অন্য গল্প-২

সর্ষে ইলিশ

এ কে এম ফজলুল হক

আজ সকাল থেকে খটখটে রোদ। কিন্তু বাইরে ঠান্ডা। খুব কনকনে না; হালকা ঠান্ডা। আমি অফিসের কাপড় পরে বাইরে বের হবো, দরজা খুললাম। ঠিক এই সময় ঘটনা’টা ঘটলো। এতো বড়ো ঘটনা আমার গা রীতিমতো কাঁপছে। এ কাঁপাকাঁপিতে অফিসে যাই কি করে? অফিসে টেলিফোন করে জানালাম আসবো না। তারপর বসলাম চা নিয়ে। চা করে দিলো আমার বড়ো মেয়ে। সে এবার গ্রেড টুয়েলভ শেষ করছে, ইউনিভার্সিটিতে যাবে। ভর্তির জন্য অপেক্ষা করছে। আচ্ছা, মেয়ের কথা এখন থাক। আজকের কথাই বলি, ঠিক করলাম আজ এক অনুষ্ঠান হবে বাসায়, অঘোষিত অনুষ্ঠান। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়া যাবে না।
আমার বউকে ডেকে বললাম ‘এই শুনছো আজ বড় সড় কিছু করো। এই একটু সাদা ভাত সাথে সর্ষে ইলিশ, কয়েক পিস্ দো পেয়াজা। পটলের দোলমা, শাক ভাজি একদম গ্রামের স্টাইলে কড়া ভাজা। একটু ঝোল ঝোল গরুর গোস্ত হলেও ভালো হয়।
বউ বললো. ‘কি ব্যাপার বলো তো’।
আমি বললাম ‘কই কিছু না’।
বউ বললো ‘কিছু তো অবশ্যই আছে। তুমি তো এমনিতেই অফিস কামাই দিতে চাও না। দশবার ঠেললেও একটা ছুটি নেয়ানো যায় না তোমাকে দিয়ে। আজ একদম মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি’।
আমি বললাম ‘কারণ ফারণ জিজ্ঞেস করতে পারবে না, তাহলে প্রোগ্রাম ক্যানসেল। আচ্ছা, আরেকটা কাজ করলে কেমন হয়? তোমার বান্ধবীকে খবর দেই।’
আমি জানি, আমার বৌয়ের কাছে এর’চে বড় খুশীর খবর আর কিছুই নেই। তার বান্ধবী সীমা; কালের সাক্ষী। সে মেডিকেল কলেজের দিন গুলো থেকে তার সাথে জড়িয়ে আছে। সাথে তার বর সুমন- ইয়ারমেট। তিনজন মিলে যেন এক আত্মা, যখনই সময় পায় আড্ডা জমায়। আর দাওয়াত টাওয়াত হলে তো কথাই নেই।
আমার প্রস্তাব শুনে বউ যেন খুশীতে ফেটে পড়বে; বললো ‘তুমিই না হয় ওদের ফোন করো, আমি যাচ্ছি বলেই দৌড়’।
দৌড়ে গিয়ে ফ্রীজ থেকে মাছ বার করে আনলো, সে মাছ সিঙ্কে ভিজালো। চাল শেষ, স্টোর রুম থেকে চাল আনালো, আমাকে দিয়ে পেঁয়াজ কাটালো তারপর বলে কিছু বাজার লাগবে এনে দিতে হবে। আমি চটজলদি এনে দিলাম, সামনের গ্রোসারি থেকে।

ছবি : অনলাইন থেকে


এই ফাঁকে আমি সুমনকে কল করলাম। সুমন ধরলো।
‘কি খবর ভাই আজ অফিসে যান নি’?
‘নারে ভাই যাওয়া হয় নি’।
‘কি করছেন বাসায়?’
‘বাসায় আর কি করবো ভাবলাম তোমাদেরকে নিয়ে একটা আয়োজন করি, অনেক দিন তো দেখা হয় না তাই’।
‘যাহ ঠাট্টা করছেন’।
‘সত্যি; ঠাট্টা না’। শুনে সুমন ঘাই ঘুই শুরু করে দিলো। তার বিশ্বাস হয় নি। ওজুহাত দিলো তার কোমরে ব্যথা। এদিকে তার বউও নেই। কাজে। আমি হতাশ কণ্ঠে বললাম ‘তাহলে বাদ দাও। তবে বাদ দেবার আগে আমার বৌয়ের সাথে একটু কথা বলো। তারপর না হয় বাদ দিও’। আমি ফোন’টা ধরিয়ে দিলাম। ঘটনার সত্যতা শুনে সুমন বললো ‘বস আমি আসবো, অবশ্যই আসবো। আপনার বৌয়ের রান্না কতদিন খাই না; কিন্তু হাতে যে কাজ আছে, অফিসের। শেষ করে করে আসি, কি বলেন’।
আমি বললাম ‘ঠিক আছে, কিন্তু তোমার না কোমরে ব্যথা’। ‘ব্যথা হয়েছে তো কি হয়েছে, আমি তো কুস্তি করতে যাচ্ছি না। খেতে যাচ্ছি। পেট ব্যথা হলে একটা কথা ছিল। তাতো আর নেই’।
আমি বললাম ‘একদম নায্য কথা’।
সুমনের পর এবার সীমা- তাকেও ফোন করা হলো। সে এখন ব্যস্ত কথা বলতে পারবে না, কিন্তু সেও আসবে ছুটির পর; সাতটায়।
সাতটা পর্যন্ত আমাদের অনেক কাজ। কাজ গুছাচ্ছি। মনে মনে টু ডু লিস্ট ঠিক করলাম। বউ রান্নাঘরে আমি ক্লিনিং। কোন অনুষ্ঠানে ঘরের ক্লিনিংটা আমিই করি সাথে বাচ্চারা সাহায্য করে। আজ বাচ্চাদের নানা ক্লাস, এসাইনমেন্ট অনলাইনে। তারপরও তারা সাহায্য করছে ফাকে ফুকে। একজন সাহায্য করতে এসে একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেললো ‘হাতের কফি ফেলে সোফার বারোটা বাজিয়ে দিলো। আমি হাসি মুখে বললাম ‘বাবা এ’যদি হয় হেল্পের ধরণ তাহলে বরং আজ হেল্প বাদ দাও’। সে বললো ‘বাবা ডোন্ট ও’রি’। আমি তার শান্তনায় ভরসা করতে না পেরে হতাশ হয়ে বসে পড়লাম। সময় যাচ্ছে। সে অল্প সময়ের মধ্যে সত্যি সত্যি সোফার কাভার ধুয়ে আনলো। বিছানাগুলোর চাদর বদলে দিলো। আমার বড় মেয়েটার কাপড় চুজ করে দিলো। কাপড় চুজ করার কারণ আমার অনুরোধ সবাই আজ সুন্দর কাপড় পরবে। ছবি তুলবো। মজার মজার খাবারের ছবি, সাথে ভালো কাপড় থাকবে না; তা তো হয় না। তাই সবাই কাপড় খুঁজে বেড়াচ্ছে।
আমার জন্য ঠিক হলো পাজামা- পাঞ্জাবি। একটা পাঞ্জাবি আমার খুব পছন্দের। ক্রিম কালারের সাথে সোনালী বোতাম, আমার শাশুড়ি দিয়েছেন এক ঈদে। অনেকদিন ধরেই পরি। আমার বৌ’য়ের মন্তব্য ‘এই পাঞ্জাবি আজ রাখো, অনেক তো পরলে’।
আমি বললাম ‘আজই এ’টা পরার দিন। এটা তুমি পরে বুঝবে’।
সে আরেকটু খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলো ‘কেন?।
আমি বললাম ‘কই কিছু না’, বলেই তার সামনে থেকে সরে পড়লাম। রুমে এসে চিন্তা করছি আর কি বাকী। কোক স্প্রাইট আনা হয় নি। এক দোকান থেকে অর্ডার করলাম। তারা সময়ের আগে পৌঁছে দিলো।
সাতটা বাজে। আমাদের আয়োজন রেডি। ওমা দেখি আমার সমন্ধিও এসেছেন। তিনি থাকেন আরেক সিটিতে। ভাবলাম অফিস শেষ করে আসবেন না, তাই বলি নি। কিন্তু আমার সঙ্গিনী সে না’বলা কথাই বলে দিয়েছে ভাইকে। ভাই বউ নিয়ে এসে হাজির। হাতে বিশাল লঙ্গসে’র এক কেক। যে কোন অনুষ্ঠানে তিনি ধরেই নেন আমাদের বাসায় কারো না কারো জন্মদিন। তাই হাতে করে কেক নিয়ে আসেন। তাও যে সেই কেক না। ইন্টারনেট সার্চ করে আনা লঙ্গসে’র ‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট হালাল’ কেক। বাসায় এসেই তিনি শুরু করে দিলেন ‘এই জায়নামাজ বের করো। আসর পড়বো’। তার সাথে আমিও নামাজে দাঁড়ালাম। জামাতে। জামাত শেষ, মুনাজাত ধরবো; সমন্ধি জিজ্ঞেস করলো ‘কিসের অনুষ্ঠান, একটু খুলে বল তো।
বললাম ‘দোয়ার অনুষ্ঠান’। ‘আপনি দো’আ করবেন আপনার ভাগ্নিদের জন্য’।
‘তাতো সব সময় করি কিন্তু স্পেসিফিক কোন কিছু’?
আমি বললাম ‘আছে, এখন বলা যাবে না- সময় মতো শুনবেন’।
আমার সমন্ধি বিরক্ত হয়ে বললেন ‘ভাববাদীদের মতো কথা রাখ’।
আমি বললাম ‘আচ্ছা রাখছি এখন মুনাজাত সারেন’।
সমন্ধি মুনাজাত ধরলেন, ‘হে আল্লাহ, এ পরিবারের সবাইকে তুমি সুখী করো। এমনকি তাদের পিতামাতাকে।’ জানি না কি থেকে তিনি এটা বলছেন- আমার হৃদয় কেঁপে উঠলো। আমি বললাম ‘আমিন’।
এবার টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে। ঠিক সে সময় সুমন উপস্থিত সপরিবারে। আমার বউ বললো ‘কি রে ভাই, তুমি তো দেখি মাছির মতো গুনে গুনে সময় করে আসলে’।
সুমন