কানাডায় যারা স্বল্প-মজুরির অনিশ্চিত কিন্তু অপরিহার্য কাজগুলো করেন তাদের জন্য কেন আরও ভালো কর্ম-সুবিধা দরকার

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : বৃহত্তর টরন্টো এলাকার একটি লন্ড্রিতে প্রায় এক দশক ধরে কাজ করছিলেন হং। এরপর মহামারি শুরু হয়।

তিনি বলেন, প্রায় ১০০ জন কর্মচারীর জন্য কোম্পানি মাস্ক, গাউন এবং চোখের সুরক্ষার সরঞ্জাম সরবরাহ করে। এর ফলে তিনি যখন প্রতি ঘণ্টায় ১৪ দশমিক ৭৫ ডলারের বিনিময়ে ১৮ কেজি ওজনের কাপড়ের ব্যাগগুলো আনা নেয়া করেন তখন অন্যদের সঙ্গে যুক্তিসঙ্গত দূরত্ব রক্ষা করা সম্ভব হয়। (চাকরির নিরাপত্তার স্বার্থে সিবিসি রেডিও তার নামের পরের অংশ উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকে।)

কিন্তু নববর্ষের দিন খাবার ঘরে হং তার দুজন সহকর্মীর সঙ্গে বসেছিলেন। একজন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যাকে তিনি মি. ওয়াং বলে উল্লেখ করেন এবং তারই কাহিনী বলার উদ্দেশ্যে সেখানে বসা। হং বলেন, ৩০ বর্গমিটারের মত আয়তনের ছোট্ট সেই কর্মবিরতির কক্ষে প্রায় ২০ জন শ্রমিক গাদাগাদি হয়ে অবস্থান করছিলো।

চীনা ভাষার একজন অনুবাদকের সাহায্য নিয়ে সিবিসি/রেডিও-কানাডাকে হং বলেন, মি. ওয়াং ভালো বোধ করছিলেন না। ‘তার মাথা ব্যথা করছিলো, কাশছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, সম্ভবত অ্যালার্জির কারণে এমনটা হচ্ছে।’

ওয়্যারহাউজের কর্মী, গ্রোসারি স্টোরের কর্মচারী থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের সেবিকা পর্যন্ত সব অপরিহার্য শ্রমিকরাই মহামারির আঘাতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ছবি : জাস্টিন সুলিভান/গেটি ইমেজ

কিন্তু সেসময় মি. ওয়াংয়ের স্ত্রী বেকার ছিলেন। সেজন্যে তিনি হং ও অন্য সহকর্মীদের বলেন যে, বিনাবেতনে দিনটি পার করার সামর্থ তার নেই। পরের দিন এবং তৃতীয় দিন তার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। তার ঘরে থাকা দরকার ছিলো। যদিও সে সময় হং জানতেন না, ওয়াং দ্রুতই হাসপাতালে যান। সেখানে পরীক্ষায় তার কোভিড-১৯ শণাক্ত হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি মারা যান, এর পরের মাসেই তার অবসরে যাবার কথা ছিলো। 

এদিকে হং এবং অন্য যেসব সহকর্মী একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়েছিলেন তারাও পরীক্ষায়  কোভিড-১৯ আক্রান্ত বলে শণাক্ত হন। তার সহকর্মীরা সেরে ওঠেন কিন্তু ৬০-এর কোঠায় পা রাখা হংয়ের দেহে শ্বাসকষ্ট, ক্লান্তি, স্মৃতি ঝাপসা হওয়া এবং মারাত্মকভাবে পা ফুলে যাওয়াসহ বিভিন্ন কোভিড-উত্তর লক্ষণ দেখা দেয়। কোভিডমুক্তির জন্য সরকারিভাবে দেয়া দুই সপ্তাহের আর্থিক সুবিধা (ঈজঝই) শেষ হয়ে গেলে হং তার চিকিৎসকের পরামর্শ উপেক্ষা করেই ৩০ জানুয়ারি কাজে যোগ দেন। (পরে ঈজঝই-এর আওতা বাড়িয়ে চার সপ্তাহ করা হয়)

শ্রম বিষয়ক প্রবক্তারা বলেন, ওয়্যারহাউজের কর্মী, গ্রোসারি স্টোরের কর্মচারী থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের সেবিকা পর্যন্ত সব অপরিহার্য শ্রমিকরাই মহামারির আঘাতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আর সেজন্যেই অধিকতর উচ্চ মজুরি এবং শ্রমিক সুরক্ষা ব্যবস্থাসহ তাদের কল্যাণকর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার দরকার আছে।

তারা বলছেন, এর অর্থ হলো, সবচেয়ে বেশি প্রান্তিক অবস্থায় পড়া এই শ্রমশক্তি, যারা খুব সামান্য মজুরি  পায়, যাদের চাকরির নিশ্চয়তা ভঙ্গুর এবং সচরাচর অসুস্থতাজনিত ছুটির দিনে মজুরি দেয়া হয় না, তাদের সমস্যার সমাধানে প্রাদেশিক ও টেরিটোরিগুলোর শ্রম আইন সংস্কার করতে হবে।

কানাডিয়ান লেবার কংগ্রেসের প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া হাসান ইউসুফ বলেন, ‘চলমান সঙ্কট যে সত্য প্রকাশ করেছে, আমি বিশ্বাস করি, সেটি হলো শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ, বিশেষ করে সবচেয়ে দুঃস্থ কর্মীদের সুরক্ষায় দেশজুড়ে আমাদের শ্রম আইন কতটা অপর্যাপ্ত।’ হাসান ইউসুফ ২০১৪ সাল থেকে লেবার কংগ্রেসের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি সিবিসি’র সানডে ম্যাগাজিনের প্রতিনিধি ডেভিড কমনকে বলেন, ‘আমার মনে হয়, কানাডীয়রা এই প্রথম আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে যে, যেসব লোক সামনের কাতারে ছিলো এবং দেশকে চলমান রেখেছেÑ মনোহারি সামগ্রীর সরবরাহ ঠিক রেখেছেÑ পণ্য সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে এবং অন্য সব চাহিদাও পূরণ করেছেÑ তারা বহুলাংশেই প্রান্তিক

জনগোষ্ঠীতে পরিণত। ‘তবে এটি এই সত্যও প্রকাশ করে দিয়েছে যে, এই ব্যক্তিদের অবস্থা কতটা নাজুক।’

অন্টারিওর ব্রাম্পটন ও স্কারবরোর মত এলাকার জনগণ সারা দেশের চেয়ে বেশি কোভিড সংক্রমণ, বেশি সংখ্যক মানুষের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ইত্যাদি কারণে মহামারিকালে অনেক বেশি ভোগান্তির শিকার হয়। এর অন্যতম কারণ হলো এসব এলাকায় ওয়্যারহাউজ, কারখানা ও অন্যান্য খাতের অপরিহার্য চাকরিতে কর্মরত লোকেরা বসবাস করে যাদের সঙ্গে শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করা ছিলো দুরূহ। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে কোভিডের লক্ষণ নিয়ে চাকরিতে যেতে না পারা লোকেদের নিয়ে যার অর্থ হলো ভাড়া দিতে অসমর্থ হওয়া অথবা এমনকি চাকরি হারানোও।

বর্তমানে যে সঙ্কট সেটা হলো, শ্রম আইনের বিষয়টি প্রত্যেক প্রদেশ ও টেরিটোরির নিজস্ব এখতিয়ার। সুতরাং এমন কোনও একক নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই যেটি সব কানাডীয়র জন্য অসুস্থতার দিনে মজুরি প্রদান এবং অধিকতর মানবিক ন্যূনতম বেতন দেয়ার মত একটি আইন প্রণয়ন করতে পারে।

অবশ্য, সিবিসি রেডিওকে দেয়া এক বিবৃতিতে কানাডার কর্মসংস্থান ও সামাজিক উন্নয়ন দপ্তর (ঊঝউঈ) বলেছে, পুরো মহামারির সময় ধরেই কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক ও টেরিটোরির শ্রমমন্ত্রীরা ভার্চুয়াল মিটিংয়ে মিলিত হয়েছেন এবং তারা একমত হয়েছেন যে, তাদেরকে ‘কানাডার সব শ্রমিকের কল্যাণের স্বার্থে এসব ইস্যুতে’ অবশ্যই একযোগে কাজ করতে হবে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘সিআরএসবি’র মত কোভিড-কেন্দ্রিক সুবিধার অতিরিক্ত হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকার গত বাজেটে কিছু পরিবর্তন এনছেন যা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত শিল্পে নিয়োজিত স্বল্প-বেতনের কর্মচারী যেমন, এয়ারলাইনের ব্যাগেজ বহনকারী, ট্রাকচালক এবং ব্যাংকের নগদ অর্থ ও অন্যান্য সরঞ্জাম বহনকারী কর্মীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এসব পরিবর্তনের মধ্যে চাকরির বর্ধিত নিরাপত্তাসহ অসুস্থতাজনিত ছুটি মঞ্জুর করার পাশাপাশি ঘণ্টায় ১৫ ডলার করে ন্যূনতম মজুরির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যেটি তার বাসস্থান যে প্রদেশে সেই প্রদেশের আইনে বাধা হবে না।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই ব্যবস্থার ফলে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত বেসরকারী খাতের ২৬ হাজারের বেশি শ্রমিক সুবিধা পাবে যারা বর্তমানে প্রতি ঘণ্টায় ১৫ ডলারের কম মজুরি পায়।’

হং বলেন, তিনি অন্টারিওর প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ডকে বলতে চান যে, এই প্রদেশে অসুস্থতাজনিত ছুটির সময় মজুরি দেয়ার যে সাময়িক বিধি করা হয়েছে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য অব্যাহত রাখা হোক। অন্টারিওর কোভিড-১৯কালে শ্রমিকদের আয়ের সুরক্ষা সুবিধা সম্পর্কিত বিধিতে অসুস্থতার জন্য তিনদিন মজুরি দেয়ার ব্যবস্থা আছে, যা অনেকের মতে কোভিড থেকে সেরে ওঠার জন্য যথেষ্ট নয়। এখন পর্যন্ত প্রাদেশিক সরকার এই কর্মসূচি অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়ানোর ব্যাপারে কোনও পরিকল্পনার আভাস দেয়নি। কর্মসূচিটি ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হবে।

ওয়ার্কার্স অ্যাকশন সেন্টারের দীনা ল্যাড বলেন, ‘আমরা যেটা দেখতে পেলাম সেটা হলো, ক্ষুদ্র ব্যবসায়গুলো সত্যিই কোনওভাবে এগিয়ে এসেছে এবং সত্যিই তাদের বেতন ও কর্মপরিবেশ উন্নততর করেছে। কিন্তু বৃহত্তর করপোরেশনগুলি যারা বিপুল অর্থ আয় করে, তারা সেটা করে না, যা তাদের করা উচিৎ।’

‘আমাদের উচিৎ বৃহত্তর করপোরেশনগুলিকে চাপ প্রয়োগ করা এবং তাদেরকে এটা বলা যে, করপোরেট সিটিজেন হিসাবে তোমাদের দায়িত্ব হলো তোমাদের শ্রমিকদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং তাদের বেতন বাড়ানোটা তাদের প্রাপ্য। আর এই মহামারি থেকে তোমরা যে মুনাফা করেছো তার অংশবিশেষ তোমাদের অংশীদারদের কাছে নয়, বরং শ্রমিকদের পকেটে যাওয়া উচিৎ।’

সূত্র : ব্রান্ডি ওয়েইকল – সিবিসি রেডিও