করোনার দিনগুলো
পৃথিবী আবার ভয়শূন্য হোক, আনন্দ উৎসবে ভরে উঠুক
জসিম মল্লিক
করোনা পরিস্থিতি অনেক দেশেই অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে। কানাডার অটারিওতে এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্ন্ত ৭৫ভাগ মানুষকে অন্ততঃ প্রথম ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ডোজ দিয়েছেন অন্ততঃ ২০ ভাগ মানুষ। সেপ্টেম্বরের মধ্যেই বেশিরভাগ কানাডিয়ান দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন পেয়ে যাবেন। যেখানে যেখানে ডেলটা ভ্যারিয়েণ্ট ছড়িয়েছে সেখানে পপআপ ক্লিনিকের মাধ্যমে দ্রুত ভ্যাকসিন রোল আউট চলছে। কানাডা ভাল সাফল্য পেয়েছে করোনার সংক্রমণ থেকে। স্পেনে মাস্ক উঠে গেছে। আমরিকার জীবন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে। কানাডার জীবন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। ব্যবসা বাণিজ্য চালু হচ্ছে। রেষ্টুরেন্ট, শপিং মল খুলে যাচ্ছে। যদিও আমেরিকার সাথে বর্ডার এখনই ওপেন হচ্ছেনা। ২১ জুলাই পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। বিদেশ ফেরতদের হাটেল কোয়ারেটাইন বা হোম কোরেনটাইন উঠে যাওয়ার ব্যাপারে আলোচনা চলছে।
এই প্রতিবেদন লেখার সময় বিশ্বে করোনায় মৃত্যু ৪০ লাখ ছাড়িয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের হিসাব অনুযায়ী, ১৭ জুন পযর্ন্ত বিশ্বে করোনায় মৃত্যু ৪০ লাখের মাইলফলক অতিক্রম করে। অন্যদিকে, বিশ্বে করোনায় সংক্রমিত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি ৮২ লাখ। রয়টার্সের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিশ্বে করোনায় যে ৪০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে প্রথম ২০ লাখের মৃত্যু হয়েছে এক বছরের বেশি সময়ে। কিন্তু পরবর্তী ২০ লাখের মৃত্যু হয়েছে মাত্র ১৬৬ দিনে। বিশ্বে করোনায় সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে এমন পাঁচটি দেশ হলো-যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ভারত, রাশিয়া ও মেক্সিকো। বিশ্বে করোনায় যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার প্রায় ৫০ শতাংশ হয়েছে এই পাঁচ দেশে। তবে বিশ্বে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি পেরু, হাঙ্গেরি, বসনিয়া, চেক রিপাবলিক ও জিব্রাল্টারে।
অনেক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনায় মৃত্যুর যে সরকারি হিসাব দেওয়া হচ্ছে, প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে বেশি হবে। গত মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও একই কথা জানায়।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্যের মতো কিছু দেশে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে এসেছে। তবে কিছু দেশের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, বিশ্বের অনেক দেশ করোনার টিকার সংকটে ভুগছে। বিশেষ করে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে এই সংকট প্রকট। টিকার এমন সংকটের মুখে বিশ্বের ধনী দেশগুলোর জোট জি-৭-এর নেতারা ১ বিলিয়ন ডোজ টিকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। চীনে করোনায় প্রথম কোনো রোগীর মৃত্যু হয় ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি। তবে তার ঘোষণা আসে ১১ জানুয়ারি।
গত বছরের ১৩ জানুয়ারি চীনের বাইরে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় থাইল্যান্ডে। পরে বিভিন্ন দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ে। করোনার প্রাদুর্ভাবের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি চীনের বাইরে করোনায় প্রথম কোনো রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ফিলিপাইনে। একই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাস থেকে সৃষ্ট রোগের নামকরণ করে ‘কোভিড-১৯ ’। ২০২০ সালের ১১ মার্চ করোনাকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কত দূর গড়ায়, তা নিয়ে সাধারণ মানুষ ও বিশেষজ্ঞরা প্রায় সমানভাবে চিন্তিত। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে ‘ঝুঁকি যোগাযোগ ও জনসম্পৃক্ততা’র কৌশলপত্র তৈরি করছে। ১৫ মাস আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই কৌশলপত্র তৈরির পরামর্শ দিয়েছিল।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ
২০২০ সালের মার্চে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, করোনার স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে জানা ও বোঝার অধিকার সাধারণ মানুষের আছে। মহামারি মোকাবিলার প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হওয়াও মানুষের অধিকার। সঠিক তথ্য বিভ্রান্তি এড়াতে ও ভুল-বোঝাবুঝি দূর করতে সহায়তা করে। মানুষকে কোন সময় কী তথ্য, কী বার্তা দিতে হবে এবং মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কীভাবে মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে, তা-ও বলে দিয়েছিল সংস্থাটি। সংস্থাটি বলেছিল, মহামারি মোকাবিলা প্রস্তুতি ও কর্মপরিকল্পনার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান ঝুঁকি যোগাযোগ ও জনসম্পৃক্তকরণ। ২৬ পৃষ্ঠার নির্দেশনায় কৌশলপত্র তৈরির প্রক্রিয়া কী হবে, তা-ও বলে দিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটি কৌশলগত কার্যকর পদক্ষেপের একটি খসড়া তৈরি করেছে। ছোট পরিসরে খসড়া নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে এই কৌশলপত্রের খসড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে। অধিদপ্তর থেকে তা যাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাবে। তারপর তা চূড়ান্ত হবে। চূড়ান্ত হওয়ার পর করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কবে নাগাদ ওই কৌশলপত্র কাজে লাগানো হবে, তা কেউ বলতে পারছেন না।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। ১০ দিন পর ১৮ মার্চ প্রথম করোনায় মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ নিয়মিতভাবে বাড়তে থাকে। সংক্রমণ শীর্ষে পৌঁছায় আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে। এরপর থেকে সংক্রমণ কমতে থাকে। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া অনেকেই বলেছিলেন, শীতকালে সংক্রমণ বাড়বে, সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হবে। বাস্তবে তা হয়নি। সংক্রমণ বাড়তে থাকে এ বছরের মার্চের শুরু থেকে। সংক্রমণ শীর্ষে পৌঁছায় এপ্রিলের মাঝামাঝি। তারপর থেকে সংক্রমণ কমতে থাকে।
গত ঈদের পর থেকে আবার সংক্রমণ বাড়তে থাকে। এবার সংক্রমণ প্রথম দেশের সীমান্তবর্তী জেলায় বাড়তে দেখা যায়। এখন দেশের অর্ধেকের বেশি জেলায় সংক্রমণ বাড়ছে। এরই মধ্যে দেশে করোনার ‘ডেলটা ভেরিয়েন্ট’ শনাক্ত হয়েছে ৭ মে। অনেকে ধারণা করেন, অতি সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ ভারতে করোনার ব্যাপক সংক্রমণ ও মৃত্যুর পেছনে আছে করোনার ডেলটা ধরন (ভারতে শনাক্ত)। দুই দিন আগে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) একজন বিজ্ঞানী গণমাধ্যমকে বলেছেন, ঢাকা শহরে এখন ডেলটা ভেরিয়েন্টেরও সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। দেশে টিকাদান পরিস্থিতিও সন্তোষজনক নয়। ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে এ পর্যন্ত ৪৩ লাখ মানুষও পূর্ণ দুই ডোজ টিকা পাননি। খুব শিগগির দেশের সিংহভাগ মানুষের টিকার আওতায় আসার কোনো সম্ভাবনাও নেই। এই পরিস্থিতিতে মানুষের সচেতন আচরণের কোনো বিকল্প নেই।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘মানুষকে সঠিক আচরণে উদ্বুদ্ধ করতে স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ব্যর্থ হয়েছেন। মানুষকে ঠিক সময়ে সঠিক তথ্য দেওয়া হয়নি। বরং মাঝেমধ্যে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের ওপর মানুষের আস্থা কম, তাই কর্তৃপক্ষের বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন বার্তা-উপদেশ মানুষ কানে নিচ্ছেন না।’
ঝুঁকি যোগাযোগ ও জনসম্পৃক্ততা’র কৌশলপত্রের খসড়ায় ১২টি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় ব্যবসায়ী, সামাজিক নেতা, গণমাধ্যম, পরিবহনমালিক ও শ্রমিক সংগঠন, ইমাম, মাদ্রাসা শিক্ষক অ্যাসোসিয়েশন, চিকিৎসক সংগঠন, নারী সংগঠনকে মাস্ক পরায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার কাজে সম্পৃক্ত করতে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্ট নেতাদের কাছে চাহিদাপত্র (ডিও) পাঠাবেন বলে প্রস্তাব করা হয়েছে। করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ছাড়াও ধর্ম মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে স্বপ্রণোদিত হয়ে সক্রিয় হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
প্রসঙ্গ ভারত
এদিকে কোভিডের তৃতীয় ঢেউ চলতি বছরের অক্টোবরেই ভারতে আঘাত হানতে পারে। তবে দ্বিতীয় তরঙ্গের চেয়ে এটির মোকাবিলা হবে ভালো। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে করা এক সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই ভাইরাস অন্তত আরও এক বছর বিশ্ব জনস্বাস্থ্যকে বিপন্ন করে রাখবে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের এই সমীক্ষার পাশাপাশি মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেটে বিশিষ্ট চিকিৎসকদের কিছু সুচিন্তিত অভিমতও প্রকাশিত হয়েছে। ভারতে তৃতীয় তরঙ্গের মোকাবিলা কীভাবে করা উচিত, সে বিষয়ে ওই বিশেষজ্ঞরা তাঁদের মতামত জানিয়েছেন। সরকারকে তাঁরা বলেছেন, স্বাস্থ্য পরিষেবার বিকেন্দ্রীকরণ আবশ্যক। দেশের সর্বত্র সবার জন্য একধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হলে, তাতে কাজের কাজ হবে না। রাজ্যে রাজ্যে, জেলায় জেলায় পৃথক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
স্বাস্থ্যসংক্রান্ত পরিষেবার লাগামছাড়া খরচ বন্ধ করতে হবে উল্লেখ করে তাঁরা বলেছেন, পরিষেবা খরচকে স্বচ্ছ করে তুলতে হবে। অ্যাম্বুলেন্স, অক্সিজেন, জরুরি ওষুধ ও হাসপাতালের খরচে সমতা রাখতে হবে। সে জন্য পরিষেবা খরচ নিয়ে এক স্বচ্ছ জাতীয় নীতি গ্রহণ করা দরকার। প্রয়োজন স্বাস্থ্যবিমায় গুরুত্ব দেওয়া। এই বিশেষজ্ঞরা মোট আটটি জরুরি পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, এগুলো বাস্তবায়িত হলে তৃতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলা ভালোভাবে করা সম্ভব হবে। সুপারিশে বলা হয়েছে, কাদের কখন টিকা দিতে হবে, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার রাজ্যের হাতেই ছেড়ে দেওয়া দরকার। টিকা এখন জরুরি পণ্য। তাই এর ব্যবস্থাপনা বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া অনুচিত হবে। কোভিডে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রের বিপুলসংখ্যক শ্রমিক।
রোজগার হারিয়ে তাঁদের জীবন বিপন্ন। রাষ্ট্রের উচিত, তাঁদের স্বাস্থ্যের বিষয়টি মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য দেওয়া, যাতে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারে। সংগঠিত ক্ষেত্রের মালিকদের শ্রমিক ধরে রাখতে হবে। তাঁদের ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এই মুহূর্তে দ্বিতীয় তরঙ্গের ঢেউ অনেকটাই স্তিমিত। পাশাপাশি প্রশ্ন উঠছে, তৃতীয় তরঙ্গ কবে আসতে পারে। বিশ্বের নামকরা ৪০ জন চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, মহামারি বিশারদ, ভাইরাস বিশারদের সঙ্গে কথা বলে রয়টার্স যে সমীক্ষা করেছে, তাতে অধিকাংশের মত, তৃতীয় ঢেউ ধাক্কা দেবে অক্টোবর নাগাদ। দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেসের পরিচালক রণদীপ গুলেরিয়ার মতে, দুটি কারণে মোকাবিলা সহজতর হবে। প্রথমত, তত দিনে অনেকের শরীরে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে। দ্বিতীয়ত, দেশে টিকার জোগানও অনেক বেড়ে যাবে। অধিকাংশের ধারণা, তৃতীয় ঢেউ বেশি কাবু করবে ১৮ বছরের কম বয়সীদের। ভারতে দ্বিতীয় ঢেউয়ের ঝাপটা এই মুহূর্তে অনেক কম। সংক্রমণ ও মৃত্যু দিন দিন কমছে। ফলে রাজ্যে রাজ্যে খুলতে শুরু করেছে বাজার-হাট, অফিস-কাছারি। স্বাভাবিক হচ্ছে জনজীবন। এ অবস্থায় দিল্লি হাইকোর্ট রাজ্য সরকারের মাধ্যমে সবাইকে সতর্ক করে বলেছে, কোভিডবিধি ভেঙে মানুষ বেপরোয়া হলে, তা তৃতীয় ঢেউকে মাত্রাছাড়া হয়ে উঠতে উৎসাহিত করবে। আদালতের পরামর্শ, বিপদ সম্পর্কে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে, সচেতন হতে হবে।
ভারতে আসছে করোনার আরও এক নিজস্ব নতুন টিকা। টিকা উৎপাদক সংস্থার দাবি, ‘কোরবেভ্যাক্স’ নামের এ টিকার কার্যকারিতা হবে ৯০ শতাংশ। করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই টিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে গঠিত ভারত সরকারের কমিটি ন্যাশনাল টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি গ্রুপ অন ইমিউনিজেশনের (এনটিএজিআই) প্রধান এন কে অরোরা এ তথ্য জানান। তিনি বলেছেন, আগামী অক্টোবরেই এই টিকা তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা (ট্রায়াল) শেষে বাজারে এসে যাবে। এটি হবে করোনা মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ‘গেম চেঞ্জার’। কোরবেভ্যাক্স তৈরি করছে হায়দরাবাদভিত্তিক সংস্থা বায়োলজিক্যাল ই। এর আগে ভারতে কোভ্যাক্সিন টিকা তৈরি করেছে ভারত বায়োটেক। এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অরোরা বলেন, পুনের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি ‘নোভাভ্যাক্স’ টিকার মতো ‘কোরবেভ্যাক্স’-এর কার্যকারিতাও ৯০ শতাংশ হতে চলেছে। আপাতত পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই দুই টিকা সব বয়সীদের জন্যই নিরাপদ এবং এদের কার্যকারিতা কোভিডের সব ধরনের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশের বেশি।
অরোরা আরও বলেন, এই দুই টিকার মতো ভারতে আরও যেসব টিকা পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে সেগুলো বাজারে এসে গেলে গোটা পৃথিবী ভারতীয় টিকার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। সবচেয়ে বড় কথা, এসব টিকার দামও হবে সস্তা। কোরবেভ্যাক্স টিকার দুটি ডোজের দাম পড়বে ২৫০ রুপির মতো। ভারতে এই মুহূর্তে আরও অন্তত পাঁচটি টিকা তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা স্তরে রয়েছে। ভারতে আপাতত তিনটি টিকার ব্যবহার হচ্ছে। কোভিশিল্ড, কোভ্যাক্সিন ও স্পুতনিক-ভি। এদের মধ্যে সবচেয়ে কম দামি টিকা কোভিশিল্ড। সরকার এর এক একটি ডোজের দাম বেঁধে দিয়েছে ৭৮০ রুপি। সে ক্ষেত্রে কোরবেভ্যাক্স হবে সত্যিই সস্তা। অরোরা বলেন, দুই সংস্থা বছরে ১০০ কোটি ডোজ টিকা উৎপন্ন করতে পারবে। এতে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো উপকৃত হবে।
এ কেমন শহর!
সেদিন ছিল রোববার। সারাদিন ঘরে থেকে থেকে ক্লান্ত লাগছিল। স্টে এট হোম অর্ডার আছে। চলছে কড়া লক ডাইন। সেই কবে থেকেই তো ঘরে আছি। ভয়ে ভয়ে কাজের জায়গায় যাই শুধু। এছাড়া আর কোথাও যাওয়া নাই। তার উপর রোজা শুরু হয়েছে। রোজা রেখে টের পেলাম কোনো ক্রিয়েটিভ কিছু করতে পারছিনা। সময় যেনো অনন্ত পাথরের মতো চেপে বসে আছে। আমি একটা কাজই পারি সেটা হচ্ছে লিখতে। এলেবেলে লেখা। প্রায় সময়ই যার কোনো মাথামুন্ড নাই। আমি কোনো পন্ডিত মানুষ না তাই ভাবনার গভীরে ডুব দিতে পারি না। অপাকৃত জগতে অবগাহন করতে পারি না। চিন্তার পরিধি সাধারণ জীবনে ঘুরপাক খায়।
পৃথিবীর এই দুঃসময়ে কোনো কিছুই গভীরভাবে ভাববার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। শুধু মনে হয় প্রকৃতি শোধ নিচ্ছে। আরো নেবে। প্রকৃতি অবশ্যই ব্যালেন্স করবে। এতো সহজে ছেড়ে দেবে না। অনেক পাপ, অনেক অন্যায় জমা হয়েছে। প্রতিদিন এতো দুঃসংবাদ যে মন বিবশ হয়ে আছে। অনুভূতিহীন হয়ে গেছে। শোকের আয়ু ক্রমেই ক্ষীণ হচ্ছে। কারো জন্য চোখের পানি ফেলার ফুরসত পাওয়া যাচ্ছে না। চোখের পানি মনে হয় শুকিয়ে গেছে। ঘরময় পায়চারি করি দিনভর। কখনো টিভি ছেড়ে বসে থাকি বা বইয়ের পাতা খুলে অথবা ফোন বা কম্পিউটার কোনোটার প্রতিই মন দিতে পারি না। ফোন হাতে নেওয়া মানেই খারাপ খবরগুলো সামনে চলে আসা।
ইফতারির পর জেসমিন আর আমি বের হয়েছিলাম আজ। অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ। তবে পুলিশ গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে না। ঢাকায় দেখলাম একজন নারী ডাক্তারের সাথে পুলিশের তুলকালাম কান্ড। এখানকার পুলিশ জনগণের সাথে খুবই ভদ্র আচরন করে, স্যার সম্বোধন করে। জনগণও আইন মেনে চলে। পুলিশে ছুঁলে উনিশ ঘা এই প্রবাদ এই দেশে প্রযোজ্য না। আবার পুলিশের কাজে বাধা প্রদান খুবই গর্হিত কাজ। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অভাব এবং আইন প্রয়োগে ত্রুটির কারণেও এমনটা ঘটতে পারে। তবে অই ঘটনায় আমি মোটেও বিস্মিত হইনি। ওই দেশে সবই সম্ভব। সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে। পুলিশ নিয়ম অনুযায়ী যে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। মন্ত্রী হোক, ডাক্তার হোক, সাংবাদিক হোক, আইনজীবি হোক, এমনকি প্রধানমন্ত্রী হলেও আইন অমান্য করলে পুলিশ ফাইন করতে পারে। এই দেশে আইন সবার জন্য সমান।
আমি বের হয়েছিলাম অরিত্রিকে ড্রপ করার জন্য। অরিত্রি উইকেন্ড হলেই বাবা মার কাছে আসতে চায়। কাল রাতে এসেছিল। অরিত্রিকে ড্রপ করে ডিভিপি ধরে চলে গেলাম অর্কর বাসায়। অর্ক আর খাতিজা নিচে নেমে এলো। একনজর দেখার জন্যই যাওয়া আবার কিছু খাবার পৌঁছে দেয়া হলো। আমি নিজে হালিম বানিয়েছি আজ। বাবা মার মন বলে কথা। অরিত্রির বাসা ডাইনটাউন গিয়ে মনটা হুহু করে উঠল। আজকে এমনিতে রোববার তার উপর ওয়েদারও ভাল, ঠান্ডার প্রকোপ কম।
কিন্তু ডাইনটাউন টরন্টো যেনো একটা মৃতপুরি। অন্য সময় হলে মানুষ গিজ গিজ করত রাস্তায়। তরুণ তরুনীদের পদচারনায় মুখরিত থাকত। রেষ্টুরেন্ট, পাবগুলি থাকত ভরা। নানা ধরণের একশন ডাইনটাউনে। রাস্তার ডানে বা বাঁয়ে টার্ন নিতেই সময় লেগে যেতো অনেকটা। কিন্তু আজকে যেনো সেসব কিছ্ ুনাই। যেনো ক্লান্তিতে বা শোকে মুহ্যমান হয়ে আছে, ঘুমিয়ে আছে সদা জাগ্রত ডাইনটাউন। এ কেমন শহর! এ কেমন জীবন! হাইওয়েতেও গাড়ি নেই। ফাঁকা হাইওয়ে বিশালাকায় এক মরা অজগরের মতো পড়ে আছে। নিজেকেই অচেনা লাগছিল। নিজের গাড়িটাকেও অচেনা মনে হচ্ছে। ব্যাস্ত হাইওয়েতে আমি আর আমার মতো দু’একজন সন্তান ক্ষুধায় বের হয়েছে ঘর থেকে।
টরন্টো ১৯ এপ্রিল ২০২১
আসুন ভালবাসায় বাঁচি
মানুষের ব্যাপারে আমার সবসময় একটা ভীতি কাজ করত। কোনো কারণ ছাড়াই এই ভীতি ছিল। মানুষকে আমি এড়িয়ে চলতাম। সহজে কারো সাথে মন খুলে মিশতে পারতাম না। জড়তা কাজ করত। মানুষের সামান্য একটা কটু বাক্য বা আচরণ আমার বুকে তীব্র হয়ে বাজত। এই সব কারণে অনেকের সাথেই আমার সখ্যতা হয়নি সহজে। আবার সখ্যতা হলেও স্থায়ী হয়নি। মরিচা পড়ে গেছে অনেক সম্পর্কে। কখনো আমার দিক থেকে, কখনো অপর পক্ষ থেকে। দীর্ঘ চল্লিশ বছরের সম্পর্কেও ফাটল ধরার ঘটনা আছে। এক সময় মনে হয়েছে আমাদের কোথাও কোনো সমস্যা আছে, কোনো ভুল আছে। আমরা পরস্পরকে চিনতে ভুল করেছি। আমরা একে অপরের যোগ্য হয়ে উঠিনি।
আসলে সমস্যা আমারই বেশি। আমারই যোগ্যতার অভাব। আমার অনেক সীমাবদ্ধতা, অনেক ত্রুটি আছে। আমার কারণেই বেশিরভাগ সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। সামান্য কারণে পরস্পর থেকে দূরে সরে গেছি। এটা ঠিক যে কিছু মানুষ আমাকে বুঝে হোক না বুঝে হোক কষ্ট দিয়েছে, অবজ্ঞা দেখিয়েছে, আমাকে মূল্যায়ন করেনি। আবার অনেকে আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে। আমি নিজেও সুযোগ করে দিয়েছি। আমি তাদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছি। আমি সবক্ষেত্রে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারিনি। আমি অনেক ভুল করি। একই ভুল বার বার করি।
তবে আমি মানুষের কাছ থেকে ভালবাসাই বেশি পেয়েছি। এতোখানি পাওয়ার যোগ্য আমি না। যতখানি পেয়েছি দেইনি তার কিছুই। নিয়েছি শুধু। অনেক ভালবাসাকে আমি সঠিক মূল্যায়ন করিনি। ভুল বুঝেছি, কষ্ট দিয়েছি। এখন সেসব ভাবলে অনুশোচনা হয়। ভুলের কারনে অনেক সম্পর্ক ঝড়ে গেছে যা আর ফিরে পাব না, অনেক সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে যা আর জোড়া লাগবে না। অনেক সম্পর্ক সময়ের অতলে হারিয়ে গেছে।
এখন মানুষ নিয়ে আমার কোনো ভীতি নাই আর। ভীতি দূর হয়েছে। কেউ নেগেটিভ কথা বললে বা আচরন করলে বা ভুল বুঝলে বুকে তীব্র হয়ে বাজে না। কষ্ট পাই বটে কিন্তু ভুলে থাকার চেষ্টা করি। কষ্ট না ভুললে মানুষ বাঁচতে পারত না। তারপরও কি জীবনে কি অপমানিত হইনি! অনেকই হয়েছি, এখনও কী হইনা! হই। ঘরে হই, বাইরে হই। তাই বলে ভুল বুঝে বসে থাকলে তো হবে না! এখন সবকিছু সহজভাবে নিতে চেষ্টা করি। আগে পারতাম না। সামান্য কারণে ভুল বুঝতাম, নিজেকে গুটিয়ে ফেলতাম। আমার অনেক আত্মাভিমান, অনেক জেদ। মনে হতো লেখকের কষ্ট কেউ বোঝে না। সন্তান বোঝে না, স্বামী বোঝে না, স্ত্রী বোঝে না, মা বাবা বোঝে না, বন্ধু বোঝে না, প্রেমিক বোঝে না। লেখককে সবাই কষ্ট দেয়। তবে আনন্দের ব্যপার হচ্ছে মানুষ যতনা কষ্ট দেয় তারচেয়ে ভালবাসে বেশি। ভালবাসাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। উজ্জীবিত রাখে। এখন ভালবাসার সময়। আসুন ভালাবাসায় বাঁচি।
টরন্টো ২১ এপ্রিল ২০২১
এবং টিকা সমাচার
আ্যাস্ট্রেজেনেকার টিকা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। ইউরোপ থেকে এই বিতর্কের শুরু। বিতর্কের বিষয় হচ্ছে ব্লাড কল্ট। কিন্তু হেলথ কানাডা বারবার বলছে এই টিকা এক্সট্রিমলি সেফ। হেলথ কানাডার রিভিউ সিস্টেম ওয়ার্ল্ডক্লাস। সুতরাং দ্বিধাদ্বন্দের কোনো কারণ নাই। তা সত্বেও কানাডায় অনেকেই আ্যাস্ট্রেজেনেকার টিকা নিতে চায়নি। এপয়নমেন্ট করেও টিকা নেয়নি অনেকে। পায়লট প্রোগ্রাম হিসাবে টরন্টোতে ৬০ থেকে ৬৪ যাদের বয়স তাদের প্রথম আ্যাস্ট্রেজেনেকার টিকা দেওয়া শুরু হলো। এখন ৪০ প্লাস থেকে দেওয়া হবে। হটস্পটগুলোতে পপ আপ ক্লিনিক করে ১৮ প্লাস থেকে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। ফাইজার, মর্ডানার টিকাও আছে এর মধ্যে।
ইতিমধ্যে কানাডার প্রায় এক চর্তুথাংশ মানুষ প্রথম ডোজ পেয়ে গেছে। আ্যস্ট্রেজেনেকার টিকা নিয়েছেন বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী বোরিস জনসন, জার্মানির চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেল, বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা, অন্টারিওর প্রিমিয়ার ডগফোর্ড, টরন্টোর মেয়ের জন টরি সহ অনেকেই। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাষ্টিন ট্রুডো এবং তার স্ত্রী সোফিও নিয়েছেন।
আ্যস্ট্রেজেনেকার টিকা আমি যখন নিয়েছি তখন এই টিকা নিয়ে তুমুল বিতর্ক। আমার ফ্যামিলির সবাই আস্ট্রেজেনেকার টিকার ব্যাপারে দ্বিধায় ছিল! জেসমিনতো বারবার বলছিল পরে নিলে হয় না! ফাইজার বা মডার্না নাও। কিন্তু আমি ডিটারমাইন্ড ছিলাম যে আ্যাস্ট্রেজেনেকার টিকাই নেবো।
আমি ১৬ মার্চ সুপারস্টোরে যাই টিকা দিতে। আগেই অরিত্রি এপয়নমেন্ট করে দিয়েছিল। টাইম ছিল দুপুর একটা। মনে করেছিলাম বিশাল লাইন হবে। এখন যেমন হচ্ছে। মানুষ তীব্র ঠান্ডার মধ্যেও চার পাঁচ ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে টিকা দিচ্ছে। অনেক সময় ফিরেও আসতে হচ্ছে টিকা স্বল্পতার জন্য। এখন টিকা পাওয়াই প্রধান ইস্যু, কোন টিকা সেটা ব্যাপার না। সেদিন আমি সুপারস্টোরে গিয়ে দেখি কোনো মানুষ নাই। দুটো বুথই খালি। নির্দিষ্ট সময়ের দশ মিনিট আগেই আমার টিকা দেওয়া শেষ। সুদর্শন নার্সটি শুধু বলল, কোন হাতে নিবা! এবং বলল, তোমাকে আ্যাস্ট্রেজেনেকার টিকা দেওয়া হচ্ছে। টিকা নেওয়ার পর আমার কোনো সাইড এফেক্টও হয়নি। সুতরাং টিকা নিন। নিরাপদ থাকুন। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের টিকা পাওয়া নিশ্চিত করুন।
জসিম মল্লিক
টরন্টো ২৩ এপ্রিল ২০২১