দেশবাসীর প্রতি ইসলামভীতিসহ সব ধরণের ঘৃণা প্রতিরোধের আহবান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো দেশে ইসলামভীতির বিরুদ্ধে ভূমিকা পালনের জন্য কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা ও কর সংস্থাগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তিনি গত ২২ জুলাই ইসলামভীতি বিষয়ক শীর্ষ বৈঠকে উদ্বোধনী ভাষণ দিচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘কানাডার রাজস্ব সংস্থা (Canada Revenue Agency- CRA) থেকে শুরু করে সব নিরাপত্তা সংস্থা, ইন্সটিটিউটকে জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে, তাদের নিশানা বানানো চলবে না।’
নাগরিক স্বাধীনতা সংগঠনগুলো সিআরএ-র বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছিলো যে, সংস্থাটি অডিট প্রক্রিয়া এবং নানা তুচ্ছ অজুহাতে মুসলিম দাতব্য সংস্থাগুলোকে নিশানা করছে।
প্রধানমন্ত্রী ইসলামভীতিসহ সব ধরণের ঘৃণার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সব কানাডীয়র প্রতিও আহবান জানান। তিনি বলেন, এটি প্রয়োজন এমন একটি কানাডা গড়ে তোলার জন্য, ‘যেখানে আমরা বৈচিত্র্য উদযাপন করবো, যেখানে আমরা সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াবো।’
তিনি বলেন, ‘এটিই হলো সেই অঙ্গীকার যার উচ্চকিত রাখতে আমাদের জাতিকে অবশ্যই কঠোর শ্রম দিতে হবে, কারণ অনেক, অনেক বার এবং অনেক মানুষের ক্ষেত্রে এই অঙ্গীকার ভঙ্গ করা হয়েছে।’
গত ৬ জুন কানাডার লন্ডন শহরে সন্ত্রাসী হামলায় ট্রাক চালিয়ে দিয়ে একটি মুসলিম পরিবারের চার সদস্যকে হত্যা করা হয়। ১২ জুলাই অন্টারিওর হ্যামিল্টনে হিজাব পরা এক নারী ও তার মেয়েকে হত্যার হুমকি দেয়া এবং অসভ্য বর্ণবাদী ভাষায় গালমন্দ করা হয়
ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিমস (NCCM) এক রিপোর্টে বলেছে, গত পাঁচ বছরে পরিকল্পিত সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে কানাডায় যত মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছে তাদের সংখ্যা জি-৭ ভুক্ত অন্য যে কোনও দেশের চেয়ে বেশি।
সরকারি (Crown corporation) দাতব্য সংস্থা জাতিগত সম্পর্ক বিষয়ক ফাউন্ডেশনের (Canadian Race Relations Foundation) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ হাশিম বলেন, কানাডায় মুসলিম হত্যার যে সংখ্যা তুলে ধরা হচ্ছে তা সম্ভবত কমিয়ে দেখানো পরিসংখ্যান।
তিনি বলেন, ‘আমি যখন কমিউনিটির বিভিন্ন সংগঠন এমনকি পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে যাই তখন যেটা শুনতে পাই তা হলো, পুলিশে রিপোর্ট করা হয়েছে এমন সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত হত্যার সংখ্যা অনেক বেশি।’
ইন্সটিটিউটগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনা
গ্লোবাল নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রুডো বলেন, ‘কিছু রাজনীতিক আছেন যারা ঘৃণা ও বিভেদ থেকে ফায়দা লোটেন, আমরা সরকার হিসাবে ওই প্রবণতার বিরুদ্ধে সক্রিয় আছি।’
শীর্ষ বৈঠকের আগে এনসিসিএম সরকারের সর্বস্তরে পরিপালনের জন্য নীতি বিষয়ক ৬১টি সুপারিশ প্রকাশ করে, যার মধ্যে রয়েছে:
– ইসলামভীতি বিষয়ে একজন দূত নিয়োগ দেয়া
– শহরে-নগরে জনসচেতনতা বিষয়ক প্রচারণা কার্যক্রম চালানো
– জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম ও তারা কীভাবে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী গ্রুপগুলোর সঙ্গে কাজ করে সে বিষয়ে তদন্ত অনুষ্ঠান
– ঘৃণাজনিত অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের জন্য একটি জাতীয় সহায়তা তহবিল গঠন
– প্রত্যেক প্রদেশে একটি করে প্রাদেশিক হেটক্রাইমস অ্যাকাউন্টেবিলিটি ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা
গত ২১ জুলাই ঘোষণা কেন্দ্রীয় সরকার করেছে যে, তারা ঘৃণাপ্রসূত অপরাধের ঝুঁকিতে রয়েছে এমন কমিউনিটিগুলোর সহায়তায় নেয়া ১৫০টি প্রকল্পে ৬০ লাখ ডলারের বেশি অর্থ ব্যয় করবে।
ঘৃণাপ্রসূত অপরাধের ঝুঁকিতে থাকা সম্প্রদায়গুলোর সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে ২০২১ সালের বাজেটে আরও ২০ লাখ ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে। অলাভজনক সংগঠন, যেমন উপাসনালয়, বিদ্যালয় এবং কমিউনিটিভিত্তিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের নিরাপত্তা কাঠামো জোরদারের জন্য এই অর্থ দেয়া হবে।
পরিবহন মন্ত্রী ওমর আলঘাবরা বহু বছর থেকে বলে আসছেন, ইসলামভীতি পরিমিত থেকে দিনদিন অপরিমিত হয়ে উঠেছে সরকারসমূহ, বিভিন্ন ইন্সটিটিউট ও গণমাধ্যমের হাত ধরেই।
ইসলামভীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থার অংশ হিসাবে চলতি বছর ২৯ জানুয়ারি কুইবেক সিটির মসজিদে হামলার স্মরণে জাতীয় দিবস ঘোষণা করা হয়।
হাশিম কুইবেক প্রদেশের বিল ২১ শীর্ষক আইনের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করেন। ওই আইনে কিছু সরকারি চাকুরের জন্য ধর্মীয় প্রতীক পরিধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আসুন আমরা সত্য চেপে না যাই। এটি হলো সরকার অনুমোদিত বৈষম্য।’
ওয়াটারলু অঞ্চলের ডিস্ট্রিক্ট স্কুল বোর্ডের শিক্ষা বিষয়ক পরিচালক জিওয়ান চানিকা বলেন, ‘কৌতুহলোদ্দীপক এটাই যে, ওই সেই প্রদেশ যেখানে (কুইবেক সিটিতে) সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে… এটা সেই প্রদেশ যেখানে মুসলিম মেয়েরা এখন বেড়ে উঠছে এটা জেনে যে, হিজাব ছেড়ে না দেয়া পর্যন্ত এখানে তাদের জন্য সম্ভাবনার কোনও দুয়ার খোলা নেই।’
মুসলিম নারীর প্রতি সহিংসতা
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার রিপোর্টে প্রকাশ, ২০১৯ সালে দেশটিতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণাপ্রসূত হামলার বিভিন্ন ধরনের মধ্যে নারীদের টার্গেট করে হামলা চালানোর ঘটনাই ছিলো বেশি। ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে কানাডায় ঘৃণাপ্রসূত হামলার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের প্রায় অর্ধেকই (৪৭শতাংশ) ছিলো নারী। আর অন্য সব সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যত ঘৃণাপ্রসূত হামলার ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই ছিলো মুসলিম নারী।
শীর্ষ বৈঠকে জনগণের জন্য উন্মুক্ত ছিল না
কানাডিয়ান হেরিটেজের নির্বাহী পরিচালক পিটার ফ্লেগেল বলেন, ‘আমরা জানি, আমাদের কাজ কেবল তখনই কার্যকর হতে পারে যখন আমরা (অন্য সব সম্প্রদায়ের সঙ্গে) ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবো। এজন্যেই এমনভাবে ধারাবাহিক শীর্ষ বৈঠকের পরিকল্পনা করা হয় যেখানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নেতা ও রাজনৈতিক নেতাদের সমাবেশ ঘটবে।’
তারপরও, ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত এই বৈঠক সাধারণ মানুষের জন্য মূলত রুদ্ধই ছিলো। সরকার বলছে, অংশগ্রহণকারী এবং যারা মতামত তুলে ধরেছেন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
উদ্বোধনী বক্তব্য ও একটি পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পেজে লাইভ দেখানো হয়। কিন্তু সেখানেও জনগণের অংশগ্রহণের কোনও সুযোগ রাখা হয়নি কিংবা কারও বক্তব্যের কোনও প্রতিলিপি দেয়া হয়নি।
মোহাম্মদ হাশিম বলেন, ‘আজকের দিনে যখন ইসলামভীতির মোকাবিলা করতে যাচ্ছি তখন আসুন আমরা স্মরণ করি যে, (নিহত) এমন অনেকে আছেন যাদের কবর আজ আলোকিত হয়েছে। তারা আমাদের ভাই, আমাদের বোন, এবং অতি সম্প্রতি আমাদের বাবা-মা, আমাদের পিতামহ-পিতামহী।’
-সূত্র : রিদাহ হায়দার /নিউকানাডিয়ানমিডিয়া.কম।