খাদ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় কানাডিয়ান ক্রেতারা অভ্যাস পাল্টাতে বাধ্য হচ্ছেন
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক, ০২ অক্টোবর ২০২১ : কানাডায় মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রায় ৪০ শতাংশ ক্রেতা মনোহারি সামগ্রী কিনতে গিয়ে আগের চেয়ে বেশি পরিমাণে মূল্যছাড় ও বিশেষ সুবিধার ওপর দিকে নজর রাখছেন।
ডালহৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি-খাদ্য গবেষণা কেন্দ্রের (Agri-Food Analytics Lab) নতুন এক রিপোর্টে দেখা গেছে, জরিপে অংশ নেয়া ৮৬ শতাংশ কানাডীয় মনে করেন, খাদ্যমূল্য ছয় মাস আগের তুলনায় বেশি। এর ফলে, প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে দুজন বলেন, টাকা বাঁচানোর জন্য তারা গত এক বছর ধরে বাজার করার অভ্যাসে পরিবর্তন এনেছেন। খবর গ্লোবাল নিউজ এর। রিপোর্ট করেছেন সিন বয়েনটন।
ভ্যাঙ্কুভারের বাসিন্দা ৪৫ বছর বয়সী কিম বলেন, “আমি আসলেই একজন ভালো ক্রেতা। আমি সব সময় মূল্যছাড় এবং বিশেষ সুবিধাজনক প্যাকেজ খুঁজে নিই। তবে এ বছর এটা ছিলো কঠিন। আমাকে খেলাটা আরও জোরদার করতে হয়েছে।” মিজ. কিম তার পুরো নাম ব্যবহারে সম্মত হননি।
কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব থেকে বিশ্ব অর্থনীতির ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসার এই মুহূর্তে কানাডা ও অন্য অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। মহামারীর শুরুর মাসগুলিতে মানুষ ঘরে থাকার কারণে চাহিদার স্বল্পতায় জিনিপত্রের দাম পড়ে যায়। আর অর্থনীতির বড় খাতগুলি মাসের পর মাস বন্ধ থাকে।
যেহেতু এখন দোকানপাট আবারও খুলছে এবং সামাজিক মেলামেশা শুরু হচ্ছে, সে কারণে চাহিদাও বাড়ছে এবং পণ্য নির্মাতা ও কৃষি ব্যবসায় সংশ্লিষ্টরা জোগান দিতে জোর চেষ্টা করছেন।
কোন বিশেষ পণ্যটির দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে জিজ্ঞাসা করা হলে, বেশিরভাগ কানাডীয় মাংসের দামের কথা বলেন। এদের সংখ্যা ছিলো ৫১.৮%। দাম বাড়ার তালিকায় এর পরেই মনোহারি পণ্যের কথা বলেন ১৫.৭% কানাডীয়।
স্ট্যাটিস্টিক কানাডার হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর সার্বিকভাবে কানাডার মূল্যস্ফীতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪.১ শতাংশ। এটি ২০০৩ সালের পর মূল্যস্ফীতির সর্বোচ্চ হার।
স্ট্যাটিস্টিক কানাডার হিসাবে, গত এক বছর সময়কালে ভোগ্যপণ্যের মূল্য সূচকে খাদ্যমূল্য ২.৭ শতাংশ বেড়েছে। তবে ডালহৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ের দলটি বলছে, তারা দেখতে পেয়েছেন, মূল্যস্ফীতির হার প্রায় পাঁচ শতাংশের কাছাকাছি।
অবশ্য উভয় পক্ষই একমত যে, অন্যসব খাদ্যের তুলনায় মাংসের দাম বেশি বেড়েছে। স্ট্যাটিস্টিক কানাডার হিসাবে, ২০২০ সালের আগস্টের তুলনায় এখন মাংসের দাম বেড়েছে প্রায় সাত শতাংশ।
ডালহৌসির সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রায় অর্ধেক কানাডীয় ছয় মাস আগে যে পরিমাণ মাংস কিনতেন তার চেয়ে এখন কম পরিমাণে কিনছেন। সমীক্ষায় গত সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে ১০ হাজারের বেশি কানাডীয়র মতামত সংগ্রহ করা হয়। তাতে অর্ধেকের বেশি কানাডীয় বলেন, অন্য খাবারের তুলনায় ওই সময় মাংসের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।
সমীক্ষায় অংশ নেয়া কানাডীয়রা ফলমূল, সবজি, মাছ ও বেকারি পণ্যের দাম বেড়েছে বলেও উল্লেখ করেন। দাম বৃদ্ধির এই প্রবণতাকে বিশেষজ্ঞরা গত কয়েক বছরের তুলনায় অস্বাভাবিক বলে উল্লেখ করেন।
ডালহৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবং কৃষি-খাদ্য বিশ্লেষণ ল্যাব-এর পরিচালক সিলভেইন শার্লিবয় (Sylvain Charlebois) কানাডিয়ান প্রেসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
“মনোহারি শপের প্রতিটি পণ্যেই মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়েছে- প্রভাব পড়েনি এমন কোনও পণ্য নেই।”
“সচরাচর ফুলকপি, গরুর গোশত বা টমেটো নিয়ে কথা হতো। চলতি বছর ভিন্ন সব পণ্য আলোচনায় উঠে এসেছে।”
রিপোর্টে দেখা যায়, প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি উত্তরদাতা কেনাকাটায় গত বছরের চেয়ে বেশি পরিমাণে মুদ্রিত ও ডিজিটাল কুপন ব্যবহার করেছেন। অনুরূপ সংখ্যক উত্তরদাতা বলেন, টাকা বাঁচানোর আরেকটি উপায় হিসাবে তারা ২০২০ সালের চেয়ে এ বছর বেশি পরিমাণে মূল্যছাড়ের পণ্য কিনছেন যেগুলি প্রায় মেয়াদউত্তীর্ণ হবার পর্যায়ে রয়েছে।
স্টোরগুলোতে মূল্যছাড়ের পণ্যগুলি ২০২০ সালের চেয়ে ক্রেতাদের বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করছে। মোট ৩৯.৬% কানাডীয় ২০২০ সালের চেয়ে বেশি হারে মেয়াদউত্তীর্ণ/ মেয়াদের তারিখের আগে খাওয়া ভালো এরকম পণ্য মেয়াদ শেষ হবার আগে আগে ছাড়কৃত মূল্যে কিনছেন।
তবে তিনি এটাও খেয়াল করেন যে, তার কেনাকাটার ট্রলি চলতি বছরেরই আগের তুলনায় কম ভরেছে। তাই তিনি প্রায়শ ওই খাবারে একাধিক রাত পার করার চেষ্টা করেন।
তিনি হেসে হেসে বলেন, “নিঃসন্দেহে রাতের খাবারে মাংসের উপকরণ কমাতে হয়েছে, এটা ঠিক। হতে পারে, আমরা মাসে একদিন নিজেদেরকে ভালো কিছু খাবো, আর এটাই বাস্তবতা।”
ক্যালগেরির বাসিন্দা ব্রাইসির বয়স ত্রিশের কোটায়। তিনি বলেন, ফলমূল ও সবজির দাম গত বছর থেকেই “আকাশ ছুঁতে যাচ্ছে” এটা তিনিও লক্ষ্য করেছেন। এর ফলে তার স্কুলগামী দুই সন্তানের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবারের জোগান দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, “ভারসাম্য রক্ষা করা খুব কঠিন। আমি নিজে মাঝেমধ্যে কিছু জিনিস (ফলমূল ও সবজি) দোকানের কাউন্টারেই ছেড়ে আসি যাতে অন্যগুলো বাড়িতে আনা নিশ্চিত করা যায়।”
ডালহৌসির সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ১০ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, অন্যান্য পণ্যের তুলনায় ফলমূল ও সবজির দাম গত ছয় মাসে বেশি বেড়েছে। সমীক্ষা রিপোর্টের লেখকরা অবশ্য উল্লেখ করেন যে, পণ্য উৎপাদনের ব্যয় এই সময়কালে সাধারণভাবে সস্তা ছিলো।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার উদ্ঘাটন হলো, তাদের মূল্য সূচকে দৃশ্যত অনেক সবজির দামই প্রকৃতপক্ষে গত বছরের তুলনায় কমেছে, যদিও কিছু ফলের দাম – বিশেষ করে আপেলের দাম বেড়েছে।
সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে যে, ছয় মাস আগের তুলনায় এখন খাদ্যমূল্য বেড়েছে বলে ৮৬ শতাংশ কানাডীয় বিশ্বাস করলেও, এই পর্যবেক্ষণ সবচেয়ে বেশি হলো বেবি বুম জেনারেশনের মধ্যে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১৯৬০এর দশকের মাঝামাঝি যাদের জন্ম), যাদের ৯৩ শতাংশই খাদ্যমূল্য বাড়ার কথা বলেছেন।
ব্রাইসি বলেন, তার নিজের এবং তা বন্ধুদের মত অপেক্ষাকৃত তরুণ কানাডীয়রাও মূল্যবৃদ্ধির চাপ অনুভব করছেন এবং তিনি আশাবাদী যে, মহামারীর বাস্তবতার সঙ্গে অর্থনীতি আরও খানিকটা খাপ খাইয়ে নিলে পণ্যমূল্য আবারও কমে আসতে শুরু করবে।
তিনি বলেন, “যদি আরেকটি লকডাউন আসে তাহলে নিশ্চয়ই আমি খাদে পড়তে চাইব না। আশা করবো সবকিছু শিগগিরই শান্ত হয়ে আসবে।”
সামনের দিনগুলির প্রসঙ্গে শার্লিবয় বলেন, যেহেতু জাহাজীকরণ, শ্রমিক ও অন্যান্য জোগানদারির উচ্চমূল্য বহাল থাকবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে তাই খাদ্যপণ্যের দামও বাড়তিই থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্তার এক সূচকে দেখা যায়, বছর ঘুরে গত আগস্টে সারা বিশ্বে খাদ্যের দাম ৩০ শতাংশ বেড়েছে।
– কানাডিয়ান প্রেস ও রয়টারস-এর নথি থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে