কাহিনী বিচিত্রা
সাইদুল হোসেন
মেয়েটির নাম বিশ্ওয়া শর্মা
জানুয়ারী ১৮, ২০১৬ সালের ঘটনা। সাবওয়ে ট্রেইনে চড়ে ড্যানফোর্থ এভেনিউ যাচ্ছিলাম। পাশে বসা অল্প বয়সী একটি মেয়েকে দেখে মনে হলো যে সে একজন ইন্ডিয়ান এবং গুজরাটি। তাই সরাসরি গুজরাটি ভাষায় বললাম : কেম্ছ? (কেমন আছ?) হেসে দিয়ে সে বলল : মজাম্মা (ভালো আছি।) তারপর সে প্রশ্ন করলো : তুমিও কি গুজরাটি? বললাম : না, বাংলাদেশী। তবে তোমাদের ভাষার দু’চারটা কথা জানি, পরিচিত গুজরাটিদের কাছ থেকে শিখে নিয়েছি।
জিজ্ঞাসা করলাম : তোমার নাম কি?
আমার নাম বিশ্ওয়া (বাংলায়- বিশ্ব), তবুও নিশ্চিত হওয়ার উদ্দেশ্যে বললাম : দুনিয়া?
বলল : হাঁনজি।
– কি কর তুমি? জানতে চাইলাম।
– চার মাস আগে ইন্ডিয়া থেকে চার বছরের জন্য ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে architecture-এ পড়াশুনার উদ্দেশ্যে ক্যানাডা (Toronto) এসেছি বাবার খরচে, কোন স্কলারশিপে নয়। আরো তিনটি ইন্ডিয়ান মেয়ের সংগে হোষ্টেলে থাকি।
অবাক হয়ে বললাম : তোমাকে দেখে তো মনে হয়েছিল তোমার বয়স ১৫-১৬ বছরের বেশী হবে না অথচ তুমি বলছো তুমি ইউনিভার্সিটিতে পড়!
বিশ্ওয়া বললো : অত অল্প বয়স আমার নয়। আমার বয়স এখন ২১, আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। মা-বাবারই পছন্দ করা গুজরাটি ছেলে। মিসিসাগাতে থাকে, মোটামুটি একটা চাকরি করে। পরিবার ভালো। স্বভাবচরিত্র ভালো। মা-বাবা ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে তবে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। গতকাল সেই ছেলেটির সংগে এই প্রথমবারের মত দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে, আমরা কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলেছি।
ওর কথা শেষ হলে জানতে চাইলাম : ছেলেটিকে তোমার ভবিষ্যৎ স্বামী হিসেবে পছন্দ হয়েছে কি? ছেলেটিরইবা অভিমত কি?
সে তখন বললো : বিয়ে তো একদিন করতেই হবে- এহিতো ইন্ডিয়ান রিওয়াজ হ্যায়। তাছাড়া মাবাবা পছন্দ করে সম্বন্ধ পাকা করতে যাচ্ছেন আমার তো দ্বিমত থাকা উচিত নয়। ওকে ভালোই লেগেছে আমারÑ নম্র-ভদ্র, দেখতেও মন্দ নয়। কসম খেয়ে বললো যে সে smoke করে না, drink করে না, দোসরা কোঈ গার্ল ভি নেহী হ্যায় জিন্দেগীমে। নেক আদমী হ্যায়, ব্যস ঔর কেয়া চাহিয়ে? (সিগারেট খায় না, মদ খায় না, গার্লফ্রেন্ড নেই, সচ্চরিত্র ছেলে। বাস, আর কি চাই?)
আবার প্রশ্ন করলাম : ছেলেটির তোমাকে পছন্দ হয়েছে কি? কিছু বলেছে?
– না, কিছু বলেনি। তবে জানতে পারবো শিঘ্রই।
এবার জিজ্ঞাসা করলাম : অন্যান্য বহু গুজরাটিদের মত তোমরাও কি প্যাটেল?
বললো : না, আমাদের পদবী শর্মা।
আরো গল্প করা যেতো কিন্তু আমাদের দু’জনেরই destination একই হওয়াতে দু’জনই এক সংগে ট্রেইন থেকে নেমে পড়লাম। তারপর পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে বললাম : আর তো কোন দিন দেখা হবে না আমাদের দু’জনের। Wish you Goodluck ! আর এই নাও চকলেটটা, আমার তরফ থেকে গিফ্ট। খেতে খেতে আমার কথা স্মরণ করো। Bye.
বিশ্ওয়াও হাত উঠিয়ে বললো : Bye.
তারপর দু’জন নিজনিজ গন্তব্যের দিকে হাঁটা দিলাম।
দু’টি ঘটনা
এপ্রিল ১৬, ২০১৬ সাল। Fracture Clinic -এ সেদিন সকালের অভিজ্ঞতা।
(এক)
পেশেন্টের নাম Jerry Abdul. আফ্রিকান ব্ল্যাক।
বললাম : আসসালামু আলাইকুম। সে প্রশ্ন করলো : কি বললে তুমি?
আমি বললাম : তোমার নামের শেষে আবদুল দেখতে পাচ্ছি। আবদুল তো মুসলিমদের নাম। তাই তোমাকে মুসলিম গ্রীটিং আসসালামু আলাইকুম জানালাম।
শুনে আবদুল বললো : থ্যাংক ইউ, বাট আই এম নো মোর আ মুসলিম দো আই ওয়াজ বর্ণ আ মুসলিম। (তোমাকে ধন্যবাদ। তবে আমি এখন আর মুসলিম নই যদিও আমার জন্ম হয়েছিল মুসলিম পরিবারেই।)
(দুই)
পূর্ণ হিজাবী এক সোমালী মা তার ১২-১৩ বছর বয়সের হিজাবী মেয়েকে নিয়ে এসে সামনে দাঁড়ালো। বললাম : আসসালামু আলাইকুম। মহিলা বললো : ওয়ালাইকুম সালাম। তারপর তাদের বুঝিয়ে বললাম তাদের কি করতে হবে।
ওদের সীটে যাওয়ার আগে মহিলা বললো : Bray অর্থাৎ Pray (সোমালিরা P উচ্চারণ করতে পারে না, ওরা ইংলিশ P-কে B উচ্চারণ করে) for my daughter, she is combleting memorizing the Kitab, Insha Allah..
বোঝলাম যে মেয়েটি কিতাব অর্থাৎ কুরআন হিফ্য করছে, হাফীযে কুরআন হতে চায়।
বললাম : May Allah help her and bless her.
মহিলা বললো : আ-মী-ন।
* * *
এই প্রসংগে মনে পড়ে গেল যে আমার এক শুভাকাক্সক্ষী আমিনুল হক সিদ্দিকি, IT Engineer (Specialist with a famous American company) ৪৯ বছর বয়সে হাফীযে কুরআন হয়েছেন ২০১৬ সনের জুন মাসে। অসীম ধৈর্য এবং আল্লাহর রহমত না থাকলে এত অধিক বয়সে সম্পূর্ণ কুরআন হিফ্য করা প্রায় এক অসম্ভব ব্যাপার। Congratulations জানাবার জন্যে তাঁর Atlanta (Georgia) অফিসে ফোন করলাম। তিনি বিনীতভাবে বললেন : আপনাদের মত শুভাকাক্সক্ষীদের দু’আ আল্লাহ কবুল করেছেন, তাই এটা সম্ভব হয়েছে।
একদিন আল্লাহই মীমাংসা করবেন
বুধবার, এপ্রিল ২৭, ২০১৬
আজকের খবর।
পেশেন্ট : নারগাস বানো। বৃদ্ধা মহিলা। মুসলিম।
এক ইন্ডিয়ান গুজরাটি হিন্দু মহিলা সেই বৃদ্ধাকে সংগে নিয়ে গত সপ্তাহে ক্লিনিকে এসেছিল।
এপয়েন্টমেন্ট থাকাতে আজ আবার এসেছিল। গত সপ্তাহে কোন আলাপ-পরিচয় হয়নি, আজই প্রথম আমি আলোচনার সূত্রপাত করলাম।
গুজরাটি মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম : এই বৃদ্ধা আপনার কে হয়?
– আমার শাশুড়ি। তিনি মুসলিম। পাকিস্তানী, পাঞ্জাবী।
জিজ্ঞাসা করলাম : আপনার নাম কি?
বললো : আমার নাম ক্রপালী। আমি ইন্ডিয়ান, গুজরাটি, হিন্দু।
বললাম : মুসলিম পরিবারে বিয়ে হয়েছে আপনার, ওরা আপনাকে মুসলিম হতে বলেনি?
– না। ক্যানাডাতেই আমাদের পরিচয় ও বিয়ে হয়েছে। আমার হাজব্যান্ড খুব উদারচিত্ত লোক। সে ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামায় না। মুসলিম হওয়ার জন্য কোন চাপ প্রয়োগ করেনি কোনদিন। He says, I am fine with your religion, practise your religion freely. আমি বাসায় পূজা করি, হিন্দু ধর্মীয় অন্যান্য অনুষ্ঠানও নিয়মিত করে যাচ্ছি। No problem.
– আপনার শাশুড়ি তো মুসলিম। তার আচার-ব্যবহার কেমন?
– আমার শাশুড়ি খুব উদারচিত্ত মহিলা। আমার ধর্ম নিয়ে তিনি কোন প্রশ্ন তুলেননি কোনদিন, বরং আমার পূজা-পার্বনে নানা ধরনের সাহায্য-সহায়তা করে থাকেন।
– আপনাদের সন্তানাদি?
– আমার বয়স এখন ৪১ বছর। চাকরি করি। আমাদের এক ছেলে। ১৮ বছর। সে না মুসলিম, না হিন্দু। কোন ধর্মই মানে না সে। ধর্মীয় জটিলতা থেকে সে মুক্ত। No problem with my son.
এবার শাশুড়ি মহিলাকে উর্দুতে জিজ্ঞাসা করলাম (তিনি ইংরেজী জানেন না) : আপনি তো একজন মুসলিম, আপনার ছেলের বৌ একজন হিন্দু, তাকে আপনারা ইসলামী শারীয়ার নির্দেশ অনুসারে মুসলিম বানাননি। এটা কেমন করে আপনি সমর্থন করলেন?
জবাবে তিনি জানালেন : মেরি বহু বড়ী আচ্ছি লাড়কি হ্যায়, মেরা দেখভাল আচ্ছি তরাহসে কারতি হ্যায়। কোঈ শিকায়েত নেহী উসকি খেলাফ।
হর ইনসানকো দুনিয়ামেঁ আল্লাহহিনে বানায়া হ্যায়, ওলোগকা আপনা আপনা মজহবভী হ্যায়। দুনিয়া এয়সাহি চল রাহা হ্যায় শুরুসে। আল্লাহহি ফায়সলা করেংগে ইক রোজ। ম্যায় কৌন হুঁ রুকনেওয়ালী?
কথাগুলোর সরল বাংলা অনুবাদটা হচ্ছে : আমার বৌমাটা খুবই ভালো মেয়ে, আমাকে খুব আদরযত্ন করে। ওর বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই।
দুনিয়ার সব মানুষকেই আল্লাহ বানিয়েছেন, ওদের নিজনিজ ধর্মও আছে। এভাবেই দুনিয়াটা চলছে সেই আদিকাল থেকে। বিভেদের মীমাংসা আল্লাহই করবেন একদিন। আমি বাধা দেয়ার কে?
ব্যাস, কিস্সা খতম!
আমার দু’জন পরম শুভাকাঙক্ষী ও এক স্কুল সহপাঠীর মৃত্যু
(এক)
ডঃ মোশাররফ হোসেন
জুন ২৫, ২০১৬ সালের ঘটনা। আগের দিন সন্ধ্যায় পূর্বপরিচিত এক বাংলাদেশী ফোন করে আমাকে জানালেন যে ঢাকার বিখ্যাত Management Consultancy Firm RAPPORT BANGLADESH Limited-এর Founder & Managing Director Dr. Mosharraf Hossain মাস দুই আগে মারা গেছেন। (ইন্নালিল্লাহি….) আমি মরহুম মোশাররফ হোসেনের কাছে গভীরভাবে ঋণী, তিনি ১৯৮৩-৮৮ সনে বহু Consultancy assignment দিয়ে আমার চরম আর্থিক দুর্দিনে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন।
এবং আমি তাঁর কাছে আরো ঋণী এই জন্য যে তিনি আমার প্রথম বই ইসলাম কুরআন ও হাদীস-এর মুদ্রণ ও প্রকাশনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব বহন করেছিলেন (২০০৪ সন)
(দুই)
কাজী আলাউদ্দীন আহমেদ
আমার অপর পরম শুভাকাক্সক্ষী ও বন্ধু কাজী আলাউদ্দীন আহমেদও আজ আর বেঁচে নেই। বহুদিন সংবাদাদি না পেয়ে তাঁর ঢাকার বাসায় ফোন করে (এপ্রিল ২০১৬) জানলাম যে তিনি ২০১৩ সনের ১লা জুলাই এই দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে পরপারে চলে গেছেন। (ইন্নালিল্লাহি….) আমরা দু’জন বহু বছর East Pakistan Industrial Development Corporation-এ (EPIDC-তে) কাজ করেছি। তিনি ছিলেন Secretariat-এ আর আমি ছিলাম Audit Department-এ। উল্লেখযোগ্য যে এই কাজী সাহেবই ডঃ মোশাররফ হোসেনের কাছে আমাকে introduce করে দিয়েছিলেন। আমার বাংলা সাহিত্য চর্চা বিষয়েও তিনি ছিলেন পরম উৎসাহী ও সমঝদার আদমী। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন।
(তিন)
নওয়াব আলী – আমার এক স্কুল সহপাঠীর মৃত্যু
নওয়াব আলী ছিল আমাদের গ্রামেরই ছেলে, এক ধনী কৃষক পরিবারের সন্তান। আমরা আমাদের গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে একই ক্লাসে পড়তাম (১৯৩৯-৪৫)। সে বয়সে আমার চেয়ে ৬-৭ বছরের বড় ছিল। গ্রামেই কাটিয়েছে সে ওর সারাটি জীবন। ওর সংগে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল ১৯৬৮ সনে যখন গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। টেলিফোনে দু’বার কথা হয়েছিল আমাদের মাঝে- ২০০৭ সনে একবার এবং পরে আরো একবার। কথা হলেই হাউমাউ করে কাঁদত, অতীতের কথা স্মরণ করত, আমাকে একবার দেখতে চাইত। দ্বিতীয়বার যখন কথা হয় তখন বলেছিল যে সে ছাড়া গ্রামের আর বাকি সব সহপাঠীরা একে একে মৃত্যু বরণ করেছে, একমাত্র সে-ই আজো বেঁচে আছে; তবে আমি যেন দু’আ করি ওর দীর্ঘ জীবনের জন্য। (২০০৭ সনে ওর বয়স বলেছিল ৮১ বছর।)
ইতিমধ্যে ওর স্ত্রী মারা যায়, ছোট মেয়েটা (বিবাহিতা) ওর দেখাশুনা করত, মেয়েটা আমাকে ফোনে জানিয়েছিল। চেয়েছিলাম ওর সংগে কথা বলতে। মেয়েটা বলল : চাচা, আপনি বাবার কথা বুঝতে পারবেন না কারণ তার সবগুলো দাঁত পড়ে গেছে, কথা বুঝতে আমাদেরই খুব কষ্ট হয়।
খবর পেলাম সেই নওয়াব আলীও এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরপারে চলে গেছে দু’বছর আগে ৮৮ বছর বয়সে (২০১৪)। (ইন্নালিল্লাহি….) দীর্ঘ জীবনই পেয়েছিল সে বলা চলে। ৭০-৭৫ বছর আগের প্রাইমারী স্কুলের সহপাঠীদের মাঝে একমাত্র আমিই আজো বেঁচে আছি। ২০১৬ সালে আমার বয়স ছিল ৮৩ বছর।
আল্লাহ নওয়াব আলীকে জান্নাতবাসী করুন।
আমার রুচি পরিবর্তন
আগষ্ট ০১, ২০১৬।
আজীবন আমি বই পড়ার ভক্ত, গান শোনার ভক্ত, নাচ দেখার ভক্ত, মুভি (বিশেষতঃ হিন্দি মুভি) দেখার ভক্ত। ফলে বহু অর্থ ব্যয় করেছি বই কিনতে, মুভি video কিনতে, গানের DVD, audio cassettes & CD কিনতে। কিন্তু যতোই বয়স বাড়ছে ততোই সেসবের প্রতি আকর্ষণ কমছে। গল্প-কবিতার বই কেনা, video/audio/CD কেনা কচিৎ ঘটে। বই যা কিনি তা-ও শুধু ইসলামী বই। অন্যদিকে, কেনার পর ওসব রাখারও স্থানাভাব।
এই রুচি পরিবর্তনের ফলে স্থানীয় Public Library থেকে বই-CD-Video আনা শুরু করেছি। এতে একদিকে যেমন খরচ বাঁচে, অন্যদিকে ওগুলো রাখারও প্রয়োজন হয় না। তাই শেলফগুলোকে হালকা করার জন্য
– 200 audio cassettes ওগুলোর holders সহ garbage করে দিয়েছি;
– বহু audio-video-CD দান করে দিয়েছি;
– বহু Home Video Cassettes (ইসলামী) মসজিদের লাইব্রেরীতে donate করে দিয়েছি;
– বহু ইংরেজী বই হসপিটালের gift shop-এ ফড়হধঃব করে দিয়েছি;
– বর্তমানে যত film videos কিনি দেখার পর সেগুলোকে ঐ ংঃড়ৎব-এ আবার ফেরত দিয়ে দিই।
এতসব করার পরও শেলফ ভর্তি বই- ওগুলোর ৮০%ই ইসলামী- বিশেষতঃ কুরআন ও হাদীস এবং সেই সম্পর্কিত। মাঝে মাঝে ভাবি, আমি মরে গেলে এসবের কি গতি হবে?
বাকি যা আছে সেগুলো বাংলা-ইংরেজী-আরবী-উর্দু ডিকশনারি; কিছু আছে ইতিহাস, আর কিছু আছে self-help books. বাংলা গল্প-কবিতার বইয়ের সংখ্যা নগণ্য।
এছাড়া যা আছে সেগুলো আমারই লেখা এবং প্রকাশিত নানা ধরনের বই যার সংখ্যা ক্রমাগত বিক্রির ফলে কমে যাচ্ছে।
তবে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় যে যদিও বই পড়াতে এবং audio-video আকর্ষণ কমে গেছে অন্যদিকে নূতন গল্প-কবিতা লেখার প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে। ফলে দিনের অনেকটা সময় আমার কাটে ডেসকে বসে কাগজে কলম চালিয়ে, নূতন কিছু সৃষ্টিতে। এসবে আমার কোন ক্লান্তি বা অনাগ্রহ নেই। আমার স্ত্রী ঘনঘন অনুযোগ করেন, এত দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকাটা তোমার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর; এবার থামো, বিশ্রাম নাও। বই লেখা হলেই তো সেটাকে ছাপিয়ে পাবলিশ করতে ছুটাছুটি শুরু করবে। অথচ খরচের টাকা ঘরে আসে না। এবার থামো। [এ পর্যন্ত আমার লেখা ও প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৯টি]
ওর কথা শতকরা একশো ভাগ সত্যি, কিন্তু তথাপি থামি না।
কি কারণ? কারণ একটাই : আমি সৃজনশীল কাজে নিজেকে সর্বক্ষণ নিয়োজিত রাখতে চাই যাতে এমনটা মনে না হয় যে শুধু TV দেখে, পত্রিকা পড়ে আমার এই দীর্ঘ জীবনটা বৃথা গেল। আমার বয়স ৮৩ বছর অতিক্রম করেছে।
ঠিক একই প্রেরণা থেকে একটু কষ্ট হলেও প্রতি সপ্তাহে দু’দিন হসপিটালে গিয়ে ভলানটিয়ারিং-এর কাজটা করি। রুগ্ন-অসহায়দের correct information দিয়ে, উৎসাহ দিয়ে, ভরসা দিয়ে, চিকিৎসায় সাহায্য করে আমি তৃপ্তি পাই। তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তাদের যন্ত্রণার ভার লাঘব করতে চাই। সমাজ সেবা, আর্তের সেবা আমাকে তৃপ্তি দেয়, আনন্দ দেয়।
* * *
ক’দিন আগে Dr. Zakir Naik-এর একটা DVD দেখতে গিয়ে এক হিন্দু পন্ডিতজীর মুখে এই উর্দু শেরটা শুনলাম-
লোগ কেহতে হ্যায় কে
খুদা নযর নেহী আতা,
হামতো কেহতে হ্যায় কে
খুদাকি সিওয়া নেহী নযর আতা ॥
অর্থটা হচ্ছে : মানুষ বলে থাকে যে খুদাকে (আল্লাহকে) দেখতে পাই না, কিন্তু আমি তো বলবো যে [যেদিকেই দৃষ্টি দিই না কেন] খুদাকে ছাড়া অন্য কিছু তো আমার নযরেই পড়ে না।
এসব হলো আল্লাহভক্তদের কথা কিন্তু যাদের মনে ভক্তি নেই তারা তো অন্তর্দৃষ্টি না থাকার ফলে, অবিশ্বাসের কারণে, নিজেদেরকে অতিবুদ্ধিমান ভাবার ফলে শূন্যতাই শুধু দেখে, বঞ্চিত থেকে যায় সত্যদর্শনের এবং আল্লাহর রহমত লাভের সৌভাগ্য থেকে।
একজন নাইজিরিয়ান মুসলিম ভাইয়ের বদান্যতা :
THE MUSLIM HANDBOOK
আগষ্ট ১০, ২০১৬ সালের ঘটনা।
Wheel-Trans -এর এক ড্রাইভারের সংগে ইতিপূর্বে একদিন ইসলাম ধর্ম নিয়ে কিছু আলোচনা হয়েছিল। গত ডিসেম্বর মাসে সেই ড্রাইভারই (নাইজিরিয়ান) আমাকে বাসা থেকে হসপিটালে নিয়ে গেল। যাওয়ার আগে একটা মোটা বই আমার হাতে দিতে দিতে বলল : Brother, this book is for you. No payment now. Please read it thoroughly and give me your comments. I will then decide if I’ll take money from you or not. May Allah bless you, my brother.
বাসায় নিয়ে গিয়ে দেখলাম বিরাট সেই কিতাব (৪১৪ পৃষ্ঠা), নাম THE MUSLIM HANDBOOK. কয়েকদিন ধরে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে শেষ করলাম সেই বই, চমৎকৃত না হয়ে পারলাম না। ইসলাম ধর্মের Principles and Practices-এর অতি সুন্দর বিষষ-well-documented presentation. ইংরেজী জানা যে কোন মুসলিম এবং মুসলিম পরিবারে জ্ঞান লাভের জন্য এ এক অমূল্য রতন। লেখক Mubarak Ali, Ph.D./Published from Toronto, Canada. 2001. আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে লেখক একজন professional engineer!
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই যে আজ আট মাস হয়ে গেল সেই কোমলহৃদয় বদান্য ড্রাইভার ভাইটির দেখা পাচ্ছি না। আমি তার কাছে ঋণে আবদ্ধ।
পুনশ্চ (সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৬)
আজ সেই নাইজিরিয়ানের দেখা পেলাম অবশেষে। বইটা সম্পর্কে আমার প্রশংসা শুনে খুব খুশী হয়ে Kazzem (ওর নাম) বললো যে বইয়ের দাম দিতে হবে না, আমি যেন আল্লাহর কাছে ওকে রহমত করার জন্য দু’আ করি।
সাইদুল হোসেন
মিসিসাগা