রজনী
এ, কে, এম ফজলুল হক
তখন সম্ভবত জুন মাস। কানাডায় নতুন কোথাও কাজ পাই না দেখে মুভি কোম্পানীতে চাকুরী নিলাম। আমার কাজ প্রোডাকশন ইউনিটকে সাপোর্ট দেয়া। একেক দিন একেক ইউনিটে কাজ। আমি মহা আনন্দে এ’কাজ করে যাচ্ছি। মুভির কাজে বিশেষ মজা হলো এখানে পেমেন্ট ভালো এবং খাওয়া দাওয়া ফ্রি। তার উপর হরেক রকম আনন্দ ফুর্তি। আনন্দ ফুর্তি বলতে একেকটা এপিসোড শেষ হলে ফায়ার ওয়ার্কস হয়, পার্টি হয়। আমি পার্টিতে যাই না, কিন্তু ফায়ার ওয়ার্কস দেখি, ভালো লাগে।
সে রাতে আমাদের ডিউটি হ্যামিল্টনের কোন এক জায়গায়। হ্যামিল্টন টরোন্টোর পাশের সিটি। টরন্টো থেকে নব্বুই কিলো দক্ষিণে নায়েগ্রার পথে। আমি রওয়ানা হলাম, সাথে আমার বস এক কানাডিয়ান যুবক। দিনের আলো ক্রমশ ফিকে আসছে। আমরা কিউ,ই,ডব্লিউ নামের হাইওয়ে থেকে হ্যামিল্টনের দিকে ঢুকে পড়লাম। এক সময় দেখি সে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে গভীর জঙ্গলের দিকে। আমি জিজ্ঞেস করলাম “কি ব্যাপার এখানে শুটিং হবে নাকি?” সে বললো – “ অবশ্যই হবে, কিন্তু আজ না কাল ভোরে। আজ তোমার কাজ ইউনিট গার্ড দেয়া”।
সন্ধ্যা উৎরে রাত হলো। জঙ্গলের ঠিক মাঝখানে ইউনিট আর রাস্তার শেষ মাথায় গেস্ট হাউস। গেস্ট হাউসে মুভির লোকেরা আছে। ক্লিনার থেকে শুরু করে টেকনিসিয়ান, ক্যামেরাম্যান সবাই। প্রথমে ফুড সার্ভ করা হলো। সার্ভের নিয়ম হলো তিনবেলা খাবার; সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায়। এক ঘন্টা করে সময় দেয়া থাকে। তারপরে সারাদিনের জন্য একটা ভ্যান ভর্তি খাবার রেডি থাকে চা নাস্তার জন্য। ভ্যানের খাবার দিনে যখন তখন খাওয়া যায়, কিন্তু মূল খাবারের জন্য ভেন্যুতে যেতে হয়। আমি কি কারণে জানি সেদিন দেরী করে ফেললাম। সার্ভ শেষ। গেস্ট হাউসের বাইরে থেকে দেখলাম তারা টেবিল গুছাচ্ছে; লজ্জায় আর ঢুকিনি। চলে আসলাম। আসার পর আমাকে কাজ বুঝিয়ে দেয়া হলো- শুনে আমার ভয়ে আত্মা পানি হবার জোগাড়। বলে কি, এ জায়গায় ক্যামেরা, লাইট, কম্পিউটার সব সব খোলা পড়ে আছে- এ গুলো পাহারা দিতে হবে। আশঙ্কায় পড়ে গেলাম, আমি এগুলো পাহারা দিলে আমাকে পাহারা দিবে কে? আমার আশঙ্কা দেখে বস বললো চিন্তার কিছু নাই, আমি আছি গেস্ট হাউসে।
কাজ শুরু হলো, এতক্ষণ বুঝিনি খেলা আরো কঠিন। কারণ, এ’কেতো অন্ধকার তারপরে গভীর জঙ্গল চারিদিক নিস্তব্দ। মাঝে মাঝে রাত জাগা পাখির ডানা ঝাপ্টানোর শব্দ। সে শব্দ বুকে ভয় ধরিয়ে দেয়। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি এটা তিন রাস্তার মিলনমুখ। পাশে একটা তাবু টানানো। তিন রাস্তার এক রাস্তা হ্যামিল্টন থেকে সোজা এসে চলে গেছে গেস্ট হাউসের দিকে, যেটা ধরে আমরা এ’সেছি। আর এক রাস্তা আঁকা বাঁকা হয়ে উঠে গেছে পাহাড়ের উপরে যেখানে কিচেন।
শুনলাম, কিচেনের পাশে ডিউটি করছে আলী। আলী আমার সহকর্মী। ইরানিয়ান। চমৎকার এক লোক। মুখে সব সময়ে হাসি লেগেই থাকে। এই যেমন, যদি জিজ্ঞেস করি “আলী কি খবর”? একগাল হেসে বলবে “আরে খবর তো খুব ভালো”। এমনভাবে বলবে যেন ‘সত্যি-ই খুব ভালো”। এসব মানুষকে আমার ভালো লাগে। আলীর কথা শুনে ঠিক করলাম কিছুক্ষন আড্ডা দিয়ে আসবো। দেখা যাক না আলী আমাকে দেখে কি করে? চমকাবে! চমকাক। আমি উপরে উঠতে থাকলাম। বালি সিমেন্টের রাস্তা তারার আলোয় ভালোই বুঝা যায়। তারপরে আবার রাস্তার উপরটাতে গাছের ডালপালা নাই কিছুদূর পর্যন্ত কেটে ছোট করে দেয়া হয়েছে।
আমাকে দেখে আলী উচ্ছসিত হয়ে উঠলো। আমি তার পাশে নতুন কেনা গাড়িতে গিয়ে বসলাম। কথা শুরু কি দিয়ে মনে নেই। শুধু মনে আছে এক সময় হ্যামিল্টনের জঙ্গল নিয়ে কথা উঠলো। আমি জানতে চাইলাম “এসব জঙ্গলে কি থাকে?”
আলী বললো “ হরিণ, রেকুন আর কায়োটি।”
“কায়োটি মানে? সে আবার কি”
“কেনাডিয়ান ওয়াইল্ড এনিম্যাল, হিংস্র”
শুনে আমি চুপসে গেলাম। আলী ধরতে পারলো। মুখ ঘুরিয়ে বললো-
“তুমি মনে হয় ভয় পেয়েছো? ভয়ের কিছু নাই, আমি এখানে আছি, কিছু হলে কল করো”
আমি বিরক্ত হলাম মনে মনে ‘বেটা বলে কি; কায়োটি ধরলে তোকে কল করার জন্য বসে থাকবে! বলদ কোথাকার’
আলী বললো “এই, তুমি দেখি সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছো? আরে ধুর, আমি মজা করলাম। এখানে বড় জোর রেকুন আর হরিণ থাকতে পারে।”
“ও আচ্ছা” বলে চুপ হয়ে বসে রইলাম। আলী বক বক করেই যাচ্ছে, বললো “এখানে কাছাকাছি কোথাও একটা ঝর্ণা আছে। নাম বললো- ওবেস্টর। চলো একদিন ঘুরে আসি”। আমি তখনো চুপ। আমাকে চুপ থাকতে দেখে ও বললো, “ তুমি এবার যাও? বাইচান্স কিছু একটা চুরি হলে বিরাট সর্বনাশ হবে”। আমি দেখলাম কথাটা ঠিক। তড়িঘড়ি করে চলে আসলাম। এসে দেখি তাঁবুতে যে লাইট টা ছিল তার চার্জ ও চলে গেছে। অন্ধকার।
এক সময় অন্ধকার আরো জেঁকে বসলো। ঘন জঙ্গল ও গাছ গাছালির ভিতর দিয়ে দূরে গেস্ট হাউসের ক্ষীণ লাইট দেখা যাচ্ছে। এটুকুই ভরসা। এ অন্ধকারে কাউকে ডাকবো যে সে ইচ্ছা ও হচ্ছে না। নিজের উপর বিরক্ত লাগছে, কেন যে টর্চটা নিয়ে আসি নি। কি আর করা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ আর প্রকৃতি দেখছি। রাত হলে প্রকৃতির চেহারাই অন্য রকম হয়ে যায়। কেমন যেন অচেনা। আরো অদ্ভুত ব্যাপার হলো রাতের আকাশ হঠাৎ হঠাৎ রূপ পালটায়। এই যেমন দেখা যাচ্ছে অন্ধকার- আবার হালকা আলোর রেখা মনে হচ্ছে ভোর হয়ে যাবে, কিন্তু ঘড়ি দেখি, এখনো অনেক বাকী। এ সময় হঁক হঁক হঁক করে এক পাল কানাডিয়ান হাঁস বনের উপর দিয়ে উড়ে গেলো। পুরো বন যেন জেগে উঠলো কিছু সময়ের জন্য। আবার নিস্তব্দ।
এ নিস্তব্দতায় আমি তাবুর ভিতর বাইর করছি। হঠাৎ চোখে পড়লো রাস্তার পাশে কি একটা খাটের মতো। ভালো করে না দেখলে চোখে পড়ে না। জিনিষটা কি একটু দেখতে গেলাম। রীতিমতো একটা সিঙ্গেল খাট ‘লোহার’। উপরে টিনের কারুকাজ করা। চারপাশে বেষ্টনী দেয়া। আমি অবাক হচ্ছি এ জায়গায় এটা রেখে গেলো কে? খাটের পাশে গাছপালা নেই তবে বড়ো বড়ো ঘাস আছে ও ঘাসের জন্য নীচটা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। উপরটা কিন্তু একদম পরিষ্কার। দুই এক জায়গায় হালকা মরচে ধরেছে বলে মনে হলো। আমার মোবাইলে তখন লাইটও নেই যে আলো জেলে দেখবো। চোখের অন্ধকার সয়ে আনার চেষ্টা করছি। মনে মনে ঠিক করলাম -এ’টা এখানে কেন ভেবে বের করবো। চিন্তা শুরু। প্রথমে মনে হলো এটা একটা বিজ্ঞাপন ‘সামনে গেস্ট হাউজ। সেখানে গিয়ে আরামে ঘুমান’- এ ধরণের কিছু একটা বুঝাচ্ছে। যুক্তিটা মনে ধরলো না। কারণ সেটা হলে আশেপাশে এতো ঘাস থাকবে কেন? দ্বিতীয় কারণ কেউ ফেলে গেছে। কিন্তু এটা ও সম্ভব না। এটা কানাডা। পরিষ্কার পরিছন্ন এক দেশ। যাহোক, এবার আশপাশটা ভালো করে খেয়াল করতে লাগলাম। খেয়াল করলাম খাটের হেডবোর্ডটা বেশ সুন্দর। মোবাইলের ডিসপ্লের আলোয় দেখলাম- বড়ো বড়ো হরফে কি যেন লেখা হেডবোর্ডে। পড়তে চেষ্টা করলাম। “ডিয়ার জন” অথবা “উইলিয়াম” এ ধরণের কোন এক নাম। তারপর লেখা “শান্তিতে ঘুমাও।” ওরেব্বাপ, এটা একটা কবর! লাফ দিয়ে দূরে সরে আসলাম। আমার লাফের শব্দে খাটের নীচ থেকে কিছু একটা সর সর করে দূরে সরে গেলো। কোন দিকে না তাকিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়াতে থাকলাম। আমার সামনে তখন এক প্রচ্ছায়া- যেন কবর থেকে উঠে আসছে কিছু একটা। ভয়ে আরো জোরে দৌড় দিলাম, এক সময় মনে হলো মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। যাই নি। কোন মতে আলীর কাছে গিয়ে দেখি সে তখনো গাড়িতে বসা। গান শুনছে। আমাকে দেখে ভেবাচেকা খেয়ে গেলো।
“কি হয়েছে তোমার?”
আমি বললাম “নিঃশ^াস নিতে পারছি না”
সে কোনমতে ধরে গাড়িতে পেছন সিটে বসিয়ে এ’সি ছেড়ে দিলো জোরে। জিজ্ঞেস করলো –
“সমস্যা কি?” আমি জবাব দিলাম না। চোখ বন্ধ করে রাখলাম।
কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে বললাম ‘কবর’।
: কোথায়?
: ওইখানে।
: চলতো গিয়ে দেখি।
আমি বললাম “আর যাবো না”
“তাহলে এক কাজ করো, তুমি এখানে থাকো আমি ওইদিকটা সামলাই”
আমি মাথা নাড়লাম ‘ঠিক আছে’।
আলী গাড়ি নিয়ে চলে গেলো। আমি একা কিচেনের পাশে। এখানে অনেক সুবিধা, এ’কেতো কিচেনের আলো, তারপরে আছে অনেক গুলো ‘ফিল্ম রিক্রেশন ভেহিকল’। এগুলোর দরজা খোলা থাকে। সাথে ওয়াশ রুমও আছে। আমি একটাতে উঠে পড়লাম। আলী যাওয়ার পর আরো ঘন্টা খানেকের ম পার হ’লো। বসে আছি। শেষ রাতের দিকে শুরু হলো আরেক তান্ডব। কোত্থেকে দেখি খাবারের গন্ধে একদল রেকুন ডাস্টবিন উলটপালট করছে। আমি ভড়কে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। যাক, এবার নিশ্চিন্ত।
ধীরে ধীরে আকাশ ফর্সা হচ্ছে। মনে হলো কত যুগ ধরে ফর্সা আকাশ দেখি না।
বুক থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেলো। এক সময় পূর্বদিক লালকরে ভোরের সূর্য উঠলো। আমার মনে হলো যেন জীবন খুঁজে পেয়েছি। ধীরে ধীরে হরিণ বের হলো জঙ্গল থেকে। কি সুন্দর দলবেঁধে পাতা খাচ্ছে। বাচ্চা কাচ্চা সহ। বাকী সময়টা কোন মতে পার করলাম। ফেরার পথে মনে হলো ‘ও আল্লাহ এটা দেখে ভয় পেয়েছি। এ তো কিছুই না’।
তারপর অনেকদিন চলে গেছে। এখনো মনে করি সে রাতের কথা “ সামান্য এক কবর রাতের আঁধারে কি ভয়াবহ। রাতের আধার কি এভাবে সব কিছু বদলে দেয়? হয়তো তাই, হয়তো এভাবে আমাকে ও একদিন বদলে দেবে অন্যদের কাছে।”