ছোবল

মোয়াজ্জেম খান মনসুর

খুব অগুছালো লাগে মিরাজকে আজকাল। ঘুম খাওয়া দাওয়া পড়াশুনা সব কিছুতেই কেমন যেন আলগা আলগা ভাব। আজকাল কিছুকিছু নতুন বন্ধু আসছে বাড়ীতে। কেউ কেউ খুব মেধাবী ছাত্র আবার কেউ কেউ খুব ধনীর ছেলে। যেমন দিবস রায়হান খুব সুদর্শন মেধাবী ভদ্র কিন্তু  কেমন যেন একটা আলগা আলগা ভাব। তার চোখদুটো যেন কোথায় হারিয়ে যাওয়া বন্দর। ইকোনোমিক্সে অনার্সে প্রথম হয়েছে গতবার ঢাকা বিশ^^বিদ্যালয়ে। আমেরিকায় শিকাগো বিশ^^বিদ্যালয়ে স্কলারসিপ নিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার বাবা জাস্টিস আলিমুল রাজি রায়হান। তারও  ইচ্ছা ছেলে বাইরে পড়াশুনা পি এইচ ডি করে দেশে এসে অধ্যপনা করুক।

ডিস্ট্রিক জাজ মা ফাতেমা তাহেরার চোখেও ছেলে মিরাজকে কেমন অচেনা অচেনা লাগে। প্রশ্ন্ন করলে প্রশ্নের  উত্তর খুব সংক্ষিপ্তভাবে অথবা হ্যা বা না’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আগের মতন ড্রইং রুমে বসে চা খেতে খেতে বিশ^^বিদ্যালয়ের গল্প করে না। শিক্ষকরা কে কেমন পড়ায় তাদের চলন বলন ঢং পোশাক চিন্তা ভাবনা এগুলো নিয়ে মার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা করত এক সময়। ইদানিং বাসায় থাকলে তার রুমের দরজা প্রায়ই বন্ধ থাকে অথবা ভিড়ানো থাকে। তখন আর ফাতেমা তাহেরা ছেলের প্রাইভেসি ভাংতে চায় না। প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেকে তার মতন করে থাকতে দেয়। কিন্তু আজকাল মনের গভীরে একটা উদ্বেগ শঙ্কাবোধ কাজ করে। কিন্তু সেটা, ঠিক কেমন ধরনের শঙ্কা সেটা বুজতে পারে না।

ক্লাস শেষে মিরাজ, দুলাল, ফারুক, সিহাব আর রায়হান দল বেঁধে আড্ডা মারে বিশ^^্যবিদ্যালয়ের মাঠে। আড্ডায়  সিগারেট গাঁজার ধোঁয়ায় উড়তে থাকে স্বদেশ, আমেরিকা রাশিয়া, চীন, মধ্যপ্রাচ্য আর আফ্রিকার রাজনীতির ইতিহাস আর আগামী দিনের স্বপ্নের তরী। তর্ক আলোচনা সমালোচনা চলে কমিউনিজম আর কেপিটিলিজম এর ভাল মন্দ নিয়ে। মিরাজদের এক সময়ের সাদামাটা নেশা ধীরে ধীরে তাদের আরো নতুন ভয়ংকর নেশার পথ খুলে দেয়।

কয়েক মাস ধরে রায়হান একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। কথা কম বলে। আড্ডায় থেকেও যেন নেই। রাজনীতি নিয়ে তার চৌকস যুক্তিগুলো আগুনের ফুল্কির মতন আর জ্বলে উঠে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বর্তমান আর অতীত ইতিহাস আর বিজ্ঞানের অগ্র যাত্রার ধারালো কথাবার্তায় ইদানিং সে আর সবাইকে মাতিয়ে রাখে না। সিগারেটের ধোঁয়া আকাশে ছুড়তে ছুঁড়তে বায়রন, হোমার অথবা সেক্সপিয়ারের কবিতা আর আবৃত্তি করে না। আবৃত্তি করে না দরাজ গলায় জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন অথবা আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়। রায়হান মাঝে মাঝে তার নতুন বন্ধু আমিনুলের সাথে তার আপার্টমেন্টে গিয়ে আড্ডা মারে। রায়হানের কাছে শুনেছে তার কথা। একটা বিদেশি ব্যংকে খুব ভাল চাকুরী করে খুব সোসাল ও বন্ধুত্বপূর্ণ কিন্তু কেন যেন মিরাজের আমিনুলকে পছন্দ হয় না। তার কোথায় যেন একটা গোলমাল আছে বলে মনে হয় মিরাজের। রায়হান মিরাজের সবচেয়ে ভাল বন্ধু। মিরাজ রায়হানকে বলে আমিনুলের কথা যে তাকে তার পছন্দ হয় না। রায়হান সিগারেটে ধুঁয়া তুলে অন্যমনস্ক হয়ে দূরে কোথায় তাকিয়ে থাকে আর কি যেন বলতে চেয়েও কিছু বলে না। মিরাজের মাঝে মাঝে মনে হয় রায়হানকে কেমন যেন অচেনা মনে হয়। তার ভীতরের আগুনের ফুল্কি তেজ কমে আসছে।

হ্যলো কি খবর  সিহাব!

আরে খবর শুনেছিস কিছু ?

নাতো ! কেন কি খবর বল,

দুলালকে মেরে ফেলেছে!

কি বলিস কবে কখন?

কয়েক ঘন্টা আগে নিউমার্কেটে।

দুলাল ছিল বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা। বিরোধী দলীয় নেতা খুব সাহসী তেজী মেধাবী এবং সরব।

সরকারি দলের নেতাদের সাথে তার মতবিরোধ দন্দ্ব বিরোধ লেগেই ছিল। কিন্তু তাকে খুন করা হবে এটা ছিল অবিশ^^াস্য। দিনে দুপুরে রাজধানীর রাস্তায় প্রকাশ্যে। স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। এতটা সময়ের মধ্যে একটা দেশের রাজনীতির কাঠামো গনতন্ত্রের পথ ধরে ধীরে ধীরে দৃঢ় বর্ণীল ও বিকশিত হবার কথা ছিল। বাকস্বাধীনতা, মুক্ত চিন্তন, মুক্ত কন্ঠে রাজপথে মিছিলে মিছিলে আন্দোলনের ঝলকে ঝলকে অধিকার আদায়ের কথা ছিল। নির্ভয়ে সরকারের সমালোচনা বিরুদ্বাচারন প্রতিপক্ষ হবার অধিকার থাকার কথা ছিল। নির্ভয়ে বহুমুখি চিন্তার বর্ণিল বর্হিপ্রকাশ করার অধিকার থাকার কথা ছিল প্রতিটি নাগরিকের। কিন্তু আজ এ দেশে গণতন্ত্র শেকল বন্দী। বাক স্বাধীনতার গায়ে ক্ষয়রোগ। রাজনীতিতের মেধাবী উজ্বল দূরদর্শি দেশপ্রেমে সিক্ত তারকারা নেই। সরকারি দলে অশিক্ষিত মূর্খ ভন্ড অসৎ লুটেরাদের রাম রাজত্ব। একটা দেশের জন্য এটা সত্যি দুর্ভাগ্য। দূর্ভাগা দেশ!

মিরাজ এবং তার বন্ধুরা সবাই মাস্টার্স পাশ করে গেছে।  রায়হান ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট আর মিরাজসহ সবাই সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে। রায়হান বিশ^^বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেছে। মিরাজ বিসিএস দিয়ে জয়েন করেছে প্রশাসনে।

মিরাজ রায়হান এখনও নিয়মিত আড্ডা মারে। তাদের সব বন্ধুদের কয়েক সপ্তাহ অন্তর অন্তর আড্ডা জমে কোন রেস্তোরায় বা ক্যাফেতে।

মিরাজ রায়হানের সাথে আড্ডায় যায় আমিনুলের ফ্লাটে। এখানে মিরাজ নতুন নেশার জগতে ঢুকে পরে। তারা তিনজনেই ড্রাগ নেয়। নাকে টেনে নেয়  হিরোইন। রায়হান মাঝে মাঝে ইঞ্জেকসন পুশ করে নেশা করে।  এতে অদ্ভূত নেশার জগতে ভেসে বেড়ায় তারা। দিনে দিনে তাদের নেশা বাড়তে থাকে। মিরাজের মার চোখে ধরা পরে মিরাজের প্রচন্ড পরিবর্তন। মাঝে মাঝে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রাতে বাড়ী ফিরে। মা’র বুকের ভিতর এক তীব্র হাহাকার জেগে উঠে। ভাসিয়ে নিয়ে যায় ছেলেকে নিয়ে তার স্বপ্নগুলো। ছেলেকে দিনের পর দিন বুঝনোর চেষ্টা করে। কিন্তু মিরাজের কোন পরিবর্তন হয় না। দিন দিন কেমন যেন নির্জিব হয়ে যাচ্ছে। চেহেরায় পরিবর্তন চোখে পরার মতন। চোখের নীচে কালো দাগ, ফ্যাকাসে  হয়ে গেছে গায়ের রং।  মিরাজের বেতনের টাকার অধিকাংশ খরচ হয়ে যায় নেশায়। কয়েক বছরের মধ্যে মিরাজ এতটাই নেশায় আসক্ত হয়ে গেছে তাকে রিহ্যবে ভর্তি করতে হয়েছে কয়েক বার। কিছু দিন ভাল থাকে তারপর আবার নেশায় ফিরে যায়। ছেলের এই করুণ আস্তে আস্তে নি:শেষ হয়ে যাবার অবস্থা দেখে মা ফাতেমা তাহেরা তাকে ধরে কান্নাকাটি  করেন। তার গভীর উদ্বেগ ভয়ের কথা  ছেলেকে বুঝানোর চেষ্টা করেন। মিরাজ কিছু বলে না, মায়ের হৃদয়ের গভীর দহন পোড়ন তাকে আলোড়িত বিচলিত করে তার হৃদয় বিধ্বস্ত করে । মিরাজ মায়ের বুকে মাথা রেখে ফুপিয়ে কাঁদে কিন্তু সে জানে যে পথের পথিক সে হয়েছে এখন আর সেখান থেকে আর ফেরা যাবে না। এই অন্ধকার জগতে আলোর কোন ঝলক নেই ,এ যেন এক মৃত্যু উপত্যাকা। মিরাজ জানে এখন তার নিজের উপর আর কোন নিয়ন্ত্রন নেই, আত্ম বিশ^^াস নেই। কোকেন আথবা হিরোইন না নিলে বা নিতে পারলে সে ভয়নক সহিংস হয়ে যায়, উন্মাদনায় অস্থির হয়ে উঠে। সম্পূর্ণ অন্য জগতের আচেনা মানুষ হয়ে যায়। দিনে দিনে কোকেন হেরোইনের নেশার অন্ধকার জগতে আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছে মিরাজ। যেখানে কোন আলোর ঝলক নেই, স্বপ্ন নেই ।

গত কয়েক মাস আগে রায়হান কোকেনের  ওভার ডোজে মারা গিয়েছে। একজন মেধাবী প্রতিভাবান যুবকের এমন চলে যাওয়া মেনে নেয়া সত্যি ভীষন কষ্টকর। তার সামনে ছিল পৃথিবীর অনন্ত সম্ভবনার খোলা দুয়ার। তার অসম্ভব কর্মক্ষমতা অধ্যবসায়  ও মেধার সিড়ি বেয়ে আকাশ ছোঁয়ার কথা ছিল। কিন্তু এক ভয়ংকর নেশার ছোবলে সব শেষ হয়ে গেল।

এই খবর মিরাজের মায়ের মনে এক ভয়ংকর ভয় শংকা বাঁধা বাধে। মিরাজের অপ্রতিরোধ্য  মরননেশা আর স্বাস্থ্যের অধ:পতন দেখে গভীর ক্রন্দনের ঢেউ তার হৃদয়ের এপাশ ওপাশ লন্ডভন্ড করে নিয়ে যায়। একটি মৃত্যু ভয় তাকে  দিন রাত এক অবর্ননীয় কষ্ট ব্যথা উদ্দ্যেগ আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে।

প্রতিদিন  প্রাণপ্রিয় ছেলেকে দুচোখ ভরে দেখে, জড়িয়ে  ধরে আদর করে চম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দেয় তার কপাল গাল। মায়ের গভীর ভালবাসার চিহ্ন এঁকে দেয় ছেলের শরীরে। মিরাজ নির্জীব চোখে দেখে মার ভালবাসার  বাঁধভাংগা জলস্রোত, শুনতে পায় মায়ের হৃদয়নিংড়ানো ক্রন্দনের ধ্বনি। মিরাজের চোখে নামে অশ্রুবন্যা। এক গভীর বিষাদে দহনে পোড়নে হৃদয় খন্ডিত হয়ে যায়। সে জানে তার জীবনের পথের সীমানা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসছে। এই ধরণীর আলো বাতাস জল ফুল ভালবাসা উচ্ছাস আনন্দ স্বপ্ন তার কাছে অচেনা হয়ে যাচ্ছে।

গল্পের লেখক টরন্টো প্রবাসী মোয়াজ্জেম খান মনসুর।