আদিবাসী শিশুদের উপর নির্যাতন : কানাডায় এবার সন্ধান মিললো গণকবরের
প্রবাসী কণ্ঠ: প্রথমে ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় অতীতে বন্ধ হয়ে যাওয়া কামলুপস রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের মাঠ থেকে ২১৫ জন শিশুর গণকবর এবং তার কয়েকদিন পর সাচকাচ্যুয়ানে অতীতে বন্ধ হয়ে যাওয়া মেরিভ্যাল ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের মাঠ থেকে ৭৫১ জন শিশুর গণকবর আবিস্কৃত হয় অতিসম্প্রতি। আর এই আবিস্কারের ফলে চরম বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে কানাডার সরকার। সংকটের মধ্যে নিপতিত হয় কানাডার ভাবমূর্তি। অতীতের এই নৃশংসতার জন্য ইতিমধ্যে ক্ষমাও চান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তিনি বলেন, এটি খুবই বেদনাদায়ক ও দেশের ইতিহাসে লজ্জাজনক এক অধ্যায়।
কানাডার আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রী ক্যারোলিন বেনেত বলেন, আদিবাসী শিশুদের জন্য নির্মিত আবাসিক স্কুলগুলো ছিল লজ্জাজনক ঔপনিবেশিক নীতির অংশ।
উল্লেখ্য যে, ২০০৮ সালে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার-ও ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন আদিবাসী শিশুদের জন্য নির্মিত আবাসিক স্কুলগুলোতে শিশুদের উপর দমন-নিপীড়ন চালানোর জন্য।
ধারণা করা হচ্ছে কানাডাজুরেই রয়েছে এরকম আরো বহু গণকবর যেখানে আদিবাসী শিশুদের সমাহিত করা হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে। শীঘ্রই এগুলো খুঁজে বের করার জন্য ফেডারেল ও কয়েকটি প্রভিন্সিয়াল সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এ কাজের জন্য ইতিমধ্যে আর্থিক অনুদানের কথাও ঘোষণা করা হয়েছে।
কামলুপস ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায় ১৯৭৮ সালে। আদিবাসী শিশুদের জন্য নির্মিত আবাসিক স্কুলগুলোর মধ্যে এই কামলুপস ছিল সবচেয়ে বড়।
কানাডার বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসী আবাসিক স্কুলগুলোতে শিশুদের উপর নৃশংস নির্যাতনের তথ্য নতুন কিছু নয়। প্রায় এক শতাব্দীরও বেশী সময় ধরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্কুলে দেড় লক্ষ আদিবাসী শিশুর উপর চলে এই নির্যাতন। আর এই নির্যাতনে মারা যায় ৪ থেকে ৬ হাজারের মত শিশু। কানাডার ট্রুথ এ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশনের হিসাব এটি।
তাদের অপরাধ তারা আদিবাসী পরিবারে জন্ম নিয়েছিল। ক্যাথলিক চার্চ আর সে কালের কানাডা সরকারের চোখে এই শিশুরা ছিল ‘অসভ্য’ আর ‘জংলী’। তাই তাদেরকে ‘সভ্য’ করার ‘গুরু দায়িত্ব’ নিয়েছিল তারা। আর সেই গুরু দায়িত্ব পালন করার জন্য তৈরী করা হয়েছিল আদিবাসী শিশুদের জন্য আবাসিক স্কুল। এই আবাসিক স্কুলগুলোতে জোর করে ধরে আনা হতো আদিবাসী পরিবারগুলোতে জন্ম নেয়া শিশুদেরকে। এই স্কুলগুলো ছিল কার্যত বন্দীশালা। এখানে ধরে আনার পর এই শিশুদেরকে আর তাদের বাবা-মায়ের কাছে যেতে দেয়া হতো না। কথা বলতে দেয়া হতো না তাদের নিজেদের ভাষায়। খ্রীষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হতো জোর করে। ঠিকমত খাবার দেয়া হতো না। শীতে পর্যাপ্ত উষ্ণতার ব্যবস্থা থাকতো না আবাসিক ভবনগুলোতে। ছিল না চিকিৎসা সেবার ন্যূনতম সুবিধা। অপুষ্টি আর চিকিৎসার অভাবে অনেক শিশুর মৃত্যু হতো। তার উপর ছিল শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা। কত শিশুকে যে যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল তার কোন হিসাব নেই।
আদিবাসী শিশুদের উপর এই নৃশংসতার জন্য দায়ী করা হয় অতীতের কেন্দ্রীয় সরকার ও খ্রীস্টানদের চার্চগুলোকে। আর এই আবাসিক স্কুলগুলো প্রতিষ্ঠা করার পিছনে যে কজন পরিকল্পকারী ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী স্যার জন এ. ম্যাকডোনাল্ড ও শিক্ষাবিদ এগারটন রায়ারসন। এগারটন রায়ারসন এর নামে নামকরণ করা হয় টরন্টোর ডাউনটাউনে অবস্থিত রায়ারসন বিশ^বিদ্যালয়টি। গণকবর আবিস্কারের খবর ছড়িয়ে পড়লে কদিন আগে এই বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ থেকে রায়ারসনের ভাষ্কর্যটির গলায় দড়ি বেধে টেনে হিচড়ে মাটিতে নামিয়ে ফেলা হয়। এরপর ভাষ্কর্যটির মাথাও গুড়িয়ে দেয়া হয় মুগুরের আঘাতে। এখন প্রক্রিয়া চলছে বিশ^বিদ্যালয়ের নামটি পরিবর্তন করার জন্য।
গত কয়েক বছরে কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ডের কয়েকটি ভাস্কর্যের গায়েও কালিমা লেপন করা হয়। ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। সরিয়ে ফেলা হয় কয়েকটি ভাস্কর্য।
কানাডায় আদিবাসী শিশুদের জন্য নির্মিত আবাসিক স্কুলগুলো বিদ্যমান ছিল ১৮৩১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। চলতি মাসের শুরুতে ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় ২১৫ জন শিশুর গণকবর আবিস্কারের পর খ্রীষ্ট ধর্মের প্রধান গুরু পোপ ফ্রান্সিসের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল ক্ষমা চাওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি ক্ষমা চাননি। কেবল দুঃখ প্রকাশ করেই দায় এড়িয়ে গেছেন। সাসকাচ্যুনে দ্বিতীয় গণকবরটি আবিস্কারের পর কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজেই পোপের প্রতি আহ্বান জানান কানাডায় এসে ক্ষমা চাওয়ার জন্য। কিন্তু এবারও তিনি নিরবই থেকেছেন।
স্বরণ করা যেতে পারে যে, কানাডার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৭ সালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো জি-৭ সম্মেলন পরবর্তী সফরের অংশ হিসাবে ভ্যাটিকান গিয়েছিলেন এবং পোপ ফ্রান্সিস এর সঙ্গে দেখা করেন। ঐ সময় তিনি ক্যাথলিক চার্চ পরিচালিত স্কুলগুলোতে আদিবাসী শিশুদের উপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছিল তার জন্য পোপ ফ্রান্সিসকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু ঐ আহ্বানে পোপ সাড়া দেননি।
উল্লেখ্য যে, আদিকালে খ্রীষ্টান চার্চগুলো বিভিন্ন দেশে ইউরোপিয়ানদের অবৈধ সাম্রাজ্য বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। গরীব, অশিক্ষিত ও বঞ্চিত মানুষদের নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে খ্রীষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করেছে। কানাডায়ও তারা একই কাজ করেছে। কানাডিয়ান আদিবাসী পরিবারের শিশুদেরকে জোর করে ধরে এনে ধর্মান্তরিত করার কাজে যাতে সুবিধা হয় সেজন্য আবাসিক স্কুলের প্রবর্তন করেছে সরকারের আর্থিক ও প্রশাসনিক সহায়তায়।
১৮০০ শতকের শেষের দিক থেকে শুরু করে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন আদিবাসী পরিবারের আনুমানিক দেড় লক্ষ শিশুকে জোর করে ধরে এনে আবাসিক স্কুলগুলোতে ভর্তি করানো হয়েছিল। আর এই দেড় লক্ষ শিশুর মধ্যে প্রতি ৫০ জনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছিল। ট্রুথ এ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশনের বরাত দিয়ে এই তথ্য জানায় সিটিভি নিউজ।
এই আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা যাতে করে শে^তাঙ্গ শাসন ও শোষণ নির্বিঘ্নে করা যায়। শিশুদেরকে জোর করে ইংরেজী ভাষা ও সংস্কৃতি শিখিয়ে এবং খ্রীষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করে এই উদ্দেশ্যে বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল অতীতের সরকার ও ধর্মযাজকরা মিলে। তবে এই প্রক্রিয়া যে শুধু আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠার পরই শুরু হয়েছিল তা নয়। মূলত ১৭০০ শতকের গোড়া থেকেই ইউরোপিয়ানরা এই চেষ্টা চালিয়ে আসছিল নানান উপায়ে। ১৮০০ শতকের শেষের দিকে এসে তা সরকারীভাবে শুরু হয়।
তবে আদিবাসীদের জন্য গড়ে তোলা আবাসিক স্কুলগুলোতে দেড় লক্ষ শিশুর মধ্যে মোট কতজন মারা গেছে তার প্রকৃত সংখ্যা ট্রুথ এ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশনের পক্ষে উদ্ধার করা সত্যিকার অর্থেই একটি কঠিন কাজ ছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে কমিশনের হিসাবে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা দেখানো হয়েছে ৪১০০। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যার সাথে এর মিল নেই বলে আদিবাসীদের অনেকেই মনে করেন। আলবার্টা ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ক্রিস্টাল ফ্রেজার সিটিভি নিউজকে বলেন, ‘অনেক আদিবাসী পরিবারের সদস্যরাই আমাদেরকে বলে আসছেন স্কুলগুলোতে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা আরো অনেক বেশী। তারা আরো বলেন অনেক শিশু কোনদিন আর বাড়িতে ফিরে আসেনি। তারা কোথায় আছে সে কথা জানতে চাইলে স্কুল কর্তৃপক্ষ কোন ব্যাখ্যা দিত না’
আবাসিক স্কুলগুলোতে আদিবাসী পরিবারের শিশুরা তাদের নিজ সংস্কৃতির কোন কিছুই পালন করতে পারতো না। নিষেধাজ্ঞা ছিল এ ব্যাপারে। ট্রুথ এ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশন তাদের ফাইনাল রিপোর্ট তৈরী করে আরো প্রায় ৫ বছর আগে। ৪ হাজার পৃষ্ঠার সেই রিপোর্টে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে আদিবাসী পরিবারের শিশুদের উপর কি রকম কঠোর নির্যাতন চালানো হয়েছিল তার বিস্তারিত বর্ণনা সংযুক্ত করে।
সিটিভি নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে এই আবাসিক স্কুলগুলোর কোন কোনটিতে শিশুদেরকে না জানিয়ে তাদের উপর অনৈতিকভাবে পুষ্টি গবেষণা চলানো হতো। কয়েক দশক ধরেই এই অনৈতিক প্রক্রিয়া চালু ছিল। শিশুদেরকে অপর্যাপ্ত খাবার দেয়া ছিল গবেষণার অংশ।
ট্রুথ এ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়, আবাসিক স্কুলগুলোতে ঠিক কত সংখ্যাক শিশু মারা গিয়েছিল তার পুর্ণাঙ্গ তথ্য না পাওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। তার মধ্যে আছে, কোন শিশু মারা গেলে স্কুল কর্তৃপক্ষ সাধারণত বাবা-মাকে বিষয়টি জানাতো না। আবার লাশ পাঠানোর খরচ আছে এই বিবেচনায়ও মারা যাওয়ার তথ্যটি চেপে যাওয়া হতো। কখনো কখনো ইনফ্লুয়েঞ্জা বা অন্যকোন ছোঁয়াচে রোগে এক সাথে কয়েকজন শিশু মারা গেলে তাদেরকে আলাদা কবরে দাফন না করে একসাথে কবর দেয়া হতো।
ইতিপূর্বে কয়েক দশক ধরেই এই শিশুদের বেশ কয়েকটি গণকবরের সন্ধান পওয়া গিয়েছিল বিভিন্ন আবাসিক স্কুলের কাছে বা স্কুল প্রাঙ্গণে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, সাচকাচ্যুয়ানের ব্যাটেলফোর্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল যেখানে সত্তর দশকের দিকে ৭২টি কবরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। ২০০১ সালে আলবার্টার ডানবো আবাসিক স্কুলের কাছে ৩৪ টি কফিন আবিস্কার হয়েছিল যেগুলোতে শিশুদের মৃতদেহ ছিল এবং দুই বছর আগে রিজাইনার মুসকোভেকওয়ান আবাসিক স্কুলের কাছে ২৪টি শিশুর কবর আবিস্কৃত হয়েছিল। কিন্তু এবার এক সঙ্গে প্রথমে ২১৫ এবং পরে ৭৫১ শিশুর কবর আবিস্কৃত হওয়াতে বিষয়টি নিয়ে হৈ-চৈ পড়ে যায় সর্বত্র।
এগুলো কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কানাডার আদিবাসী সম্প্রদায় এসব ইতিহাস কয়েক পুরুষ ধরেই জানেন। এ কথা সিটিভি নিউজকে বলেন ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া’র নৃতত্ব বিভাগের অধ্যাপক এন্ড্রু মার্টিনডেল।
ট্রুথ এ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশনের তদন্তে আরো যে তথ্য বেরিয়ে আসে তা হলো, অনেক সময় কোন স্কুল স্থান পরিবর্তন করলে কবরস্থানের রেকর্ড, অনানুষ্ঠনিক কবরস্থানের চিহ্ন ইত্যাদি লোকজনের স্মৃতি থেকে বিবর্ণ হয়ে যেত। তাছাড়া কমিশন আরো দেখতে পায় যে কিছু কিছু কবরস্থানে স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে রেকর্ডপত্র ঠিকমত রাখা হতো না । অধ্যাপক ক্রিস্টাল ফ্রেজার বলেন খুব কম স্কুল কর্তৃপক্ষই মৃতদের রেকর্ড সংরক্ষণ করতেন যদি কোন শিশুর মৃত্যু হতো নির্যাতনের কারণে বা ভুল চিকিৎসার কারণে কিংবা কোন রোগে ভুগে। ফ্রেজারের মা এবং নানী এরকম আবাসিক স্কুলের বাসিন্দা ছিলেন। তবে সৌভাগ্যক্রমে তাঁরা মৃতদের তালিকায় যুক্ত হননি।