প্রবাসে পরহিতকর্ম -৮৫
ইউরোপের পথে পথে
রীনা গুলশান
ট্যুরে যখন এসেছি, অযথা সময় নষ্ট করে লাভ নেই। অতএব লাঞ্চ খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম ব্রাসেলস সিটি ট্যুরে। বেশ বড় শহর। সব থেকে মজা পেলাম এখানকার (প্রায় গোটা ইউরোপেই) গাড়ি দেখে। সব ছোট ছোট গাড়ি। এমনকি এখানকার ‘এসইউভি’ গাড়িগুলোও বেশ ছোট। টেক্সাসের মানুষ ইউরোপে বিশেষ করে ইটালিতে গেলে নির্ঘাত ভাববে, ‘গালিভারের লিলিপুটের’ দেশে এসে পড়েছি।
যাইহোক আজ আমরা ঠিক করেছি সারাদিন ব্রাসেলস শহরের ভ্রমণটা সেরে ফেলবো। আগামীকাল সারাদিন যাবে Folon the great aritst in the world এর মিউজিয়াম দেখতে। মিঠুর মুখ থেকে ঐ মিউজিয়ামের নাম শুনতে শুনতে কান পচে গেছে। যাইহোক তাই একদিন গোটা Folon এর মিউজিয়াম এবং তার পরদিন ‘ব্রুজেস’ এর জন্য রাখা আছে। আজ সারাদিন তাই ব্রাসেলস এর সিটি ঘুরছি।
পথে যেতে যেতে যা কিছুই ভাল চোখে পড়েছে মিঠু অবিরাম তার সম্পর্কে বলে যাচ্ছে। যেতে যেতে মনুমেন্ট আবারো দেখলাম। আমাদের বাংলাদেশের মত এদেরও একটা স্মৃতিসৌধ আছে। সেখানে নামলাম। ঝকঝকে সদা মার্বেল পাথরের। কেমন একটা শান্তি শান্তি অনুভূতি। ফুল রাখা আছে। কিন্তু কেবলই এই টাটকা ফুলগুলো। একটি কাগজের টুকরো কিংবা কোন ফুলের পাতাও পড়ে নেই। মিঠু একটি ফুলের তোড়া কিনেছিল। সেটা স্মৃতিসৌধের উপরে রাখলো। আমি মনে মনে তাঁদের জন্য চির শান্তি কামনা করলাম। এরপর আমরা অন্যত্র রওনা করলাম। মিঠু ব্রাসেলসের সব থেকে বড় মলে নিয়ে গেল। তবে মলে আম একদমই আকর্ষণ বোধ করিনা। কিছুক্ষণ এলোমেলো ঘুরলাম। তারপর ব্রাসেলসের মূল আকর্ষণ (যারা জানে) তারা এখনো ব্রাসেলসে মলে শপিং করবে না। তারা অবশ্যই ‘Royel Gallery of Saint Hubert Shopping Mall’ এ যাবে। এটি ওপেন। এটি স্ট্রিটে কিন্তুু একটি এরিয়ার মধ্যে। খুব সুন্দর ভাবে গুছিয়ে করা। আমরা যেহেতু ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ছিলাম, তাই মনে হচ্ছে নববধুর সজ্জায় সজ্জিত। গোটা ইউরোপই তখন সাজ সাজ রব। কিন্তু ব্রাসেলস সত্যিই এক নম্বরে ছিল। যেহেতু এটা ইউরোপেরও রাজধানী। সত্যি এর সজ্জা দেখে আমি মোহিত হয়ে পড়লাম। ডিসেম্বরের গোটা মাসটি ইউরোপ ভ্রমণ করেছি। সর্বত্রই সাজ সাজ রব। কিন্তু বেলজিয়ামের সন্ধ্যা একেবারেই আলাদা। এমনকি সাজানোর স্টাইলও আলাদ। এ ছাড়া এরা ক্রীসমাস উপলক্ষ্যে প্রচুর আয়োজনও করেছে। বিভিন্ন রকম। পথ নাটক, ধর্মীয় অবতারণায়। এছাড়া কিছুক্ষণ পর পর বিভিন্ন স্ট্রীটে দেখছিলাম চার্চের যাযক, সিস্টার এবং ব্রাদাররা ক্রীসমাসের গান করছে। এবং অত্যন্ত ডিসিপ্লিন সহকারে। এবং পথচারীগণ তাদেরকে শ্রদ্ধাভরে জায়গা করে দিচ্ছে। কিছুক্ষণের জন্য এমনকি গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ছে। এমনকি অনেক ধর্মীয় ভক্ত তাদের সাথী হচ্ছে। আমরাও অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদের ধর্মীয় সঙ্গীত উপভোগ করলাম।
এরপর ঐ মলের মধ্যে ঢুকে পরলাম। এক একটি দোকান দেখে দারুণ বিস্মিত হয়ে পড়ছিলাম। ‘রোলেক্স’, ‘ওমেগা’ এইরকম পৃথিবীর সব থেকে দামী দামী ব্রান্ডের দোকান এখানে। আমরা এক একটি দোকানের মধ্যে ঢুকছিলাম এবং হতভম্ব হয়ে পড়ছিলাম। এই সব খুবই দূর্লভ কালেকশন। একটি বিখ্যাত ব্রান্ডের পার্স (purse ) এর দোকানে ঢুকলাম। দেখলাম ৭/৮টি পার্স কাঁচের ঘেরটোপের মধ্যে বন্দি হয়ে আছে। প্রাইস কার্ড সামনেই ছিল। একটি পার্স এর দাম দেখলাম ১৮০০ ইউরো। কানাডিয়ান ডলারে প্রায় ২৬০০। ভাবলাম চোখে ভুল দেখছি। ব্যাগটি কি সোনা দিয়ে তৈরী? আমি আবার ব্যাগটি দেখতে চাইলাম। সিকিউরিটি আমাকে দেখতে দিল। আমি খুব মজা করে দেখলাম। দেখলাম, খুবই নরমাল একটি ব্যাগ। কি জানি বাবা কি দিয়ে তৈরী। দেখলাম পৃথিবী ব্যাপী ‘WIND’ এর অরিজিনাল প্রবর্তকও বেলজিয়াম। এরপর আমার সব থেকে সখ ছিল যে বেলজিয়াম গ্লাস এর কথা ছোট থেকে শুনে আসছি, সেটা দেখবো। এরপর এই গ্লাসের (কাঁচ) দোকানে গেলাম। দেখলাম এখানকার আর্টিস্টরা কি অপরূপ ভাবেই না এই কাঁচের উপর পেইন্ট করে। টুরিস্টরা সব থেকে বেশী এই পেইন্টেড গ্লাস কিনছে। ছোট, বড় সব ধরণের চিত্রাঙ্গণ করা গ্লাস কিনছে। আমার প্রচন্ড ইচ্ছা থাকা সত্বেও এই গ্লাস কিনতে পারলাম না। কারণ এখনও বহু পথ পরিক্রমণ করতে হবে। আমি এমনকি মিনিমাম গিফ্ট কেনা থেকেও বিরত থাকছি। কারণ, আমার নিজেকেই নিজের কাছে ভার মনে হচেছ। আরো বিভিন্ন রকম গিফট আইটেমের দোকানে ঘুরলাম। অতপর দুপুর অনেক্ষণ গড়িয়ে গেছে। এখন ক্ষুধারা তাদের অস্তিত্ব জানান দিল। মিঠু জানে কোথায় অরিজিনাল হালাল দোকান পাওয়া যায়। একমাত্র জার্মান ছাড়া সমস্ত ইউরোপে হালাল রেস্টুরেন্ট অজস্র। জার্মানে আছে। তবে এইসব দেশের তুলনায় কম। বেলজিয়ামের খাবারের মধ্যে তিনটে খাবার অত্যন্ত প্রচলিত এবং খুব ফেমাস। লন্ডন থেকে আসবার সময় ভাগ্নে/ভাগ্নিরা আমাকে বলছিল বেলজিয়ামের পটেটো ফ্রাইস খেতে ভুলবেন না। পিৎজা এবং শর্মা।
আমি ভুলিনি। আমি বললাম শর্মাই খাবো। অতএব অত্যন্ত মজা করে শর্মা খেয়ে বাড়ি চলে আসলাম। আগামীকাল সকাল সকাল বিশ^বিখ্যাত আর্টিস্ট Folon এর মিউজিয়ামে যাবো। সারাদিন ঘোরাঘুরির ক্লান্তি এবং আগামীকাল অতিপ্রিয় বিখ্যাত মিউজিয়ামে যাবার আনন্দে ভাল একটা ঘুম হলো। সকাল সকাল উঠে আমি পারোটা, আলু ভাজি আর সুজির মোহন ভোগ রান্না করে সবাইকে খাওয়ালাম।
ঠিক ১১টার মধ্যেই রওনা হলাম Folon এর বিখ্যাত মিউজিয়ামের উদ্দেশ্যে। এটা ব্রাসেলস এর ২০ মিনিট সাউথের দিকে La Hulpe এ অবস্থিত। মিঠুর ৪৫ মিনিটের মত লাগলো পৌঁছাতে। কিন্তু এত বড় সীমানায় কোন মিউজিয়াম আমি আজ পর্যন্ত কখনো দেখিনি। প্রথম গেটটি পার হলাম। একজন সিকিউরিটিকে মিঠু তার পরিচয় পত্র ইত্যাদি ফ্রেন্সে বলে গাড়ি ভেতরে নেবার পারমিশন নিলো। তারপরও একটা লেকের (সম্ভবত লেকটি প্রাকৃতিক নয়) পাড়ের আরো পরে গাড়ি নেবার পারমিশন পেল না। এত বিশাল এরিয়া। ঢুকতে বাম দিকে একটা অপরূপ শোভিত লেক। এবং ডানদিকে খোলা প্রান্তর। বিশাল সবুজ ঘাসে ভরা সেই প্রান্তর। সেখানে নিয়মিত খোলা প্রান্তরেই বাচ্চাদেরকে আর্ট শেখানো হয়। আবার Folon এর জন্ম এবং মৃত্যু বার্ষিকীতে খুব বিশাল আকারে কনসার্ট হয়। মিঠু Folon এর খুব ভক্ত। সে ঐ কনসার্ট মিস করে না। তখন নাকি এই এত বড় খোলা প্রান্তরে লোকে লোকারন্ন হয়ে যায়।
Jean Michel Folon জন্ম গ্রহন করেন ১৯৩৪ সালের ১ মার্চ। এবং মৃত্যুবরণ করেন ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবরে Monaco-তে। Folon ৭১ বছর বয়সে লিউকমিয়াতে ভুগে মৃত্যুবরণ করেন। এই ৭১ বছর বয়সের প্রায় সমস্ত সময়টাই তিনি অতি উজ্জল এবং প্রাঞ্জল ছিলেন। কোন দুঃখ এবং বেদানাকে তিনি পরোয়া করতেন না। এবং শিল্পের খুব কম মাধ্যমই আছে যেখানে Folon এর পদচারণা ছিল না। এমনকি মিউজিয়ামের প্রতিও ছিল অপরিসীম আগ্রহ। তাইতো তার এই বিশাল রূমে অসাধারণ একটা মিউজিকের মাধ্যমে এই অমর শিল্পীর জীবনী দেখানো হয়। আর মিউজিকটা অতি আগ্রহে করেছিলেন ফ্রান্সের বিখ্যাত মিউজিসিয়ান Michel Colombire. এটা দেখার পর প্রতিটি দর্শনার্থীর চোখে জল আসতে বাধ্য হবে। কতটা নিবেদিত প্রাণ ছিলেন এই শিল্পী। ৪১ বছর ধরে Folon উজ্জলতর ভাবে নিবেদন করেছিলেন আর্টের প্রতিটি ক্ষেত্রে-তার ভেতরে Art, illustration, Painting and Sculpture.
এই মিউজিয়ামে ১১৯৫ টি তার আর্ট ওয়ার্কস আছে। আগেই বলেছি যে, তার লিউকোমিয়া হয়েছিল। তবু মৃত্যুর ৭ দিন (কেউ কেউ বলে ৩ দিন) আগেও তিনি একটি Sculpture
এর কাজ করছিলেন। মৃত্যুর আগের দশ বছর উনি পেইন্টিং এর থেকেও Sculpture এর কাজ বেশী পছন্দ করতেন। এবং মজার ব্যাপার Folon অনেকটা নার্সিসাসের মত ছিলেন। উনি নিজেকেই ভালবাসতেন পেইন্টিং এবং স্কাল্পচারের মাধ্যমে। প্রতিটি স্কাল্পচারে উনি নিজের মূর্তি বানিয়েছেন। পেইন্টিং এ উনি অজস্্র নিজের ছবি এঁকেছেন।
সব থেকে যেটা ইন্টারেস্টিং হলো, উনার এই ১১৯৫ (বিক্রিত ছবি বাদে) ছবির মধ্যে একটি মাত্র নারীর ছবি (সম্ভবত তার মায়ের) আছে। বেশ অল্প বয়সি একটি পবিত্র মুখাবয়বের। এটা একটা চরম বিষ্ময়ের এবং আমার ভাললাগার। যেখানে
প্রায় প্রতিটি আর্টিস্টের ৪ ভাগ ছবির মধ্যে ৩ ভাগই নারীর এবং নগ্ন নারীর ছবি থাকে। সেখানে Folon এর কোন নারীর পেইন্টিং নাই। সম্ভবত নারী বিদ্বেষী ছিলেন (এটা আমার ব্যক্তিগত ভাবনা)।
বাংলাদেশের মানুষের জন্য Folon অবশ্যই একজন কিংবদন্তির নাম। ১৯৭১ সালে উনি যুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে সমর্থন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি ভিজিট করতেও গিয়েছিলেন। একটি পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের উদ্বোধনী খাম
এর ডিজান Folon করে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমস্ত ঐতিহ্যকে সম্মান করে উনি ডিজাইনটা করেছিলেন। Folon এর এই মিউজিয়ামে ১৩ টি কক্ষ এবং সম্পূর্ণ গ্লাস রিফ্লেকশন দেয়া বিশাল বিশাল চত্বর। সেই চত্বরেই বাংলাদেশের নামসহ তার এই কর্ম শোভিত হচ্ছে।
১৩ কক্ষই দেখা শেষ করলাম। তার মধ্যে একটি কক্ষ ছিল অসাধারণ যেটা তিার নিজের ডিজাইন করা। এই কক্ষটির মধ্যে প্রবেশ করলে মনে হবে আপনি আকাশের মধ্যে বিচরণ করছেন। সব চাঁদ, তারা আপনার হাতের মুঠোয়। এবং অপরূপ মিউজিক আর লাইটিং। সে এক মনোমুগ্ধকর অনুভূতি।
এবং সবার শেষের কক্ষটি ছিল আলো-আধারিতে ভরা। কেমন যেন একটা বেদনার সুরে ভরা। দেখলাম একটি বিশাল মানুষের প্রতিকৃতি (তার নিজেরই অবয়ব)। এবং এটা তার শেষ কৃতি। মৃত্যুর তিনদিন আগেও তিনি এই স্কাল্পচার এর উপর কাজ করেছেন। এবং যেখানে যেটা রেখেছিলেন (তার ব্যবহৃত ছুরি, কাচি, হাতুড়ি ইত্যাদি) ঠিক সেইখানেই সেটা রাখা আছে। এত খারাপ লাগছিল।
খুব ছোটবেলায় যখন Folon Genval এ বাস করতেন তখন এই বিশাল পার্কটিতে উনি ভ্রমণ করতে আসতেন। আর স্বপ্ন দেখতেন এই পার্কের এরিয়াতে তার আর্টের একটা মিউজিয়াম করবেন।
বেঁচে থাকা অবস্থায় খুব কম গুণিজন তার কৃতিত্ব দেখে যেতে পেরেছেন। অথবা তার স্বপ্নগুলো ঠিকঠাক পূরণ করতে পেরেছেন। এই দিক থেকে Folon খুব ভাগ্যবান ছিলেন। তিনি হয়তো তার সব স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছিলেন।
শুধু ঐ একটি স্কাল্পচার ছাড়া। ফিরে আসবার সময় এই কথাটাই ভাবছিলাম, ‘মানুষের সব স্বপ্ন পূরণ হয় না।’ (চলবে)
রীনা গুলশান। টরন্টো।
gulshanararina@gmail.com