মুসলমানদের ওপর আরেক দফা হামলার পর সমালোচকরা অনলাইনে বিদ্বেষ প্রচারের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুত আইন প্রণয়নের দাবি জানাচ্ছেন

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো গত ৯ জুন বলেন, সপ্তাহান্তে অন্টারিওর লন্ডনে মুসলিম পরিবারের সদস্যদের হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি অনলাইনে বিদ্বেষমূলক প্রচারণার মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকতে পারে। এই বক্তব্যের পর মানবাধিকারের প্রবক্তারা এই সমস্যার সমাধানে আইন প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি পূরণে তার সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করছেন। খবর সিবিসি নিউজের। রিপোর্ট করেছেন পিটার জিমোনিক, ক্রিস্টেন এভারসন ও অ্যাসলে বাক।

প্রগ্রেসিভ গভর্নেন্স বিষয়ক ডিজিটাল শীর্ষ সম্মেলনে ট্রুডো বলেন, ‘তাদেরকে অজ্ঞাত কারণে ইচ্ছাকৃতভাবে নৃশংস কায়দায় চাপা দেয়া হয়েছে। আর আমরা এখনও পুরোপুরি জানি না কেন ও কী কারণে এটা ঘটানো হলো।’ তিনি বলেন, ‘এর পেছনে অনলাইনে সহিংসতার উস্কানি কিংবা এমন কিছু বিষয়ের সংশ্লিষ্টতা থাকার সম্ভাবনা আছে যা নিয়ে আমাদেরকে ভাবতে হবে।’

গত ৬ জুন লন্ডন অন্টারিওতে রাস্তায় হেঁটে যাবার সময় একটি কালো ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে চার ব্যক্তি নিহত হন। এরা হলেন, সালমান আফজাল (৪৬), তার স্ত্রী মাদিহা সালমান (৪৪), তাদের ১৫ বছরের মেয়ে ইয়ামনা আফজাল এবং সালমান আফজালের ৭৪ বছর বয়সী মা। পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য নয় বছরের ফায়েজ ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়।

পরদিন সোমবার লন্ডন পুলিশ ২০ বছর বয়সী এক তরুণের বিরুদ্ধে হত্যার চার ডিগ্রি মাত্রার এবং হত্যা চেষ্টার এক ডিগ্রি মাত্রার অভিযোগ আনে তাদের ভাষায় ‘ইসলামী ধর্মবিশ্বাসের কারণে’ একটি পরিবারের বিরুদ্ধে ‘পরিকল্পিত ও পূর্ব-নির্ধারিত কর্মকাণ্ডের’ দায়ে।

গত ৬ জুন লন্ডন অন্টারিওতে রাস্তায় হেঁটে যাবার সময় ট্রাক চাপা দিয়ে হত্যা করা হয় এক মুসলিম পরিবারের চার সদস্যকে। হামলায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসে কান্নায় ভেঙে পরেন অনেকে। ছবি: কার্লোস অসরিও/ রয়টার্স

২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের মসজিদে গুলি বর্ষণের ঘটনার পর ট্রুডো ক্রাইস্টচার্চ কর্মপরিকল্পপনার আহবানে স্বাক্ষর করেন যাতে অনলাইনে সন্ত্রাসী এবং সহিংস চরমপন্থা বিষয়ক সমস্ত বিষয়বস্তু অপসারণের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ট্রুডো ‘অনলাইনে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য,  কৌশলে ফায়দা আদায় (বীঢ়ষড়রঃধঃরড়হ), হয়রানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের শিকার ব্যক্তিদের রক্ষায় আরও কিছু করার’ অঙ্গীকার করেন।

কিন্তু পার্লামেন্টের গ্রীষ্মকালীন অধিবেশন মুলতবি হবার মাত্র ১০ দিন বাকি থাকলেও কেন্দ্রীয় সরকার ওই ধরণের কোনও আইন এখনও উত্থাপন করেনি।

মানবাধিকারের প্রবক্তা আমিরা এলগাওয়াবি (অসরৎধ ঊষমযধধিনু) এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অনলাইনে ঘৃণা ছড়ানোর বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি বলেন, ঘৃণাপ্রসূত বক্তব্য ছড়ানোর বিরুদ্ধে কানাডায় যে আইন রয়েছে তা ব্যর্থ হচ্ছে।

এলগাওয়াবি বলেন, ‘এটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক যে, শুধু কানাডার মুসলমান নয়, বরং অনলাইনে বিদ্বেষের শিকার অন্যান্য অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীসহ জনগণের জীবনযাত্রায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে এমন প্রকৃত কাজ এখনও করা হয়নি। আর এটি আমাদের এবং কানাডীয়দের জন্য সত্যিকারের লজ্জার।’

‘একটি মৌলিক বিষয়’

এলগাওয়াবি বলেন, সতর্কীকরণের মত বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে যার মধ্য দিয়ে এটি সুনিশ্চিত হয়ে যায় যে, কিছু একটা করা জরুরী ছিলো। 

২০১৭ সালে আলেক্সান্ডার বিসোনেত্তি কুইবেকের একটি মসজিদে ছয় ব্যক্তিকে হত্যা করে। তদন্তে বেরিয়ে আসে যে, ওই বন্দুকধারী অনলাইনের মাধ্যমে চরমপন্থী হয়ে ওঠে এবং সে কট্টর দক্ষিণপন্থী গণমাধ্যমের প্রচারণায় বুঁদ হয়েছিলো।

লন্ডনের ঘটনার তদন্ত এখন চলমান কিন্তু ‘অনলাইনে সহিংসতার প্ররোচনা’ সম্পর্কে ট্রুডোর সম্ভাব্য মন্তব্য আইন প্রণয়নের বিষয়ে অগ্রগতির ঘাটতি বিষয়ে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে।

মানবাধিকারের প্রবক্তা আমিরা এলগাওয়াবি

এলগাওয়াবি বলেন, ‘এই হামলাকারীও যদি কার্যত অনলাইনের মাধ্যমে চরমপন্থী হয়ে থাকে তাহলে আমার মনে হয়, সেটি হবে আমাদের জন্য এক ভয়ঙ্কর, ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া।’

কানাডার ঘৃণাবিরোধী নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান বার্নি ফারবার (ইবৎহরব ঋধৎনবৎ) বলেন, মসজিদে গুলিবর্ষণের মত অপরাধে

জড়িয়ে পড়া ব্যক্তিদের বেশিরভাগই অনলাইনের প্রচারণার মাধ্যমে চরমপন্থী হয়ে ওঠে এবং এ ধরণের আরও হামলা প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো আইন দিয়ে মোকাবিলা করা।

সিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আইন বলবৎ করতে হবে, ঘৃণাপ্রসূত বিষয়বস্তু প্রচারের দায়ে জরিমানার বিধান আরোপ করতে হবে যা তাদেরকে আক্ষরিক অর্থেই পেটে আঘাত করতে পারে, আর এটাই পারে তাদের পরিবর্তন করার মনোভাব জাগিয়ে তুলতে, কারণ, এটা ছাড়া অন্য কোনওভাবে এটা হবে না।’

ফারবার বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার খুব একটা সক্রিয় না হলেও তিনি আশাবাদী যে, প্রাদেশিক সরকারগুলি দ্রুত ব্যবস্থা নেবে।

তিনি বলেন, ‘কোনও কিছু ঘটে যাবার পর প্রতিবারই বিভিন্ন ধরণের অজুহাত খাড়া করা হয়, কিন্তু এখন, লন্ডনের এই ভয়াবহ ট্রাজেডির পর, আমার মনে হয়, এটি প্রতিটি মানুষের মনে নতুন করে আলো ফেলেছে। আমি মনে করি, এটি নিশ্চয়ই মনোযোগের মূল বিষয় হয়ে উঠবে।’

ঐতিহ্য (ঐবৎরঃধমব) বিষয়ক মন্ত্রী স্টিভেন গিলবল্ট-এর (ঝঃবাবহ এঁরষনবধঁষঃ) দপ্তর বলেছে, তারা ‘সময়োপযোগী করেই’ একটি আইন উত্থাপন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যেটি অনলাইন প্লাটফরমগুলিকে অবৈধ বিষয়বস্তু পর্যবেক্ষণ ও অপসারণে বাধ্য করবে।

এক বিবৃতিতে মন্ত্রীর দপ্তর বলেছে, ‘আমরা এমন একটি আইন করতে চাই যে আইনে, অধিকতর ক্ষতি ঘটে যাবার আগেই অবৈধ বিষয়বস্তু পর্যবেক্ষণ ও অপসারণে অনলাইন প্লাটফরমগুলির সক্রিয় দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করবে।’ এতে আরও বলা হয়, ‘কানাডায় বিদ্যমান অনলাইন প্লাটফরমগুলির বৃহত্তর জবাবদিহি ও স্বচছতা নিশ্চিত করা আমাদের লক্ষ্য। বিষয়টি পর্যালোচনার একটি সুষ্ঠু ও স্বাধীন কর্মকৌশলই অনলাইন প্লাটফরম এবং তাদের ব্যবহারকারী উভয়েই এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে পারে।’