলক এবং বর্ণবাদী’।
ব্রিটিশ কলম্বিয়ার এমপি মার্ক স্ট্রাহল বলেন ‘আইনটি যদিও প্রভিন্সিয়াল লেভেলের, তবু কিছু কিছু বিষয় আছে যা প্রভিন্সের এখতিয়ারের সীমানা অতিক্রম করে। তাই আমরা এ ধরণের একটি আইনকে চ্যালেঞ্জহীন হতে দিতে পারি না।’ সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
উল্লেখ্য যে, কুইবেক প্রভিন্স ধর্মীয় পোষাকের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও ফেডারেল লেভেলে এই ধরণের আইন নেই। রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ (আরসিএমপি) ২০১৬ সালে তাদের নারী অফিসারদেরকে ইউনিফর্ম হিসেবে হিজাব পরার অনুমতি দিয়েছে। উদ্দেশ্য – আরো অধিক সংখ্যক মুসলিম নারী এই পেশায় অনুপ্রানিত হবে। এটি কানাডার সমাজে বৈচিত্রকেও প্রতিফলিত করবে বলে উল্লেখ করেন আরসিএমপির তৎকালীন মুখপাত্র স্কট বার্ডসলি। খবর গ্লোবাল নিউজের।
উল্লেখ্য যে, ইউনিফর্মে বৈচিত্রের জন্য কানাডার আরসিএমপি বিভাগের নাম ডাক রয়েছে। হিজাব অনুমোদনের আগে দুই শতাব্দী ধরে এর জমকালো ইউনিফর্ম অপরিবর্তিত ছিল।
আরসিএমপি কর্তৃপক্ষ তিন প্রকারের হিজাব পরীক্ষা করার পর একটিকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এটি প্রয়োজনে তাৎক্ষনিকভাবে খুলে ফেলা যায় এবং ব্যবহারকারী অফিসারদের নিরাপত্তায় কোন ঝুঁকি সৃষ্টি করে না।
উল্লেখ্য যে, ১৯৯০ সালে আরসিএমপি তাদের শিখ অফিসারদের জন্য পাগড়ী ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল। হিজাব পড়ার অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে আরসিএমপি তৃতীয়। এর আগে টরন্টো ও এডমনটন পুলিশ বিভাগ মুসলিম মহিলা পুলিশ কর্মীদের হিজাব পরিধানের অনুমতি প্রদান করে।
আরসিএমপি পুলিশ বাহিনীর মোট সদস্যের এক পঞ্চমাংশ নারী। তবে তাঁদের মধ্যে কতজন মুসলিম সদস্য রয়েছেন এবং ঐ মুসলিম সদস্যদের কতজন ইউনিফর্ম হিসেবে হিজাব পরতে চেয়েছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য যে, যুক্তরাজ্য, সুইডেন, নরওয়ে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি স্টেট তাদের নারী পুলিশ সদস্যদেরকে হিজাব পরিধানের অনুমতি প্রদান করেছে ইতিপূর্বে।
কিন্তু কানাডার কুইবেক প্রভিন্স সরকারী কর্মস্থলে হিজাবসহ অন্যান্য ধর্মীয় পোষাক পরার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা কেন জারী করেছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। একে অন্যায় সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রীও।
সম্প্রতি সিটিভি নিউজের কোশ্চেন পিরিয়ড এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বিলটির বিষয়ে মোলায়েম সুরে কথা বলেননি।
সরাসরি তিনি একে ‘অন্যায়’ বলে অভিহিত করেছেন। হিজাব পরার কারণে স্কুল থেকে শিক্ষিকা ফাতেমাকে অপসারনের পর বিল-২১ বিষয়ে সিবিসি নিউজে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘শুধু সরকার নয়, নাগরিকদেরও মৌলিক অধিকার রক্ষার বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি বিল-২১ এর সাথে একমত নই, এবং আমি সর্বদাই এই বিলের সাথে একমত নই। আর এই আইনের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে হস্তক্ষেপ করার ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেয়ার সম্ভাবনাকে আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না। পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায়।’
প্রধান মন্ত্রী আরো বলেন, সরকার এই মৌলিক অধিকার রক্ষায় এগিয়ে আসতে পারে এবং এগিয়ে আসা উচিৎ। একই সাথে আমাদের জনগণকেও একে অপরের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। এবং আমরা সেটাই দেখছি কুইবেকের ‘চেলসি’তে যেখানে কমিউনিটি, পরিবারগুলো এবং শিশুরা সবাই মিলে বলছে , একজন তরুণ শিক্ষিকা মুসলিম হওয়ার কারণে চাকরী হারাবে এটা একেবারেই ভুল সিদ্ধান্ত।
সিবিসি নিউজ জানায়, ফাতেমা ‘চেলসি’র ঐ এলিমেন্টারী স্কুলে সাবস্টিটিউট টিচার হিসাবে কাজ করছিলেন গত কয়েক মাস ধরে। পরে তাঁকে পার্মানেন্ট পদের জন্য আবেদন করতে বলা হয়। তিনি সেইভাবে আবেদন করার পর চাকরীতে স্থায়ী নিয়োগ পান।
ফাতেমা স্থায়ী শিক্ষিকা হিসাবে স্কুলে যোগদান করেন গত শরৎ থেকে। প্রথম দিকে কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু মাসখানেক পর একদিন স্কুলের প্রিন্সিপাল ফাতেমাকে ডেকে বলেন তাঁকে ক্লাশরুমের বাইরে অন্যত্র কাজ করতে হবে। কারণ তিনি মাথায় হিজাব পরিধান করেন।
বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর প্রায় শ’দেড়েক অভিভাবক, শিক্ষার্থী এবং কমিউনিটির অন্যান্য সদস্যরা স্থানীয় প্রভিন্সিয়াল পার্লামেন্ট এর সদস্য Robert Bussière এর অফিসের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন।
কুইবেকে ধর্মনিরপেক্ষতার আইনের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করছেন তাঁদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে অন্টারিও’র ব্রাম্পটনের মেয়র বলেন, এই আইন বৈষম্যমূলক। ধর্মীয় স্বাধীনতা একটি মৌলিক নীতি যা অবশ্যই বহাল রাখা উচিৎ। তিনি কানাডার অন্যান্য সিটির মেয়রদেরকেও আহ্বান জানান বৈষম্যমূলক এই আইনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে।
প্যাট্রিক ব্রাউনের আহ্বানের প্রতি সাড়া দিয়ে টরন্টোর সিটি কাউন্সিল সর্বসম্মতিক্রমে কুইবেকের ধর্মনিরপেক্ষতার আইনের বিরুদ্ধে লড়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এক লক্ষ ডলার আর্থিক অনুদানেরও সিদ্ধান্ত নেয় আইনী লড়াইয়ের জন্য।
এ প্রসঙ্গে টরন্টোর মেয়র জন টরি বলেন, “আমরা টরন্টোনিয়ান এবং কানাডিয়ান হিসাবে এমন একটি আইনকে কেবল একপাশে দাঁড়িয়ে থেকে পর্যবেক্ষণ করবো যা আমাদের ধর্মীয় এবং অন্যান্য মৌলিক স্বাধীনতাকে খর্ব করে তা হয় না। ‘কানাডিয়ান চার্টার অব রাইটস এ্যান্ড ফ্রিডম’ এ আমাদের এই মৌলিক স্বাধীনতাগুলো স্বীকৃত।”
জন টরি অন্যান্য সিটি কর্তৃপক্ষকেও এই আন্দোলনে যোগ দেয়ার অহ্বান জানান।
এদিকে ফেডারেল সরকার কেন বিল-২১ এর বিপক্ষে অনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ নেয়নি তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে প্রধান মন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, কুইবেকের অধিবাসীরা ইতিমধ্যেই আদালতে আইনটির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। তাই তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে কোন আইনি পদক্ষেপ নেয়ার আগে দেখতে চান ঐ চ্যালেঞ্জ কতদূর কাজ করছে।
অন্যদিকে কুইবেকের প্রিমিয়ার ফ্রাঁসোয়া লেগল্ট বিল-২১ এর বিরুদ্ধে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জের বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, আমি বুঝি না প্রধানমন্ত্রী কিভাবে একটি আইনের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করবেন যে আইনটি সিংহভাগ লোক সমর্থন করেন কুইবেকে।
তিনি আরো বলেন, বিল-২১ গণতান্ত্রিক উপায়ে ভোটের মাধ্যমে গৃহীত হয়েছে। আমি জানিনা এরকম একটি স্পর্ষকাতর বিষয়ের উপর কেন্দ্রীয় সরকার কি ভাবে হস্তক্ষেপ করবে। সিবিসি নিউজ এ তথ্য জানায়।
ফ্রাঁসোয়া লেগল্ট বলেন, ধর্মনিরপেক্ষার এই আইনটি কানাডার স্বাধীন ও মুক্ত সমাজের সঙ্গে কোন বিরোধ তৈরী করে না।
সিটিভি নিউজের আরেক খবরে বলা হয়, কুইবেকের প্রিমিয়ার ফ্রাঁসোয়া লেগল্ট বলেছেন কুইবেকের স্কুল বোর্ড কর্তৃক এরকম একজন শিক্ষিকাকে চাকরী প্রদান করা উচিৎ হয়নি যিনি হিজাব পরেন। বিষয়টি আগেই নিশ্চিত করা উচিত ছিল।
তিনি সাংবাদিকদের আরো বলেন, বিল-২১ কেবল মাত্র কর্মক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বাড়িতে বা রাস্তায় যে কেউ ইচ্ছে করলে তাঁর নিজ নিজ ধর্ম বিশ^াসের পোষাক পরতে পারেন। কুইবেক ধর্মনিরপেক্ষতাকে বেছে নিয়েছে। তাই আমি মনে করি এটাকে সবারই সম্মান করা উচিৎ।
প্রিমিয়ার ফ্রাঁসোয়া লেগল্ট আরো ব্যাখ্যা করে বলেন, কুইবেকের সরকারী কর্ম ক্ষেত্রে যাঁদেরকে ২০১৯ সালের মার্চ এর আগে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাঁরা ইচ্ছেমত ধর্মীয় পোষাক পরতে পারেন আইন অনুযায়ী। কারণ বিল-২১ পার্লামেন্টে গৃহীত হয়েছে ২০১৯ সালের মার্চে। কিন্তু ফাতেমা সাবস্টিটিউট টিচার হিসাবে কাজ শুরু করে গত বসন্তে। আর স্থায়ী ভাবে তাঁকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে গত অক্টোবরে। তার অর্থ হলো, তিনি কর্মক্ষেত্রে হিজাব পরার অধিকার রাখেন না আইন অনুযায়ী। তাঁর নিয়োগ ২০১৯ সালের মার্চ এর আগে হলে তিনি হিজাব পরতে পারতেন।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, কুইবেকের ইংলিশ স্কুল বোর্ড ধর্মনিরপেক্ষতার এই আইনের বিরুদ্ধে আপিল করেছিল এবং আদালত তাদের পক্ষে রায়ও দিয়েছিল। কিন্তু সরকার আদালতের ঐ রয়ের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করে। ফলে বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কুইবেকের ইংলিশ স্কুল বোর্ডকে ধর্মনিরপেক্ষতার আইন তথা ‘বিল-২১’ কে মেনে চলতে হবে।
উল্লেখ্য যে, কুইবেকের ধর্মনিরপেক্ষতার আইন এই প্রদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার লংঘন করে কিন্তু সংবিধানে একটি উপধারা থাকায় এই মৌলিক অধিকার লংঘন অনুমোদনযোগ্য। গত ২০ এপ্রিল এমনই রুল জারি করেছেন সুপিরিয়র কোর্টের একজন বিচারক।
কুইবেকের বিচারমন্ত্রী,শিমন জোলিন-ব্যারেটি, যিনি ‘বিল-২১’ এর স্রষ্টা, বলেন, ইংরেজি স্কুলকে ছাড় দেয়ার ব্যাপারে আদালতের সিদ্ধান্ত এই প্রদেশকে ভাষার ভিত্তিতে বিভক্ত করার হুমকি সৃষ্টি করবে এবং কুইবেকে দুই ধরণের নাগরিকের জন্ম দেবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা এই রায়ের সঙ্গে একমত নই। কুইবেকে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে চাই, আর এখানে জাতীয় সংসদে যেসব আইন গ্রহণ করা হয়েছে তা প্রত্যেকের ওপর প্রযোজ্য হবে।’
রায়ে ইংরেজি স্কুল ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রেই ধর্মনিরপেক্ষতার আইনটি পুরোপুরি বলবৎ রাখা হয়েছে। আইনটি চারটি আইনী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে এবং এটি কেন অসাংবিধানিক সেই বিষয়ে প্রতিটি চ্যালেঞ্জেই বেশ কিছু যুক্তি রয়েছে।
কানাডীয় মুসলিম ন্যাশনাল কাউন্সিল ও কানাডার সিভিল লিবার্টিজ অ্যাসোসিয়েশনসহ নাগরিক মুক্তি বিষয়ক গ্রুপগুলো আইনটি পাস হবার পর থেকেই এর বিরুদ্ধে মামলা করতে শুরু করে।
উল্লেখ্য যে, কুইবেক প্রভিন্সের কোন সরকারী অফিসে কর্মরত নাগরিকেরা ধর্মীয় পোষাক বা প্রতীক ব্যবহার করতে পারবেন না এমন আইনের খসড়া (বিল-২১) পার্লামেন্টে উত্থাপনের পর থেকেই স্থানীয় মুসলিম নারীদের প্রতি চরম মাত্রায় বৈষম্য ও হয়রানি বৃদ্ধির অভিযোগ উঠেছিল। এই অভিযোগ করেন মন্ট্রিয়লের ওমেন এ্যাডভোকেসী গ্রুপ `Justice Femme’। এই গ্রুপটি মহিলাদেরকে আইনি ও মানসিক সহায়তা দিয়ে থাকে। বিলটি উত্থাপনের পরবর্তী কয়েক মাসে বেশ কিছু হয়রানির অভিযোগ পেয়েছিল তাঁরা কুইবেকের হিজাবধারী মহিলাদের কাছ থেকে। অভিযোগের মধ্যে আছে আক্রমনাত্মক মন্তব্য থেকে শুরু করে শারীরিক সহিংসতাও। খবর সিবিসি নিউজের।
`Justice Femme’ এর প্রেসিডেন্ট হানাদী সাদ বলেন, আইনের খসড়া (বিল-২১) পার্লামেন্টে উত্থাপনের পর থেকেই তাদের সংস্থা `Justice Femme’ বৈষম্য ও হয়রানির বিষয়ে যে পরিমাণ অভিযোগ পেয়েছে তার মাত্রা ‘অস্বাভাবিক’। তিনি আরো বলেন, মুসলিম নারীরা বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা হারাচ্ছেন।
তবে কানাডার বেশিরভাগ মানুষ ‘কানাডিয়ান চার্টার অব রাইটস এ্যান্ড ফ্রিডম’ প্রতি দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল এবং বৈচিত্রের ধারণার জোরালো সমর্থক হলেও ইতিপূর্বের এক জরিপে দেখা গেছে যে, এক-তৃতীয়াংশ কানাডিয়ান তাদের নির্বাচিত রাজনীতিকদের ধর্মীয় প্রতীক পরিধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা চায়। দি কানাডিয়ান প্রেস এ তথ্য প্রকাশ করে।
জরিপে অংশ নেওয়া কুইবেকবাসীর বেশিরভাগই একমত ছিলেন যে, কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিকদের দায়িত্বে থাকার সময় হিজাব, ক্রুসিফিক্স বা পাগড়ির মত ধর্মীয় প্রতীক পরতে দেওয়া উচিৎ নয়।
সারাদেশের ৪৯ শতাংশ মানুষ অবশ্য মত দিয়েছিলেন যে, তাঁরা এধরণের নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করবেন না। তবে ৩৭ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন, তাঁরা সমর্থন করবেন।
২০১৯ সালে লেগার মার্কেটিংয়ের এই জরিপ চালানো হয়েছিল, কুইবেকে প্রস্তাবিত ধর্মনিরপেক্ষ আইনের ব্যাপারে জনগণের অনুভূতি কি ছিল তা জানার জন্য। এই আইন অবশ্য নির্বাচিত রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তবে তাঁদেরও এই আইনের আওতায় আনা উচিৎ কিনা এমন একটি প্রশ্ন জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতীকের ব্যাপারে কী ধরণের মনোভাব পোষণ করেন সেটা জানার জন্যই এটা করা হয়।
জরিপের আয়োজক কানাডিয়ান স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জ্যাক জেডওয়াব বলেছিলেন, জরিপে যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে তা গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরকে যাঁরা হুমকি বলে মনে করেন প্রধানত তাঁরাই এ ধরণের নিষেধাজ্ঞার পক্ষে। তাঁরা ইসলাম ও মুসলিমদের সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন এবং হিজাবের ব্যাপারে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখান।
উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে হিজাবের ব্যাপারে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বিতর্কের ঝড় তুলেছিলেন কুইবেকের এক বিচারক। শুধু হিজাব পরার কারণে মন্ট্রিলের এক নারীর মামলা শুনতে তিনি অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। বিতর্কের সূচনা ঘটে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন এল-আলোউল নামের এক মুসলিম মহিলা হিজাব পরে তাঁর বাজেয়াপ্ত করা গাড়ি ফিরে পাবার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হন।
বিচারক মারেঙ্গো তখন এল-আলোউলকে বলেছিলেন, ‘আমার বিবেচনায় আপনার পোশাক যথাযথ নয়। আদালত হলো একটি ধর্মনিরপেক্ষ জায়গা। তাই আদালতের সামনে কেউ ধর্মীয় প্রতীক পরতে পারেন না।’
মারেঙ্গো মামলাটি স্থগিত রাখেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এল-আলোউল তাঁর গাড়ি ফিরে পান। কিন্তু ঘটনাটি সারা বিশ্বে সংবাদ শিরোনাম হয়।
তবে ঘটনার পাঁচ বছর পর অবশেষে সেই বিচারক ক্ষমা চেয়েছেন। সিবিসি নিউজের এক খবরে বলা হয় সেই বিচারক স্বীকার করছেন যে, এল-আলোউলকে হিজাব খুলতে বলে তিনি ভুল করেছিলেন। এজন্যে এল-আলোউলকে যে অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে সেজন্যে তিনি দুঃখিত। তবে এল-আলোউলকে আঘাত করার বা তাঁর প্রতি কোনও রকম অশ্রদ্ধা থেকে মারেঙ্গো এটা করেননি বলে জানান।
মারেঙ্গো ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ওই সময় তিনি এল-আলোউলের হিজাবকে মাথায় টুপি পরা এবং সানগ্লাস পরার মত ব্যাপার বলেই ধরে নিয়েছিলেন।
মারেঙ্গো তার বিবৃতিতে বলেন, ‘আমি হ্যাট ও সানগ্লাস পরার বিষয়টি উল্লেখ করেছিলাম নিছক আদালতের শোভনতার বিষয়টি বিবেচনায় যেটা সাধারণভাবে আদালতকক্ষে অনুসরণ করা হয়। আমি কোনওভাবেই আপনার প্রতি বা আপনার বিশ্বাসের প্রতি অশ্রদ্ধা থেকে এটা করিনি।’
এল-আলোউলের কাছে সর্বান্তকরণে ক্ষমা চাওয়ার মধ্য দিয়ে নিজের বিবৃতি শেষ করেন মারেঙ্গো। মারেঙ্গোর বিবৃতির জবাবে এল-আলোউলও এক বিবৃতি দেন এবং তাতে তিনি মারেঙ্গোর ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি মেনে নেন।
এল-আলোউল বলেন, ‘আদালত কক্ষের সেই দিনটির কথা আমার মনে এখনও এতটাই তীব্র যেন সেটি গতকালের ঘটনা। আমি কল্পনাও করতে পারছিলাম না যে, কেবল আমার হিজাবের জন্য আমাকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হবে, আমার বিশ্বাসের কারণে আমার অধিকার কেড়ে নেয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেদিন তিনি আমাকে কতটা কষ্ট দিয়েছেন এবং তাঁর কাজের জন্য কেন তাকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে আশা করি মারেঙ্গো সেটি বুঝবেন। এমন নয় যে, আমাদের বিচার ব্যবস্থা কিছু মানুষের জন্য তৈরি এবং অন্যদের জন্য নয়। না, এখানে গণতন্ত্র আছে যেখানে আইনের চোখে সবাই সমান।’
‘আমি তাঁর ক্ষমা প্রার্থনা মেনে নিচ্ছি। আমার ধর্ম বিশ্বাস আমাকে সেই শিক্ষাই দিয়েছে।’
কুইবেকের ধর্মনিরপেক্ষতার আইন ও কপটাচরণ
লক্ষনীয় যে, কুইবেকে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে পোষাক সংক্রান্ত এক আইন। সেই আইন অনুযায়ী হিজাব, পাগড়ী এসব পরিধান করে কেউ সরকারী অফিসে কাজ করতে পারবে না। কিন্তু যাঁরা এই আইন প্রণয়ন করেছেন অর্থাৎ রাজনীতিকরা, তাঁরা তাদের পছন্দমত ধর্মীয় পোষাক পরতে পারবেন কর্মস্থলে। তাদের মূল কর্মস্থল, যেখানে বসে তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষাতার আইন পাশ করেছেন সেই কুইবেক পার্লামেন্ট ভবনের অভ্যন্তরে স্পীকারের মাথার উপর ঝুলে আছে যিশু খৃষ্টের ক্রশবিদ্ধ বিশাল আকৃতির এক দেয়াল মূর্তি। এই মূর্তিটি কি ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক? এই প্রশ্ন অনেকেই তুলেছেন। এমনকি দাবীও উঠেছে এটি অপসারণের। কিন্তু আজো এটি সরানো হয়নি। ইতিপূর্বে ‘পার্টি কুইবেকো’ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় অস্বীকৃতি জানিয়েছিল মূর্তিটি অপসারণের ব্যাপারে।